সেঁজুতি পর্ব_১৯

0
1820

#সেঁজুতি(পর্ব_১৯)
#লেখা_সুমাইয়া_আক্তার_মনি

সাওন কথাগুলো বলে জোরে নিঃশ্বাস নিলো। সবাই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে। ওর কথাগুলো কমবেশি সবার গায়ে লেগেছে, এটা মুখ দেখলে স্পষ্ট ভাবে বুঝা যায়। তবুও মনে যত ক্ষোভ ছিল, আজ শেষ করেছে সাওন। না হলে আগেরমতো চলতে থাকলে সবার সাথে শুধু সম্পর্ক নষ্টই হতো ; মজবুত হওয়ার নাম কোনোকালেই দেখতো না। আজ এর একটা না একটা বিহিত তো হবেই। হোক ভালো কিংবা মন্দ। এই মুহূর্তের পর থেকে যদি সম্পর্ক ঠিক থাকে তাহলে সে সম্পর্ক মজবুত হবে, এটা সাওনের বিশ্বাস। সাওন সবাইকে চুপচাপ দেখে নিজেও আস্তে উঠে গেল৷

সাওনের কথাগুলো খুব মনযোগ দিয়ে শুনছিল ওর দুলাভাইয়েরা। সাওন নিজের কথাও বলেছে পাশাপাশি ওর বোনদের সংসারের কথাও বলেছে। মোটকথা, একজনের সংসারে অন্য একজন হস্তক্ষেপ করলেই সংসারের অবনতি ঘটে। এটা স্পষ্ট ভাবে সাওন বুঝিয়ে দিয়েছে। সব কথাগুলো অক্ষরে অক্ষরে সত্যি ছিল।

সবার পরিবারেই কমবেশি এমন অবস্থা। শ্বশুর বাড়িতে যদি কেউ ভালো কিছুও বলে থাকে, তাহলে সেটা গায়ে লাগে না। কেউ কেউ ভাবে শুধু শুধুই দোষ ধরে। তাই এই খেয়াল শুধু স্বামীর নিজের রাখা উচিত। ভালো কিংবা মন্দ উভয়েরই। এমনকি কারো সামনেই বউকে হেনস্তা করা উচিত না৷ কারণ, কার মনে কী থাকে বুঝা মুশকিল। কারো লক্ষ্যই থাকে মানুষদের হেনস্তা করা। যদি সেসব চিন্তা ধারী মানুষদের সামনেই কারো গায়ে হাত তোলা অথবা মুখ দিয়ে বিভিন্ন কথা বলা ; তাহলে সেসব সুযোগ সন্ধানী মানুষ একেরপর এক সুযোগ খুঁজেই থাকবে। এবং ভুক্তভোগী মানুষদের এমন অবস্থায় বারবার পরতে হবে। তাই সবার উচিত সচেতনতা অবলম্বন করে চলা। শান্ত মাথায় বুঝিয়ে বলা, তাহলে নিশ্চয়ই বুঝবে সবাই। তাহলে দুর্বল চিন্তাধারী মানুষেরাও কোনো সুযোগ পাবে না।

সাওন চলে যাওয়ার পরে দুলাভাইয়েরা জোরেসোরে নিঃশ্বাস নিলো। একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো, দুজনেই সাওনের মতো ভুল করেছে। লোক-সম্মুখে মানুষ হেনস্তা যাকে বলা যায়। সবারই সচেতনতা অবলম্বন করা উচিত। পরিবারের, নিজেদের, এমনকি বাড়ির বউদেরকেও। কেউ যেন কারো দিকে আঙুল তুলতে না পারে সেভাবে চলা উচিত। তাহলেই সংসারে সুখ বর্ষিত হবে৷

আনোয়ারা বেগম বেশ চুপচাপ হয়ে গেল। বিশেষ করে সাওনের শেষ কথাগুলোর জন্য। তার দুই মেয়েও বেশ চুপ হয়ে আছে।

রুমে গিয়ে খাটে মাথা ঠেকিয়ে বসলো সাওন। মন থেকে খুব বড় একটা পাথর নেমে গিয়েছে আজ। যা যা মনে আসছিল সব বলে দিয়েছে। ভালো-মন্দের কিছুরই খেয়াল করেনি।

.

রাতে খাবারের জন্য বরাবরের মতোই আশিক ডাকতে আসলো। আশিককে কোলে নিয়ে সাওন সবার সামনে গেল। সবার মুখমণ্ডলের দিকে চোখ বুলালো। বেশ ভার ভার হয়ে আছে মুখের অবস্থা। বিশেষ করে বড় বোনের ও আনোয়ারা বেগমের। সাওন কিছু না বলে চুপচাপ খেয়ে রুমে আসলো।

মোবাইলের সাথে কয়েকঘন্টা হল, মনমালিন্য চলছে। বিকেল থেকে মোবাইল ধরেনি, ধরেই বা কী করবে! সেই তো তার অভিমানীনি অভিমান করে আছে। একটা দীর্ঘশ্বাস বের করে মোবাইলে চোখ বুলায় সাওন। এতগুলো মেসেজের শুধু একটাই রিপ্লাই,”হুম।”

সাওন একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সেঁজুতিকে কল দিল। দ্বিতীয় বারে কল রিসিভ করে সেঁজুতি। বেশ চুপচাপ দুজনেই। জড়তা কাটিয়ে সাওন বললো,“খেয়েছো রাতে?”

“ হুম।” ছোট করে বললো সেঁজুতি ।

“আচ্ছা। ঘুমাবে না?”

সাওনের কথায় এবারেও অস্ফুটস্বরে সেঁজুতি বললো, “হুম।”

সাওন শান্ত ভাবে বললো, “ বুঝেছি৷ হুম হুম রোগে পেয়েছে, এখন ঘুমিয়ে পরো৷ ঘুম ছাড়া হুম রোগ যাবে না। ”

সাওনের কথায় কিছু বললো না সেঁজুতি। সাওন শান্ত ভাবে বললো, “রাখছি।”

সেঁজুতি বললো, “হুম।”

সাওন ছোট করে বললো, “হুম হুম করে ঘুমাও। মন ভালো হয়ে যাবে। ”

সেঁজুতি হুম বলার আগেই কল কেটে দেয় সাওন।
সেঁজুতি চুপচাপ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আছে। সাওন বিছানায় এপাশ-ওপাশ করছে, ঘুম আসছে না। সমস্ত চিন্তা মাথায় ভর করে আছে। যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে, সেসব অতীত। এখন ভবিষ্যতে কী হবে! এসব নিয়ে ভীষণ চিন্তিত সাওন। কথায় আছে, যার কেউ নেই তাঁর আল্লাহ আছে। হয়তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, শুধু সময়ের অপেক্ষা।

.

সকালে অফিসে চলে যায় সাওন। আনোয়ারা বেগম তড়িঘড়ি করে ছেলের জন্য পরোটা, ভাজি করেন। সাওন স্বাভাবিক ভাবেই হাসিমুখে খায়। যাওয়ার সময়ে বলে যায়, বাজার আছে?
জবাবে আনোয়ারা বেগম শুধু কাঁচাবাজার আনতে বলল। বাকিসব আছে।
সাওন ‘আচ্ছা’ বলে চলে গেল।

সকালে নাশতা করার পরে মেজোবোন বললো,“বিকেলের দিকে তারা চলে যাবে। চার-পাঁচদিন বেড়ানোর জন্য ছুটি নিয়েছে তার স্বামী। এখন সময় শেষ। চাকুরীও করতে হবে। ”

মেজো বোনের কথার পরে বড় বোন বললো,“ আচ্ছা যা। আগামীকাল সকালে আমি যাবো। না গেলে তোর ভাইয়ের ব্যবসায় ক্ষতি হবে। আজকে দু’জনে একসাথে গেলে ব্যপারটি খারাপ দেখায়। যে কাহিনীগুলো হল!
কথাটি বলে তিনি দীর্ঘশ্বাস নিলেন।”

মেজো বোন কিছু বলল না। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে তৈরি হল। অপেক্ষা সাওনের। অফিস থেকে আসলেই দেখা করে চলে যাবে।
বিকেলের দিকে কাঁচাবাজার, গলদা চিংড়ি নিয়ে বাড়িতে ফিরে সাওন।
বড় বোনকে সামনে পেয়ে সবকিছু ধরিয়ে দিয়ে নিজের রুমে গেল। ফ্রেশ হওয়ার পরে সেঁজুতিকে ফোনকল দিলো। সেঁজুতি ঘুমে ব্যস্ত। সাওন দুই-তিন বার কল দেওয়ার পরে সেঁজুতির কোনো হদিস না পেয়ে ; গায়ে টি-শার্ট জড়িয়ে রুমের বাইরে আসলো। মনে মনে সত্যটা বুঝে গিয়েছে, সেঁজুতির চারিপাশে যা-ই হোক না কেন! সে তার ঘুমের রাজ্য থেকে ফিরবে না। মনে মনে মৃদ্যু হেসে চেয়ার টেনে বসলো। আনোয়ারা বেগম খাবার গুছিয়ে রেখেছেন। আনোয়ারা বেগম জিজ্ঞেস করলেন,“ আর কিছু লাগবে, বাবা?”
জবাবে সাওন বললো,“না।”
আশিক চুপচাপ এসে সাওনের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। সাওন হাসিমুখে বলে,“ মামার মন খারাপ?”
সাওনের কথায় মাথা নাড়িয়ে ‘না’ সম্বোধন করে আশিক। খাওয়ার শেষে আশিককে সাথে নিয়ে নিজের রুমে গেল।
মেজো দুলাভাই তৈরি হয়ে সাওনের রুমে গেল দেখা করতে। সাওনের পাশ ঘেঁষে বসে বললো,“ ভুল-ত্রুটি মাফ করে দিয়ো। মানুষ আজ আছে, আগামীকাল নাও থাকতে পারে।”

তার কথা শুনে মৃদ্যু হেসে সাওন বলে, তা ঠিক। সবকিছুই আল্লাহর হাতে। কয়েকদিন থেকে গেলে হতো, না?

মেজো ভাই বলল,“ অফিসের ঝামেলা তো জানোই। ছুটি শেষ এখন নিজ অবস্থানে যেতে হবে। ”

তার কথায় সাওন বললো,“ আচ্ছা। সময় করে আসবেন। ”

দুলাভাই বললো,“ হ্যাঁ। পরিবার নিয়ে যেয়ো, এই গরিবের বাড়িতে। ”

দুলাভাইয়ের কথায় হেসে দেয় সাওন। দুলাভাইও হাসে।

আশিকের হাতে পাঁচশো টাকা ধরিয়ে দিয়ে দুলাভাই চলে আসলো। তার পিছুপিছু সাওন নিজেও আসলো। দুলাভাই দরজা অবধি গিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সাওনের রুমের কাছে এসে মেজো আপু বললো,“ গেলাম ভাই। ভুল-ত্রুটি করছি অনেক, মাফ করিস। হঠাৎ শুনবি বোন নাই, তখন দয়ামায়া রাখিস না। আর সেঁজুতিকে নিয়ে আসিস বাড়িতে। আমরা কোনো বোন এসে ঝামেলা দেবো না। যদি মা’কে দেখতে ইচ্ছে করে যখন আসবো তখন চলে যাবো।”

মেজো আপুর কথা শুনে সাওন বললো,“ ভাই না থাকলে ঝামেলা থাকবে না। আমার কিছু হলে মাফ করে দিয়ো।”

সাওনের কথায় চুপ হয়ে যায় মেজো আপু। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে চলে গেলেন তিনি।
সাওন চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।

.

সাওনের এতগুলো ফোনকল দেখে হকচকিয়ে যায় সেঁজুতি। এত ঘুম কোথা থেকে আসলো! একবারও হদিস পায়নি। নিশ্চয়ই অফিস থেকে আসার পরে কল দিয়েছে। ফোনে না পেয়ে চিন্তিত হয়ে আছে নিশ্চিয়ই।

সাওনের জন্য চিন্তাও হচ্ছে আবার সেদিনের কথা মনে করে চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে সেঁজুতি।
সবকিছু মাথার উপরে ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। শত বাঁধা হওয়ার পরেও যদি প্রেমিকের জন্য মরিয়া হতে পারে, তাহলে স্বামীর জন্য কেন পারবে না! যার সাথে একটা পবিত্র সম্পর্কে আবদ্ধ রয়েছে, তার জন্য মরিয়া হতে পারবে না! অবশ্যই তার স্বামীর জন্য সবকিছুই করবে। নিজের পরিবর্তন আনা দরকার, এটা বুঝতে পারে সেঁজুতি। সেই ছোট থেকে ওর চঞ্চলতার জন্য কম কথা শুনতে হয়নি। এখন তো স্বামীর বাড়ি। চুপ তো থাকতেই হবে, তবে কেউ খোঁচা লাগিয়ে কথা বললে চুপ থাকতে পারে না। আগে না হয় জবাব দিয়েছিল কিন্তু যখন থেকে সাওন সবার উত্তর দিয়ে দেয় ; তখন থেকে ওর চুপ থাকা উচিত ছিল। পরবর্তীতে সাওনতো বেশ পরিবর্তন এনেছে নিজের মধ্যে। তাহলে সেঁজুতিরও উচিত ছিল নিজের পরিবর্তন আনা। আগে ভুল ছিল, এখন সে সবকিছু ঠিক করে নিবে। মুখে বললেই তো স্বামীর সংসার থেকে মুক্তি নেয় না কেউ। যেখানে সাওনের মতো একজন পেয়েছে ভাগ্যে, সেখানে এসবের কোনো কথাই উঠে না।
নিজের পরিবর্তন আনা দরকার। তারপর যদি উল্টাপাল্টা কিছু হয়, তখন অন্য কথা। এসব ভেবে ভেবে সাওনকে কল দেয় সেঁজুতি। সাওন ফোনকল কেটে ব্যাক করলো।
ফোন রিসিভ করার সাথে সাথেই সাওন বলা শুরু করলো, “ঘুম ভাঙলো?”

জবাবে সেঁজুতি বললো,”হুম।”

সাওন মৃদ্যু হেসে বলল,” আবারও হুম হুম শুরু করেছো?”

সেঁজুতি আবারও হুম বলে হেসে দেয়। ছোট করে বললো,”খেয়েছেন?”

জবাবে সাওন বলল, “হ্যাঁ। তুমি খেয়েছো? ”

সেঁজুতি ছোট করে জবাব দিলো, “হুম”। তারপরে আবারও চুপচাপ।

সেঁজুতিকে চুপ দেখে সাওন বলতে থাকলো,”মান-অভিমানের পাল্লা ভীষণ খারাপ। কাছের মানুষও পর হয়ে যায়। আপনি আপনি শুরু হয়। তাছাড়াও নতুন অসুখের দেখা পাওয়া যায়, যার নাম হুম হুম অসুখ। কেউ এই অসুখের রোগী হলে আমিও ডাক্তার হতে পারি। সে কি জানে এসব?”

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here