— নিজের স্রী থাকতেও আপনি দ্বিতীয় বিয়ের পিরিতে বসেছেন রুপায়ন বাবু?
ভরা বিয়ের আসরে চিৎকার শব্দে এরকম কথায় চমকে উঠলো সবাই। স্বর অনুসারে তাকাতেই নিজের মৃত বউকে দেখে চোখ কপালে উঠলো রুপায়নের। রেজিস্ট্রি পেপারে সবেমাত্র সাইন করতে যাচ্ছিলো রুপায়ন। কিন্তু আর করা হয়নি। রুপায়ন উঠে দাড়াতেই তার পাশে থাকা হবু বউ উঠে দাড়ালো। আত্মীয় স্বজনের মধ্য পিনপতন নীরবতা বিরাজমান! কিছুদিন আগেই সামনে থাকা ক্ষত বিক্ষত মেয়েটার সাথে ধুমধাম করে বিয়ে খেয়ে গেছে তারা। কেউ কেউ কানাকানি করতে লাগলো।
রুপায়ন সহ পরিবারের সবাই অবাকের সর্বোচ্চ সিমাকে অতিক্রম করলো। কেননা কিছুদিন আগেই যে মেয়ের কবর নিজে চোখে সবাই দেখে এসেছে, সে মেয়ে কিভাবে এখানে আসতে পারে?
সবাইকে তাক লাগিয়ে ধির পায়ে হাটতে লাগলো আরোহী। শরীর তার ক্ষত বিক্ষত! পোশাকটাও বেশ পুরোনো নয়। লাল রঙা বেনারসি সাড়িটা ছাই কালারে রুপবদল করেছে। মুখে চোখে ভেজা মাটির ছাপ স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। আরোহীর শরীরে এত ক্ষত থাকা সত্বেও মুখে কোন কষ্টের ছাপ দেখছে না রুপায়ন। তার মুখে শুধু রাগ। আরোহী সোজা তার স্বামী রুপায়নের সামনে দাড়ালো। রুপায়নের পাশে থাকা তার অর্ধ বিবাহিত হবু বউয়ের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বললো,
— আর কল্পনা ধোয়াছোঁয়ার বাইরে ছিলো যে আপনি এতটা আন্তসম্মানহীন মানুষ রুপায়ন বাবু। নিজের প্রথম স্রীকে রেখে কিভাবে আরেকটা বিয়ে করতে যাচ্ছিলেন আপনি?
প্রতিত্তোরে রুপায়ন কিছুই বলতে পারলো না। তার অবাক চাউনি! আরোহীর বলা কথাগুলো তার হয়তো কান অব্দি পৌঁছাতে পেরেছে কি না তাতেও সন্দেহ। একজন মরা মানুষ কিভাবে জিবিত হতে পারে তা জানা নেই রুপায়নের। যার বেরা ঘেরা কবর সচক্ষে দেখে এসেছে তাকে এভাবে সামনে দেখে রুপায়নের পুরো পরিবারই অবাক। আরোহী তার উত্তর পেলো না। এবার ক্রোধ নিয়ত্রনের বাইরে যাচ্ছে। বিয়ের দুদীন পেরোতে না পেরোতেই আরেকটা বিয়ে দিয়ে দিচ্ছে তার পরিবার? এতটা নিচ প্রকৃতির মানুষ তার শশুড় বাড়ির লোক তা জানা ছিলোনা আরোহীর। ভাবতেই আরোহী মাথা নিচু করে নিলো। একটু এগিয়ে তার স্বামী রুপায়নের সামনে গিয়ে দাড়ালো আরোহী। রুপায়েনের চোখে চোখ রেখে বললো,
— নিচু মনের মানুষের মনটাও কালো কুচকুচে হয় রুপায়ন বাবু! আজ আপনার সাতটা বিয়ে হলেও কোন সমস্যা নেই। কিন্তু আমরা মেয়েদের একটা বিয়েতেই যত ঝামেলা পোষাতে হয় তা হয়তো আপনাদের বেলায় পাঁচবারেও হয়না। কেন বলুন তো? কারন, আমরা মেয়ে!
আরোহী আরও চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলো,
— বলুন রুপায়ন বাবু। কেন নিজের বউকে ছেড়ে আরেকটা বিয়েতে বসে পড়লেন? কেন আরোহীকে সবার সামনে নিচু করে দিলেন?
কথাগুলো বলতে বলতে কেদে দেয় আরোহী।আরোহীর কথায় রুপায়নের খালা তেড়ে আসে আরোহীর সামনে। রুপায়নের সামনে থেকে এক ঝটকায় নিজের সামনে এনে দুগালে দুটো কষে থাপ্পড় পারেন উনি। এতে সাজানো বিয়ে বাড়ির সবাই অবাক হয়। কেউই এমনটা প্রত্যাশা করেনি।
এদিকে আরোহীর কোন ভাবান্তর ঘটেনা রুপায়নের খালার আচরনে। বিয়ের প্রস্তাব থেকে শুরু করে বাসর ঘরে ডোকার আগ অব্দি এনি নানা ভাবে কটুকথা শুনিয়েছে আরোহীকে। কখনো মজার ছলে আবার কখনো সামনা সামনি। আরোহীর দু বাহু ঝাঁকিয়ে বললেন আসফিয়া আমন,
— এই মে, মরার পরেও দেখছি আমার আব্বাটার(রুপায়নের)পেছোনে পড়ে আছো তুমি। কোথ থেকে এসেছো শুনি? বড়লোকের ছেলেকে রেখে কবরেও শান্তি পাচ্ছিলে না তুমি তাইনা? বড়লোকের ছেলেকে কিভাবে এত সহজে হাতছাড়া হতে দি, তাই ছুটে এসেছো এখানে? তা দেখেতো মনে হচ্ছে সত্যি সত্যি কবর থেকে উঠে এসেছো। কে বলোতো তুমি? ও্ ওই মৃত বউই নাকি অন্য কেউ?
আসফিয়া আনমের খোচালো কথায় কান্নার বেগ বাড়ে আরোহীর। একটা মেয়ের সম্মন্ধ ঠিক হওয়ার পর থেকে তার সপ্ন বোনার ধাপে পা রাখে সে। এত এত সুখানুভব অনুভব করে। সেগুলোর প্রতিটিই হয়েছে আরোহীর বেলায়ও। এটাকি অন্যায় তার? রুপায়নের আচরন, কথাবার্তায় সে প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যায় আরোহী। প্রথমে সে এটাকে শুধুই মোহ হিসেবে বিবেচনা করে, এরপর বিয়ের কিছুক্ষণ আগ পর্যন্ত রুপায়নকে দেখার তৃষ্ণায় ধুঁকেছে সে। এটাকি ভালোবাসার কিঞ্চিৎ সংজ্ঞা নয়? সেতো তার সবটা দিয়ে রুপায়নকে ভালো বেসেছে। নিজেকে রুপায়নে বিলীন করতে চেয়েছে। এই ভালোবাসাটা কি তার দোষ? রুপায়নকে বিয়ের পরও দূরে থাকার যে কষ্টে ভুগেছে, সেটা? সেটা যে কতটা কষ্ট-যন্রনা দায়ক তা জানে আরোহী। তাইতো ছুটে এসেছে এই বিয়ে থামাতে। নিজের ভালোবাসার মানুষটিকে নিজের করে রাখতে। এটাই যদি আরোহীর দোষ হয়ে থাকে তাহলে সে একশো বার ঠিক করছে।
আরোহীর নিষ্চুপতা আসরে আরও গুনগুন ছড়িয়ে দিচ্ছে। অনেকেই ফসফিস করে একে অপরকে কিসব বলাবলি করছে। আসফিয়া আনম আবারো বলতে লাগলেন,
— এখন চোরের মতো কেঁদে কি প্রমান করতে লাগলে? আজ আমার আব্বার বিয়ে হবেই! যদি মরারই ইচ্ছে ছিলো তাহলে বাসরঘর থেকে পালালে কেন? আর আজ যেই শুনেছো বিয়ে হয়ে যাচ্ছে সেই দৌড়ে চলে এসেছো? চলে যাও এখান থেকে।
নিজের ভেতরটা আরও ক্ষততে রক্তরঙা হতে লাগলো আরোহীর। সর্বশ উজার করে চেচিয়ে বললো,
— আমি এ বিয়ে কিছুতেই হতে দিতে পারবো না। নিজের স্বামীকে কিছুতেই অন্যকারো হতে দেখতে পারবো না আমি। পারবো না!
আরোহীর কথায় আফফিয়া খানম কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ওনাকে থামিয়ে এগিয়ে এলো রুপায়নের বাবা মৃদুল শেখ। উনি শন্ত গলাতেই আরোহীকে জিজ্ঞেস করলেন,
— এতদিন কই ছিলে তুমি? তোমার মৃত্যুর খবর পেতেই আমরা সপরিবারে গিয়েছিলাম। এমনকি নিজো চোখে তা প্রত্যক্ষন করেছি। তাহ..
আরোহীর শশুড়কে থামিয়ে আরোহী শুধু ‘ আমি আদেও.. ‘ বললো তার আগেই তাকে থামিয়ে রুপায়নের মা, আরোহীর শাশুড়ী বললেন,
— সব মেয়েদেরই নিজের বাসর নিয়ে হাজারটা ইচ্ছে আনন্দ থাকে। কাঙ্খিত আশা কি তোমার মাঝে সেদিন জাগেনি? কিভাবে পেরেছিলে নিজের সৌখিন সময়টুকুকে ধুলোয় মিষিয়ে বেয়াদবের মতো বাসরঘর থেকে পালাতে? এটাকি শৈশবের বেভুল খেলা মনে হয়েছিলো তোমার? তবুও মানতাম যদি তোমার পরিবার তোমায় এভাবে লুকিয়ে না রেখে নিজের ভুলগুলো মাফ চেয়ে আমাদের কাছে সেদিনিই পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু তা না করে সেদিন কোথাকার কে, তার কবর দেখিয়ে দিলো?
— আপা ওর সাথে অত কথা বলার কোন দরকার নাই। শোন ডংগি মেয়ে, আমার স্বামীকে চেনোতো কত বড় উকিল? জাস্ট তুড়ি মেরে এই ডিবোর্স করিয়ে দিবে। ছয় মাসও লাগবে না! নাও এখন এখান থেকে বিদেয় হও। আমার আব্বার বিয়ে হবে। যাও যাও যাও।
নিজেকে পাথরের ন্যায় শক্ত করে বললো আরোহী তার শাশুড়ীকে,
— আপনি ভুল ভাবছেন। আমায় কেউ কোথাও লুকিয়ে রাখেনি। বরং…
— চুপ! কোন কথা নয়। মেঘা, এই মেয়েকে ঘার ধাক্কা দিয়ে বের করে দাও।
আসফিয়া আনমের কথায় সয়তানি হাসিমুখে জোর পায়ে হেটে এলো রুপায়নের বোন মেঘা। এসেই আরোহীর হাত শক্ত করে ধরে টানতে লাগলো। এদিকে আরোহীও তার সবটা দিয়ে আটকাতে চেষ্টা করছে। আজ প্রায় তিন দিন পেটে পানি ছাড়া কিছুই যায়নি আরোহীর। এখানে কিভাবে এসেছে তা শুধু আরোহীই জানে। আরোহীর দূর্বলতার সুযোগে আরও চেপে ধরছে মেঘা। মেঘা তার ভাবি হিসেবে কখনই এমন কাউকে চায়নি যে কিনা আগেকার মেয়েদের মতো সালোয়ার কামিজ পড়বে। বরং সে সর্ট ড্রেস পড়া আধুনিক মেয়েকে চাইছিলো তার ভাবী হিসেবে। আর সেগুলো সবটাই আছে রুপের পাশে থাকা তার নতুন ভাবীর মধ্যে।
— দাড়াও মেঘা।
ভিরের মাঝ থেকে একজন মধ্যবয়ষ্ক লোক বলে উঠলেন কথাটা। বিয়ের সাজে সজ্জিত রুপায়নের নতুন বউয়ের হাতখানা ধরে মৃদুল শেখ এর সামনে আসলেন তিনি। কষ্টদায়ক কন্ঠে বললেন,
— আজ এগুলো দেখানোর জন্যই এত তাড়াহুড়ো করছিলেন এ বিয়েতে আপনারা তাইনা? এসব কি মৃদুল বাবু? আমি সবার সামনে স্পষ্ট গলায় বলছি, আমার মেয়ের বিয়ে এখানে কিছুতেই হবেনা। আমি নিজে হতে দিবো না এ বিয়ে!
সোহরা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বললো,
— কিন্তু বাবা..
— কোন কিন্তু নয় সোহ! চল এখান থেকে।মিথ্যে নাটকের পরিহাস খুলে বসেছেন এনারা।
মেয়েকে টানতে টানতে নিয়ে গেলেন উনি। মাথা নিচু করে কপালে হাত ঠেকালো মৃদুল শেখ। সবার আরোহীকে ঘৃনা দৃষ্টি ছুড়ে দিচ্ছে। ভিরের মাঝেও গুঞ্জনের আওয়াজ আসছে।হঠাৎই কেউ বলে উঠলো,
— এখানে থেকে আর কি হবে? চলো সবাই! অনেক পর্বে ধারাবাহিক চলছিলো এতক্ষণ!
লোকটার কথায় সবাই হ্যা মেললো। চলে যেতে লাগলেন সবাই। যাওয়ার চগে আরেকজন মৃদুল বাবুকে বললেন,
— সন্মান, শ্রদ্ধার অধিকাংশই পেতেন এই মহল্লা থেকে। এরকম বিচ্ছিরি দাগ না লাগালেও হতো!
বলে লোকটি চলে গেলেন। ওনার কথায় বুক ভারি হয়ে আসছিলো মৃদুল বাবুর। উনি জোর পায়ে হেটে উপরে চলে গেলেন।মৃদুল শেখ উপরে যাওয়ার সাথে সাথেই পুরো পরিবার বর্গ রাগি চোখে তাকালো আরোহীর দিকে। কটমটে চাউনি নিয়ে এগিয়ে এলেন রুপের চাচী। বললেন,
— শান্তি? খ্যান্ত হয়েছো? ধন্তি মেয়ে তুমি!
বলে চলে গেলেন রুপায়নের চাচী। ওনার যাওয়ার সাথে সাথেই রুপায়নের চাচাও স্হান ত্যাগ করলেন। আসফিয়া আদম রেগে আরোহীর হাতটা ধরে বললেন,
— বাসর রাতে পালিয়েছিলে কেন? আমার আব্বার জিবনটাকে নষ্ট করে নগরের সাথে নষ্টিফষ্টি করার ধান্দায় বেড়িয়েছিলে সেদিন?? মনিরা… মনিরা!
বাড়ির কাজের লোক উপস্থিত হলো সেখানে। আসফিয়া আনম আড় চোখে একবার আরোহীকে দেখলো। এরপর চেয়াল খিচে মনিরাকে বললো,
— যাতো গিয়ে স্টোররুমটার একটা অংশ পরিষ্কার করে দে। ও ওখানের থাকবে। বাপ মে মিলে এতো বড় জব্দ করলো? মেয়েকে মৃত বলে লুকিয়ে রেখে শেষে কিনা এত বড় পায়তারা? স্টোররুমে থাকবে তুমি। যা মনিরা।
মনিরা খানম ওখান থেকে চলে যেতেই আরোহী আরো জোরে কেঁদে দেয়। আরোহীর কান্নায় রুপায়ন বাদে সকলে তাচ্ছিল্য হাসে।
বারবার তাকে ঠকবাজ বলছে তার নিজের শশুর বাড়ির লোকজন। এতে কষ্ট হচ্ছে না আরোহীর! আরোহীর কষ্ট হচ্ছে এখানে, বারবার তার পরিবারকেও অবমাননা করা হচ্ছে। কিছু হলেই কি মা বাবার নামে এসব বলবে হবে তাদের? সবটা না জেনেই! ভেবে পায় না আরোহী।
কারো হাত ধরার স্পর্শে চমকে ওঠে আরোহী। হাত অনুসারে তাকাতেই লাল নাক ওয়ালা রুপায়নকে দেখতে পায় সে। হঠাৎই আরোহীকে টেনে নিয়ে উপরে উঠতে থাকে রুপায়ন। রুপায়নের কাজকর্মে উপস্থিত সকলে অবাক। যে ছেলেটা এতক্ষণ চুপচাপ ছিলো সে হঠাৎ এমন করবে তা ভেবতে পরেননি ওনারা।পেছন থেকে আসফিয়া খানম, রুপায়নের মা ডাকলেও সাড়া মিললো না।
এদিকে আরোহীকে টেনে ছাঁদে এনে দাড় করায় রুপায়ন। আরোহী রুপায়নের মুখে স্পষ্ট রাগ দেখছে!
____
–” আমি তোমায় ছাড়বো না আরোহী! আমার রুপায়নকে বিয়ের মঞ্চ থেকে উঠিয়ে নিয়ে গেছো।তোমাকে এর শাস্তি পেতেই হবে! ” (সোহরা)
চলবে…..
রুপ_আহরন💚পর্ব_১
#লেখক:হৃদয় আহমেদ
গল্পটা চলবে তো??