#শঙ্খচিল
#Ruhi_Jahan_Maya
পর্বঃ- ৫৩
বারান্দায় দাঁড়িয়ে ইলহাম সিগারেটের ধোঁয়া উড়াচ্ছে এবং আকাশ পানে তাকিয়ে আনমনে কিছু একটা ভেবে চলেছে। হঠাৎ পেছনে কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ইলহাম সতর্ক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। মানহা ইলহামের কাধে হাত রাখতেই ইলহাম ঝট করে পেছনে তাকালো, মানহা চমকে গিয়ে বললো,
” কুল কুল আমি আসামি নই। এভাবে তাকাবেন ভাইয়া। ”
মানহা কে দেখে হন্ত দন্ত হয়ে ইলহাম সিগারেট টা দ্রুত ফেলে দিয়ে বললো, ” ভাবি তুমি৷ ”
মানহা স্মিথ হেসে বললো ” হ্যাঁ আমি। আপনি যে ধূমপান করেন আমি জানি। ”
ইলহাম একটু লজ্জা পেলো। মানহা বললো, ” লজ্জা পেতে হবে না। ডিনার করেন নি ভাইয়া। চলুন আপনাকে খাবার বেরে দেই৷ ”
ইলহাম গিয়ে খাবার টেবিলে বসলো। ক্ষানিক বাদে ওয়াহাব ও ইলহামের সাথে বসলো, মানহা ভাত, মাছ বেড়ে দিলো, ইলহাম ভাত খেতে শুরু করলো৷ মানহা বসতে বসতে বললো, ” ইলহাম ভাইয়া আপনাকে আমার কিছু বলার আছে। ”
ইলহাম চমকে গিয়ে বললো, ” কি কথা ভাবি? ”
” তানহা আপনাকে পছন্দ করে, আপনি জানেন নিশ্চয়ই? ”
” হ্যাঁ জানি। তবে তানহা কে আমি ভালোবাসি না।”
” তানহা কি দেখতে খারাপ নাকি চারিত্রিক ভাবে কোন ত্রুটি আছে?”
ইলহাম শ্বাস ফেলে বললো ” কোন ত্রুটি নেই ভাবি৷ আমি জানি তানহা ভালো মেয়ে। বরং আমি-ই সভাব সুলভ খারাপ। ”
” ছোট থেকে তানহা আমার থেকেও বেশি শান্ত শিষ্ট, কথা কম বলা একটা মেয়ে৷ ও খুব রক্ষনশীল। আমার বোন বলে সাফাই দিচ্ছি না ভাইয়া, তানহা যেমন আমার বোন আপনিও আমার ভাই। আমার ধারণা ওর মতো রক্ষনশীল মেয়ে আপনার লাইফে এলে আপনি অসুখী হবেন না। আমি চাই আমার মা হারা বোনটা তার পছন্দের মানুষ টাকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পাক।”
ইলহাম চুপ করে, খাবার চিবুচ্ছে এবং মনোযোগ দিয়ে মানহার কথা শুনছে। মানহা কিছুটা আকুতির স্বরে বললো, ” প্লিজ তানহার কথাটা একবার ভেবে দেখবেন। ”
ইলহাম মানহার দিকে তাকালো মূহুর্তেই তার তানহার কথা মনে পড়লো, তানহার সাথে প্রথম কথা বলা, সেই গোলাপি ঠোট, গোলাপি কুর্তি পড়া, পিট পিট করে কথা বলা। জ্বরের তোপে ইলহামের হাত চেপে ধরা, ইলহামে প্রতি রাগ, সব কিছু মনে বার বার নড়া দিচ্ছে। ইলহাম খাবার শেষ করে কিছু না বলেই রুমে চলে গেলো।
” ইলহামের মতো একটা ছেলের প্রেমে পড়তে পারে কেউ?”
মানহা ওয়াহাবের দিকে তাকিয়ে বললো, ” পারে৷ অবশ্যই পারে। ভালোবাসা জিনিস টাই এমন। কখন কার প্রতি সৃষ্টি হয়, বুঝা বড়ই মুশকিল। আমাদের দেখা হওয়া টা কত অদ্ভুত ছিলো তাই না?”
ওয়াহাব মুচকি হেসে বললো, “হুম। ইমারজেন্সি থেকে বের হয়ে আনমনে আপনার দিকে তাকিয়ে ছিলাম, মন টাকে আর ফেরাতে পারি নি। ”
মানহা লজ্জায় অন্য দিকে তাকিয়ে মনে মনে হাসলো।
——————————————–
তানহা গত রাতে টেনশনে ঘুমাতে পারে নি, না পেরেছে পড়ায় মনোযোগ দিতে। গত কাল রাতে বাবা বাড়ি ফিরে নি, ফোনটাও রিসিভ করে নি।
শেহতাজ বেগমের ছেলের চিন্তায় প্রেসার বেড়ে গেছে। তানহা না পড়তে বসতে পারছে না পারছে চিন্তা মুক্ত হতে। আর ক্ষানিকটা সময় বাদেই সে পরিক্ষা দিতে যাবে। দাদী কে বা সামলাবে কে, তানহা সৃষ্টি কর্তার নাম ডেকে যাচ্ছে। বাবা যেনো ঠিক ঠাক থাকে। অনেকটা চেষ্টা করেও তানহা দাদী কে কিছু খাওয়াতে পারলো না।
তানহা একবার ঘড়ির দিকে তাকালো, আটটা পঞ্চাশ বাজে, তানহা দ্রুতো রেডি হতে গেলো৷ রেডি হয়ে রহিমা খালার ওপর দাদীর দ্বায়িত্ব দিয়ে, তানহা না খেয়েই বেড়িয়ে পড়লো।
পরিক্ষা শেষ হবার আর আধা ঘন্টা বাকি, তানহার মাথা ভীষণ ঝিম ধরেছে, চোখ দুটো ডলে তানহা আবারো লেখায় মনোযোগ দিলো। শেষ কয়েক মিনিট তানহা চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলো। ঘন্টা পড়তেই তানহা খুব কষ্টে ক্যান্টিনে এলো৷ দুটো সমুচা আর পানির অর্ডার দিতেই তার বাবার কথা মনে পড়লো। এক্সাম হলে, ফোন নেওয়া নিষেধ তাই সে তোর ফোনটাও আনে নি।
তানহা তার হাত ঘড়িটার দিকে তাকালো, ধ্যত কেনো যে, খাবার অর্ডার দিলো৷ এখন আরো কিছু ক্ষন এখানে বসে থাকতে হবে৷ তানহা বিল দিয়ে সমুচা, এবং পানির বোতল হাতে নিয়ে বেড়িয়ে এলো। খুব বেশি ভীর না থাকায় তানহা খুব সহজেই রিকশা পেয়ে গেলো।
সমুচা খেয়ে পানি পান করার পর, মাথা ঝিমুনি অনেক টাই কমে গিয়েছে। তানহা ঘন ঘন হাত ঘড়িটার দিকে তাকাচ্ছে, দাদীর শারিরীক অবস্থা কেমন তা-ও সে জানেতে পারে নি।
রিকশার শাহবাগ পেরিয়ে বুয়েটে ক্যাম্পাস ধরে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মানুষের সোর গোল শুনে তানহা তাকাতেই দেখলো একটা গাড়ি দেয়ালের সাথে ধাক্কা খেয়ে ভেতর থেকে ধোঁয়া বের হচ্ছে হয়তো ইঞ্জিন ব্লাস্ট হয়ে গেছে৷ ফায়ার সার্ভিস গাড়ি ভাংগার চেষ্টা করতে গাড়ির দরজা খুলতে সক্ষম হলো। তানহা রিকশাটা থামিয়ে দিলো, রিকশা থেকে নেমে সামনে এগুতে শুরু করলো, তার মন ভীষণ ছট ফট করছে গাড়ির ভেতরের মানুষ কে দেখার জন্য৷
তানহা মানুষের ভীর ঠেলে সামনে এগুতেই সাদা কাপড়ে, ঢাকা আধ পোড়া লাশ টা দেখতে পেলো।
হাত টা বের হয়ে আছে৷ তানহা ঢোক গিলে খেয়াল করে তাকিয়ে দেখলো মৃত লোকটার হাতে তার বাবার মতোই সবুজ, এবং সাদা পাথরের আংটি। কয়েক মূহুর্তের জন্য তানহার ভেতটা মোচড় দিয়ে উঠলো। তানহা কাঁপা কাঁপা হাতে কাপড়টা সরাতেই চিৎকার দিয়ে উঠলো। চেহারা, শরীরে অর্ধেক অংশ পুড়ে গিয়েছে তবে পড়নে গতকালের আধ পোড়া শার্ট আর আংটি প্রমাণ করে দিচ্ছে, তার সামনে তার বাবাই শুয়ে আছে৷ তানহার মাথাটা ঘুর পাক খাচ্ছে, তার শরিরের শক্তি ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। তানহা চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।
কিছুটা দূর থেকেই স্তব্ধ হয়ে ইলহামে সব কিছুই দেখছ ছিলো। তানহা মস্তিষ্ক বাবার মৃত্যুর ব্যাপারটা নিতে নিতে পারে নি। তাই সে জ্ঞান হারিয়েছে। ইলহাম তানহার কাছে গেলো, তানহা কে পাঁজা কোলে নিয়ে গাড়ির সিটে শুইয়ে দিলো। অতঃপর দ্রুত ফায়ার সার্ভিস কে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার নির্দেশনা দিলো।
ইলহাম আগে থেকেই জানে লাশটা মুকুল সাহেবের, তাই শাহবাগ থানা থেকে মুকুল সাহেবের মৃত দেহ সোজা মানহাদের বাড়ি গেলো। যেতে যেতে ইলহাম ওয়াহাব কে মৃত্যু সংবাদ জানালো।
———————————————–
মেডিক্যাল ক্লাস শেষে মানহা বাড়ি ফিরেছে মাত্র। ব্যাগ টা টেবিলে রাখে মানহা বিছানায় বসলো, ঠিক তখনি ওয়াহাব হন্ত দন্ত হয়ে রুমে ঢুকলো। ভর দুপুরে মানহা ওয়াহাবে কে দেখে ক্ষানিকটা অবাক হয়ে বললো,
” ওয়াহাব আপনি এই সময়? সব কিছু ঠিক আছে তো? ”
ওয়াহাব জরানো কন্ঠে বললো, ” না ঠিক নেই। ”
” কি হয়েছে ওয়াহাব, আপনাকে এমন লাগছে কেনো? বলুন? ”
ওহাব শুকনো ঢোক গিলে বললো, ” বাবা আর নেই মানহা। আজ সকালে উনি পলাশি রোডে এক্সিডেন্টে করেছেন। ”
মানহা অস্ফুট স্বরে বললো, “কিহহ।” বলেই ধপ করে বসে পড়লো। ভেতর টা মরুভূমির মতো শুকিয়ে আসছে৷ কলিজাটা বার বার মোচড়াচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ হাতুড়ি দিয়ে বুকে আঘাত করছে। মানহা চিতকার দিতে পারছে না, ভেতরটা যেনো শূন্য হয়ে গেছে।
ওয়াহাব মানহাকে বুকে চেপে নিলো। বাবা হারানোর শোকটা মানহা নিজের মধ্যে দমিয়ে রাখতে পারলো না। চিৎকার দিয়ে কান্না শুরু করলো।
।।।।।।
কিছুক্ষণ বাদে জানাযার জন্য মুকুল সাহেবের মৃত্য লাশ নিয়ে যাওয়া হবে। শেহতাজ বেগম পাগলের মতো ছট ফট করে কেঁদেই চলেছেন। আর কিছুক্ষণ বাদেই তার কলিজার টুকরা ছেলেটাকে নিয়ে যাবে। পাশেই মানহা বাক রুদ্ধ হয়ে বসে আছে, চোখ দিয়ে অনরগল পানি বেয়ে পড়ছে।
তানহা জোড়ে শ্বাস নিয়ে চিতৎকার দিয়ে উঠলো। রহিমা খালা খালা তানহাকে জাপটে ধরে কান্না করতে লাগলেন। তানহার মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
” শেষ বার মুকুল ভাইরে দেইখা লও। মুকুল ভাইরে মাটি দিতে নিয়া যাইবো। ”
তানহা বলহীন মানুষের মতো বাবার মৃত দেহের কাছে এলো, গত কালই তো বাবার তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো আজ বাবা নেই, শেষ বারে মতো বাবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই তানহা চমকে উঠলো, কারন এক সপ্তাহ আগেই তানহা তার বাবার চুলে কালো কলব/রং লাগিয়ে দিয়েছিলো। বাবার চুল লাল কিভাবে হবে? এতো দ্রুত রঙ উঠবে বা কিভাবে? তানহার ভীষণ অদ্ভুত লাগছে…
ইলহাম ফিস ফিস করে ওয়াহাব কে বললো, ” ভাইয়া মাগরিবের আজানের সময় হয়ে গেছে৷ আংকেলের মৃত দেহ এবার মসজিদে নিয়ে যেতে হবে। ”
ইমাম সাহেব, মুখটা ঢেকে দিলেন। রহিমা খালা তানহাকে সরিয়ে নিয়ে এলো। মুকুল সাহেবের মৃত দেহ মসজিদে নিয়ে যাওয়া হলো। মানহা তানহা বাবার বিদায়ের পানে তাকিয়ে রইলো।
তানহার মনে প্রশ্নটা হয়েই গেলো, এক সপ্তাহ মধ্যে কিভাবে চুলে রঙ উঠে যেতে পারে, আর যদি ওঠেও তাহলে চুল সাদা না হয়ে লাল কেনো হবে?
।
।
চলবে
গল্প লিখতে বসে আমি কখনো কাঁদি নাই তবে আজ কেনো জানি না খুব খুব কান্না পেলো। মানহা, তানহার জায়গায় আমি নিজেকে অনুভব করলাম।