সেঁজুতি পর্ব_৯

0
2158

#সেঁজুতি(পর্ব_৯)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

বড় আপুর কথা শুনে সবাই হেসে দিলো। আশিকের নিষ্পাপ চাহনি কিছুই বুঝতে পারেনি। চুপচাপ এসে সেঁজুতির গায়ে হেলান দিয়ে আছে। মামী বলতে অজ্ঞান সে। এ বাড়িতে আসলেই সেঁজুতির পিছুপিছু থাকবে। সেঁজুতিও আশিকের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নেয়। বড়দের সাথে যতই রাগারাগি হোক, সে রাগের সূত্রপাত ধরে বাচ্চাদের সাথে কখনোই রাগ দেখায় না সেঁজুতি।

মেজো দুলাভাই হেসে হেসে বলল, “বাহ! মামী ভাগ্নের কতো ভাব। ”

মেজো দুলাভাইয়ের কথাশুনে হেসে দিলো সেঁজুতি।.
.
আনোয়ারা বেগম চায়ের কাপ রাখতে আসলেন। মেজো জামাই ডেকে সবার সাথেই বসালেন তাকে। মাথাব্যথা কমেছে কি-না জিজ্ঞেস করলো সবাই। আনোয়ারা বেগম সেঁজুতির দিকে একবার তাকিয়ে বললেন,“ মাথাব্যথার মলম দেওয়ার জন্য কিছুটা কমেছে।”
বড় মেয়ে, আনোয়ারা বেগমকে উদ্দেশ্য করে হেসে হেসে বললো,“ এতদিন নাতির জন্য ব্যকুল হয়ে থাকতে। এখন আসা মাত্রই অসুস্থ বানিয়ে দিলো!”

আনোয়ারা বেগম মেয়ের কথা শুনে হেসে দিলেন। আশিককে উদ্দেশ্য করে বললেন,“ নানুভাই! এদিকে আসো। ”

আনোয়ারা বেগমের ডাক শুনে আশিকও হাসি মুখে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। নানি -নাতির খুনসুটি মনযোগ দিয়ে দেখছে সবাই।
.
.
.
সাওন অস্থির হয়ে বসে আছে। সেঁজুতি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো। সাওন কিছু না বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। যে নিঃশ্বাসে অনেককিছু প্রকাশ পাচ্ছে৷ তবুও আমতা-আমতা করে বললো,“ সন্ধ্যেয় ওভাবে বলেছো কেন?”

সেঁজুতি চিন্তিতস্বরে বললো, “কী বলেছি?”

সাওন বড়সড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “কিছু না।”

সেঁজুতি খুব শান্তভাবে সাওনের দিকে তাকিয়েছিল।ওর না বলা কথাগুলো বুঝতে পেরেও চুপ হয়ে আছে।
আম্মা আর মা এই দুটো শব্দকে ঘিরে হয়তো সাওনের এমন দীর্ঘশ্বাস নেওয়া৷ সেঁজুতিও কথা বাড়ালো না।

.
.
রাত্রির নিস্তব্ধ প্রহরে সাওনের চোখদুটো নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে। খুব চিন্তিত থাকলেও কিছুই প্রকাশ করছে না সে। জীবিকা নির্বাহ, সংসার, প্রিয় মানুষগুলোর মুখগুলো ভেসে আসছে চারিদিকে। কিন্তু ব্যর্থতা তার, সবকিছু থেকেও না থাকার মতো সংসার চলছে। যার কারণে দীর্ঘশ্বাস ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না।

হয়তো অষ্টম শ্রেণির সাহিত্য কণিকা বইয়ের, সুখী মানুষ গল্পের মোড়লের মতো অবস্থায় পরেছে। মোড়লের মতো কোনো অন্যায় না করেও সে আজ অস্থিরতা নামক অসুখে ভুগছে। এ অসুখ যে ভীষণ ভয়ংকর। পরিবার নামক জটিলতার জন্যই এই অসুখের দেখা মিলেছে তার। কেন সে, সুখী মানুষ হতে পারলো না! সমস্ত গ্লানি জাগবে যখন, তখন কি সুখী মানুষ হতে পারবে? এর উত্তর কি আজও কোনো লাইব্রেরি নামক স্থানে, লুকায়িত বইয়ের পাতায় রয়েছে? কোথায় সন্ধান পাবে সেই লাইব্রেরির? দুটো ক্লান্তিকর চোখ বুজলেই যেন সেই লাইব্রেরির ঠিকানা সম্মুখে ভেসে আসে, এটাই প্রার্থনা সাওনের। সেও সুখী মানুষ হতে চায়। একটা সুন্দর পরিবার চায়, যেখানে কোনো কথা কাটাকাটি, ঝগড়াঝাটির ঝামেলা থাকবে না। তবে এই আশা পূরণ হবে কি-না দ্বিধায় আছে সাওন।
দু চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস নিলো।

.
.
আজ ছুটির দিন। সকালে ঘুম ভেঙে অফিসে যাওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ করতে হয়নি সাওনের। গভীর ঘুমে মগ্ন সে। সেঁজুতি সবার জন্য নাস্তা তৈরি করছে। সাথে সাওনের বড় বোনও সাহায্য করছে।
আনোয়ারা বেগম, আশিকের সাথে ব্যস্ত। দুই নানী, নাতির ভীষণ ভাব। মাঝে মাঝে রান্নাঘরে এসে মা ও মামীর খোঁজ নিয়ে যাচ্ছে আশিক।
কিছুক্ষণ পরে দৌঁড়ে সাওনের রুমে গেল। সাওনের পেটে মাথা রেখে শুয়ে ফ্যানের দিকে নিশ্চুপ হয়ে তাকিয়ে আছে। সাওন কারো অস্তিত্ব পেয়ে ধড়ফড়িয়ে উঠে। আশিককে দেখে হেসে দেয়। হাস্যজ্বল মুখে বলে, “ মামা! এত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠেছো?”

জবাবে আশিক কিছু না বলে মুখ টিপে হেসে দেয়।
.
.

আশিক কার্টুন দেখছে। মেজো দুলাভাই, সাওন পাশেই বসা আছে। আনোয়ারা বেগম ও তার দুই মেয়ে একসাথে কোনো কথা নিয়ে ব্যস্ত আছে। সেঁজুতি রান্না করতে ব্যস্ত।

সেদিনের ঘটনার পরে আর বাবার বাড়িতে যায়নি সেঁজুতি। কেমন একটা বিরক্ত লাগছিলো, সব দায়ভার ওর কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে তারা চলে গেল। এমন পরিস্থিতির শিকার হয়তো খুব কম জনেই হয়। ওই ঘটনার পরে আর বাবার বাড়িতে পা রাখেনি সেঁজুতি, শুধু ফোনকলেই কথা হয়েছে। যার যা ইচ্ছে ওর উপরে চাপিয়ে মুক্ত হয়ে যায়।

সাওনের বোনরা বাবার বাড়িতে এসে কত সানন্দে আছে, এর দেখাদেখি সেঁজুতিরও একটু শান্তির নিঃশ্বাস নিতে ইচ্ছে করে। নিশ্চয়ই ওর বাড়িতে গেলে এভাবে শান্তিতে থাকতে পারবে। শ্বশুর বাড়িতে তো একেরপর এক কথার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। মাঝেমাঝে সবকিছু বুঝতে পারে সেঁজুতি, ভাবে সবকিছু সহ্য করবে। তবুও পারে না, অতিরিক্ত দোষ ধরলে প্রতিবাদ করতেই হবে। কিন্তু প্রতিবাদ করলেই পুরস্কার স্বরূপ বাচালতা উপাধি পায়। সত্যিই কী প্রয়োজনের অধিক কথা বলে?
ওর পরিবারে থাকাকালীন শুনেছিল, মাঝেমাঝে সবকিছু দাঁতে দাঁত চেপেও সহ্য করা উচিত। তাই বলে অতিরিক্ত কিছু হলেও সহ্য করবে?

শ্বশুর বাড়িতে পা ফেলার সাথে সাথেই তো কত কথার মুখোমুখি হতে হয়েছে। এখন পর্যন্তও চলছে, ভবিষ্যতে হয়তো আরও চলবে।
আর ওর নিজের পরিবারও সবকিছুর দায়ভার ওর মাথায় দেয়। ওর বাচালতার জন্য নাকি এমন হয়।তাই রেগে ছিল এতদিন কিন্তু এখন সব রাগ ভুলে যেতে ইচ্ছে করছে। মেহমানরা ঘরে থাকলে তো আর যেতে পারবে না। তাই মনে মনে একবুক ব্যর্থতা নিয়ে কাজে মনোযোগ দিল।

মেজো দুলাভাই বললো, “ আজকে তো ছুটির দিনই গেল। তাহলে চলো কোথাও ঘুরতে যাই। ”

মেজো দুলাভাইয়ের কথা শুনে সাওন মাথা নাড়ালো। মুখের উপরে না বলবে কীভাবে? মাঝেমাঝে অনিচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও রাজী হতে হয়। সাওনের দুই বোনও সম্মতি প্রকাশ করলো, বিকেলে সবাই ঘুরতে বের হবে। আশিক তো মহা খুশি।

.
.

দুপুরের খাবারের পরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সেঁজুতি। অনেক খাটুনি করতে হচ্ছে, যার জন্য ক্লান্ত এসে ভর করে। সাওন পাশে বসেই মোবাইল ঘাটছিল। সেঁজুতিকে নিশ্চুপ দেখে ওর দিকে তাকালো সাওন। সেঁজুতি চোখ বন্ধ করে আছে, সাওন কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে সেঁজুতির মুখমণ্ডল গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছিল। অতঃপর আমতা-আমতা করে বললো, “ সেঁজুতি! ”

কেবল তন্দ্রার মতো পরেছিল তখনি সাওনের ডাক শুনে হকচকিয়ে গেল সেঁজুতি। চোখ খুলে সাওনকে উদ্দেশ্য করে বললো, “ হুম। ”

সাওন ধীর কণ্ঠে বললো, “ ঘুরতে যাবে? ”

সেঁজুতি শান্ত ভাবে বললো, “ নাহ। ভালো লাগছে না আজ। ”

সাওন ধীর কণ্ঠে বললো, “ আপুরা যাবে, ভাইয়া যাবে। চলো সবাই একসাথে ঘুরে আসি, ভালো লাগবে। ”

জবাবে সেঁজুতি কিছু বললো না। নিশ্চুপ হয়ে শুয়ে আছে। সেঁজুতিকে নিশ্চুপ দেখে সাওন আবারও বললো, “ কী হলো? ”

এবারে শান্ত ভাবে সেঁজুতি বললো, “ তোমরা যাও। আমি যাবো না।”

সাওন কিছুক্ষণ নীরবতা পালন করে বললো, “ তুমি না গেলে সবাই খারাপ ভাববে। ”

সেঁজুতি সাওনের চোখাচোখি হয়ে বললো,“ আমায় এমনিতেও সবাই ভালো জানে না। তাছাড়া, এতদিনেও স্বামীর সাথে কোথাও ঘুরতে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। আজও নাই-বা গেলাম। ”

সেঁজুতির কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে যায় সাওন। দৃঢ় কণ্ঠে বললো, “ সেঁজুতি!”

“আমি বড্ড বেহায়া মেয়ে। একবার মুখ দিয়ে যা বলি তাই করি। আমি যাবো না বলেছি, তাহলে যাবোই না। আপনি শুধু শুধু মন খারাপ করবেন না। পরিবারের সাথে ঘুরতে যাওয়ার আনন্দই আলাদা, সেখানে শুধু শুধু আমার জন্য বঞ্চিত হবেন কেন? তখনও ঘুরেফিরে সবাই আমাকেই কথা শুনাবে, প্লিজ এমন করবেন না। আজকে ক্লান্ত আমি, কারো কথার জবাব দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। আপনি অনেকদিন ঘুরাঘুরি করেননি , বিয়ের পরে আপুরা যখন এসেছিল তখন ঘুরাঘুরি করেছেন। এখন মাসখানেক পরে আবারও সুযোগ পেয়েছেন, সেই সুযোগকে অবহেলা করবেন না। স্বামীর সাথে ঘুরাঘুরি করার সুযোগ যখন আসবে আমিও তখন যাবো। আপনার মতো অবহেলায় ভাসিয়ে দেবো না।”

সেঁজুতির কথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে যায় সাওন। ঠোঁটে কাঁপুনি দিচ্ছে, মুখমণ্ডলে কেমন অস্থিরতার ছাঁপ বয়ে যায়। চাপা কান্নার আভাস মিলছে ওর মুখমণ্ডলে। তবে খুব দৃঢ় থাকায় নিজেকে সামলে নিলো সাওন। একটা জোরেসোরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো ওর থেকে।

বারো শব্দের দুটো বাক্য চারিপাশে ভেসে আসছে সাওনের। যার সঠিক ব্যখ্যা জানলেও মুখ খুলে কেউ প্রকাশ করে না। এতটাই কঠিন এই কথাটি।

“ একজন মেয়ের আর্তনাদ কম-বেশি সবার নজরে যায়। কিন্তু একজন ছেলের আর্তনাদ ক’জন দেখে?”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here