আমার বোনু পর্ব-২৬

0
2426

#আমার_বোনু
#Part_26
#Writer_NOVA

— কে-আ-আপ-আপনি!

লোকটা বোধহয় ঊষার এই অবস্থা দেখে হাসলো। কেন জানি ঊষার মনে হলো। যদিও তার মুখটা রুমাল দিয়ে আটকানো, চোখে সানগ্লাসটা পরা। ঊষা আশেপাশে চোখ বুলালো। দু-চারজন কলেজ পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী ছাড়া কেউ নেই। বৃষ্টির প্রকোপটাও কমে গেছে। ঊষার কেমন জানি ভীষণ ভয় করছে। লোকটা যদি কোন কুমতলবে আসে! তাহলে কি সে তার প্রতিরোধ করতে পারবে। ভয়ে ভয়ে কিছুটা দূরে সরে দাঁড়ালো। লোকটা ওর এক হাত দূরে পাশ কাটিয়ে দাড়িয়েছে। মিনিট খানিক পর হঠাৎ হাতে হেচকা টান পরতেই ঊষা চেচিয়ে উঠলো।

— ছাড়ুন আমায়। আপনার সাহস কি করে হয় আমাকে টার্চ করার। আমি কিন্তু চিৎকার করবো।

হাতের বন্ধনী আলগা হয়ে গেলো। ঊষা চোখ তুলে তাকাতেই দেখতে পেলো জিবরান কপালে তিন ভাজ ফেলে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞেস করলো,

— কি হয়েছে ঊষারাণী?

— আমি ভেবেছি ঐ যে ঐ লোকটা!

কথার মাঝে এদিক সেদিক তাকালো ঊষা। তারপর বিস্ফোরিত চোখে কিছুটা তড়িঘড়ি করে আশেপাশে দেখে বললো,

— এখানে একটা রেনকোট পরিহিত লোক ছিলো। তাকে আমার ভীষণ ভয় করছিলো। কোথায় গেলো সে? আপনি তাকে দেখেননি? সে আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো।

জিবরান ঊষাকে শান্ত করতে করতে বললো,
— এখানে কেউ ছিলো না ঊষারাণী।

— আপনি বিশ্বাস করুন এখানে একজন ছিলো। আমি মিথ্যে বলছি না।

— তাহলে এখন কোথায় গেলো। রাস্তার ডানপাশেও কেউ নেই তেমনি বামপাশেও। সামনে ডোবা, পেছনে সরু খাল৷ সে কোথায় গেলো? সেকি এগুলোতে লাফ দিয়েছে? নয়তো এতটুকু সময়ের মধ্যে সে যাবে কোথায়?

— কিন্তু এখানে একজন ছিলো।

জিবরান এগিয়ে এসে ঊষাকে এক হাতে পরম মমতায় জড়িয়ে ধরলো। ঊষা মাথা উঠাতে চাইলে জিবরান আরো শক্ত করে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরলো। ঊষা এবার শান্ত হয়ে গেলো। তার হাত, পা অনরবত কাঁপছে। মুহুর্তের মধ্যে মানুষটা গায়েব হলো কোথায়? কিছু সময় এভাবে থাকার পর ঊষার নার্ভাসনেসটা কমলো।

— ঊষা চলো।

— হুম চলেন।

জিবরান ঊষার হাত ধরে গাড়ির দিকে নিয়ে গেলো। ঊষার হাতটা সে শক্ত করে ধরে আছে। ঊষা এক পলক তার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেললো। মাস খানিক আগের বোকামির জন্য এখন নিজেরি আফসোস হয়। ইশ, হুজুগের বশে কি ভুলটা করতে বসেছিলো। জিবরানকে হারালে সে জীবনের বড় একটা পূর্ণতাকে হারিয়ে ফেলতো।

জিবরান, ঊষার যাওয়ার পরই সেই রেনকোট পরিহিত লোকটা পেছনের দিক থেকে বের হলো। একটুর জন্য জিবরানের নজরে পরেনি। ভাগ্যিস সে জিবরানের গাড়ি দেখে ফেলেছিলো। বাঁকা হেসে বিরবির করে বললো,

— সবে তো মাত্র শুরু ঊষা! আরো কত কি বাকি আছে।

ঊষা হন্তদন্ত হয়ে বাসায় প্রবেশ করেই ডাইনিং টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। চেয়ারে বসে দুই হাতে মাথা চেপে ধরে মেঝের দিকে দৃষ্টি দিলো। জিবরানের কাছে বিষয়টা ঘোলাটে লাগছে। ঊষা মিথ্যে বলার মেয়ে নয়।গাড়িতে ঊষার মুখ থেকে সবটা শুনেছে। কে ছিলো লোকটা? পরিচিত কেউ কি? না এবার একটা ব্যবস্থা নিতেই হয়।

জিনিয়া বেডশীটটা গুছাতে গুছাতে স্বামী, ছেলের দিকে তাকালো। তারা দুজন খেলতে ব্যস্ত। বাবা,ছেলে হুড়োহুড়ি করে পুরো খাট ওলটপালট করে ফেলছে। সে একবার অর্ণবকে চোখ রাঙিয়ে বললো,

— বাচ্চার সাথে সাথে তুমিও বাচ্চা হয়ে যাচ্ছো। আমার কাজ না বাড়ালে তো তোমাদের ভালো লাগে না।

অর্ণব এক চিলতে হাসি দিয়ে অনলের সাথে খেলতে লাগলো। অনল খিলখিল করে হাসছে। জিনিয়া বেশি কিছু বললো না। অর্ণব এমনিতেও বেশি একটা সময় পায় না। আজ পেয়েছে তাই ছেলের সাথে কাটাক। খেলার মাঝে অর্ণব জিনিয়ার পাশে এসে গালে টুপ করে চুমু খেয়ে সরে গেলো। আকস্মিক এমন হওয়ায় সে চোখ বড় করে ফেললো। অর্ণব চোখ মেরে সরে গেলো। জিনিয়া কপট রাগ দেখিয়ে বললো,

— ঘুষ দেওয়া হচ্ছে?

অর্ণব এক আঙুল দিয়ে নিজের গালে কয়েক টোকা দিয়ে বললো,

— হুম তেমনটাই ধরে নাও।

— লাগবে না তোমার ঘুষ।

অনল এগিয়ে এসে বললো,
— কে লাগবে না আম্মু?

অর্ণব ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বললো,
— তোমার বুঝতে হবে না সোনা। বড়দের কথার মধ্যে কথা বলতে হয় না। এটা একটা বেড হেবিট। ভালো ছেলেরা কখনও বাজে অভ্যাস গড়ে না। তুমি তো ভালো ছেলে তাই না। তুমি কি বাজে অভ্যাস গড়বে?

অনল মাথা নাড়িয়ে না বোধক উত্তর বুঝিয়ে বললো,
— একটু না। আমি তো ভালো ছেলে।

জিনিয়া এগিয়ে এসে অনলের গালে হাত রেখে বললো,
— এইতো আমার লক্ষ্মী ছেলে।

কথা শেষ করেই জিনিয়া “আউচ” বলে চেচিয়ে উঠলো। অর্ণব তার কোমড়ে জোরে একটা চিমটি কেটেছে। জিনিয়া চোখ পাকিয়ে তাকাতেই অর্ণব ঠোঁট চোখা করে চুমু দেখালো। জিনিয়া ফিক করে হেসে উঠলো। বহু দিন পর তার স্বামীর শয়তানি বুদ্ধিরা এসে হানা দিয়েছে। আজ জিনিয়ার খবর আছে। সারাক্ষণ এসব সহ্য করতে হবে।

অথৈ নিজের উঁচু পেটটা নিয়ে আদিলের সামনে দাঁড়ালো। ডেলিভারির সময় যদিও এগিয়ে আসেনি।তবুও তার এখন চলাফেরা করতে বহু কষ্ট হয়। নিজের ব্যালেন্স রাখতে দুই কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। আদিল খাটে বসে ল্যাপটপে কেস বিষয়ক একটা আর্টিকেলে চোখ বুলাচ্ছিলো। অথৈ-কে এভাবে পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে জিজ্ঞেস করলো,

— কিছু বলবে অথৈ?

অথৈ মাথা নাড়ালো। কিন্তু মুখে কিছু বললো না। আদিল কিছুটা সরে খাটে বসার জায়গা করে দিয়ে বললো,

— পাশে বসো।

অথৈ বাধ্য মেয়ের মতো পাশে বসে পরলো। সে দ্বিধাদ্বন্দ্ব পরে গেছে। আদিলকে একটা কথা বলার ছিলো। সে বলবে কি বলবে না তা নিয়ে কনফিউশানে আছে। আদিল যদি রিয়েক্ট করে। সেই ভেবে বলতে ভয় পাচ্ছে। আদিল অথৈ এর মনের ভাব কিছুটা আন্দাজ করতে পারলো। ল্যাপটপ বন্ধ করে অথৈ এর এক হাত টেনে নিয়ে নিজের হাতে আবদ্ধ করলো। আশ্বাসের সুরে বললো,

— যা বলবে বলে ফেলো। আমি কিছু বলবো না।

অথৈর মুখটা এক নিমিষে বদলে গেলো। মনে হলো এক দমকা হাওয়ায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে দিয়েছে। নড়েচড়ে বসে খুশিমনে আদিলকে বললো,

— সত্যি তুমি কিছু বলবে না?

আদিল অথৈ এর আঙুলগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে উত্তর দিলো।

— না কিছু বলবো না। তুমি বলতে পারো।

অথৈ জড়তা কাটিয়ে আমতাআমতা করে বললো,
— বলছিলাম কি!

— কোন ভনিতা নয়। সরাসরি বলো।

— আচ্ছা বলছি। আমার ডেলিভারির তো আরো অনেক দিন বাকি আছে। তাই কিছু দিন বাবার বাসায় বেড়িয়ে আসি। কখন কি হয় তাতো বলতে পারি না। আল্লাহ না করুক বাচ্চা জন্ম দেওয়ার পর যদি মারা যাই। এর জন্য কিছু দিন আমি আমাদের বাসায় থেকে আসতে চাই।

এসব কথা বলে অথৈ ভয় পাওয়া আরম্ভ করলো। আদিল না রেগে যায়। মৃত্যুর কথা বলেছে সে। এখন নিশ্চয়ই বকা খাবে। কিন্তু কি করবে সে? মা-বাবা, ছোট ভাই-বোনদের দেখার জন্য তার মনটা বড্ড আনচান করছে।আদিল কিছু সময় চুপ থেকে বললো,

— থাপ্পড় খেতে ইচ্ছে করছে?

অথৈ ভয়ে ভয়ে বললো,
— কেনো?

— কানের নিচে কষিয়ে দুটো থা*প্পড় মারবো। চারদিন অব্দি কানে কিছু শুনবে না। মরে যাবো মানে কি? কোথায় যাবে তুমি আমায় ছেড়ে? আল্লাহ কখনও যেনো এমনটা না করে।

অথৈ চুপ হয়ে গেলো। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে মিনমিন করে বললো,
— আজকাল বড্ড বাজে স্বপ্ন দেখি। আমি বোধহয় বেশি দিন বাচবো না। যদি আমি মারা যাই তাহলে তুমি আমাদের সন্তানকে দেখে রেখো। ওর জন্য ভালো দেখে একটা মা এনে দিও।

আদিল ছেৎ করে রেগে গেলো। চোয়াল শক্ত করে কঠিন গলায় বললো,
— চুপ একদম চুপ। মারবো এক চড়। কখনো এসব কথা বলবে না। কখনো না।

কথাগুলো বলতে বলতে অথৈকে নিজের বুকে জড়িয়ে নিলো। অথৈ ডুকরে কেঁদে উঠলো। এসব শুনলে অাদিলের ভীষণ ভয় হয়। অদিতিকে ভুলে অনেক কষ্টে সে অথৈকে নিয়ে নিজের সবকিছু সাজিয়েছে। এখন সে অথৈ কে হারাতে চায় না। বিচ্ছেদের জ্বালা যে কতটা ভয়নাক তা সে জানে। দ্বিতীয়বার তা সে ভোগান্তি পোহাতে ইচ্ছুক নয়।

~~~ যে মানুষগুলো আপনার খারাপ সময়ে পাশে থাকবে তাদের কখনও ভুলে যেয়েন না।💛

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here