#ব্রোকেন_হার্ট
লেখাঃ মান্নাত মিম
|৩|
জ্বরের ঘোরে মনে হয় আমার ভালোবাসার কিংবা মোহের তৈরি হয়েছে, কিংবা ক্ষনিকের মোহ-ও তো হতে পারে; নাহলে কেন নতুনত্বের মাঝে ভাঙনের সৃষ্ট ঘটবে? থাক, তাদের সাথে আমার মতো নিম্নব্যক্তির ভালোবাসা মানায় না। তারা ঘুম না আসলে লেইট নাইট পার্টি করে, আর আমরা সাইকেল নিয়ে কী করি? এলাকা চষে বেড়াই। কতো অমিল! সৌন্দর্য নাহয় বাদ তবে বাকি স্ট্যাটাস তো একদমই মিলে না। আমার হঠাৎ হওয়া ভালোবাসা আমাতেই আবদ্ধ করে নিলাম। উচিত হয়নি কোনকিছু না ভেবে আচমকা কারো প্রেমে পড়া। কিন্তু কী করব? প্রেম জিনিসটাই এমন। আচমকা, হঠাৎই করে তৈরি হয়। উপরন্তু এত সুন্দর ব্যক্তিত্বের পুরুষ পেলে নিজেকে সংযত করে রাখাই বড়ো দায়। তাই প্রেম, ভালোবাসাকে সাময়িক মোহ কিংবা এসব আমাদের মতো মেয়েদের জন্য না ভেবে সেদিন রাতটা নির্ঘুম কাটিয়ে দিলাম। নিজের সাথেই চ্যালেঞ্জ হিসেবে নতুন ভোরের আশায় রইলাম।
______
“হাই! আমি ক্রিশ্চান।”
নিজের সিটে বসতে না বসতেই নতুন সূর্যোদয়ের মতোই ক্রিশ্চান নামক ছেলের উদয় ঘটল। মুখ তুলে তাকালাম ক্রিশ্চানের পানে। সে আমার দিকে তাকিয়ে তার হাত বাড়িয়ে রেখেছে হ্যান্ডশেক করার উদ্দেশ্যে। আমি আবার মিশুক টাইপের নই, একা চুপচাপ থাকা পছন্দ আমার। তবুও ক্লাসের প্রথম দিন সবার সাথে পরিচয় হওয়া উচিত মনে করে হাসিমুখে তার সাথে হ্যান্ডশেক করি। এতেই যেন আমাকে সে পেয়ে বসলো।
“তুমি খুবই সুন্দরী, হাসি-ও মিষ্টি !”
“ফ্ল্যার্টিং করছ?”
“আরে নাহ, সত্যি বলছি। সবচেয়ে ভালো লাগে তোমার চোখ দু’টো, সিন্ধু নীল অক্ষি যেন!”
“এখানে সৌন্দর্যের কী হলো?”
“যাও তোমার মধ্যে রোমান্টিকতা নেই।”
“সে-ই তো ফ্ল্যার্টিং করছ। স্বীকার করো।”
বলেই শব্দ করে হেসে ফেললাম। ক্রিশ্চানের সঙ্গ খারাপ লাগল না। ঘন্টা কয়েকের মধ্যেই গাঢ় বন্ধুত্বে রূপ নিলো আমাদের মধ্যকার সম্পর্ক। আমার সম্পর্কেও জিজ্ঞেস করল। তার সম্পর্কেও বলল। বাবা-মা’য়ের একমাত্র আদরের সন্তান সে। তাকে নিয়ে খুব আশা তাঁদের। যাক শুনে খুশি হলাম, কারো বাবা-মায়ের প্রিয় সন্তান সে। দুঃখ-দুর্দ্দশা কম দেখেছে ছেলেটা। এন্ডারসনের মতোই সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্ম তার-ও। ওহ্, হঠাৎই মনে পড়ল এন্ডারসনের কথা। আনমনা হয়ে গেলাম তার ভাবনায়। কতক্ষণ কাটল এভাবেই। সম্বিত ফিরল ক্রিশ্চানের ডাকে।
“এই তুমি আছো না কি?”
“আজব তো! এখানেই তো দেখতে পাচ্ছ না?”
“পাচ্ছি তবে তোমার শরীর। মনটা কোথায়?”
বলার ফাঁকে ক্রিশ্চান এদিক-সেদিক খোঁজার ভান করল৷ আমি হেসে তার পিঠে দিলাম কয়েক ঘা বসিয়ে। সে পিঠে হাত দিয়ে ব্যথাতুর শব্দ করে বলল,
“দিলে তো মেরে। ব্যথা হচ্ছে বজ্জাত মেয়ে।”
“তাই না কি? তার গার্লফ্রেন্ডের হাতে যখন খাও তখন হয় না বুঝি?”
“আরে থাকলে না আদরযত্ন পাব।”
“বলো কি সত্যি নেই?”
অবিশ্বাস্য, আঁতকে ওঠে মুখে হাত দিয়ে বললাম আমি।
“আসলেই নেই। লেখাপড়ায় এত চাপ সহ্য করা লাগে, গার্লফ্রেন্ড আর বানানো হয়ে ওঠে না।”
ক্রিশ্চান কাঁধ ঝাঁকিয়ে দৃঢ়তার সহিত বলল। আমি অবশ্য বিশ্বাস করলাম। ছোটো-ছোটো চোখের চশমা পরা, ব্রাউন কালার কোকড়া চুলের ক্রিশ্চানের কথা।
“বানাবে কেন? তোমাকে দেখেই তো এসে পড়বে। ছেলে হিসেবে তো মন্দ নও।”
আমার ওপর খানিকটা ঝুঁকে ক্রিশ্চান বলল,
“তাহলে তুমি-ই পটে যাও।”
“হয়েছে আর পটানো। এখন বলো কী নিবে?”
“কফি অর্ডার দেও আগে। তারপর মেনু বলছি। আর আজকের ট্রিট আমার পক্ষ থেকে আমার নতুন বন্ধুটির জন্য।”
“এই না, না প্লিজ।”
“উহুম, কোনো কথা নয়।”
প্রথম ক্লাস করার পরে ক্যান্টিনে নিয়ে আসে ক্রিশ্চান। তারপরেই কথাবার্তা শুরু হয় আমাদের জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে। ছেলেটা মিশুক ধরনের। সহজেই মন ভালো করার কায়দা জানে। প্রথম দিন-ই একটা ভালো ছেলে বন্ধু জুটল আমার মতো ইন্ট্রোভার্ট মেয়ের। এমন সময় ক্যান্টিনের গেট দিয়ে এন্ডারসনের আগমন ঘটে। চোখাচোখি হলো তার সাথে আমার। অবশ্য ন্যানো সেকেন্ডেরই। সেই ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যেই পাশে থাকা গার্লফ্রেন্ড-ও আমার চোখ এড়ালো না। তাই সর্বক্ষণ চোখ জুড়ানো তাকিয়ে থেকে তাদের রঙ্গলীলা দেখার মতো ধৈর্য আমার নেই। গাঁট হয়ে বসে রইলাম আমাদের টেবিলে। ক্রিশ্চানের সাথে কথা আর আগাতে পারলাম না। কফির মধ্যে চুমুকের সাথে অন্য খেয়ালে হারিয়ে যেতে লাগলাম৷ সেই খেয়ালে এন্ডারসনেরই আনাগোনা। সেই আনাগোনায় যারপরনাই আমাকে বিরক্ত করছে। কফির চুমুকেই মুখ কুঁচকে এলো আমার। এন্ডারসনকে মনমগজ থেকে সরাতে পারছি না। কী বেহাল দশা হাহ্!
“কেমন আছো ইমি?”
পাশ ফিরে তাকিয়ে এন্ডারসনকে দেখতে পাই। অবাকের পারদ বোধহয় ছুঁয়ে যায় আমার চক্ষুকোটর। আমার সাথে কথা বলতে এসেছে এন্ডারসন! খুশি হব না কি বিস্ময় কাটাব? দ্বিধার মাঝেই ক্রিশ্চানের কণ্ঠ শুনতে পাই।
“তোমরা একে-অপরকে চিনো?”
“অবশ্যই।”
এন্ডারসন জবাব দিলো। তবে চেনাজানার বিষয়টা বিশ্লেষণ করল না। আমি-ই ক্রিশ্চানকে জানালাম বিষয়টা।
“আমার ঠোঁট কেটে যাওয়া, কপাল ফোলা যাওয়া নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলে না?”
“হুম।”
মাথা নেড়ে ক্রিশ্চান সায় জানাল। তখন ঘটনা খুলে বললাম, তবে এন্ডারসনকে দেখতে গিয়ে যে এমতাবস্থা হয়েছে, সেটা প্রকাশ্যে আনলাম না। কিছু কিছু জিনিস একান্তে, সংগোপনে থাকাই ভালো। সবার অলক্ষ্যে।
এন্ডারসন ইউনিভার্সিটির চেনামুখ। সেক্ষেত্রে ক্রিশ্চান-ও তাকে চেনে এবং জানে। দু’জনের কথাবার্তা চলল অল্প সময় ধরে। তন্মধ্যেই সেখানে নিজেকে কেমন অচেনা ঠেকল, অস্বস্তিবোধ করতে লাগলাম। সেটা কি এন্ডারসনের আগমনে? অবশ্যই নাহলে তো ভালোই সময় কাটছিল ক্রিশ্চানের সাথে। ক্যাম্পাস বিষয়ক আলোচনায় মন বসানোর মতো মেয়ে নই আমি। এদিকে এন্ডারসন কেন আমার ভালো জিজ্ঞেস করতে এলো, সেটাই তাকে জিজ্ঞাসা করতে বেমালুম ভুলে গেলাম। তাই তাদের আলোচনা করতে দিয়ে ওঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
“তোমরা কথা বলো। আমি আসছি।”
বলে দ্রুত পায়ে তাদের কাছ থেকে চলে আসতে লাগলাম। পিছু ডাক শোনে ছিলাম বোধহয় দু’জনের একজনার। তবে ক্যান্টিনের জনসমাগম হট্টগোল বেশি বিধায় ডাকটা কার বোধগম্য হলো না আমার।
______
এন্ডারসন নামটা আমার সকল অসুখের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবকিছুতে আমার বিষণ্ণভাব, উদাসীনতার সমীরণ বইছে। অথচ আমার লক্ষ্য কী সেটাই ভুলে বসেছি প্রায়। কী করব? যখনই এন্ডারসনকে দেখি, তখনই মনের মধ্যে অন্যরকম অনুভূতিরা এসে ডানা ঝাপটাতে শুরু করে। চারপাশে কেমন দমবন্ধ, দমবন্ধ অনুভূতি হয়। মনযোগ ঘুরেফিরে তার কাছেই যায়, তার এটেনশন পেতে চায়। এতসব দ্বিধাদ্বন্দে আমার লেখাপড়া দেখা যায় লাটে উঠবে। উপরন্তু এখানে চাকরি জোগাড় হয়নি এখন পর্যন্ত। দু’দিন হলো ইউনিভার্সিটি যাওয়া হচ্ছে না। চাকরির খোঁজ চলছে। না যাওয়ারও একটা কারণ রয়েছে। সেই কারণ হলো এন্ডারসনের মুখোমুখি না হওয়া। তার মুখোমুখি হলে আমি নিজের সাথে করা সকল প্রতিজ্ঞাবাক্য ভুলে যাই। নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি নিজস্ব সত্তা, অস্তিত্ব। তার মাঝেই বুঁদ হয়ে থাকি।
“কী করছ?”
“এই তো গোছগাছ করছিলাম।”
“চাকরির কী খবর?”
মাম্মার কথায় উদাসীনতারা পেয়ে বসল যেন। চাকরি হাহ্! দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ধরে যাওয়া গলায় কোনোমতে বললাম,
“এখনো পাইনি।”
“ইমি, দ্রুত চেষ্টা করো। জানোই তো বাড়িটা ঋণের।”
মাথা নেড়ে সায় জানালাম।
“খেতে এসো।”
খাবার গলা দিয়ে নামবে না। চিন্তায় মস্তিষ্ক অকেজো হয়ে পড়ছে। বাড়ির ঋণের কথা এন্ডারসনকে ক্ষনিকের মধ্যে ভুলিয়ে দিলো।
চলবে…
আপনাদের গঠনমূলক মন্তব্যের আশায় অপেক্ষাকৃত।