শঙ্খচিল পর্বঃ-২৯

0
1552

#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya

পর্বঃ-২৯

” চাচা আপনি ঔষধ গুলো কেনো ঠিক মতো খান না, বলুন তো? ”
ওয়াহাব চশমা টা ঠিক করে, প্রেসক্রিপশন লিখতে লিখতে সামনের চেয়ারে বসা বৃদ্ধ লোকের উদ্দেশ্য বললো। বৃদ্ধ লোকটা এক গাল হেসে বললো,
” ঔষধ খেতে আর ভালো লাগে না বাবা। ”

“তা বললে কি হবে চাচা। এবার ঔষধ কমিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু যে ঔষধ গুলো লিখে দিয়েছি মাস্ট খেতেই হবে৷ ”

বৃদ্ধের পাশে বসা যুবকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” চাচার খেয়াল রাখবেন। ঔষধ গুলো নিয়মিত কন্টিনিউ করলে চাচা সুস্থ হবে ইনশাআল্লাহ। ”

” জ্বি আচ্ছা। আজ তাহলে আসি। ”

ওয়াহাব বৃদ্ধের উদ্দেশ্য বললো, “ভালো থাকবেন চাচা। ”
বৃদ্ধ স্মিথ হেসে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। ক্ষানিক বাদেই আরেক জন দরজায় নক করলো,ওয়াহাব রোগী ভেবে প্রেসস্ক্রিপশনের পাতা উলটে বললো,
” ভেতরে আসতে পারেন। ”

ওয়াহাবের সামনে এসে কেউ দাঁড়ালো, ওয়াহাব তাকালো না। হাতের ইশারায় বসতে বললো, ওয়াহাব তার গলা থেকে থেটিস্কোপ খুলতে খুলতে বললো,
” আপনার সমস্যার বলুন? ”

” বুকের বা পাশে সমস্যা। ” পরিচিত কন্ঠ শুনে ওয়াহাব চমকে গিয়ে তাকালো। তার সামনে অতি পরিচিত এক রমনী বসে আছে, সে আর কেউ না তার প্রেয়সী মানহা।

হাল্কা বেগুনি রঙের শাড়ি বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা পানি লেগে গাড়ো ছাপ ধারণ করেছে। মানহার চোখে মুখে এখনো বৃষ্টির পানির ছিটা লেগে আছে। এলো মেলো কোকড়ানো চুল গুলো গালে কপালে লেপ্টে আছে।
চোখের নিচে কাজল লেপ্টে গেছে, শ্যাম বর্ন মুখে চোখের নিচে কালো দাগ হয়েছে। হয়তো রাত জাগার জন্য, নয় তো কাজল লেপ্টে যাবার কারনে। লিপস্টিকহীন ফ্যাকাসে ঠোঁট তবুও দেখতে বেশ লাগছে, মানহাকে । ওয়াহাবের মনে হচ্ছে, মানহার এই রূপ যে কোন পুরুষ মানুষ কে ঘায়েল করতে যথেষ্ট।
মানহা ওয়াহাবের দিকে তাকিয়ে আছে ওয়াহাবের কথা শোনার জন্য। ওয়াহাব তাকে পর্য্যবেক্ষন করছে, ভাবতেই মানহার একটু লজ্জা লাগছে। তবুও মানহা অধীর আগ্রহে বসে আছে, ওয়াহাব তাকে কিছু বলুন, সে শুনতে চায়…

হঠাৎ ওয়াহাব বললো, ” মানহা আপনি এখানে?”

” ভিজিট দিয়ে ভেতরে এসেছি। ”

” বুঝলাম।কিন্তু হঠাৎ? ”

” আমার অসুখ হয়েছে।”

ওয়াহাব অবাক হয়ে বললো, “অসুখ? ”

” হু। অসুখ। বুকের বা পাশে খুব যন্ত্রণা হয়। ”

ওয়াহাব মনে মনে হাসলো, অতঃপর বললো, ” আমি হার্টের ডাক্তার নই। আমি অর্থপেডিক্স স্পেশালিষ্ট। বাংলায় যাকে বলে হাড্ডির ডাক্তার। ”

মানহা কাতর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। ওয়াহাব আবার বললো, ” আপনাকে আমি হার্টের ডাক্তার রেফার করতে পারি…”

” না। আমি চাই আপনি আমার চিকিৎসা করুন। ”

” খুব সিরিয়াস ব্যাথা?”

” হু।”

ওয়াহাব দুষ্টুমি করে বললো,, তাহলে বোধহয় সার্জারী করতে হবে। ”

” করুন। মনে হচ্ছে আমি মারা যাচ্ছি প্রতিটা মূহুর্তে। কারো অভাবে। মরতে হলে একে বারেই মরতে চাই। ”

ওয়াহাব চমকে গিয়ে মানহার দিকে তাকিয়ে রইলো। ভেতরে ভেতরে হঠাৎ কেমন অপরাধী বোধ করতে শুরু করলো। মানহা দিকে মনো যোগী হয়ে তাকিয়ে রইলো। কিছু একটা ভেবে বললো,
” তাহলে এটা মনের রোগ। হার্টের রোগ নয়। ”

হঠাৎ মানহা হেসে উঠলো, ওয়াহাব পূর্নরায় অবাক হয়ে তাকালো,
” মনের রোগের কি কোন ঔষধ আছে?”

” না। ”

” কিছু কিছু ক্ষেত্রে আছে। ”

ওয়াহাব পালটা প্রশ্ন করলো, ” যেমন? ”

” আমার রোগ একজন সারাতে পারে। সে হলো আপনি। আপনিময় মনোরোগে ধরেছে আমায়। আপনাকে আমার চাই।”

ওয়াহাব অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। সত্যি মেয়েটা তার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। এই কথপোকথনের পরও কি ওয়াহাব মানহাকে সত্যিটা বলবে। নাকি ফিরিয়ে দিয়ে আগের মতো নাটক চালিয়ে যাবে..

ওয়াহাব আড় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, ” আর তিন দিন পর আপনার বিয়ে, আপনি কি ভুলে যাচ্ছেন?”

” না। আমি আপনাকে ভালোবাসি ওয়াহাব। আপনাকে..”

ওয়াহাব আগ্রহের বসে বললো,” আর যদি আমি না করি তো?”

মানহা কিছু বললো না। ছল ছল দৃষ্টিতে ওয়াহাবের দিকে তাকিয়ে রইলো। ওয়াহাব তাকে প্রত্যাখ্যান করলে সে কি করবে? এই প্রশ্নটা কেনো আগে তার মাথায় আসে নি। ভাবতে ভাবতেই মানহার চোখ দিয়ে টুপ করে অশ্রু গরিয়ে পরলো।
ওয়াহাব প্রেসস্ক্রিপশনে কিছু একটা লিখছে। মানহা মাথা নিচু করে বসে আছে, ওয়াহাবের উত্তরের জন্য। প্রেসস্ক্রিপশন টা এগিয়ে দিয়ে ওয়াহাব বললো,

” এখানে দুটো ঔষধের নাম লিখে দিয়েছি। এগুলো খেলে, ভালো ঘুম হবে, মাথা ঠান্ডা লাগবে। ”

মানহা প্রেসস্ক্রিপশন টা হাতে নিয়ে চুপ চাপ ওয়াহাবের কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো সাথে অজস্র অভিমান আর অভিযোগ নিয়ে।
হাস্পাতালের মূল ফটকে আসতেই মানহা দেখলো আগের মতোই বৃষ্টি হচ্ছে মুষলধারে। হঠাৎ মানহা বৃষ্টির মধ্যেই বেরিয়ে গেলো হাস্পাতাল থেকে।
অশ্রু গুলো মিশে যাচ্ছে বৃষ্টির জলের সাথে, চোখের কাগল লেপ্টে গেছে চোখের চারো পাশে। হাল্কা বেগুনি শাড়িটা ভিজে গাড়ো রঙ ধারন করেছে। মানহার খুব চিৎকার করতে ইচ্ছে করছে। মানহা নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না ফুটপাতের এক কোনে বসে চিতকার করে কান্না শুরু করলো। কেউ শুনলো না তার কান্না, কেউ শুনলো না তার আহাজারি।
মেঘলা আকাশের মতোই ভারি হয়ে গেছে তার অভিমান।

————————————————–

মাথার ওপরে সিলিং ফ্যান চলছে, ইলহাম হাত পা মেলে বিছানায় শুয়ে আছে, তার বাম হাতে দুই আংগুলের মাঝে জ্বলন্ত সিগারেট৷
ইলহাম সিগারেট টা ঠোঁটের মাঝ খানে রেখে পোড়া তামাকের ধোঁয়া টেনে নিলো।
চোখের পলক ফেলতেই হঠাৎ তানহার মুখ খানা ভেসে উঠলো। হলুদ ফর্সা, গোলাপি চুড়িদার আর ঠোঁটের হাল্কা গোলাপি লিপস্টিক। ঠিক যেনো তার অনামিকা। অবশ্য অনামিকা তানহার মতো হলুদ ফর্সা ছিলো না, অনামিকা ছিলো উজ্জ্বল শ্যামলা, গোলাপি রঙে অনামিকার ভীষণ পছন্দ ছিলো, তাই অনামিকা বেশির ভাগ সময়ই গোলাপি চুড়িদার, গোলাপি শাড়ি, গোলাপি লিপস্টিক দিতো।

হঠাৎ আংগুলে জ্বালা অনুভব করতেই ইলহামের ধ্যান ভেংগে গেলো। সিগারেট পুড়ে ছাই হয়ে গেছে অথচ সে এতোক্ষণ টেরই পায় নি।
একটা সিগারেটে ইলহাম তৃপ্তি অনুভব করলো না৷ তাই দ্বিতীয় বার আরেক টা সিগারেট জ্বালালো। চোখ বুজে শুয়ে রইলো, গতো চার দিন ধরে ইলহাম ঘুমায় না। আজ হঠাৎ চোখটা বুজলেই তানহার মুখটা তার চোখের সামনে ভেসে আসছে, ইলহাম কে জরিয়ে ধরে কান্না করার পর থেকেই এমন টা হচ্ছে। ইলহাম মনে মনে ভাবছে, তানহা যদি আরো কিছুক্ষণ তাকে জরিয়ে ধরে থাকতো, হয়তো আরো কিছুক্ষণ শান্তি অনুভব করতে পারতো সে।
ধ্যাৎ কি ভাবছে সে, আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের জীবন আর তার জীবন এক নয়, তার জীবনের মূল লক্ষ্য কোবড়া কে ধরা৷ এই একটা লক্ষ্যেই সে পুলিশ হয়েছে, যেই পর্যন্ত ব্লাক কোবড়া কে ধরতে না পারবে সে পর্যন্ত তার শান্তি নেই। অনামিকার খুনি কে সে ফাঁসির দড়িতে ঝুলাবে আর নয়তো ইনকাউন্টার করবে, তাতে চাকরি চলে গিয়ে শাস্তি হলেও তার কোনো আফসোস নাই। তার লক্ষ্য তো পূরণ হবে।

ভু ভু শব্দে ইলহাম চোখ মেলে তাকালো। পাশেই তার ফোন বাজছে, ফোনটা হাতে নিতেই সে দেখতে পেলো হারুন রশীদ কল দিয়েছে। ইলহাম চোখ ডলতে ডলতে বললো,
” হ্যাঁ বলো হারুন!”

” স্যার আপনার ঘুমের ডিস্টার্ব করলাম.. ”

” আমি ঘুমাই নি৷ শুয়ে ছিলাম। এখন বলো কি খবর.. ”

” কালকে সকাল দশটায় ছেলেটাকে কোর্টে চালান দেয়া হবে। আপনি আলামত উদ্ধার করেছেন, আপনার সাক্ষি বয়ানের রেকর্ড সব কোর্টের সাবমিট করা হয়ে গেছে স্যার৷ ”

” সকাল নয় টায় কোর্টে থেকো হারুন। ”

” ওকে। শুভ রাত্রি স্যার। ” বলেই হারুন ফোনটা কেটে দিলো।

জানালার পাশে দাঁড়িয়ে ইলহাম ভাবছে, রাত কি ভাবে শুভ হতে পারে…


চলবে
কেমন হয়েছে জানাবেন সবাই। ধন্যবাদ 🌹

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here