# যে শহরে এখনো ফুল ফোটে
# পর্ব ১৩
“সাহেদা, কাঁদছ কেন?”
“রুমির এত বড় বেয়াদবিটা চোখের সামনে দেখেও এই প্রশ্ন করলে? অবশ্য করবে না কেন, বেয়াদবি করেছে তো আমার ভাইয়ের সাথে, তোমার ভাইয়ের সাথে তো না।”
“আমার তোমার তো কথা না সাহেদা। আর আমার ভাই রুমির কী হয় বলো? চাচা হয় তাই না? তোমার ভাই রুমির মামা হয়। তাহলে দু’জনই গুরুজন, আপনজন। অর্থাৎ চাচা হোক বা মামা কারও সাথেই রুমির বেয়াদবি করা উচিত নয়। তাই ভাগাভাগি করার প্রশ্নই আসে না।”
“এত বুঝলে মেয়েকে শাসন করলে না যে?”
“কারণ মেয়ে শুধু মামা মামীর সাথে তর্ক করেছে তা তো নয়। এর সাথে আরও অনেক ঘটনা আছে।”
“তা তো আছেই। আমাদের নামেও দুনিয়ার অভিযোগ করেছে। অথচ কী না করলাম এই মেয়ের জন্য। ভালো জায়গায় পড়ালেখা করালাম, ধুমধাম করে বিয়ে দিলাম, সেই বিয়ে না টেকার দায় এখন আমাদের দেয়, ওর মামা মামীকে দেয়। তেজ দেখিয়ে ঘর ছেড়েছে রুমি নিজে। আসার পর রুমি আর তিতলির দেখাশোনাও তো আমরা করছি। তারপরও এত অভিযোগ কিসের? ”
“আমিও শুরুতে তোমার মতোই ক্ষিপ্ত ছিলাম। এটাই ভাবছিলাম যে কোথায় কম রাখলাম।”
“আমরা কোন কম রাখি নাই। মেয়েই বেয়াদব। এই তেজের জন্য সংসার হয় নাই। ভাবি তো মিথ্যা বলে নাই। এই যে বললো বাড়ি ছেড়ে যাবে। দেখি এখন বাপের বাড়ি ছেড়ে কই যায়। আমি আটকাবো না। দেখুক কে জায়গা দেয় ওকে মেয়ে নিয়ে। দুনিয়া এত সহজ ভাবে, মানুষের কথায় বাপ মা কে শত্রু মনে হয় এখন। সেই মানুষেরা কেউ ওকে জায়গা দেয় কিনা আজ ও দেখবে।”
“কেউ পাশো থাকবে না সাহেদা। কেউ থাকেও না। কিন্তু সেটা বোঝার জন্য মেয়েকে যেতে দিলে আমরা কেমন বাবা মা হলাম? ও যে জায়গায় জায়গায় ফোন দিচ্ছে বারান্দায় বসে আমি ঠিক শুনতে পাচ্ছিলাম। যাওয়ার জায়গা পেলে এতক্ষণে বের হয়ে যেত, আমিও আটকাতাম না হয়তো রাগ থেকে। তবে ভালো হয়েছে ও জায়গা পায়নি। আমারও রাগটা শান্ত হয়ে মাথা পরিষ্কার হয়েছে। এখন পরিষ্কার করে ভাবতে পারছি। শুনো আমরা মেয়েকে পড়ালেখা করালাম, বিয়ে দিলাম সব ঠিক আছে। তারপরও মেয়ের মনে এত কষ্ট কেন আমাদের নিয়ে জানো?”
সাহেদা বেগম চোখ মুছে উঠে বসেন। বহুদিন পর সানোয়ার সাহেব এত কথা বলছেন, একটু অবাকও হয়েছেন সাহেদা বেগম। তাই শোনার ইচ্ছে আছে স্বামী কী বলে, “কেন কষ্ট সেটা আমি জানি না তা কিন্তু না, আমিও জানি রুমির আব্বা। ঐ যে রুমি বললো, আমরা ওর সাথে বিরক্ত দেখাই, আমাদের দেখাদেখি রশ্মি আর আদিলও ওকে সম্মান দেয় না। ওর আত্মীয় স্বজনরা আমাদের জন্য কথা শোনানোর সুযোগ পায়। সব ঠিক আছে। কিন্তু রুমি কী আমাদের দিক টা ভাবে? যদিও রুমি পরিবারের বড় মেয়ে, কিন্তু পরিবারের আগে নিজের জিদটাকেই রাখে।”
“সাহেদা, রুমির জেদটা তো অহেতুক না। ও কী করলে আত্মীয় স্বজনের কাছে আমরা বড় থাকতাম? মাটি কামড়ে সংসার করলে? তুমি সারাজীবন আমাকে সন্দেহ করে সংসার করে সুখে আছ? না আমি সুখে আছি? আর হিমেলের ঘটনা হাতেনাতে প্রমাণ হওয়া, সেখানে আজকের দিনের একটা মেয়ে কিভাবে মেনে নেয়?”
“আমাদের দিন চলে গিয়েছে। সন্দেহ ছিল না সত্য ছিল, আল্লাহ আর তুমি জানো। তবে আমি কিন্তু তিন বাচ্চা বুকে নিয়ে সংসার করে গিয়েছি। নিজে সুখ পেয়েছি কিনা জানি না। বাচ্চাদের তো বঞ্চিত করিনাই।”
“হিমেল তো কয়টা টাকা পাঠিয়ে খালাস।মেয়ের জন্য কোন ভালোবাসা তো দেখি না। দেখলে বুঝতাম রুমি মেয়েকে বাবার আদর থেকে বঞ্চিত করছে। শুনো আমরা রুমির সাথে এমন ভাব করতেছি গত কয়েক মাস ধরে যেন ওকে আর তিতলিকে থাকতে দিয়ে দয়া করছি। এটা তো মিথ্যা বলে নাই রুমি। এই যে রোজ রোজ ও বাসায় আসলে তুমি জিদ দেখাও, আমি বিরক্ত মুখ করে থাকি, ও বাসায় ক্লান্ত হয়ে ফিরলে, আমরা তিতলির নামে বিচার দেই। কিন্তু এগুলো হতো যদি রুমি আর দশটা মেয়ের মতো বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসতো? মোটোও না। তখন আমি ওর পছন্দের বাজার আনতাম, তুমি নাতনির জন্য রান্না করতে, আদিল আর রশ্মি ভাগ্নিকে নিয়ে আহ্লাদ করতো। অথচ আমরা সবাই এখন কেমন ব্যবহার করি। আজ রুমি চিল্লাতে চিল্লাতে এগুলো বলেছে বলে বেয়াদব মনে হচ্ছে। কিন্তু কথা তো ভুল না।”
সাহেদা বেগম চুপ করে থাকেন। মনের ভেতর কোথাও না কোথাও তিনিও জানেন, রুমির দীর্ঘদিনের চাপা অভিমান আর কষ্ট আজ অভিযোগ হয়ে বের হয়েছে। তবে তিনি সহসাই জবাব খুঁজে পান, “আমি কী করবো? মাপা টাকা, আদিলটাও চাকরি পেল না, রশ্মির বিয়ে আটকে আছে, সংসারের কাজ। সবকিছু মিলে হাসিমুখে থাকতে তো পারি না। আর তুমি একটা মানুষ বাড়িতে আছ কী নাই তাই বুঝি না। নাতনিটাকে তুমি দেখ?”
সাহেদা বেগম ভেবেছিলেন সানোয়ার সাহেব ঝগড়া করবেন, কিন্তু তা না করে সানোয়ার সাহেব সায় দেন, “সাহেদা তোমার উপর সংসারের অনেক বোঝা, আমি এখন বুঝতে পারছি। আর এমন হবে না। দেখবা সব ঠিক হবে। রুমি তো ওর আর তিতলির খরচ দিচ্ছেই, আমাদের তো চাপ দেয় না। আর এটা রুমির নিজেরও বাসা, বিয়ে হয়েছিল বলে ওকে যেন আমরা পর করে দিলাম। কিন্তু এই শেষ, এমনটা আর করা যাবে না। রশ্মি আর আদিলের সাথে কথা বলতে হবে, ওরা যেন তিতলি আর রুমির সাথে কোন খারাপ ব্যবহার না করে। রুমিকে আমি বলবো, ও মামা মামীর কাছে মাফ চাইবে।”
সানোয়ার সাহেব নিজ থেকে পরিবারের ভালোমন্দের দায়দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিচ্ছেন দেখে সাহেদা বেগমের মনটা ভালো হয়ে যায়।
“সাহেদা আরেকটা কথা, রশ্মিকে যারা দেখতে আসবে তারা যদি রুমির ব্যাপারটা মেনে নেয়, তাহলেই যেন সামনে আগায়। এই কথাটা তুমি বড় ভাইকে বলে দিও। এখন অনেক রাত হয়েছে, সকালে আমি রুমির সাথে কথা বলবো।”
*****
রুমি সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি। রাত একটার দিকে মরিয়মের ম্যাসেজটা এসে যেন ওর আত্মবিশ্বাসটা একেবারেই শেষ করে দেয়। এলোমেলো নানা ভাবনা আসে মনে, একবার মনে হয় আত্মহত্যা করবে। কিন্তু পরমুহূর্তে নিজেকে ধিক্কার দেয় এমন একটা কথা মনে আসার জন্য। তিতলির এত কিছু বোঝার বয়স হয়নি, তবে সব ঠিক নেই এইটা বুঝেছে। তাই অন্য দিনের মতো খাওয়া নিয়ে বিরক্ত না করে চুপচাপ খেয়ে নিয়েছে। রুমি খায় নি। সানোয়ার সাহেব বারোটার দিকে দরজা নক করেছিলেন, কিন্তু রুমি জবাব না দেওয়ায় আর ডাকাডাকি করেননি। সকালে ঠান্ডা মাথায় কথা বলবেন।
(আমার লেখা ভালো লাগলে অর্ডার করতে পারেন আমার প্রথম একক উপন্যাস “হৃদয়ে তার পায়ের ছাপ”।)