#শুকতারা (পর্ব-৪৫)
#হালিমা রহমান
সূচির শেষ কথাটুকু এক শ্বাসে কিছুতেই শেষ করতে পারলো না ইশতিয়াক।থেমে থেমে, রয়ে-সয়ে,বুঝে-সুঝে,দম নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পরে সে যখন পুরো চিঠিটা শেষ করলো,তখন চার চারটে প্রাণীর অবস্থা বর্ণনাতীত।একটি নতুন ভোরের কোমল স্নিগ্ধতা চুষে নিঃশেষ করে দিলো হতভাগীর এই একটি চিঠি। ভিতর থেকে উথলে আসা একটি প্রবল স্রোত ঠেকাতে মুখে আঁচল গুজলো হুমায়রা।নিশ্চুপ প্রকৃতিতে প্রতিধ্বনিত হলো বাধ ভাঙা কান্না ঠেকানোর ক্ষীণ শব্দ। ফয়সাল স্তম্ভিত,বজ্রাহত।কাল রাত থেকে সূচি ঘরে নেই।সে ধরেই নিয়েছিলো রাগের মাথায় সূচি ভূমির বাড়িতে গেছে।সকাল হলেই বোন-দুলাভাই,পুলিশ নিয়ে হানা দেবে তার বাড়িতে।কিন্তু ফয়সালকে পাবে না।ভোরেই সে গায়েব হয়ে যাবে উদয়পুর থেকে।এই তো হওয়ার কথা ছিল।এ তো একদম ধরা কথা।কিন্তু কী হলো? সবাইকে ফাঁকি দিয়ে সে চলে গেল! প্রাণ দিতে গেল নদীতে! মনে পড়লো কাল নয়টায় সে লঞ্চের শব্দ শুনেছিল।তবে কি ঐ মেয়েটা মরতে গিয়েছিলো বলেই একটা বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছিলো ঘাটে?তাই আধ-ঘন্টা পরে লঞ্চ ছেড়েছে? কল্পনায় একটা জোরালো ছবি ভেসে উঠলো।সূচি ঝাঁপিয়ে পড়ছে নদীর বুকে,ঘাটের সবাই হৈ হৈ করছে।কেউ আগ বাড়িয়ে অন্ধকারে তাকে বাঁচাতে যাচ্ছে না।এক সময়ে মেয়েটা কাতল মাছের মতো ডুবে গেল অতলে।সে নেই! কাল ভোরেও যে ছিল,কাল সন্ধ্যায় যে ছিল,আজ সে নেই! এই থাকা না থাকা স্বস্তির নাকি অস্বস্তির সহসা তা ভাবতে পারলো না সে।
মিনিট দুয়েকের মাঝে নিজেকে ধাতস্ত করে,হাতের চিঠিটা ফেলে উড়ে গেল ইশতিয়াক।ফয়সালের সামনে দাঁড়িয়ে তার ঘাড়টাকে শক্ত মুঠিতে পুরে ধপাধপ কয়েকটা ঘুষি বসিয়ে দিলো গালে।বেগতিকে একটি ঘুষি পড়লো নাকের উপরে।ঝরঝর করে ঝরলো রক্ত।কাল সন্ধ্যা থেকে এই নরম জায়গাটি ছিল আহত।আজ আবার আঘাত পড়তেই খুব দুর্বল হয়ে পড়লো ফয়সাল।মনের অবস্থা খারাপ।সূচির পরিণতি অপ্রত্যাশিত,মেনে নেওয়া যায় না। সে বিচ্ছেদ চেয়েছে,মুক্তি চেয়েছে কিন্তু চার মাসের অর্ধাঙ্গিনীর মৃত্যু ঘুণাক্ষরেও চায়নি। প্রতিদ্বন্দ্বীকে থামানোর শক্তি রইলো না আর।ইশতিয়াকের শক্ত হাঁটুর আঘাত নিজের হাঁটুতে অনুভব করতেই হুড়মুড় করে বসে পড়লো সে।সূচির পছন্দের কোঁকড়া চুলগুলো তখন ইশতিয়াকের শক্ত হাতের মুঠোয়।ঝাঁকড়া চুলগুলোতে শক্তি খাটিয়ে সজোরে টান মেরে গর্জে উঠলো ইশতিয়াক।
” জানোয়ার,সূচি ঘরে ঘুমায়,তাই না? তোর সাহস হলো কী করে? কী করে মারলি তুই ঐ মেয়েটাকে?তুই খুন করেছিস সূচিকে। হাহ খোদা! কাল কেন আমি ওকে জোর করে রাখলাম না।কেন বড় ভাইয়ের মতো নিজের কাছে রাখলাম না! ঐটুকু একটা মেয়ে, না জানি তুই কী করেছিস ওর সাথে! তোকে, তোকে আমি চৌদ্দ শিকের ভাত খাইয়ে ছাড়ব।হারামজাদা তোর হাতের আঙুলগুলোকে কেটে কুকুরকে খাওয়াব।”
আরেকবার আঘাত পড়লো ফয়সালের গালে,ঘাড়ে,নাকে।রক্তে চুইয়ে পড়ছে তার নাক থেকে, ভাসিয়ে দিচ্ছে ঠোঁট ও থুতনি।চুল টেনে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো ভূমির কাতর গলা, ” মেরো না ইশতি,মেরো না ওকে।”
চোখের কোলে পানি, রাগ-ক্ষোভে টইটম্বুর দুটো টকটকে লাল চোখ নিয়ে চরম বিস্ময়ে চেয়ে রইলো ইশতিয়াক।উত্তেজনায় অসুস্থ বউয়ের কথা সে ভুলেই বসেছিলো।সূচির মৃত্যু ভূমির বুকে ঠিক কতখানি বাজবে তা অজানা নয়।কিন্তু আশ্চর্য! ভূমির চোখে পানি নেই,মুখে তাপ -উত্তাপ নেই।যা আছে তা স্রেফ বিস্ময়,হতভম্ব ও অবিশ্বাসের সংমিশ্রণ।
” মেরো না ওকে। ফয়সাল সত্যি বলেছে।সূচি নিশ্চয়ই ঘরেই ঘুমিয়ে আছে।ও ছোট থেকেই খুব দুষ্টু।নিশ্চিত দুষ্টুমি করে চিঠিটা লিখেছে।আমাকে ও টেনশনে রাখতে পারলে বাঁচে। মরার মতো সাহস নেই ওর,কিছুতেই নেই।ও এইটুকু,এই যে আমার দুই হাতের এইটুকু। ও কীভাবে অন্ধকারে পূবের বিল পাড়ি দেবে? ও মরতেই পারে না।মরার মতো এখনো ওতো বড় হয়নি। ও অনেক ছোট, ও কিছুতেই মরতে পারে না।”
ভাবগ্রস্তের মতো নিজেকে নিজে শোনালো কয়েকবার।নিজের মনেই আওড়ে নিলো, ” সূচি ছোট,ও মরতে পারে না।ওর ওতো সাহস নেই।ও আমাকে ছেড়ে যেতে পারে না।”
ভূমির অবস্থা খারাপ।মেয়েটা হয়তো পাগল হয়ে গেছে।এলোমেলো কী যেন বলছে নিজের মনে।বিড়বিড়ানি শোনা যাচ্ছে একটু একটু।দু-পা এগিয়ে কাঁধে হাত রাখলো হুমায়রা।সহ্য হলো না ভূমির।নরম হাতটা সজোরে সরিয়ে দিলো কাঁধ থেকে।অন্য কাউকে সহ্য করবে না ও।কাতর দৃষ্টিতে ফয়সালের দিকে চেয়ে গলায় একরাশ মিনতি ঢেলে বললো,
” একটু ডেকে দে না ভাই।আল্লাহর কসম,আমি দেখেই চলে যাব।এক নজর দেখব,শুধু একনজর।তুই না চাইলে কোনো কথাও বলব না। আর কোনোদিন তোদের মাঝে আসব না।সূচিকে আর কোনোদিন আমার বাড়িতে ঢুকতে দেব না। তুই শুধু আজকে একটু ডেকে দে।”
দূর থেকে ফয়সালের গোঙানির শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা গেল না।ইশতিয়াক স্তম্ভিত,নিশ্চুপ,স্থাণুর মতো নিশ্চল।শোক-তাপ, বিপদে মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি লোপ পায়।ছেলেটার এখন সেই দশা।কোথায় কোন প্রতিক্রিয়া দেখানো উচিত তাই ভেবে পাচ্ছে না। হাত-পায়ের শক্তি পাচ্ছে না।এতো বছরের সংসারে ভূমির এমন গলা ও কোনোদিন শোনেনি,এমন দৃষ্টিও ওর অচেনা।
কাঙ্ক্ষিত উত্তর না পেয়ে হুট করেই রেগে গেল ভূমি।কপাল চেপে ধরে দাঁত খিঁচিয়ে বললো, ” কি রে, কী বলছি তোকে? দে না ডেকে।দিবি নাকি আমি নিজেই ঘরে ঢুকে খুঁজে নেব? সূচিকে সামনে পেলে ওকে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারব।এতো জ্বালা আর সইতে পারি না। নিজের শরীর নিয়েই বাঁচি না।এর উপর আছে সূচি।ওর ঐ শুকনো শরীরের ছিরি কি আমার সহ্য হয়?
জীবনেও না।হ্যাঁ রে,কাল রাতে খেয়েছিলো ও?”
আচমকা রাগ ভুলে নিজের স্বরে গুনগুনিয়ে কাঁদতে শুরু করলো।ওর সব অনুভূতির সুতো ছিঁড়ে একে অন্যের সাথে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গেছে যেন।কখন কোনটা বেরিয়ে আসছে তা বোঝা মুশকিল।
” কাল তোরা ওকে খেতেও দিলি না।মাত্রই বসেছিলো খেতে।এক লোকমা মুখে দিয়েছে কেবল,ওমনিই আব্বার ডাক। খাওয়ার সময় কুকুরকেও তাড়াতে নেই।অথচ, কাল আমার সূচি খেতেও পারলো না।তোরা কেউ খাওয়ার সময়টুকু দিলি না মেয়েটাকে।আমাকে একবার ওকে দেখতে দে না, ফয়সাল।শুধু একবার।ওকে না দেখে বাড়ি ফিরলে আমি কিছুতেই ভাত গিলতে পারব না। কেঁদেই মরে যাব।ওকে একটু ঘুম থেকে তোল,আমি তোর পায়ে পড়ছি ভাই “— পায়ে পড়ার উদ্দেশ্যেই হয়তো দু’পা এগিয়ে যাচ্ছিলো ভূমি। কিন্তু আর সহ্য করতে পারলো না। এতোক্ষণের উত্তেজনায় ভুলেই গিয়েছিলো একটি চিঠি ওর সমস্ত শক্তি শুষে নিয়েছে।নড়াচড়ার আগেই চোখ-মুখে অন্ধকার দেখলো।মাথা গেল ঘুরে।ভারী পা দুটোতে মাটি আঁকড়ে ধরার শক্তি হলো আর।নিজের অবস্থা ভবিষ্যতের হাতে ন্যস্ত করে, সকল বিলাপ-প্রলাপ সাঙ্গ করে ভূমি জ্ঞান হারালো।
ভাগ্য ভালো হুমায়রা কাছেই ছিল। ভূমির পাগলাটে কথা-বার্তায় ভয় জাগছিলো এতোক্ষণ।সূচির বড় আপার টালমাটাল অবস্থা দেখে দৌড়ে গেল ওর দিকে।ভারী শরীরটা মাটিতে লুটিয়ে পড়ার আগেই বুকে আগলে নিলো।মাটিতে পড়তে দিলো না।মাটিতে ধপ করে পড়লে আজ ভূমির খবর ছিল।হয়তো,বোনের মতো সেও সবাইকে রেখে পাড়ি জমাতো ও পাড়ে।
” ইশতিয়াক ভাই,কান্দাকাটির সময় পরে পাইবেন।আগে ভূমিরে আইসা ধরেন,আমি একা আর সামলাইতে পারতাছি না।”
চাবুক পড়লো ইশতিয়াকের পিঠে।ফিরে এলো হারিয়ে যাওয়া বোধশক্তি।ফয়সালকে ছেড়ে দৌড়ে এলো বৌয়ের কাছে।ভূমিকে সাবধানে নিজের বুকে নিয়ে আলতো চাপড় মারলো গালে।
” ও ভূমি,ভূমি! ভূমি,চোখ খোলো।কিছু হয়নি সূচির।ও ঠিক আছে।ভূমি,এই ভূমি।ভূমি,চোখ খোলো।”
” আপনে আমার ঘরে নিয়া আসেন কষ্ট কইরা।বিছনায় শোয়ায়া দেন,আমি ওর চোখ-মুখে পানি-টানি দেই।আর ভাই আপনে যায়া একটা অটোর ব্যবস্থা করেন।মনে হয় না,এই রোগীরে বাসায় রাখা যাইব। উদয়পুর হাসপাতালে নিয়া যান জলদি।একা না পারলে চলেন আমিও যাই।দেরি করার সময় নাই।”
হুমায়রার সামলে নেওয়ার ক্ষমতা প্রবল।এ গুণের জেরে বিপদ-আপদে সে দশটা পুরুষকে টক্কর দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। এই বিপদেও সে স্থির রইলো।একটুও বিচলিত হলো না।
কোলে নেওয়ার সাধ্য নেই,ভূমি আজকাল খুব ভারী হয়ে গেছে।তাছাড়া,কোলে নেওয়ার ঝুঁকি আছে।পেটে চাপ পড়লে সমস্যা।খুব সাবধানে ধরাধরি করে,স্থান বিশেষে টেনে-হিঁচড়ে ভূমিকে যখন হুমায়রার খাটে শুইয়ে দিলো,তখন দম বেরিয়ে যাচ্ছিলো ইশতিয়াকের।ভূমির অবস্থায় মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে তার।হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছে।এই ভূমি তার সবচেয়ে দুর্বল,সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গা।এই একটি মেয়ের বিষয়ে সে সবচেয়ে স্বার্থপর। বসে থাকলে চলবে না।একটা গাড়ির ব্যবস্থা করতে হবে।হুমায়রা কাজে লেগে গেছে,তাকেও বেরিয়ে পড়তে হবে।বেরোতে বেরোতে চোখ মুছে দয়াময়ের দরবারে কাতর মিনতি জানালো মনে মনে, ” আমার আয়ু ওকে দাও খোদা।ওকে তুমি সুস্থ রাখো।”
দৌড়ে কাজী বাড়ির বিশাল উঠোন পেরোনোর সময় খেয়ালও করলো না, তাদের প্রধান অপরাধী আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াচ্ছে।
________________________________
সকাল সাড়ে সাতটা।এতো সকালে ঘুম থেকে উঠার ইচ্ছা নেই রায়হানের।তার নিজের ফার্মেসী,আরো কিছুক্ষণ বিছানায় গড়িয়ে নিলে কেউ কিছু বলবে না।চম্পা রান্না করছে।মাটির চুলার ধোঁয়ার সাথে ভেসে আসছে পেঁয়াজ-মরিচ তেলে ভাজার ঘ্রাণ।খালি বিছানায় কোলবালিশটা জড়িয়ে সবে চোখটা বুজেছে সে,ওমনি কল এলো ফোনে।সকাল সকাল বিরক্তিটা আকাশ ছুঁয়ে দিলো।আধো আধো চোখে স্ক্রিনের দিকে চেয়ে ইশতিয়াকের নাম দেখে আঁতকে উঠলো।এতো সকালে ইশতিয়াক! ভূমি যে অসুস্থ তা জানে সে।এই এপ্রিলের শেষেই অপারেশনের তারিখ।ভূমিকে হাসপাতালে নেওয়ার সময় হয়ে এলো নাকি?
মিনিট কয়েক চাপা গলায় ইশতিয়াকের সাথে কথা বলে লাফিয়ে নামলো খাট থেকে।চোখ-মুখ থেকে ঘুমের রেশ কেটে সেখানে বিরাজ করছে চরম বিস্ময়,অস্থিরতা।রান্নাঘরের পাশ দিয়ে থপথপ করে হেঁটে যাওয়ার সময় টের পেল চম্পা।তেলের মাঝে ধোয়া মাছের টুকরোগুলো ঢেলে দিতে দিতে স্বামীকে ডেকে বললো, ” এই উইঠা গেছো? হাত-মুখ ধুইয়া আসো,ভাত দেই।”
কান দিলো না রায়হান।খালি গায়ে,খালি পায়ে এক দৌড়ে চলে গেল জয়ার ঘরের কাছে।দরজা ভেজানো।দুয়ারে দাঁড়িয়ে লিলির বাবাকে ডাকলো গলা ছেড়ে।
” লতিফ ভাই,ও লতিফ ভাই।”
লিলিকে ঘুম থেকে তুলছিলো লতিফ।জয়া পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।ডাকাডাকি শুনে বাইরে বেড়িয়ে এলো।সদ্য ঘুম ভাঙা রায়হানকে দেখে অবাক হলো।
” কি গো রায়হান, কী হইছে?”
” আপনার বি পজিটিভ রক্ত না?”
” হ।”
” তাড়াতাড়ি রেডি হন।আমাদের ভূমি হাসপাতালে ভর্তি।ডাক্তার রক্তের ব্যবস্থা করতে বলেছে।মেয়ের অবস্থা খারাপ।”
চমকে উঠলো দুজনে। চমকে উঠলেন সাহিদা বেগম নিজেও।বসার ঘরেই বসে ছিলেন তিনি।অজানা অস্থিরতায় ঘুম হয়নি সারা রাত।রায়হানের হাঁকাহাঁকিতে দুয়ারে এসে দাঁড়িয়েছিলেন। ভূমির নাম শুনে মেরুদন্ড সোজা হয়ে গেল মুহূর্তেই।কান-মন পেতে চেয়ে রইলেন রায়হানের দিকে।কতদিন মেয়েটার কোনো খবর জানা হয়নি!
ভমির যে অন্তঃসত্ত্বা তা জানা নেই অনেকের।ব্যস্ত পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো জয়া।উৎকন্ঠা নিয়ে প্রশ্ন করলো, ” কী হইছে রায়হান? ভূমির কী হইছে?”
” ভূমি প্রেগন্যান্ট, হাসপাতালে ভর্তি।কাকি,কাকা কী করে?”
” ঘুমায়।”
” কাল রাতে সূচির কোনো খবর নিয়েছিলেন?”
মাথা নাড়লেন সাহিদা বেগম।দুর্বল গলায় বললেন,
” তোমার কাকায় চেইত্তা যায় ওর নাম শুনলে।খবর নেওয়ার কথা কইতে পারি নাই ভয়ে।”
সকাল সকাল এরকম একটি উত্তর শুনে ক্ষোভ,হতাশা, বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হয়ে গেল রায়হান।চোখ-মুখ কুঁচকে বললো, ” আপনি ভয়ই পান।এদিকে মেয়ে দুটো মরুক।”
আঁতকে উঠলেন সাহিদা বেগম।শেষ রাতে চোখ লেগে আসতেই ছোট মেয়েটাকে নিয়ে কী যেন একটা বাজে স্বপ্ন দেখেছিলেন।হুট করেই সেই স্বপ্নটা ভেসে উঠলো চোখের উপরে।ব্যস্ত হয়ে বললেন, ” কী হইছে রায়হান?”
” আমি পুরো খবর জানি না।কালকের ঝামেলার জের ধরে ওদের মাঝে উল্টাপাল্টা কী যেন হয়েছে,ভূমিরা সকালে গেছিলো কাজী বাড়িতে।সূচিকে পায়নি।ওকে না পেয়েই নাকি ভূমি অসুস্থ হয়ে গেছে।ইশতিয়াক বেশি কথা বলতে পারেনি।কাকাকে ডেকে সূচির খোঁজ করেন।আর লতিফ ভাই, আপনি তাড়াতাড়ি আসেন।নাস্তা বাজার থেকে করবনি।”
কথা শেষ করে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াচ্ছিলো রায়হান, জয়ার আর্তচিৎকারে থমকে গেল পা।পিছন থেকে ভেসে আসছে জয়ার আর্তনাদ, পায়ের ব্যস্ততার ছন্দ।
” কাকি,কাকি, পইড়া যায়েন না।আল্লাহ, ঢুইল্লা পইড়া গেল।লিলির বাপ,তাড়াতাড়ি এদিকে আসেন।ও মনি,ও চম্পা,তাড়াতাড়ি আয়।কাকি অজ্ঞান হয়া গেছে।কাকি,কাকি গো…
_________________________________
পঁচিশে এপিল,সকাল নয়টা।উদয়পুর লঞ্চ ঘাটে পঞ্চাশের বেশি মানুষ।মমিন শেখ, রতন পাটোয়ারী,তাদের বাজারের বন্ধু-বান্ধব,রায়হানসহ আরো অনেকে উপস্থিত।মহিলা মহলের সংখ্যাই বেশি।বোরকায় জড়ানো সাহিদা বেগম পাথর হয়ে বসে আছেন মাটিতে। দৃষ্টি সুদূর নদীতে, পুরোনো কাঠের বিশাল নৌকাটার দিকে তার নজর।মাঝি দুটোর সাথে আরো বাড়তি দুটো লোকের দিকে তার মন-প্রাণ পাতা।ক্ষণে ক্ষণে জাল ফেলছে তারা।টেনে জাল তোলার আগে শোনা যাচ্ছে জনতার কন্ঠ।
” জাল ভারী লাগে? পাইছেন কিছু? আটকাইছে কিছু জালে?”
প্রতিবার না, না শোনার পরেও তাদের ধৈর্য কমে না।সেই আধ ঘন্টা ধরে তারা দাঁড়িয়ে আছে এখানে।দূরের নৌকাটা চষে বেড়াচ্ছে চিরযৌবনা মেঘনার একাংশে।
সাহিদা বেগমের এক হাত জয়ার হাতে। তার আশেপাশে আছে চম্পা,লিলি,রনি,মনি,ওদিকের হিন্দু বাড়ির বউ নিরুপমা,রত্না,রত্নার মা,দর্জি বাড়ির আরো অনেকে।কেউ বসা, কেউ দাঁড়ানো।
মমিন শেখকে ধরে দাঁড়িয়ে আছেন রতন পাটোয়ারী। লাঠি যেমন আশি বছরের বৃদ্ধকে দাঁড়াতে সাহায্য করে,তিনিও তেমনি বন্ধুকে সাহায্য করছেন।একরোখা, গোঁয়ার মানুষকে ছাঁচে ঢেলে নিজের মনমতো গড়ে নেওয়া কঠিন। কিন্তু তাদেরকে ভেঙে দেওয়া খুব সহজ।মমিন শেখের মেরুদন্ডটা মনে হচ্ছে কেউ ভেঙে দিয়েছে।সে দাঁড়াতেই পারছে না।তার মতো মানুষের কাছে চক্ষুলজ্জা,মান-সম্মানই সব।মেয়ের শুকনো মুখ,দুঃখ-কষ্ট,হাজারটা অভিযোগ ঠাই পায়নি এসবের কাছে।বাপ-মেয়ের মাঝে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল একটি মোটা প্রাচীর।এ প্রাচীর ভেদ করে সূচি কখনো পৌঁছাতে পারেনি বাবার মন পর্যন্ত।কিন্তু আজ? মেয়ের মৃত্যু সংবাদের কাছে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে তার তথাকথিত চক্ষুলজ্জা, মান-সম্মান।গুড়িয়ে গেছে সব।ঘুম ভেঙে হৈ চৈ শুনে প্রথমে ভেবেছিলেন ঘরে বুঝি ডাকাত পড়েছে। ঘুমের রেশ কেটে কান পরিষ্কার হতেই মাথা কাজ করা শুরু করলো। চোখে পড়লো খাটের উপরে শুইয়ে রাখা স্ত্রীর নিস্তেজ মুখ।কানে এলো রায়হানের উত্তেজিত কন্ঠ।দুয়ারে দাঁড়িয়ে কাদেরকে যেন শুনিয়ে বলছে, ” ইশতিয়াকের কাছ থেকে পুরো খবর শুনেছি মাত্র।ভূমির অবস্থা খারাপ।পুরোপুরি জ্ঞান ফিরছে না।জ্ঞান না ফেরা অবধি অপারেশন করা যাবে না।উদয়পুর হাসপাতালে রাখেনি ওকে। ইশতিয়াক এখন ভোলা হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। লতিফ ভাই আপনি সেখানেই চলে যান।”
” সূচির কোনো খবর পাইছো?”
” ওহ সূচি! আমাদের সূচি সুইসাইড করেছে।মাত্রই শুনলাম,মরার আগে একটা চিঠি লিখে গেছে। ইশতিয়াক আর ভূমি ভোরে গেছিলো কাজী বাড়িতে।ওরাই পেয়েছে আগে।ঐ চিঠিতে বলেছে, ওর স্বামী নাকি কালকে বেল্ট দিয়ে মেরেছে ওকে।ছোট মানুষ,ধাক্কা সামলাতে পারেনি।ঘরে কেউ ছিল না,সামলানোর মতো পাশে কেউ ছিল না।বিনা বাধাতে মেয়েটা নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে।আমাদের বোন সাতার জানে না।এখন ওর অবস্থা তা আমি ভাবতেও পারছি না।”
সম্মিলিত চিৎকারে মুখর হয়ে উঠলো সারা বাড়ি।সূচি নেই! সত্যি নেই! কথাটা যেন বিশ্বাস হতে চায় না।কিন্তু বসে থাকলে তো চলবে না।অনেক কাজ বাকি। লোক জমা করে কাজী বাড়িতে হানা দেওয়া শেষে সবাই আবিষ্কার করলো, পুরো কাজী বাড়ি ফাঁকা।সূচিদের ঘরের দরজা হাট করে খোলা।হুমায়রা ইশতিয়াকের সাথে হাসপাতালে গেছে।এই সুযোগে ফয়সাল পালিয়েছে।তন্ন তন্ন করে খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেল না তাকে।ক্রোধে আচ্ছন্ন হয়ে মমিন শেখ হুংকার ছাডলেন, ” কু** বাচ্চারে আমি জবাই দিমু।আমার মাইয়াটারে মাইরা ফালাইছে ওয়।ও রতন, ও রায়হান,আমার সূচি আর নাই।আমার ছোট সূচি,আমার কইলজা সূচি।আমারে ছাইড়া আমার মায়ে গেছে গা।আমি এহন কী নিয়া বাঁচুম? তোরা আমারে মাইরা ফালা,তবুও আমার সূচিরে আইন্না দে।”
সূচি ঠিকই লিখেছিলো।মরার পরে সত্যিই ওর কদর বেড়েছে।
নদীতে সবাই লাশ খুঁজছে।জ্যান্ত না হোক,অন্তত লাশটা হাতে আসুক।অন্তত আরেকবার ছুঁয়ে দেখা যাক,আরেকবার বুকে জড়িয়ে ধরা যাক। মাঝি দুটো নৌকা নিয়ে ঘুরছে নদীতে। তাদের সাথে থাকা দুটো লোক জাল ফেলছে,আবার টেনে তুলছে।প্রতিবারেই প্রত্যাশা এবারে কিছু মিলবে,এবারে কিছু উঠবে জালে।কিন্তু কিছুক্ষণ পর পর হতাশা ছাড়া আর কিছুই আসে না।তবুও থেমে নেই কেউ।নতুন করে আশা জমায় বুকে।আবারও ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালায়।কখনো কখনো ব্যর্থতায় লুকিয়ে থাকে আশা।
” কি গো জালে পাইছো কিছু।”
” কি যেন আটকাইছে।ভারী না হালকা কিছু।”
” কী আটকাইছে? কী পাইছো?”
নদীর তীর থেকে ভেসে আসা প্রশ্নে বিরক্ত হয় লোক দুটো।তেতো গলায় উত্তর দেয়, ” জাল তুলতে দেন আগে।”
জাল তোলা শেষ।ভারী নয়, হালকা কিছুই এসেছে।পুরোনো ত্যানার মতো নরম কী যেন একটা।জাল থেকে টেনে বের করে লোক দুটো।টানাটানি করে ভিজা ত্যানাটা মেলে ধরতেই চোখে পড়ে,ওটা শাড়ি।একটা লম্বা ধূসর রঙা ভেজা শাড়ি।তীরের দিকে ছুঁড়ে মেরে চিৎকার করে একটা লোক, ” একটা শাড়ি পাইছি।”
” ছাড়ো, ছাড়ো আমারে।ঐটা আমার সূচির শাড়ি।কালকে আমার মাইয়ার গায়ে এইটা আছিলো।ও কাজল ভাই,আরেকটু গভীরে যাও।আমার মাইয়ারে তুমি পাইবা।শাড়ি যহন পাইছো তথন সূচিরেও পাইবা।”
ধূসর রঙা শাড়িটাকে বুকে জড়িয়ে নির্নিমেষ চেয়ে রইলেন মমিন শেখ।চেয়ে রইলেন নদীর দিকে।তার বুকের মানিক পড়ে আছে সেখানেই।
আবারো ব্যর্থ প্রচেষ্টা,মানুষগুলো অধ্যাবসায়ের শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে।চলছে জাল ফেলা,জাল তোলা।হতাশা,বিষাদ, অপ্রাপ্তির বেদনা।তারপরে আবার নতুন উদ্যম,আবার খোঁজাখুঁজি। মেয়ের শাড়িটাকে বুকে জড়িয়ে নদীর দিকেই চেয়ে ছিলেন মমিন শেখ।সহসা ছেদ পড়লো ধ্যানে।সকলের চোখ কাটিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে সাহিদা বেগম এসেছেন স্বামীর কাছে।মেয়ের ভেজা শাড়ি টেনে নিতে নিতে লুটিয়ে পড়লেন মমিন শেখের পায়ে।
” আমার মাইয়ারে ফিরায়া দেন সূচির বাপ।আল্লাহর দোহাই লাগে আমার সূচিরে আমার কোলে দেন।আমি মাইয়াটারে বুকে নিয়া দূরে যামু গা।কাউরে কষ্ট দিতে দিমু না।দেন না,আমার সোনারে আমার কাছে ফিরায়া দেন।না জানি আমার মানিকে কত কষ্ট কইরা মরছে গো।সাতার জানে না,নিশ্চয়ই হাতে পায়ে শাড়ি জড়ায়া গেছিলো।এতো পানির মইধ্যে কেমনে টাইন্না খুলছে শাড়ি? কত কষ্ট হইছে!ও খোদা, আমারে নেও তুমি।আমার সোনারে আমার বুকে দাও।ফিরা আয় সূচি,আর একটাবার ফিরা আয়।”
বেলা গড়ায়,একসময়ে সাঙ্গ হয় খোঁজাখুঁজি। কারো চোখ বেয়ে পানি গড়ায়,বাতাস মাতে দীর্ঘশ্বাসে।নিশ্চল মমিন শেখের পাথর কঠিন পায়ে সাহিদা বেগমের মাথাটা পড়েই রইলো।সঙ্গে চললো বিলাপ,ব্যর্থ কান্না।মেঘনার আশপাশের বাতাসে প্রতিধ্বনিত হয় এক শোকগ্রস্ত মায়ের শেষ ইচ্ছা।
” ফিরে আয় সূচি,আরেকটিবার ফিরে আয়।”
( প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি)
_______________________
( আসসালামু আলাইকুম। শুকতারার প্রথম পরিচ্ছেদটি শেষ হলো।ভুল-ত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো।ধন্যবাদ পাঠক মহলকে।দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ শুরু করতে একটু দেরি হবে।আগামী তিন তারিখে আমার এডমিশন টেস্ট। এর আগে আর লিখতে চাচ্ছি না।শেষ সময়ের প্রস্তুতিতে লেখা সম্ভব না।একটু বিরতির পর ইনশাআল্লাহ দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ শুরু করব)