শঙ্খচিল পর্বঃ-২৮

0
1533

#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya

পর্বঃ-২৮

সূর্যকে আড়ালে করে এক ঝাক মেঘের মেলা বসেছে আকাশ জুরে৷ গত রাত থেকেই শুরু হয়েছে কাল বৈশাখী ঝড়, তবে এখন আর ঝড় নেই তবে ঝিঁরি ঝিঁরি বর্ষণ রয়েই গেছে। তানহা হাতে একটা ছাতা নিয়ে মেইন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, একবার হাত ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে তো আরেক বার বাইরের বৃষ্টির দিকে। আজ মনে হয় আর কলেজে যাওয়া হবে না তার। পলাশী থেকে ধানমন্ডি যাওয়া এই বৃষ্টির মাঝে খুব কঠিন এমন টাও নয়। আর চার দিন পড় তার বড় বোনের বিয়ে নোটস গুলো আগে থেকেই বাসায় এনে রাখতে হবে তাকে৷ ভাবতে ভাবতেই তানহা ছাতা মেলে বেড়িয়ে পড়লো।
বাসার মোড়ে এসে কোন রিকশা পেলো না তানহা। বাধ্য হয়েই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মাঝে হাটা শুরু করলো তানহা।
হাটতে হাটতে তানহা পলাশি ছাড়িয়ে শাহবাগ চলে এলো, রাস্তায় মানুষের আনাগোনা কম, এক দল শিশু বৃষ্টিতে মোচড়ানো প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে খেলছে।

তানহা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাচ্চাদের খেলা দেখছে। তার উনিশ বছর জীবনে এভাবে কখনো বৃষ্টিতে ভেজা হয় নি। সত্যি শৈশবের স্মৃতিতে কতই না আনন্দ, আর শুখ। তানহার শৈশব টা একটু অন্যরকমই কেটেছে, তার মনে আছে ছোট বেলায় বেশির ভাগ সময় তানহা মায়ের জন্য কান্না কাটি করতো, বাবা বকবে সে ভয়ে কখনো বাবার কাছে মায়ের কথা বলতো না। দাদীর কাছে জিজ্ঞেস করলেও সে উত্তর দিতো না। তানহার বয়স ছিলো তখন মাত্র পাঁচ বছর, সে সময় মা দেখতে কেমন মায়ের বর্ননা পর্যন্ত তানহা মানহা জানতো না। তবে বাবার মুখে সে অনেক বারই শুনেছে তার মা দেখতে নাকি একে বারেই মানহা আপুর মতো। শৈশবের স্মৃতি গুলো সব সময় মনে গেঁথে থাকে।

” আপনি এখানে? ”

তানহা পেছনে তাকাতেই দেখলো ইলহাম ছাতা হাতে দাঁড়িয়ে আছে ক্ষানিকটা দূরেই পুলিশের গাড়ি রাখা। তানহা একটু অবাক হয়ে বললো,

” আপনি?”

” হ্যাঁ। আমি শাহাবাগ থানার অফিসার ইনচার্জ আমার এখানে থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি এখানে কি করছেন তা এই বৃষ্টিতে?”

” কিছু না। ”

ইলহাম সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ” আবার কার পিছু নিয়েছেন শুনি? আপনার তো আবার সাপের লেজে পা দেওয়ার অভ্যাস। ”

তানহা অবাক হয়ে বললো, ” আমি আবার কার লেজে পা দিলাম শুনি? ”

” কেনো জানেন না বুঝি? ”

” না। বলুন। ”

” ধানমন্ডি লেকে ভিডিও করতে গিয়েছিলেন কেনো? ওরা কারা জানেন? একবার পাবলিক লি যদি ভিডিও টা ভাইরাল হয়, আপনার জীবনে ঝুঁকি হয়ে যেতো। ”

তানহা শ্বাস ফেলে বললো, ” কি আর ভাইরাল হবে। আপনি তো সেদিন মলে দাঁড়িয়েই ডিলেট করে দিলেন। ”

ইলহাম তানহার দিকে তাকিয়ে শ্বাস ফেললো, সে দিন ভাগ্যিস মলে তানহা তার ছদ্দবেশে মাড়ামাড়ি করার ভিডিও টা ডিলেট করে দিয়েছিলো, লোক চক্ষুর সামনে পড়লে ঘটনা টা রটতে হয়তো খুব বেশি সময় লাগতো না।

” আপনি আমাকে হ্যাল্প করবেন কি না বলুন? ওই গুন্ডা বখাটে ছেলেটা আমাকে কতোটা মানুষীক টর্চার করেছে তা একমাত্র আমি জানি। যেভাবেই হোক আমি ওই খুনি, গুন্ডা লোকটাকে শাস্তি দেবোই। ” দাঁতে দাঁত পিষে কথা গুলো বললো তানহা।

ইলহাম অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো, হুট করেই তানহার চোখের কোনা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো৷ নিজের নামে এমন কথা শুনে ইলহাম আগের মতো বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো। তানহা তার নকল রুপ টাকে কতটা ঘ্রিনা করে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার নিজের সামনে। ভাবতেই অবাক লাগে, যদি তানহা তার আসল পরিচয় যেনে যায়, সেদিন ও কি ঠিক এভাবেই তাকি ঘ্রিনা করবে…

” আমাকে সাহায্য করবেন কি না বলুন? ”

ইলহাম তানহার দিকে তাকিয়ে বললো ” হুম। করবো। ”

” আমি জানতাম আপনি আমাকে হ্যাল্প করবেন..”

ইলহাম আড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ” আমাকে বিশ্বাস করেন? ”

” হুম।”

“তাহলে ওই লোকটার পিছু নিবেন না। ”

” কিন্তু কেনো? কেস টা যেহেতু আমাকে ঘিরে, সুযোগ থাকতে আমি প্রমাণ যোগার কেনো করবো না, এতে তো আপনারই হ্যাল্প হবে, ওই খুনি লোকটাও ধরা পড়বে৷ ”

” আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। ওই কিশোর ছেলেটা কোন সাধারণ মানুষ নয়, মাদক পাচারকারী ধর্ষক। দুদিন আগেই ওকে কোর্টে চালান করা হয়েছে। ”

” আর ওই গুন্ডা খুনি লোকটা, ওনাকে ধরতে পেরেছেন? ”

ইলহাম কপালে দু আংগুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে বললো, ” না। ওই ছেলেটাকে ধরতে পারি নি। ”

” শীট শীট! ” বলেই তানহা শব্দ করলো। যেনো, মাদক সাপ্লাই এবং ধর্ষক ছেলেটার চেয়ে গুন্ডা ছেলেটা ধরা পড়লেই সে বেশি খুশি হতো।

” আমি নিজে ওই লোকটাকে খুন করতে দেখেছি তাও আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনে। ”

ইলহাম হাতে হাত ভাজ করে বললো, ” আর কেউ দেখেছে,বা গুলির শব্দ শুনেছে? ”

” না৷ ”

” আইন প্রমাণ খুঁজে। না কোন সাক্ষি আছে না আছে প্রমান। না কেউ শব্দ শুনেছে। ”

বলেই ইলহাম বাথরুমের চলে গেলো। ক্ষানিক বাদে ফ্রেশ হয়ে আসতেই তানহা দেখলো, ইলহাম পোশাক বদলে সাধারণ টিশার্ট এবং ট্রাউজার পরে দাঁড়িয়ে আছে। ইলহাম তার নিজের টেবিলে বসতে বসতে বললো, ” চা খাবেন?”

তানহা উত্তরে কিছু বললো না।ক্ষানিকটা চুপ থেকে সে বললো, ” আমাদের বিল্ডিংয়ের পাশে কন্সট্রাকশনের কাজ চলছে, অন্য মেশিনের শব্দের কারনে মানুষ শুনতে পারে নি। আমি ওই গলির দু হাত দূরে ছিলাম তাই আমি শুনেছি। নিজের চোখে দেখেছি, নিসংশ ভাবে একটা মানুষ কে কি ভাবে খুব করতে পারে। প্রমান নেই আমার কাছে, কিন্তু আমি দু চোখ দিয়ে দেখেছি। ইলহাম আমার চোখের দিকে একবার তাকান..”

ইলহাম স্তব্ধ হয়ে তানহার দিকে তাকিয়ে রইলো। তানহার চোখের কার্নিশ লাল বর্ন ধারণা করেছে, তানহা কান্না করছে। হঠাৎ চোখের কোনা বেয়ে দু ফোটা পানি গাল বেয়ে পড়লো। তানহা আবার বলতে শুরু করলো, ” মানুষ চোখ দিয়ে যা দেখে তা কি এতো সহজেই ভুলে যেতে পারে?
লোকটা তুলে নিয়ে আমাকে জানে মেরে ফেলার ভয় দেখিয়েছে। মেন্টালি ডিপ্রেশনে পড়ে গেছিলাম আমি। আপনি আমার মানষিক কষ্ট টা বুঝবেন না এস.আই ইলহাম৷ ”
বলেই তানহা ব্যাগ টা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তানহা চলে যাচ্ছে, দরজা দিয়ে যখনি তানহা বের হতে যাবে ঠিক তখনি ইলহাম বললো…

” দাড়ান। ”

তানহা থমকে দাঁড়ালো। পেছনে ঘুরে তাকালো না। ইলহাম তানহার কাছে এসে দাঁড়ালো, পকেট থেকে ট্যিসু বের করে তানহার কাছে এগিয়ে দিলো, তবে তানহা ট্যিসু টা না নিয়ে হন হন করে বাইরে চলে গেলো। ইলহাম দাঁড়িয়ে রইলো, কিছু একটা ভেবে তানহার পিছু পিছু রওনা দিলো বাইরে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি পড়ছে, সে দিকে তানহার খেয়াল নেই, গাঁয়ের অর্ধেক টা ভিজে গেছে তার। চোখের নোনা জল বৃষ্টির ফোটার সাথে মিশে গেছে চেহারা জুরে।
তানহার ভীষণ চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু পারছে না। কি অদ্ভুত এখন কান্নাও পাচ্ছে না তার। রাস্তার এক পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছে তানহা, পেছনে চলন্ত বাসের হর্নের শব্দ যেনো তার কান অব্দি পৌঁছতে পারছে না। বাস টা হর্ন চালিয়েই যাচ্ছে, তানহা রাস্তা থেকে সরছে না। ইলহাম থানা থেকে বের হতেই দেখলো রাস্তা এক পাশে দিয়ে তানহা হেটে যাচ্ছে, বাসের সাইরেন বাজা শর্তেও সে সরে দাঁড়াচ্ছে না।

গাড়িটা কাছে আসার আগ মূহুর্তেই ইলহাম দৌড়ে তানহার হাত টেনে তানহাকে সরিয়ে নিলো৷ তানহা ব্যালেন্স হারিয়ে ইলহামের বুকে পরে গেলো৷ ইলহাম দু হাত মেলে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তানহা তার বুকে থেকে সরছে না। এমতা অবস্থায় সে কি করবে বুঝতে পারছে না। হঠাৎ তানহা শব্দ করে কেঁদে উঠলো।

ইলহামের প্রথম ভালোবাসা, অনামিকা মারা যাবার পর এই প্রথম বার কেউ ইলহাম কে জরিয়ে ধরেছে। হুট করে ইলহামের অনামিকার কথা মনে পরে গেলো, ছয় বছর আগের অতীত হুট করেই ইলহামের মন নাড়া দিয়ে উঠলো।
ইলহাম আলতো করে তানহার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। ভালোবাসা নামক অনুভূতিটা দ্বিতীয় বার সে অনুভব করছে। কি অদ্ভুত!
তানহা আগের মতোই কেঁদেই চলেছে। তানহা যখন জানবে ওই খুনি লোকটা আর কেউ না ইলহাম নিজেই, তাকে আর কেউ না ইলহাম নিজের তুলে নিয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিলো। তখন কি পরিনতি হবে, ভাবতেই ইলহাম হাতটা সরিয়ে নিলো। তখন থাকবে একরাশ ঘ্রিনা ঘ্রিনা…..


চলবে
কেমন হয়েছে জানাবেন সবাই। গঠন মূলক মন্তব্য আশা করছি।
হ্যাপি রিডার্স 🌹

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here