ফেইরিটেল পর্ব-৫৭

0
1585

#ফেইরিটেল
#Arishan_Nur (ছদ্মনাম)
Part–57

আজ বাসার পরিবেশ বেশ উৎসবময়। সোনালী আপু ঘুরতে এসেছে সঙ্গে প্রান্ত ভাই আর তাদের পুচকে মেয়ে সায়মা এসেছে। সুপ্তি বেগম জামাই আপ্যায়নের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। ঘরে দু’জন জামাই অবস্থান করছে আজ। রান্না-বান্নায় কমতি রাখা যাবে না৷ চুলায় পোলাও চড়িয়ে এসে ইমাদের কাছে দাড়ালো সে। ইমাদ আর সায়মা প্রায় কাছাকাছি বয়সের হওয়ার দরুণ তাদের মধ্যে ভাব বেশ। দু’জনই খেলছে। কিন্তু ইমাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তাকে রোগ-অসুস্থতা আক্রমণ করেছিল। বাচ্চা মানুষ খেলা নিয়ে তুমুল ব্যস্ত, লাফালাফি করলেও দুর্বলতা তাকে গ্রাস করে ফেলেছে। সুপ্তি বেগম ভাবলেন এখন থেকে দিনে দু’গ্লাস দুধ বাবুকে খাওয়াবেন৷ তখনই বেল বাজে৷ ইমাদ খেলনা ছুঁড়ে ফেলে গেইটের দিকে ছুট লাগায়। তার আম্মু-আব্বু এসেছে৷ সুপ্তি বেগম নাতির দিকে তাকিয়ে হাসলেন। এই তো সেদিনের কথা তার মিরা এমন ছোট্ট ছিল। দুই ঝুটি বেঁধে স্কুল যেত। আজ চোখের পলকে তার মেয়ে বড় হয়ে গেল। সময় কী অদ্ভুত! অথচ তার স্পষ্ট মিরার নবজাতক চেহারা চোখে ভাসে৷

মিরার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে৷ ছেলের সঙ্গে কথা বলছে সে। ইমাদ গেইট খুলে মা-বাবাকে দেখতে পেয়ে বেজায় খুশি। সারাদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটলো। মা যখনই বাসায় ফেরে তার আনন্দ লাগে। মাঝে মাঝে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আম্মুর জন্য সে অপেক্ষায় থাকে।

ইমান ছেলের জন্য চকলেট বের করল পকেট থেকে। ইমাদ বলে উঠে, ” সায়মা আপুও এসেছে বাবা৷”

মিরা বলে, ” তোমরা দু’জন শেয়ার করে নিও চকলেটটা।”

ড্রয়িংরুমে সবাই বসে ছিল। হাসাহাসির আওয়াজ আসছে৷ ইমান গিয়ে সাদের পাশে বসল। সাদ ভাইয়ের দিকে তাকালো। ইমান তাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ” তোকে অনেক খুশি বলে মনে হচ্ছে? ”

সাদ অর্থপূর্ণ হাসল। যার অর্থ তুমি ঠিক ধরেছে৷ এই ছয় বছরে সাদের সঙ্গে ইমানের সম্পর্ক অনেক গভীর হয়েছে। সাদ হুট করে ম্যাচিউর হয়ে গেল। পরিস্থিতি বুঝতে শিখে গেল৷ সবচেয়ে বড় কথা, “ভালোবাসা” মানে কী সেটা উপলব্ধি করেছে৷ ভাইয়া যতোবারই অন্য কোথাও শিফট হতো সে গিয়ে অন্তত ভাইয়ের সঙ্গে এক-দু’সপ্তাহ থেকে আসত। দু’ভাই মিলে একসঙ্গে ডিনার করত। রান্না করত। তার টাকার প্রয়োজন পড়লে ভাইকে পাশে পেয়েছে। ভাই-ব্রাদারের সম্পর্ক এখন অনেক মজবুত।

প্রান্ত ভাইয়া বলে উঠে, ” আজকে অনেকদিন পর সবাই একসঙ্গে। সেই লাস্ট মিরার বিয়ের দিন আমরা সবাই একসঙ্গে এভাবে গল্প করেছি। এরপর সবাই এতো বিজি হয়ে পড়লাম যে দেখা-সাক্ষাৎ কমে গেল৷”

ইমান হাসল। এরপর বলে, ” আমি তো দেশেই ছিলাম না৷”

প্রান্ত ভাইয়া বলে, মিরা-ইমানের বিয়ে কথা আমি কোনদিন ভুলব না। সে কী বৃষ্টি! বর নিজে কাজী ডাকতে গিয়েছিল। হাহা৷ গাড়ির ইঞ্জিনে পানি ঢুকলো। বেজায় ঝামেলা হয়েছিল সেদিন৷”

ইমান খেয়াল করেছে সোনালী আপু আগের মতো আগে আর ভাইয়ের আদর দেয় না। ইন ফ্যাক্ট কথাও বলে না। একসঙ্গে বসলেও তাদের মধ্যে আর আগের মতো কথা হয় না ম নিশ্চয়ই তাকে এখনো ভুল ভেবে বসে আছে। ইমান সবার সামনেই বলে উঠে, “সোনালী আপু? ”

আপু যেন চমকে উঠে তার ডাকে। মিরাও রুমের দিকে যাচ্ছিল, সে হাঁটা থামিয়ে দিল৷

ইমান উঠে এসে আপুর সামনে মেঝেতে বসে তার একটা হাত ধরে বলে, ” মা যখন মারা গেল আমি খুব বেশি বড় ছিলাম না। বাবা জেল যাওয়ার পর আমার ঠায় হলো নানাবাসায়। মা হারা একলা আমি। বুক ভর্তি কান্না। ওই সময় তুমি আমাকে মায়ের মতো আগলে রাখলে৷ একবার আমার টাইফয়েড হলো। রাতে জ্বর আসলো। তুমি সারারাত জেগে সেবা করলে। ফযরের আযানের পর আমি চোখ মেলে জিজ্ঞেস করি, কেন সারারাত জেগে থাকলে? তুমি তো আর আমার মা নও। মনে আছে তুমি কী উত্তর দিয়েছিলে? বলেছিলে বোনেরা দ্বিতীয় মা হয়। যার মা নেই তার বোন থাকলেও মায়ের অভাব বেশ খানিকটা কমে যায়৷ ওইদিন থেকে তোমাকে আমি সবচেয়ে বেশি সম্মান করি। ভালোবাসি আপু৷”

ইমানের কথায় পরিবেশ যেন গম্ভীর হয়েছে। সবাই চুপ। কেবল সিলিং ফ্যানের আওয়াজ হচ্ছে৷

সোনালী আপুর চোখে পানি চলে এসেছে। এটা সত্য সে ইমানকে অনেক আদর করে ছোট থেকেই। মা হারা হওয়ার পর এই মায়া-মমতার টান অধিক মাত্রায় ফুলে-ফেঁপে বেড়ে গিয়েছে৷ কিন্তু গত ছয়টা বছর ধরে সে রাগ করেছে ইমানের উপর। ওর কর্মের উপর। সে নাক টেনে বলে, ” মিরুও আমার ছোট বোন। ওকেও আমি ভালোবাসি৷। তুই কেন আমার বোনকে কষ্ট দিলি?ইমান করুন চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলে, ” তোমার বোনকে কষ্ট দিয়ে কী আমি সুখ পেয়েছি? বরং প্রতিনিয়ত দগ্ধ হয়েছি। ”

মিরা চুপ থাকতে না পেরে বলে, ” আপু, আমি জানি তুমি আমাদের দু’জনকেই ভালোবাসো। আমাদের সম্পর্কের ফাটলের জন্য ভাই-বোনের সম্পর্কে দূরত্ব এনো না প্লিজ।”

সোনালী আপু ইমানের মাথায় হাত রাখলো। এরপর বলে, ” তোর রাজকপাল যে মিরার মতো কাউকে পেয়েছিস। সাত রাজার ধনের সমান ও। কিন্তু সম্পদ সামলে রাখতে পারিস নি। তোর জন্যই আফসোস হচ্ছে আমার।”

ইমান মাথা নিচু করে নিল। এরপর রুমজুড়ে পিনপতন নীরবতা।

সাদ বলে উঠে, ” তোমরা কী জানো, সাইকোলজি মতে, প্রতিটা মানুষের হাসি-খুশি, আনন্দে থাকা উচিত। দীর্ঘদিন আনন্দ না করলে একজন স্বাভাবিক মানুষ মানসিক ভাবে অসুস্থ হতে পারে? এ বাসায় আসা থেকে দেখছি ইমাদ বাদে সকলে বুকে দুঃখের গোডাউন নিয়ে ঘুরো।”

সাদের কথায় সবাই হাসলো। প্রান্ত ভাইয়া দুষ্টুমি করে বলে, “তো সাইকোলজি বিশেষজ্ঞ আমাদের আনন্দে থাকার উপায় কী?”

সাদ চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারপাশে দেখল। তার নজর আটকে যায় ইমাদের খেলনার বক্সের দিকে। বিশাল বড় লুডু বোর্ড দেখে তার মুখে হাসি ফুটে উঠে। সে লুডু বোর্ড বের করে বলে, ” লেট’স প্লে।”

তার কাজ-কর্ম সবটা সবাই মজার ছলে নিয়েছিল। কিন্তু একটা সময় লুডু খেলা নিয়ে সবাই সিরিয়াস হলো৷ নব্বই দশকের ছেলে-মেয়েদের কাছে লুডু হলো একটা আবেগ৷ লুডুর বোর্ড দেখলে তারা নস্টালজিক হয়ে পড়ে। টিন এইজের কথা স্মরণ হয়। সবাই লুডু খেলতে আগ্রহ দেখালো। বাদ পড়ল না, সুপ্তি বেগমও। টিম করা হলো। সুপ্তি বেগম এবং ইরা এক টিমে। সোনালী আপু, প্রান্ত ভাই এক টিমে। তাদের সঙ্গে সায়মাও যুক্ত হয়েছে৷ সাদ, মিরা আর ইমান একা খেলবে। তবে ইমাদ তার মায়ের কোলে এসে বসল৷ বাবা আসার পর মাকে সে কম সময় দিচ্ছে। এইজন্য এখন আম্মুর কাছে এসে বসেছে সে। এছাড়াও তার শরীর ভালো লাগছে না, ঘুমাতে মন চাইইমান বলে, ” ইমাদকে নিয়ে যাব। ও একা হোটেল কী করবে জন্য ভাবছি যদি ইরাও আসে ভালো হত।”

তখনই ইমাদ তার বিশ্ববিখ্যাত গম্ভীর মুখে বলে, ” কিন্তু বাবা আমি তো ওলরেডি চাচ্চুর সঙ্গে ঘুরতে যাওয়ার প্লান করেছি। আমি যাব না৷”

— ” আম্মু যাবে তোমার। আমরাও ঘুরব বাবাই। তুমি একলা থাকতে পারবে না।”

–” চাচ্চুর সঙ্গে বেশি মজা হবে৷ আমি যাব না। তুমি আম্মুর সঙ্গে যাও বাবা৷ আম্মু কিন্তু একা রাতে ঘুমাতে পারে না। এজন্য আমি আম্মুর সঙ্গে ঘুমাই। তুমি কিন্তু আম্মুর সঙ্গে ঘুমাবে বাবা৷”

তার কথায় ইমান লজ্জা পেল। ছেলে তার বিরাট বেফাঁস কথা বলে দিচ্ছে৷

ইমাদ আরো সংযোজন করে বলে, ” আম্মুর যখন ঘুম আসে না, অন্ধকারে ভয় পায়, আমি আম্মুকে জড়ায় ধরে ঘুমাই। ওখানে গিয়ে আম্মু ভয় পেলে, আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবে বাবা। ”

ইমান বলে উঠে, ” আচ্ছা রে আমার বাপ।”

মিরা কটমট করে তার দিকে তাকালো। ইমান বাদে বাকি সবাই মিটমিট করে হাসলো৷

খাওয়া শেষ করে বাসার তিন পুরুষ ছাদে যায় সি’গা’রে’টে সুখটান দিতে। প্রান্ত সন্ধ্যা থেকে খেয়াল করেছে সাদ আর ইরা খালি ইশারায় কথা বলে। প্রেম করার সময় সে আর সোনালীও এমন করত৷ তাই চেপে বসে সাদকে সত্য বলার জন্য।

ইমান অর্ধেক বুঝে বলে, ” সাদ তুই না বদলে গেছিস? ট্রু লাভের মিনিং বুঝেছিস? তোর এংরি বার্ড ছাড়া কাউকে চোখে পড়ে না৷ ভালো লাগে না কাউকে আর৷ তাহলে বাংলাদেশে এসে আবারো এসবে জড়ালি ক্যান?”

সাদ তাকে বলে, ” প্রান্ত ভাই যার কথা বলছে সে-ই আমার প্রিয় রাগী-কন্যা, মাই এংরি বার্ড! ওকে ভালোবাসার পর আমি অন্য নারীতে আসক্ত হতে পারি নি আর। বারবার ওর কাছেই মন আটকে পরেছে আমার এন্ড লাকিলি তুমি তাকে চেনো ব্রো।”

–” কে সে? কথা প্যাচাবি ন।”

–” তোমার একমাত্র শালিকা। আমি ওকে বিয়ে করতে চাই৷ ভাই প্লিজ সবকিছু ম্যানেজ করে দাও।”

ইমান যেন টাস্কি খেল৷ ইরা আর সাদ! কেমনে কী? মাই গড! তার নাকের ডগায় এতোকিছু ঘটে গেছে?

চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here