#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya
পর্বঃ-২২
দিনটা শুক্রবার।
মুকুল সাহেব বেশ ফুর ফুরে মেজাজে বারান্দার গাছ গুলোতে পানি দিচ্ছেন৷ অনেক দিন পর তার মন টা বেশ ভালো। ভালো তো হবার-ই কথা কারন আজ তার বড় মেয়ে কে মানহা কে পাত্র পক্ষ দেখতে আসবে। তানহা হাতে এক কাপ চা নিয়ে, বারান্দায় এসে দাড়াতেই দেখলো বাবা মনোযোগ দিয়ে গাছে পানি দিচ্ছে, টেবিলে চায়ের কাপ টা রেখে বললো, ” বাবা চা এনেছি। ”
” ওহ চা? চায়ের কথা তো আমি ভুলেই গিয়েছিলাম। চা টা এনে ভালো করেছিস। ”
এক দমে বলে ফেললেন। তানহা ক্ষানিকটা অবাক হয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার জানা মনে বাবা কখনো এতো কথা এক বারে বলে না৷ হঠাৎ বাবার এই ক্ষুদ্র পরিবর্তন দেখে তানহা অবাক না হয়ে পারলো না। মুকুল সাহেব চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললেন,
” সব কাজ কর্ম কত দূর? ওনাদের আপ্যায়নে যাতে কোন ক্রুটি না থাকে বুঝলি তানহা?”
” বিকেলের আগে সব হয়ে যাবে বাবা। আমি আর রহিমা খালা অনেক টাই গুছিয়ে নিয়েছি কাজ কর্ম। ”
” ভেরি গুড৷ ” বলেই মুকুল সাহেব উঠে দাড়ালেন। কি যেনো মনে করে চায়ে কাপ হাতে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলেন। তানহা বাবার যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো। এতো দিন পর বাবা কে হাসি-খুশি দেখে তার ভীষণ ভালো লাগছে। সব সময় আপু সব কাজ সামলিয়েছে, এবার তার পালা, সে নিজেও তার বোনের জন্য কিছু করতে চায়, ভাবতে ভাবতে তানহা প্রফুল্ল মনে রান্না ঘরে চলে গেলো।
বেলা দশটা বাজে অথচ মানহা এখনো ঘর থেকে বের হয় নি। মানহা উবু হয়ে শুয়ে লাল সবুজ ডালিম গাছের দিকে এক পানে তাকিয়ে আছে৷ অতিরিক্ত কান্না করার ফলে চোখ দুটোর নিচে কালি জমেছে দু দিনেই মানহার পরিবর্তন চলে এসেছে। মানহা ফোনটা হাতে নিয়ে, ওয়াহাবের মেসেজ কনভারশনে ঢুকলো, গোলাপি-বেগুনি শার্ট ওপরে সাদা এপ্রোন, হলুদ ফর্সা চাহার চশমা বন্দি মায়াবী দুটো চোখ। মানহা একবার ওয়াহাবের ছবি স্পর্শ করতেই চোখ দুটো তার ঘোলা হয়ে গেলো,
কান্না জরানো কন্ঠে মানহা ফিস ফিস করে বললো, ” ভালো থেকো ডাক্তার সাহেব। তোমার ভবিষ্যতের জন্য শুভ কামনা। ”
বলেই পূর্নরায় স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। হয়তো তার কথা ওয়াহাবের কান অব্দি পৌছাবে না। হয়তো ওয়াহাব জানবে না এই ছোট্ট পাখিটা তাকে যে বড্ড ভালোবাসে…
মুকুল সাহেব হঠাৎ মানহার ঘরে ঢুকতেই অসস্থিতে পড়ে গেলেন, মানহা ওয়াহাবের ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। বিয়ের আগে এমনটা হয়, এই যুগে এই সব হয় বর কনে বিয়ের আগে একজন আরেক জন কে দেখে।
মুকুল সাহেবের স্পষ্ট মনে আছে পঁচিশ বছর আগের কথা যখন ওনার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো, বর্তমান যুগের মতো স্মার্ট ফোন, ছবি ছিলো না। তখন রেহানা কলেজে উঠেছে মাত্র, মুকুল সাহেব ঘন্টার পর ঘন্টা কলেজ গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো রেহানা কে এক নজর দেখার জন্য। এক সময় রেহানা কে মুকুল সাহেব স্ত্রী হিসেবে পেলো ঠিক-ই কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের কারনে তার স্ত্রীর পাশে নেই৷
ভাবতে ভাবতেই মুকুল সাহেব চশমাটা খুলে চোখ মুছে নিলেন। দরজায় টোকা দিয়ে বললেন…
” মানহা মানহা…”
মানহা তাড়া হুড়ো করে ফোনটা বালিশের তলায় রেখে বললো, ” হ্যাঁ হ্যাঁ বাবা। ভেতরে এসো..”
মুকুল সাহেব হাতে গোলাপি রঙের একটা শাড়ি নিয়ে মানহার রুমে প্রবেশ করলো। মানহা বাবার হাতের শাড়িটার দিকে তাকালো, অতঃপর বাবার দিকে জ্ঞিগ্যাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। মুকুট সাহেব মানহার দিকে শাড়িটা এগিয়ে দিয়ে বললেন,
” তোর মা যে বছর মারা,গিয়েছিলো সে বছর এই শাড়িটা তোর মায়ের জন্য কিনেছিলাম। তোর মা এতোটা-ই অসুস্থ ছিলো যে এই শাড়ি টা পড়তেই পারে নি৷ তুই তো দেখতে অবিকল তোর মায়ের মতো হয়েছিস, এই শাড়িটা পড়লে তোকেও রেহানার মতো লাগবে…”
মানহা শাড়ি টা হাতে নিয়ে বুকে জরিয়ে নিলো। আজ মা বেঁচে থাকলে বাবার মতো মা ও খুব খুশি হতো৷ ভাবতে ভাবতে মানহা বাবা কে জরিয়ে ধরে কেঁদে দিলো। মুকুল সাহেব পরম মমতায় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
—————————————————
বিকাল চারটা কি সারে চারটা বাজে। মুকুল সাহেব ফোন হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যে কোন সময় পাত্র পক্ষের লোক চলে আসবে। শেহতাজ বেগম মানহার রুমের যাবে বলে অগ্রসর হলেন, ঠিক তখনি তানহা দাদীকে ডাক দিয়ে বললো, ” দাদী তাড়াতাড়ি আপুর রুমে এসো। শাড়ি পড়াতে পারছি না। ”
শেহতাজ বেগম মানহার রুমে গেলো। মানহা ব্লাউজ পেটিকোট পড়ে দাঁড়িয়ে আছে, শেহতাজ বেগম হেসে বললো, ” পাত্র পক্ষ এলো বলে, আর তুই এখনো শাড়ি পরিস নি? এই অবস্থায় পাত্র পক্ষের সামনে যাবি নাকি?”
তানহা ফিক করে হেসে বললো, ” যদি তুমি আপু কে শাড়ি না পড়িয়ে দাও এই অবস্থায় -ই হবু দুলাভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দেবো৷ ”
মানহা কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ” তানহা তুই খুব
পেঁকে গেছিস। ”
তানহা চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো, তবে আগের মতো মিটি মিটি হাসি থামলো না। শেহতাজ বেগম মানহাকে,শাড়ি পড়িয়ে দিলেন। পেছন থেকে মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে বললেন,
” কি সুন্দর লাগছে আমার মানহা টা কে… “বলেই গালে হাত ছুইঁয়ে চুমু দিলেন। বসার রুমে লোক জনের শব্দের সবার ধ্যান ভাংলো। কারো বুঝতে আর বাকি রইলো না, পাত্র পক্ষের লোক জন চলে এসেছে।
তানহা দ্রুত রান্না ঘরে চলে গেলো, রাহিমা খালার সাথে নাস্তা রেডি করার জন্য। দাদী ক্ষানিক ক্ষন বসে থেকে, মেহমান দের কাছে চলে গেলেন।
মানহা রুমে একা বসে আছে, রুমময় ভাবসা গরমে মানহা ঘেমে একাকার, অথচ মাথার ওপরে ঠিকই সিলিং ফ্যান চলছে, মানহার ভীষণ অস্থির লাগছে। বার বার মনে হচ্ছে, কি যেনো নেই..কি যেনো নেই। বুকের বা পাশ টা কেনো এতো খালি খালি লাগছে তার…
ট্রে ভর্তি নাস্তা রেডি করে রহিমা খালার সাথে তানহা বসার রুমের টেবিলে খাবার রাখলো, ঠিক তখনি মুকুল সাহেব বললেন,
” আমার ছোট মেয়ে তানহা। ”
তানহা সবাই কে সালাম দিয়ে চলে আসতে যাবে ঠিক তখনি তার চোখ দুটো থমকে গেলো। সোফার এক কোনে এস.আই ইলহাম বসে আছে। তানহার দিকে তাকিয়ে মুচকি দিতেই তানহা চোখ চরক করে তাকিয়ে রইলো, তার মনে একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে, ইলহাম এখানে কেনো এসেছে। ইলহাম ব্যাতিত যুবক বয়সি আর কেউ নেই কেনো? পাত্র বা কোথায়? তাহলে এস.আই ইলহাম কি পাত্র? তা কিভাবে সম্ভব পাত্র তো ডাক্তার। ভাবতে ভাবতেই রুম থেকে মানহা বেরিয়ে এলো। তানিয়া জ্যুসের গ্লাস টা হাতে নিয়ে বললো, ” আংকেল ওয়াহাবের আমাদের সাথেই আসার কথা ছিলো, কিন্তু হঠাৎ ওর ইমারজেন্সি ওটি পড়েছে তাই আসতে পারে নি। ”
ওয়াহাবের মা গম্ভীর কন্ঠে বললো, ” তানিয়া আংটি তো আমরা বড়রাই পড়াবো৷ ওয়াহাবের থাকাটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না…”
মুকুল সাহেব কি বলবেন বুঝতে পারলেন না। শেহতাজ বেগম স্মিথ হেসে বললেন, ” তা ঠিক আছে। আপনি একটু নাস্তা খেলে..”
” ও সব না হয়। পড়ে হবে। আগে মানহা কে আংটি পড়াই..”
তানিয়া মায়ের কানে ফিস ফিস করে বললো, ” এমন করছো কেনো মা৷ উনি গুরুজন একটু মিষ্টি খেতেই পারতে। ”
শেহতাজ বেগম উঠে, মানহার রুমে চলে গেলেন। মুখে কিছু প্রকাশ না করলেও ওয়াহাবের মায়ের ব্যাবহারে খুব অবাক হলেন। মানহার রুমে ঢুকতেই শেহতাজ বেগম দেখতে পেলেন মানহা আনমনে, জানালার বাইরের দিকে তাকি আছে৷ মুখ ঘেমে একাকার,
” মানহা…”
” হুঁ।” বলেই দাদীর ডাকে সারা দিলো মানহা৷
” তোর এই অবস্থা কেনো?ঘেমে একাকার হয় গেছিস। তাড়াতাড়ি টিস্যু দিয়ে ঘাম মুছে নে। মেহমান দের সাথে দেখা করতে হবে তো…”
দাদীর কথা শুনে মানহার হৃদ স্পন্দন কয়েক গুন বেড়ে গেলো, ট্যিসু দিয়ে কোন মতে ঘাম মুছে নিলো, অতঃপর দাদীর পিছু পিছু বসার রুমে গেলো৷ সবাই কে সালাম দিয়ে, তাকাতেই তানিয়া, শিহাব, কুসুম বেগম কে দেখে চমকে উঠলো মানহা। পাশেই বসে আছে অপরিচিত এক যুবক দেখতে কিছুটা ওয়াহাবের মতো। মানহা এর আগেও তাকে দেখেছে, নাম টা ঠিক মনে পড়ছে না মানহার,
তাহলে ইনি কি পাত্র???
।
।
চলবে
সবাই কমেন্ট করবেন কিন্তু😒