#বেলীফুল
পর্ব- ৩০
ইলা তুলনের পাশে বসে ওর হাতটা নিজের হাতে তুলে নিয়ে বলল, “ভুলে যা ভাই, এসব কথা একদম ভুলে যা!”
তুলন কেমন নিস্পৃহ দৃষ্টিতে শূন্যের দিকে চেয়ে আছে। ওকে দেখে ইলার বুকটা হু হু করে উঠল। এমন উচ্ছ্বল প্রানবন্ত মেয়েটার কী হাল হয়েছে! লোকগুলো মরে না কেন? এত খারাপ লোকের বেঁচে থাকার কী প্রয়োজন?
তুলনের মা এসে বললেন, “তুমি একটু ভালো করে কথা বলো মা। বোঝাও ওকে। একেবারে মুষড়ে পড়ছে বেচারি। আরে আরও খারাপ কিছু তো হতে পারত। আল্লাহর দয়ায় হয় নাই। ওরা কোনো ক্ষতি করার আগেই মেয়েটা ফেরত আসতে পারছে। তুমি ওরে একটু বুঝায় বলো তো।”
ইলা একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। শুধু সে-ই জানে, তুলনের এত কষ্টের কারন কী। সবাই জানে তু্লনের কোনো দোষ নেই, ছেলেগুলো তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। তুলনের প্রেমকাহিনী, দেখা করতে যাওয়া আর তারপর ফাঁদে পা দেয়ার পুরো ব্যাপারটা তাদের অজানা। তুলনের বলার মতো অবস্থাও ছিল না৷ আর বাকি শুধু ইলা জানে। সে ভুলেও এসব কথা উচ্চারণ করেনি।
ইলা চুপটি করে দরজাটা টেনে আটকে দিয়ে এলো। তুলনের মুখটা তুলে বলল, “তাকা আমার দিকে! কিচ্ছু হয়নি তো!”
তুলন ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ইলাকে জড়িয়ে ধরে বলল, “মানুষ এত বিশ্বাসঘাতক কেমন করে হতে পারে জানিস ইলা?”
“ওর উদ্দেশ্য শুরু থেকেই খারাপ ছিল। তুই বুঝিসনি।”
“কেন বুঝিনি বল তো? ওরা কী করেছে জানিস? আমাকে…” তুলন বলতে পারল না পুরোটা। অস্থির হয়ে গেল।
তুলনের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকল। তুলন একটু শান্ত হয়ে এলে ইলা বলল, “দেখিস, ওদের এমন শাস্তি হবে, জীবনে কোনো মেয়ের দিকে চোখ তুলে তাকাবে না।”
তুলন ফোঁপাতে ফোপাঁতে বলল, “ওরা কী করবে জানি না, আমি আর জীবনে কোনো ছেলের দিকে তাকাব না।”
কথাটা শুনে অতি দুঃখের মাঝেও ইলার হাসি পেয়ে গেল।
***
প্ল্যানটা গুছিয়ে এনেছে সাজিদ। জানত এরকম হবেই! ছেলেগুলো ছাড়া পেয়ে যাবে। নিরবের কাছ থেকে জানতে পেরেছে ছেলেগুলোর জামিন হয়ে যাবে খুব দ্রুত। একটা ‘বিশেষ মহল’ থেকে চাপ আসছে। পুলিশের কিছু করার নেই। হাতেনাতে ধরা অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাবে এরচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য আর কী বা হতে পারে!
সাজিদ তাই অন্য পথ ভাবছে। কয়েকটা ফোন করে পরবর্তী কার্যক্রম ঠিকঠাক করে ফেলল সে।
ইউনিভার্সিটিতে ছাত্র আন্দোলন এখনো চলছে। এক আন্দোলনের ভেতর ঢুকে গেল অন্য আরেকটি দাবি। কোনো ধর্ষককে ইউনিভার্সিটিতে ঢুকতে দেয়া যাবে না। পোস্টার, দেয়াল লিখন, প্ল্যাকার্ডে ভরে গেল ক্যাম্পাস। ছাত্ররা তুমুল উত্তেজিত।
এর মাঝে একদিন ছাড়া পেয়ে গেল অর্কের দল। সদর্পেই তারা ক্যাম্পাসে ঢুকেছিল। ভেবেছিল কেউ তাদের কিছু বলার সাহস পাবে না। বড় বড় কর্তাব্যক্তির পা চেটে যেটুকু জায়গা দখল করতে পেরেছে তা সাধারণ ছাত্রদের ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে যথেষ্ট।
কিন্তু ওরা জানত না জনবলের শক্তি। শুধু ছেলেরা না, ধর্ষনের প্রতিবাদে বের হয়ে এসেছে প্রতিটি মেয়েও।
সাজিদের নেতৃত্বে চলল সেদিন তুমুল আন্দোলন। অর্কদের ঢুকতে দেয়া হলো বিনা বাঁধায়। তারপর উত্তপ্ত জনতা ঝাঁপিয়ে পড়ল তাদের ওপর। গণপিটুনি দিয়ে বের করে দেয়া হলো ক্যাম্পাস থেকে।
নিরবের তত্ত্বাবধানে সাংবাদিকও এসেছিল বেশ কিছু। একটা মোক্ষম ছবি তুলে ফেলতে পারল এক ফটোগ্রাফার। অর্কর মুখে জুতো ছুড়ে মেরেছে কোনো এক মেয়ে। জুতোটা গালে লাগার সময়েই ক্লিক করেছে। যাকে বলে পারফেক্ট টাইমিং!
সেই ছবিটাই ছাপা হয়েছে পত্রিকার প্রথম পাতায়।
সেদিন রাতে ঘুমুতে গিয়ে সাজিদের কেমন অদ্ভূত আনন্দ হলো। লোকগুলোকে শাস্তি দেয়াতে পারল শেষ পর্যন্ত।
***
মৌরি বসে বসে ডায়েরি লিখছে। নিয়মিত ডায়েরি লেখা তার অনেকদিনের স্বভার। মাঝে বেশ কিছুদিন লেখা হয়নি পরিস্থিতির কারনে। আজ অনেকদিন পর তার মন একটু শান্ত। সেদিন অবশ্য সে খুবই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল মৌরি। বিশেষ করে আরেকটা মেয়েকে ঠিক তার অবস্থায় দেখতে পেয়ে। ধীরে ধীরে সামলে নিয়েছে সে। সাজিদ অনেক সাহায্য করেছে মন ভালো করতে। আর পত্রিকার প্রথম পাতায় অর্কের ছবিটা দেখে বুকের জ্বালা অনেকটা কমেছে।
সেদিনকার ঘটনা লিখে রাখবে ভাবছিল ক’দিন ধরেই। আজ লিখতে শুরু করল।
“মানুষ চাইলেও অতীতে চলে যেতে পারে না, কথাটা বোধহয় পুরোপুরি সত্যি নয়। সেদিন সাজিদের সাথে যখন সেই বাড়িটাতে গেলাম, মনে হলো ওই অবস্থায় আবার ফিরে গেছি। অন্ধকারে মনে হচ্ছিল বুঝি অন্য কেউ নয়, আমিই পড়ে আছি মেঝেতে। শয়তানগুলো অপেক্ষা করছে কখন আমার কাছে এসে ক্ষতবিক্ষত করে দেবে। থরথর করে কাঁপছিলাম আমি। মাথা ঘুরছিল এমনভাবে যেন পড়ে যাব যে কোনো সময়। খুব গন্ডগোল হচ্ছিল জায়গাটায়। লোকগুলো হাতাহাতি করছিল নিজেদের মাঝে। আমি বোধহয় নিজেকে সামলাতে পারতাম না যদি সাজিদ না থাকতেন।
উনাকে কি আমার ভাইয়া ডাকা উচিত? কেন যেন ভাইয়ের জায়গায় তাকে বসাতে ইচ্ছে করে না। ভাই তো অন্যরকম হয়, তাকে আমার দেবদূতের মতো মনে দেয়। দেখতে-শুনতে, কাজেকর্মে ঠিক যেন একটা আশীর্বাদের জীবন্ত রূপ!
সাজিদ আমার হাত ধরে ফেলেছিলেন তখন। আলতো চাপ দিয়ে সাহস দিচ্ছিলেন। বাবাও ছিল পাশে। যখন বুঝলাম বাস্তবে আমি নিরাপদ, ওই লোকগুলোই বিপদে, তখন মন শক্ত হলো।
কিন্তু ওই মেয়েটা….খুব নরম মনের বোধহয়। হাসপাতালে নেয়ার সময় গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছিল মেয়েটার। চেপে ধরে রেখেছিলাম আমি। ও শুধু একটা কথাই বিড়বিড় করছিল, “কেন করলে? কেন করলে?” আমি বুঝতে পারছিলাম ওর মানসিক অবস্থা। কী পরিমাণে ভয় হয় আমি তো জানি। আত্মা কাঁপতে থাকে। হৃৎপিণ্ড উঠে আসে গলার কাছে। একেকটা নররাক্ষসকে মৃত্যুদূত মনে হয়।
মেয়েটা মনে হচ্ছে খুব আঘাত পেয়েছে মানসিকভাবে। ভাগ্যিস আমার মতো দুটো দিন তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়নি! ভাগ্যিস বেঁচে গেছে ও! কিন্তু আমার কপালে কেন এত দুঃখ লেখা ছিল?
নাহ, আর দুঃখের কথা ভাবব না। ভালো কথা ভাবতে ইচ্ছে করছে। কষ্ট নিয়ে ভাবতে ভাবতে মন তেঁতো হয়ে গেছে৷ ওইযে জোড়া শালিক উড়ে এসে বসেছে মাটিতে, খুঁটে খাচ্ছে পোকামাকড়, ঠিক ওদের মতো উড়ে যেতে পারি না কেন আমি? কেন মানুষ ওদের মতো স্বাধীন নয়? বিশেষ করে মেয়েরা?
এই এলাকায় আমার বাড়ি থেকে বের হওয়াই দায় হয়ে উঠেছে। সবাই বাঁকা চোখে তাকায়, যেন খুনের আসামি। অবশ্য খুনী হয়েও যদি পুরুষ হতাম, এত নোংরা দৃষ্টির সম্মুখীন হতাম বলে মনে হয় না। তাই বেরই হই না। কিন্তু সারাদিন কি ঘরে থাকা যায়? বাবা বলেছেন অন্যত্র চলে যাবেন। কিন্তু এই শখের বাড়ি ছেড়ে আমি কি তাকে যেতে দিতে পারি?
বাবা চেষ্টা করছেন আমার বিয়ের। কিন্তু আমাকে কে বিয়ে করবে? আমিও কি পারব সংসার করতে? মনে হয় না। জীবন একটা বড় শিক্ষা দিয়ে গেছে৷
একটা চিন্তা আসছে মাথায়। ঢাকা চলে যাব। কোনো একটা হোস্টেলে থেকে চাকরি করব। নিজের মতো মাথা উঁচু করে চলব। সেখানে কোটি মানুষের ভিড়ে কেউ আমার দিকে তাকানোর সময় পাবে না। সারাদিন খাটাখাটনি করে বাসায় ফিরে রাতে খোলা জানালা দিয়ে তারা দেখব আর গান শুনব। এরচেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে?
শ্রাবন্তীর সাথে কথা বলতে হবে। ও ব্যবস্থা করতে পারবে ঢাকায় থাকার। চেহারা আর আর্থির অবস্থা দুটোই খারাপ বলে অনেক চেষ্টা করেও বেচারির বিয়ে থা হলো না। এখন হোস্টেলে থেকে চাকরি করে, ছুটি পেলে ঘুরে বেড়ায় দেশের আনাচে কানাচে। ওর মতো হব।
শুধু বাবা মাকে ছেড়ে যেতে কষ্ট হয়। আমি এভাবে চলে গেলে তারা কি মরে যাবে না? কিন্তু আমি থেকেও তো তাদের মেরে ফেলছি। নিজেকে বিষ মনে হচ্ছে।
সাজিদের সাথে কি কথা বলব? তিনি কি আমাকে বলতে পারবেন আমার কী করনীয়? দুঃসহ স্মৃতি, অসহ্য বর্তমান আর অন্ধকার ভবিষ্যত নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াব আমি?”
(চলবে)
দুঃখিত, বৃহস্পতিবার দেয়ার কথা বলেও দিতে পারিনি। শীঘ্রই আরেক পর্ব দেব ইনশাআল্লাহ।