শঙ্খচিল পর্ব-১৯

0
1655

#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya

পর্বঃ-১৯

বেলকনি দিয়ে ঘরে দক্ষিণা বাতাস ঘরে প্রবেশ করছে। ওয়াহাবের মা তাসবী পড়তে পড়তে একবার বাইরের দিকে তাকালো। সূর্য এখনো পুরোপুরি ওঠেনি৷ আকাশ জুরে কমলা আভা। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে দরজার দিকে তাকালেন।
হাতে দু কাপ চা নিয়ে তানিয়া দাঁড়িয়ে আছে। ওয়াহাবের মা তাসবীর পরা থামিয়ে বললেন, ” দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? ভেতরে আয়..”

তানিয়া ভেতরে ঢুকে বললো,
” বাবা ওঠেনি? ”

” ফজরের নামাজ পরে, শুয়েছে তোর বাবা। তা শাহেদের সাথে কথা হয়েছে? ”

তানিয়া মায়ের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে বললো, ” গত পরশু শিহাবের সাথে কথা হয়েছে।”

চায়ের চুমুক দিয়ে বললেন, ” তোমার সাথে কথা হয় নি?”
” না মা। তোমার সাথে ইম্পর্ট্যান্ট কথা ছিলো… ”

” বলো। ”

” ওয়াহাবের মিস কে তো চেনো?”

” চিনি। গত কাল দেখলাম। কি হয়েছে? ”

” মেয়েটা মেডিক্যালে থার্ড ইয়ারে উঠেছে। ফ্যামিলি বেক গ্রাউন্ড ভালো৷ ওয়াহাবের সাথে…”

তানিয়া কথা শেষ করার আগেই তার মা কথা থামিয়ে দিয়ে, অবাক হয়ে বললো, ” তুমি ওয়াহাবের জন্য ওই মেয়েটাকে পছন্দ করেছো তাই তো?”

” হ্যাঁ। যদি তুমি বাবা সম্মতি দাও ওর ফ্যামিলির সাথে কথা বলে দেখতে পারি৷ ”

ওয়াহাবের মা কোন উত্তর দিলো না। ক্ষানিক তানিয়ার দিকে তাকিয়ে চায়ে মনোযোগ দিলেন। হয়তো কিছু ভাবছিলেন। তানিয়া মায়ের উত্তরের অপেক্ষায় কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, থেকে রুম থেকে বেড়িয়ে এলো৷

—————————————————

কোল বালিশে গা জরিয়ে শুয়ে আছে তানহা। অজানা কারনে সাদা ওরনা দিয়ে চোখ দুটো ঢেকে রেখেছে, হয়তো ঘরের উষ্মতার কারনে। বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে চোখের পাপড়ি গুলো নড়ে উঠছে। হঠাৎ ঠোঁট জোরা মৃদু কেঁপে উঠলো। চোখ মেলে হাত দুটো প্রশারিত করে বালিশের তলা থেকে ফোন টা বের করলো।
ভু ভু করে ফোনটা বেজেই চলেছে। তানহা রিসিভ করার আগেই ফোনটা কেটে গেলো। তানহা কল বেক করবে কিনা, তা ভাবতে ভাবতেই আবার ফোনটা ভু ভু করে বেজে উঠলো। তানহা ফোনটা রিসিভ করে ” হ্যালো! ” বলতেই ওপাশ থেকে অপরিচিত কেউ বললো,

” শাহবাগ থেকে হারুন রশীদ বলছি। আপনি কি তানহা বলছেন?”

” জ্বি। তানহা বলছি। ”

” ওসি স্যার আপনার কেইসের অ্যাপ্রুভাল দিয়েছেন। ”

তানহা অবাক হয়ে বললো, “সত্যি বলছেন? ”

” জ্বি। কেইস টা এস আই স্যারের হাতে এসেছে। এস আই স্যার আপনার সাথে কেইসের ব্যাপারে কথা বলতে চান। ”

” কখন আসতে হবে আমাকে? আজকে বিকেলে আসবো? ”

” না। স্যার বিকালে থানায় থাকেন না। আপনি আজ সকাল দশটা বা এগারোটায় আসুন। ”

” সকালে আমার ক্লাস আছে, কিন্তু সমস্যা নেই আমি আসবো।”

” ঠিক আছে৷ ” বলেই ফোনটা কেটে দিলেন।
ফোনটা কাটতেই তানহা দেখতে পেলো, সকাল নয় টা বেজে এগারো মিনিট৷ দ্রুত ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেডি হলো৷
খাবার টেবিলে মানহা আনমনে রুটি ছিড়ছে তবে খাচ্ছে না৷ সামনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে তাকাতেই দেখলো তানহা দাঁড়িয়ে আছে। মানহা কিছু বললো না, আজ কাল একদম কথা বলতে ইচ্ছে করে না, আনমনে তানহার দিকে তাকিয়ে তানহার উত্তরের অপেক্ষায় তাকিয়ে রইলো,
তানহা টেবিলে বসতে বসতে বললো, ” আপু একটু বের হচ্ছি।”

” আচ্ছা৷ ”

তানহা অবাক হয়ে বললো, ” শুধুই আচ্ছা? আজ সারে তিন মাস পর আমি বোরখা ছাড়া বের হচ্ছি সেটা তুমি একটুও খেয়াল করলে না?”

মানহা অপরাধী দৃষ্টিতে বোনের দিকে তাকিয়ে, রইলো। যেমন তানহা কে না দেখে সে খুব বড় ভুল করে ফেলেছে। আপাদমস্তক এক বার তাকিয়ে মানহা বললো, ” কোথায় যাচ্ছিস, হঠাৎ আজ বোরখা ছাড়া? ”

” এমনি। ফুচকা খেতে যাবো৷ ”

” বোরখা পড়েও ফুচকা খাওয়া যায়৷ ”

তানহা আমতা আমতা করে বললো, ” ক্ষুধা লেগেছে আমার। খেয়ে বলছি। ” বলেই তানহা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। কোন মতে দুটো রুটি খেয়ে বললো,
” আসছি আপু। লেইট হচ্ছে। ”

মানহা আনমনে বললো, ” আচ্ছা সাবধানে যাস। ”

তানহা বেরিয়ে যেতেই, শেহতাজ বেগম খাবারের টেবিলে এলেন, তানহার এটো প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললেন, ” মানহা বেরিয়ে গেছে? ”

মানহা নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে বললো, ” হুঁ! ”

” তুই খাচ্ছিস না কেনো?”

মানহা আবারো আনমনে বললো, ” হুঁ!”

শেহতাজ বেগম নাতনির কাধে হাত রেখে বললেন, ” কি হুঁ হুঁ শুরু করেছিস। নাস্তা ও তো ঠিক মতো করিস নি?”

মানহা ধ্যান ফিরতেই অবাক হয়ে দাদীর দিকে তাকিয়ে রইলো। দাদী মিটি মিটি হেসে বললো, ” তোর মন কই থাকে?”

” মানে কি দাদী। আমি তো খাচ্ছিলাম, রুটি শক্ত তাই আস্তে আস্তে খাচ্ছি। ”

” তাই? আমি তো কিছুক্ষণ আগে নরম রুটি খেলাম। ঠিকই তো ছিলো। ”

মানহা আমতা আমতা করে দাদীর দিকে তাকিয়ে তইলো। কি জবাব দেবে বুঝতে পারছে না। দাদী আগের মতো মিটি মিটি হেসেই চলেছে, মানহা দাদীর হাসি দেখে অবাক হয়ে বললো, ” হাসছো কেনো দাদী? ”

” তুই কার কথা ভাবছিস বলতো? ”

মানহা অবাক হয়ে বললো, কার কথা?”

” ওই ছেলেটা, যে আমার অপারেশন করলো। ”

তানহা থত মত খেয়ে দাদীর দিকে তাকিয়ে রইলো। মানহা তোতলাতে তোতলাতে বললো, ” তু তুমি ও না দাদী। আমি ওই লোকের কথা ভাবতে যাবো কেনো? আমার কি কোন কাজ নেই নাকি? ”

” সেটা তুই ভালো জানিস। ”

মানহা স্থির দৃষ্টিতে আগের মতোই দাদীর দিকে তাকিয়ে রইলো, কথা বলার কোন শব্দ খুজে পেলো না। দাদী তো ভুল কিছু বলে নি, আসলেই তো সে ওয়াহাবের কথাই ভাবছিলো। আজকাল অসভ্য ডাক্তার তাকে সর্বক্ষণ জ্বালাতন করে। ঘুমের মাঝেও তাকে শান্তি তে থাকতে দেয় না।
অথচ কিছুদিন বাদেই এই অভদ্র লোকটার ঘরে নতুন বউ আসবো। মানহার মতো এই চাতক পাখিটার অস্তিত্ব মুছেও যাবে। ভাবতে ভাবতেই শ্বাস ফেললো মানহা।
মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো, এই লোকটার ছায়ার কাছেও আর সে যাবে না, আর পড়াবে না শিহাব কে। তাতে যে যাই ভাবুক, মানহা দরকার পড়লে কোন পারিশ্রমিক নিবে না , তবুও সে ‘ কুসুমতি ‘ ভিলায় আর যাবে না।

———————————————–

” স্যার আসবো? ”

ইলহাম চেয়ার ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো দরজার সামনে তানহা দাঁড়িয়ে আছে, পড়নে সাদা গোলাপি রঙের চুড়িদার। চুল গুলো একপাশে রাখা, ঠোঁটে হালকা লিপস্টিকে হলুদ ফরসা তানহা কে আরো সুন্দর লাগছে। এই প্রথম বার ইলহাম দিনের আলোয় স্পষ্ট তানহাকে দেখতে পেলো। তানহা পূর্নরায় বললো,
” স্যার আসতে পারি? ”

” জ্বি আসুন। ”

মানহা রুমে প্রবেশ করতে করতে সারা রুমে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো, দু দিকে দুটো সো কেজ টফি এবং মেডেলে পরিপূর্ণ। মানহা এর আগের বার এসে এতো কিছু খেয়াল করে নি, হঠাৎ হাটতে হাটতে মানহা টেবিলের সাথে ধাক্কা খেয়ে সিরামিকের ফুলদানি ফেলে দিলো৷ মাটিতে পরা ফুলদানির দিকে তানহা তাকিয়ে রইলো, অতঃপর ছল ছল দৃষ্টিতে ইলহামের দিকে তাকালো। ইলহাম দুই আংগুলের ফাকে কলম নিয়ে গালে হাত দিকে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইলহামের স্থির দৃষ্টি দেখে তানহা ভেতরে দপ দপ করছে। এই চাহুনি তার পরিচিত, এই স্থির দৃষ্টি ও তার খুব পরিচিত। তবে ঠিক মনে করতে পারছে না এই চাহুনি কেনো এতো তার পরিচিত।

ইলহাম স্থির কন্ঠে বললো, ” এটা কি করলেন। ”

তানহা ছল ছল চোখে বললো, ” ভুলে লেগে পড়ে গেছে। ”

” মেডাম এটা সরকারের সম্পত্তি। সরকারি কোন কিছু নষ্ট হলে জরিমানা দিতে হয় প্লাস দন্ড মানতে হয়। ”

দন্ড শব্দ শুনে তানহা ভয় পেয়ে গেলো। সিরিয়াল কিলার কে ধরতে এসে না জানি তার নিজেরই জেলের ভাত খেতে হয়, ভাবতেই তানহা ভয়ে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো, তানহা মিন মিন করে বললো,

” আপনি কি আমাকে জেলে দেবেন? ”

” জরিমানা পরিশোধ করুন, তার পর বাকি টা দেখা যাবে। ”

” কত টাকা জরিমানা হয়েছে? ”

” পাঁচ হাজার। ”

তানহা অবাক হয়ে বললো ” পাঁচ হাজার? ”

ইলহাম বাঁকা হেসে বললো “জ্বি।”

ধ্যাত পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ফুলদানি কেনো ফুলদানির গুষ্টি কেনা যাবে। ভুলে পড়ে গেলো ওমনি দাম বেরে গেলো। তানহা মাথা নিচু করে বললো,

” আমার কাছে এখন এতো টাকা নেই। ”

ইলহাম স্মিথ হেসে বললো,
” তাহলে ৪৮ ঘন্টা লকাপে থাকুন। ”

” আরে জরিমানা দেবো না না করেছি নাকি? ”

” ওকে দেন। জরিমানা দিন, বাকি কথা পড়ে। ”

তানহা বের হতে যাবে ঠিক তখনি ইলহাম বললো, ” একা কোথায় যাচ্ছেন। যদি আবার ফিরে না আসেন তখন? ”

তানহা বিরক্ত হয়ে বললো, ” ঠিক আছে । আপনি না হয় সাথে চলুন। ”

” সরকারি গাড়ি দিয়ে গেলে, তৈলের খরচ দিতে হবে।”

তানহা কিছু বললো না। চুপ চাপ এস. আই ইলহামের পিছু পিছু৷ হারুন রশিদ গাড়ি ড্রাইভ করছে পাশেই ইলহাম বসে আছে এবং পেছনেই তানহা। ইলহাম গাড়ির লুকিয়ে গ্লাসে বার বার তানহার দিকে আড় নজরে তাকাচ্ছে, হঠাৎ গাড়ি থামতেই দেখতে পেলো তানহা বাসার মোড়ে চলে এসেছে।

তানহাত হৃদপিণ্ড দপ দপ করে উঠলো। কারন ওনারা কিভাবে জানলো এটা তানহার বাড়ির রাস্তা….??

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here