অপেক্ষা পর্ব- ১২:
লেখিকা: সামিয়া বিনতে হামিদ
সূর্যের আলো চোখে পড়তেই রক্তিমের চোখের পাতা নড়ে উঠে। মাথা উঠাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল, ঝিমঝিম করছে খুব। রক্তিম তার হাতের উপর কিছু একটার ভার অনুভব করে। পাশ ফিরে দেখে রিধি তার হাতের উপর মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে।
রিধিকে দেখে রক্তিমের শরীরের দুর্বলতা না কাটলেও মনের দুর্বলতা কেটে যায়।
রক্তিম তার হাত দিয়ে রিধির মুখের উপর পড়ে থাকা চুলগুলো সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দেয়। রিধির চিকন ঠোঁটগুলো হালকা কেঁপে উঠে। রক্তিম রিধির দিকে ঝুঁকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। অনেকক্ষণ ধরে এভাবেই দেখছিল রিধিকে।
রিধির ঘুম ভেঙে যায় হঠাৎ। চোখ খুলে রক্তিমকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সে মাথা তুলে বসে যায়।
রিধি: আ-আপনি কবে উঠলেন?
রক্তিমের কোনো সাড়া না পেয়ে রক্তিমের দিকে তাকায় রিধি।
কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রক্তিমের মুখের সামনে হাত নাড়িয়ে বলল,
রিধি: এভাবে হাঁ করে কি দেখছেন? প্রথম দেখছেন আমাকে?
রক্তিম একটু হেসে বলল,
রক্তিম: প্রতিদিন দেখলেও কম মনে হয়। প্রতিবার নতুনভাবে দেখি তোমাকে।
রিধি রক্তিমের দিকে ঝুঁকে বলল,
রিধি: গতকাল রাতে কি বলেছেন মনে আছে?
রক্তিম: ভালোবাসি।
রিধি: হ্যাঁ?
রক্তিম: রিধি আমি তোমাকে ভালোবাসি।
রিধি: পাগল হয়েছেন? কখনো সম্ভব না এসব।
রক্তিম: কেনো সম্ভব না?
রিধি: বাবা-মা কখনো মানবে না!
রক্তিম: তুমি মানলেই হলো। বাকি ব্যবস্থা হয়ে যাবে।
রিধি: আমি আপনাকে নিয়ে এসব কখনো ভাবতেই পারি না! আর আমার আপনাকে ভালোই লাগে না।
রক্তিম: একদিন লাগবে।
রিধি: এখন জোর করবেন আমাকে?
রক্তিম: জোর করে কি ভালোবাসা যায়? আমি অপেক্ষা করবো তোমার জন্য রিধি। যতোদিন বলবে ততোদিন। রিধি, তোমাকে কখন ভালো লেগে যায় আমি নিজেও বুঝতে পারি নি। অনেক বুঝিয়েছি নিজেকে। আচ্ছা, ভালোবাসা কি বলে আসে বলো? আমার তো দোষ নেই।
রিধি: ভালোবাসলে আমাকে এভাবে কষ্ট কেন দিয়েছিলেন?
রক্তিম: মা জেনে গিয়েছিল।
রিধি: কি?
রক্তিম: হ্যাঁ। মা বলেছে এই সম্পর্ক কখনো সম্ভব না। কারণ সমাজের চোখে তুমি আমার আপন বোন। কেউ জানে না তোমাকে দত্তক নেওয়া হয়েছে। আর এখন যদি সবাই জানে তোমার চরিত্রে আঙ্গুল তুলবে। মানুষ কতো কথা রটিয়ে বেড়ায়। তাই আমি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলাম। তোমাকে বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলাম আমার বাবা-মা, তোমার আসল বাবা-মা না। আমাকে ক্ষমা করে দাও রিধি। আমি অনেক কষ্ট দিয়েছি হয়তো তোমাকে।
রিধি: রক্তিম, আপনি আমাকে ভুলে গেলেই ভালো হবে। এভাবে আমার কারণে নিজেকে কষ্ট দিবেন না। আর আপনি বয়সে আমার অনেক বড়ো। আমার বুড়ো মানুষ পছন্দ না। হুহ।
রক্তিম: কি? আমি বুড়ো? তোমার আমাকে বুড়ো লাগে?
রিধি: তো! আয়নায় দেখেছেন কখনো?
রিধি হাত দিয়ে রক্তিমের চুলগুলো নাড়িয়ে, ভালো করে দেখে বলল,
ইশ, চুলেও পাক ধরেছে।
রক্তিম চোখ বড়ো বড়ো করে মাথায় হাত দিয়ে বিছানা ছেড়ে আয়নার সামনের দাঁড়িয়ে চুলগুলো দেখছে।
রক্তিম: কোথায়? চুল পেকেছে কোথায় দেখলে?
রিধি হেসে বলল,
রিধি: আমি নাস্তা বানিয়ে আনছি। আপনি ফ্রেশ হয়ে নেন।
রক্তিম গোসল সেরে রান্নাঘরে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে রিধিকে।
রিধি রক্তিমকে দেখে বলল,
রিধি: যান, আমার বিরক্ত লাগে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে।
রক্তিম রিধির কাছে এসে কেবিনেটের উপর পা ঝুলিয়ে বসে পড়ে। রিধি চোখ ছোটো করে রক্তিমের দিকে তাকায়।
রক্তিম: আমার একটাই স্বপ্ন এখন। শুনবে কি স্বপ্ন?
রিধি: শুনাবেন ভেবে নিয়েছেন তাই তো বলছেন। এখন যদি শুনতে না চায় তাও বলবেন। হুহ।
রক্তিম: আমার স্বপ্ন, তুমি শাড়ি পড়বে আর আমার জন্য রাঁধবে। আর আমি তোমাকে বসে বসে দেখবো এভাবে। তোমার চুলগুলো খোঁপা করা থাকবে, কিছু চুল খোঁপা থেকে খুলে তোমার মুখের উপর আসবে আর আমি কানের কাছে……….
রিধি রক্তিমকে থামিয়ে দিয়ে বলল,
রিধি: একমিনিট। খোঁপা ভালো ভাবে বাঁধলে চুল সামনে আসবে কেন? আর কেউ ইচ্ছে করে খোঁপা হালকা করে বাঁধেও না। কাজ করতে আসলে তো একদমই না। আর এসব আজগুবি কথা কিভাবে বলছেন? মুভিতে অতিরিক্ত হাওয়া আসে তারপর জানালা খুলে যায়, তারপর ওই বাতাসে খোঁপা খুলে যায়। আর এখানে বাতাস কিভাবে আসবে? আপনার রোমান্টিক স্বপ্ন পূরণের জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগ লাগবে। যে দুর্যোগের ঝড়ো হাওয়ায় জানালা খুলে যাবে। তারপর হয়তো খোঁপা আলগা হওয়ার কথা ভাবা যায়। আর রান্নাঘরের জানালা মনে হয় না ভারী হাওয়ায়ও খুলবে। বাবা ভালো ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে বাড়ি বানিয়েছেন।
রক্তিম রিধির কথা শুনে দাঁতে দাঁত চেপে রিধির দিকে তাকিয়ে বলল,
রক্তিম: আর কিছু?
রিধি: না। এখন আপনি যাবেন? আমি কিন্তু নাস্তা না বানিয়ে এবার চলে যাবো।
রক্তিম কিছু না বলে চলে গেল।
এদিকে আজকে ইশাদের ভার্সিটিতে প্রোগ্রাম। ইশা সকালে উঠেই শাড়ি পড়ে নিলো।
সাদা রঙের লাল পাড়ের শাড়ি। পাড়ে গোল্ডেন পাথরের কাজ আছে। লাল রঙের গোল্ডেন কাজ করা ব্লাউজ। চুলে খোঁপা করেছে। খোঁপায় বেলি ফুলের মালা লাগিয়েছে। কপালে লাল টিপ, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, হাতে লাল রঙের কাচের চুড়ি। এককথায় ইশাকে আজকে আরো বেশি সুন্দর লাগছে গতদিনের তুলনায়। এদিকে দিব্যও আজকে কি ভেবে লাল পাঞ্জাবি পড়ল, সাদা রঙের জিন্সের সাথে। সাথে গলায় ঝুলিয়েছে ক্যামেরা।
দিব্য, দিয়াকে নিয়ে বের হয়। ওইসময় ইশাও বের হয়। ইশাকে দেখে দিব্য একমিনিটের জন্য নির্বাক হয়ে যায়।
ইশা ব্যাপারটি বুঝতে পেরে লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে তাড়াতাড়ি।
দিয়া দিব্যকে ইশার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুচকি হেসে দিব্যের কানের কাছে এসে বলল,
দিয়া: ভাইয়া, মা কে বলে ভাবিকে বাসায় নিয়ে আসি একেবারে। সারাদিন তখন হাঁ করে দেখতে পারবে।
দিব্য: চটকানি দিবো বেশি কথা বললে। আর শোন, ইশার সাথেই থাকবি। এদিক ওদিক যাবি না। অনেকে ধরণের ছেলে আছে ভার্সিটিতে। বুঝেছিস?
দিয়া: বুঝেছি।
তারা বাসের জন্য দাঁড়ায়। ইশাকে আশেপাশের সব মানুষই ঘুরে ঘুরে দেখছে। দিব্যের বিষয়টি ভালো লাগছে না। দিব্য ইশার সামনে এসে দাঁড়ায়, যাতে কেউ ইশাকে না দেখতে পায়। দিব্যের কাজকর্ম দেখে দিয়া মুচকি মুচকি হাসছে।
ইশা দিয়ার দিকে তাকিয়ে দিয়াকে হাসতে দেখে ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে, আবার ভালোও লাগছে এইটা ভেবে কেউ তাকে খারাপ নজর থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে। মুহিব কি কখনো পেরেছিল? না কখনো পারে নি। উল্টো ইশার চরিত্রে আঙ্গুল তুলেছিলো।
বাস আসার পর দিয়াকে উঠিয়ে দিব্য বাসে উঠে। তারপর হাত এগিয়ে দেয়। ইশার সংকোচ হচ্ছিল, ধরবে কি ধরবে না? আবার শাড়ি পড়ে এতো উঁচু বাসে উঠা সম্ভবও না। শাড়ি ধরবে নাকি বাস?
দিব্য বুঝতে পেরেছে ইশার সংকোচ হচ্ছে। তাই বলল,
দিব্য: বাস কি দাঁড়িয়ে থাকবে? চিন্তা করো না, আমি সাহায্যের জন্য হাত এগিয়ে দিয়েছি। খারাপ চিন্তা একদম নেই মাথায়।
ইশা দিব্যের হাত ধরে উঠে পড়ে। দিয়া আর ইশা এক সিটে বসে। আর দিব্য তাদের পাশের সিটে।
বাস ভর্তি হয়ে গেলে কিছু স্টুডেন্ট দাঁড়িয়ে যায়। একটি ছেলে ইশার পাশে এসে দাঁড়ায়। দিব্যের বিরক্ত লাগছে বিষয়টি। তাই সে নিজের সিট ছেড়ে ছেলেটিকে বসতে দেয়। বাকী রাস্তা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যায়। ইশার অনেক বেশি নিরাপদ মনে হচ্ছে নিজেকে দিব্যের সাথে। নিশুও বলেছিল দিব্য অনেক ভদ্র।
ইশা জানালার বাইরে তাকিয়ে আছে। বাসের গতিতে দ্রুত পেছনে চলে যাচ্ছে সবকিছু। ইশারও কি জীবনকে আরেকবার সুযোগ দেওয়া উচিত না? সে মুহিবের স্মৃতিগুলো এভাবেই পেছনে ফেলে দিতে চাচ্ছে। আরেকবার মন খুলে ভালোবাসতে চাচ্ছে। যেখানে অধিকার আছে নিজের উপর। নিজেকে দেখলে অপরিচিত মনে হবে না। ইশা এমন ভালোবাসা চায়, যেখানে শ্বাস নেওয়ার জন্য কারো অনুমতি দরকার হয় না। যেই মানুষকে সে নিজের মতো করে ভালোবাসবে, মানুষটির পছন্দমত না। এমন মানুষ যে তাকে স্বপ্ন গড়তে সাহায্য করবে, ভাঙতে না।
তবুও এখনো ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে আসে, এই ভেবে যে অপ্রিয় স্মৃতিগুলোই তার প্রিয় মানুষটি তাকে দিয়েছিলো।
তারা ভার্সিটি পৌঁছে যায়। রোহান ভার্সিটি আসার পর থেকে অনেক মেয়ে তাকে গিলে খাচ্ছে। বড়োলোক বাবার ছেলে হয়েও রোহান কখনো চোখে লাগার মতো নিজেকে তৈরি করে আসে নি ভার্সিটিতে। আজকেই সে একটু ভিন্ন ভাবে এসেছে। অফহোয়াইট ব্লেজার, সাথে অফহোয়াইট জিন্স। ব্লেজারের নিচে হাল্কা আকাশী রঙের শার্ট ইন করে পড়েছে।
দিব্য রোহানকে দেখে বলল,
দিব্য: মাশাল্লাহ, আমার বন্ধুকে তো আজকে অনেক বেশি সুদর্শন লাগছে। আজকেই কয়েকটি বিয়ের প্রপোজাল পেয়ে যাবি।
রোহান মুচকি হেসে বলল,
রোহান: তোকেও ভালো লাগছে অনেক। চল। যাওয়া যাক।
রোহানের চোখ ইশার দিকে পড়তেই রোহান কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলে। মেয়েটি এতো সেজেগুজে কেন আসে ভার্সিটিতে? আর বারবার তার সামনেই এসে পড়ে! এখন কিভাবে আটকাবে চোখদুটি? পুরোদিন আজ চোখদুটি অবাধ্য হবে তার।
দিব্য রোহানের মুখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে বলে,
দিব্য: দোস্ত, তোর বন্ধুর একমাত্র পছন্দ কিন্তু এটি।
রোহান দিব্যের দিকে তাকিয়ে জোরপূর্বক হাসির রেখা টেনে বলল,
রোহান: কিছু মনে করিস না, এভাবে সেজেগুজে আসলে সব ছেলেরাই তাকিয়ে থাকবে। কয়জন থেকে বাঁচিয়ে রাখবি?
দিব্য: নিষেধ করার অধিকারও তো নেই।
রোহানের পরিচালনায় শুরু হয় অনুষ্ঠান। পুরস্কার বিতরণ, বক্তৃতা সহ একেকটি পর্ব শেষ হয়। দিব্য ইশার ছবি বেশি উঠাচ্ছে আজকে। তবে বাকীদেরও উঠাচ্ছে।
অনিক দিব্যের কাছে এসে বলল,
অনিক: দিয়া এসেছে?
দিব্য: হুম। ইশার সাথেই আছে।
অনিক: আচ্ছা।
ক্যামেরা থেকে চোখ উঠিয়ে দিব্য বলল,
দিব্য: আমার বোনকে কেন খুঁজছিস?
অনিক: না এমনি। জানতে চাইলাম এসেছে কিনা।
দিব্য: ওহ।
অনিক: আচ্ছা আমি ওইদিকটা দেখছি। তুই ছবি উঠা।
অনিক দিয়ার কাছে এসে বলল,
অনিক: হাই, দিয়া।
দিয়া: অনিক ভাইয়া আপনি?
অনিক মনে মনে বলল,
অনিক: ভাইয়া বলে কি চটকানিটা দিলো। একদম মনের আয়নাটায় ভেঙে শেষ।
দিয়া: কিছু বলবেন?
অনিক: তোমাকে ভালো লাগছে আজকে।
মুচকি হেসে বলল,
দিয়া: ধন্যবাদ।
একে একে সবার পার্ট শেষ। এবার ইশা কবিতা আবৃত্তি শুরু করবে।
জীবনানন্দ দাশের কবিতা- আকাশনীলা আবৃত্তি করে ইশা।
সবাই নিরব, শান্ত হয়ে যায়।
“সুরঞ্জনা, ওইখানে যেয়োনাকো তুমি,
বোলোনাকো কথা অই যুবকের সাথে, ফিরে এসো সুরঞ্জনা:
নক্ষত্রের রুপালি আগুন ভরা রাতে,
ফিরে এসো এই মাঠে, ঢেউয়ে,
ফিরে এসো হৃদয়ে আমার,
দূর থেকে দূরে – আরও দূরে
যুবকের সাথে তুমি যেয়োনাকো আর।
কী কথা তাহার সাথে? – তার সাথে! আকাশের আড়ালে আকাশে
মৃত্তিকার মতো তুমি আজ:
তার প্রেম ঘাস হয়ে আসে।
সুরঞ্জনা,
তোমার হৃদয় আজ ঘাস :
বাতাসের ওপারে বাতাস-
আকাশের ওপারে আকাশ।”
ইশা আবৃত্তি করার সময় দিব্য শুধু একটি ছবি উঠিয়েছে। বাকী সময় সে ইশার দিকেই তাকিয়ে ছিল।
এবার ইশা রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া শুরু করে। খুব আকুল কন্ঠে সে গানটি গায়।
“সখী, ভাবনা কাহারে বলে।
সখী, যাতনা কাহারে বলে।
তোমরা যে বলো দিবস- রজনী ‘ভালোবাসা,ভালোবাসা’
সখী, ভালোবাসা কারে কয়!
সে কি কেবলই যাতনাময়?
সে কি কেবলই চোখের জল?
সে কি কেবলই দুখের শ্বাস?
লোকে তবে করে কী সুখেরই তরে এমন দুখের আশ।”
ইশার চোখ ছলছল করে উঠল। গান শেষ হওয়ার পর করতালিমুখর হয়ে পড়ে এতোক্ষন শান্ত, নিরব হয়ে থাকা পরিবেশটি। দিব্য বেশ বুঝতে পেরেছে ইশার মনের কষ্ট। এতোক্ষণ রোহান চোখ বন্ধ করেই ইশার গান শুনছিল। এতো সুন্দর করেও গান গাইতে পারে মেয়েটি? এতো সব গুন একটি মেয়ের মাঝে কিভাবে থাকতে পারে? রোহান গানটি নিজের ফোনে রেকর্ড করে নেয়। এখন থেকে এই গানটি শুনেই সে ঘুমোবে। ইশার এই একটি স্মৃতি নিয়েই সে কাটিয়ে দেবে বাকি জীবন।
সবার গান শেষ হলে সবাই রোহানকে গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করে।
রোহান স্টেজে উঠে তার ব্লেজারটি খুলে গিটার হাতে নেয়। সব মেয়েরা একসাথে চিৎকার করে উঠে। অনেকে রোহান রোহান বলে চিৎকার করছে।
রোহান ইশার দিকে তাকিয়ে গিটারে সুর তোলে, তাহসিন আহমেদের খোলা জানালা দিয়ে।
“খোলা জানালা দখিনের বাতাসে,
ঢেকে যায় পর্দার আড়ালে,
কখন তুমি এসে হেসে বলে দাও
আছি তোমার পাশে।।
বহুদূর পথ ভীষণ আঁকাবাঁকা
চলতে ভীষণ ভয়।।
তুমি এসে বলে দাও আছি আমি পাশে
কোরো না কিছুতেই ভয়।
কখনো ভাবি নি চলে যাবে তুমি
আমাকে এভাবে কাঁদিয়ে,
কখনো বুঝি নি ফিরে আসবে না
আমার পৃথিবী রাঙিয়ে।।”
অনিক রোহানের চোখ আর গান গাওয়ার ধরণ দেখেই বুঝে ফেলেছে সে ইশাকে নিয়ে গানটি গাইছে। আর অনেকবার অনিক ব্যাপারটি খেয়াল করেছিল, যে রোহান ইশাকে নিয়ে অন্যভাবেই চিন্তা করে।
আর এদিকে ইশা গান শুনে মুহিবকেই কল্পনা করছে।
গান শেষ হওয়ার পর নিশু কানের কাছে এসে বলল,
নিশু: এখনো মুহিবের মধ্যেই আছিস?
ইশা: না তো। সবকিছু শেষ। ও এখন কোথা থেকে আসবে?
নিশু: না আসলেই ভালো।
অনুষ্ঠান শেষ। সবাই চলে যাবে। এমন সময় দিব্য মাইক হাতে স্টেজে উঠে।
দিব্য: গুড আফটারনুন। আজকে সবার উদ্দেশ্যে আমি কিছু বলব, আর সবার সাথেই আমি আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় শেয়ার করবো। যেহেতু এটি আমাদের শেষ বছর, আমি চাই আমার বন্ধুদের সাথে আর বাকীরা যারা আছে, তাদের সামনে আমার অনুভূতির কথা ব্যক্ত করতে।
আচ্ছা সবাই আমকে একটি প্রশ্নের উত্তর দেবে আগে, প্রথম দেখায় ভালোবাসা যায় কে কে বিশ্বাস করো?
অনেকে হাত তুলে, অনেকে অনেক ধরণের সংজ্ঞা দেয়।
রোহানের মন তখন ধীরে ধীরেই উত্তর দিচ্ছে,
রোহান: হ্যাঁ, আমি বিশ্বাস করি প্রথম দেখায় ভালোবাসা যায়। প্রথম দেখায় যে ভালোবাসা হয় সেখানে কোনো চাহিদা থাকে না। মানুষটিকে প্রথম দেখার পর সে হারিয়েও ফেলতে পারে। এখানে কাছে না পাওয়ার চাহিদাই বেশি। কোনো স্বপ্ন বাঁধার অধিকার থাকে না। প্রিয় মানুষটি অন্যেরও প্রিয় হতে পারে আগে থেকে। আর অপেক্ষার মায়াজাল তো থাকেই। অদ্ভুত মায়াজাল। যেখানে মন বলে, আরো কিছুদিন না হয় অপেক্ষায় থাকি। প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলা মানুষটি হয়তো সারা জীবনের ভালোবাসা পাওয়ার দাবী করতে পারে। এখানে, প্রিয় মানুষটির চোখ, হাসি, কথা বলার-ভঙ্গি দেখে মনে অদ্ভুত অনুভূতি সৃষ্টি হয়। এটি অদ্ভুতরস এনে দেয় জীবনে। ভালোবাসার মানুষকে দেখার জন্য, তাকে ভালোমতো জানার জন্য মন একদম তৃষ্ণার্ত হয়ে পড়ে। এটিই প্রথম দেখায় ভালোবাসার প্রকাশ।
দিব্য সবার উত্তর জানার পর বলে,
দিব্য: আমার জন্য প্রথম দেখায় ভালোবাসার কোনো সংজ্ঞা নেয়। আমার মতে ভালোবাসা প্রকাশের জন্য মুখের ভাষা ব্যর্থ। কোনো শব্দ দিয়ে এই অনুভূতি ব্যক্ত হয় না।
দিব্যের কথা শুনে ইশার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। নিশ্বাসও আটকে যাচ্ছে। মনে হয় তাকে এখনই অক্সিজেন দিতে হবে।
দিব্য আবার বলছে,
দিব্য: আমার প্রথম দেখায় ভালোবেসে ফেলা মানুষটি গল্প ও কাব্যের সব চরিত্রকে হার মানিয়েছে। আমার মনে গড়ে উঠা বহুদিনের পুরোনো অপ্সরী সে।
আমি কিন্তু কোনো কবি নই। তাকে নিয়ে দুই এক লাইন কবিতা লেখার ছন্দ আর ভাষা আমার জানা নেই। কিন্তু অপ্সরীর কাব্যের প্রতি বড়ো আকর্ষণ। বেশি কিছু পারি না আমি, তবে একটু আধটু তার ইচ্ছের সাথে নিজেকে যুক্ত রেখে রবীঠাকুরের কবিতার পাতায় চোখ ভুলিয়ে যায়। রবীন্দ্রসংগীত শুনতে তার অনেক ভালো লাগে। গান তো গাইতে পারি না, তবে গভীর রাতে রবীন্দ্রসংগীত বাজিয়ে দেই অপ্সরীকে কল্পনায় আনার জন্য। হয়তো সংগীত শুনে আমার স্বপ্নে বিচরণ করবে সে। ভালো ছবি আঁকতে পারি না, কিন্তু চোখ বন্ধ করলেই মন আপনাআপনি তার চিত্র এঁকে নেয়। গিটারে সুর দিতেও পারি না, তবুও তাকে দেখলে অদ্ভুত সুর মন নিজে নিজেই বানিয়ে ফেলে। তবে আমি ভালো ছবি উঠাতে পারি, মেয়েদের আবার খুব শখ ছবি উঠানোর। আমি কিন্তু এই কাজটি ভালোই করতে পারবো। নির্বাক অপ্সরীকে বলছি, আমি তোমাকে গান শুনাতে পারবো না, তবে তোমার সাথে রবীন্দ্রসংগীত শুনতে চাই। তোমার কবিতাগুলোকে মধুর করার জন্য সুর আছে তোমার, সেই সুর প্রতিদিন শুনতে চাই। প্রকৃতি বিলাসী হওয়ার খুব শখ তোমার, আমিও তোমার সঙ্গী হতে চাই। এই দিব্য ছেলেটি অনেক ভালোবাসে তোমাকে। অনেক বেশি। ছেলেটি তোমার স্বপ্ন পূরণে কখনো বাঁধা দেবে না। তোমার ছোট ছোট ইচ্ছে পূরণের চেষ্টা করবে। আকাশের চাঁদ এনে দেওয়ার ক্ষমতা না থাকলেও একটি গোলাপ ফুল দেওয়ার ক্ষমতা রাখবে। সেটি যদি অপ্সরীর বাগানের ফুল হয় তাতেও সমস্যা নেই।
কথাটি বলার সময় দিব্যের সাথে সাথে ইশাও হেসে দেয়।
দিব্য: আমি তোমাকে জোর করবো না। ভালোবাসায় কি কখনো জোরজবরদস্তি চলে? আমি শুধু তোমার ভালো বন্ধু হয়ে থাকতে চাই এখন। অপেক্ষায় থাকবো তোমার। যদি কখনো ভালোবেসে ফেলো আমায়, ওইটিই হবে আমার ভালোবাসার শেষ সমাপ্তি। কারণ ভালোবাসার জন্য বহু অপেক্ষার পর যে সমাপ্তিটা হয় সেটি যদি সুখের হয় তবুও মেনে নেবো। দুঃখের হলেও মেনে নেবো। কিন্তু অপেক্ষার সমাপ্তি একদিন অবশ্যই হবে।
দিব্যের কথা শুনে, নিশু ইশার কানের কাছে এসে বলল,
নিশু: এতো ভালোবাসা দেখে আমার জ্বলছে কিন্তু। ইশ, কারো নজর না লাগুক।
এদিকে রোহানের বুকে বড়ো পাথর চেপে বসেছে। না পারছে চলে যেতে, কারণ চলে গেলে দিব্য যদি সন্দেহ করে? আর না পারছে থাকতে। তবুও মুখে কৃত্রিম হাসি ঝুলিয়েছে দিব্যের খুশির জন্য। কারণ এই ছেলেটিই তাকে সবসময় সঙ্গ দিয়েছে। অদ্ভুত এক মায়া আছে তার দিব্যের প্রতি। মনে হয় বহু আপন। এই মানুষটিকে কিভাবে তার প্রিয় মানুষটির থেকে আলাদা করবে?
দিব্যের কথায় কল্পনার জগৎ থেকে ফিরে আসে রোহান।
দিব্য: আমি গান পারি না। তবে আজ দুটি লাইন গাইতে চাই নির্বাক অপ্সরীর জন্য।
দিব্য গলা ঝেড়ে শুরু করল,
“নীলাঞ্জনা, ওই নীল নীল চোখে চেয়ে দেখো না,
তোমার ওই দুটি চোখে আমি হারিয়ে গেছি,
আমি বোঝাতে তো কিছু পারি না।।”
গানটা গাওয়া শেষ করলে সবাই তালি দেয় আর চিৎকার করে উঠে। অনেকে ইশার দিকে তাকিয়ে বলছে, নীল নীল চোখ তোরই আছে, কেটস আই প্লাস নীলাঞ্জনা ওয়াও। পারফেক্ট কাপল।
ইশা তো লজ্জায় লাল হয়ে গেছে।
আর এদিকে দিয়া তো মহাখুশি। সে খুশিতে অনিকের হাত ধরে ফেলে।
অনিক চোখ বড়ো বড়ো করে দিয়ার দিকে তাকায়। আর মনে মনে ভাবে ভাইয়ের পর বোনও কি প্রেমের প্রস্তাব দেবে?
দিয়া অনিকের হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
দিয়া: জানেন, ভাইয়া আমার এতো ভালো লাগছে। ইশা আপুকে আমার অনেক পছন্দ। ভাইয়ার উপর আমার সন্দেহও হয়েছিল। আমার সন্দেহ কখনো ভুল হয় না, দেখেছেন?
অনিক: আর কার কার উপর সন্দেহ হয় তোমার?
দিয়া: মানে?
অনিক: ইয়ে মানে আমার উপর? আমাকে দেখে কি মনে হয় আমি প্রেম করছি?
দিয়া: আমি কিভাবে বলবো? আপনার উপর পিএইচডি করেছি আমি?
অনিক: আরে চেহারা দেখলে কি বোঝা যায় না?
দিয়া: আপনাকে দেখে তো মনে হয় প্রেমের উপর ডিগ্রী নিয়েছেন।
অনিক: মানে আমাকে তোমার ছ্যাঁচড়া মনে হয়!
দিয়া: আপনি নিজেই বলছেন নিজেকে ছ্যাঁচড়া। আমি তো বলিনি।
অনিক ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থাকে দিয়ার দিকে, দিয়া মুচকি হাসি দিয়ে আস্তে আস্তে সরে পড়ে।
চলবে–
আগের পর্বের লিংক:
https://www.facebook.com/groups/371586494563129/permalink/373298484391930/