কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ পর্ব-২৫

0
339

কখনো রোদ্দুর কখনো মেঘ
পর্ব ২৫
____________________
১।
ছয় মাসেরও বেশি সময় হয়ে গেছে স্নেহা শ্বশুর বাড়িতে এসেছে। এখন বাড়ির সব কিছুই নখদর্পণে। পুরনো সমস্ত অতীত ছাই হয়ে উঠেছে। বর্তমানকে ঘিরে জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু করেছে। পাহাড়ি এলাকায় সকালে একটু বেশি শীত রয়েছে।আজ কোনো কারণে স্নেহা একটু বেলা করে বিছানা ত্যাগ করেছে। তাড়াতাড়ি করে নিজের সমস্ত কাজ শেষ করার চেষ্টা করলো। শ্বশুর-শাশুড়িকে চা দিয়ে এসে উৎপলের জন্য টিফিন তৈরিতে লেগে পরল। এক্ষুনি টিফিনের জন্য চেঁচামেচি শুরু করবে। অফিসের বেলাও হতে যায়। তাড়াহুড়ো করতে রইল। এমন সময় কলিংবেলের শব্দ শোনা গেল। বিরক্ত হলো। এই অসময় আবার কে আসলো? ‘দাড়াও আসছি’ বলার পরও বাইরের মানুষটা কলিংবেল বাজানো বন্ধ করলো না। একনাগাড়ে বাজিয়ে গেল। সকাল সকাল কে বিরক্ত করছে কিছুই বুঝতে পারলো না। মনে মনে দু-একটা বকুনিও দিল। শাশুড়ি নিজের ঘর থেকে বলে উঠলেন,”বৌমা, একবার গিয়ে দেখো, কেউ এসেছে মনে হয়।” স্নেহা কোনো উত্তর করলো না। একটাই তো মানুষ কত কী সামলাবে!নিজে চুপচাপ বসে রয়েছে। উঠে গিয়ে সামান্য দরজা খুলতে পারছেন না। বিরক্ত মুখে শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখের ঘাম মুছতে মুছতে দরজার কাছে পৌঁছল। দরজা খুলতেই আনন্দ, প্রফুল্ল,ভয়,উচ্ছ্বাস, কৌতুহল সবকিছুই হৃদয়ে একসঙ্গে জেগে উঠলো। তার বিশ্বাস হচ্ছে না, ছোটবেলার বন্ধু গুলো তাকে খুঁজতে খুঁজতে তার বাড়িতে পৌঁছে গেছে। চোখে প্রায় জল এসে গেল। উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,”তোরা!”
“কেন?আসতে পারি না বুঝি!” আকাশ হেসে জবাব দিল।
“তুই চুপ কর তো। তোর সব কথায় ফোড়ন কাটা স্বভাব এখনো যায়নি।”
“বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? ভেতরে আয়।”
আকাশ নিলেশ টিকলি তিনজন হাসিমুখে বাড়ির ভেতরে ঢুকলো। তাদের সাথে সাথে একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়েও এলো। মেয়েটিকে চিনতে অসুবিধা হলো না। তিন বছর আগেই জানতে পেরেছিল টিকলির একটা মেয়ে হয়েছে। এতদিন দেখার সৌভাগ্য হয়নি, তবে চিনতে অসুবিধা হলো না। বাড়িতে ঢোকার আগেই তাকে কোলে তুলে নিল স্নেহা। ভারী মিষ্টি মুখখানা। মাথায় ছোট ছোট চুল। গলায় কালো রশি দিয়ে কবজ বাঁধা। দুই হাতে দুটো তামার চুড়ি।তবে বাচ্চাটা বড্ড রোগা। কোলে নিতেই বুকটা ধুকপুক করে উঠলো। শুধুমাত্র সন্তানের জন্য জীবনে বড় একটা সিদ্ধান্ত নিতে একটুও ভেবে দেখেনি। বেশিরভাগ মেয়ের স্বপ্নের শব্দ ‘মা’, এ শব্দটি শোনার জন্য কত বড় সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। বাচ্চাটাকে কোলে নিতেই পুরনো কথা মনে পড়ল। স্নেহা দ্রুত মাথা থেকে সবকিছু ঝেড়ে ফেলল। পুরনো কোনো কিছু মনে করতে চায় না। বাচ্চাটা এক মুহূর্তের জন্যও স্নেহার কোলে রইল না। মায়ের দিকে দুই হাত বাড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। ওদিকে ঘর থেকে শাশুড়ি বেশ জোর গলায় বললেন,”কে এলো বৌমা।”
“গ্রাম থেকে আমার বন্ধুরা এসেছে।” জোর গলায় জবাব দিল স্নেহা।
“আচ্ছা ওদের উপরে নিয়ে যাও।” স্নেহা কোনো জবাব দেওয়ার আগেই নিলেশ বলে উঠলো,”কি রে? আসতে না আসতে আমাদের উপরে পাঠিয়ে দিচ্ছে কেন? নিচে থাকলে অসুবিধা কোথায়?”
“অহ! তুই এসেই শুরু করেছিস। আমাকে তো অন্তত একটু বলার সময় দে।”
“আচ্ছা এবার বল।” নিলেশের কথা বলা এবং হাতের ভঙ্গি দেখে সবাই হেসে উঠলো। এই হাসিতে যোগ দিল না স্নেহা। নরম গলায় বলল,”আমার শ্বশুরমশাই ভীষণ অসুস্থ। তিনি হার্টের রোগী। এখানে বেশি চেঁচামেচি করিস না উপরে চল। ওখানে যা পারবি করবি কেউ কিছু বলবে না।তার আগে একবার শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করে আয়।” আর কেউ বেশি কথা বলল না। সবাই স্নেহার শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে দেখা করার পর সিঁড়ি ভেঙ্গে ওপরে উঠতে রইল। পেছনে রইল স্নেহা আর টিকলি। টিকলিকে আপাদমস্তক দেখে স্নেহা বড্ড অবাক হলো। তার চেহারার অবস্থা বড় বেদনাদায়ক। পূর্বে গোধূলি বেলার মত সুন্দর ছিল।আর এখন তার অবস্থা..। যেন অনেক গুলো রাত না খিয়ে না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। চোখেমুখে করুন ছাপ। অল্প বয়সে চুলে জট ধরেছে,দু-একটা পেকেও গেছে। গায়ের চামড়া পুড়ে তামাটে হয়েছে। চোখগুলো ভেতরে ঢুকে গেছে। মুখে দু’তিনটে ব্রণ বেরিয়েছে। তার দিকে চেয়ে বলল,”তোর এ কি অবস্থা হয়েছে? খাসনি না কি?” টিকলি তার দিকে তাকিয়ে হাসি বিনিময় করে বলল,”কই?আমার কি হয়েছে? আমি তো ঠিকই আছি।”
“আয়নায় নিজের মুখ দেখে বলছিস -না,না দেখে বলছিস?”
“ওও, তুই আমার শরীরের কথা বলছিস? ও কিছু না রে। বছর দুয়েক আগে সুমি হলো তাতেই শরীর অনেক ভেঙ্গে গেছিল। তারপর বাড়িতে অজস্র কাজ।”
“দুনিয়ায় তুই একা মা হয়েছিস আর তো কেউ হয়নি। আর কারোর বাড়িতে তো কোনো কাজ নেই, শুধু তোর একার কাজ রয়েছে।”
“তোর বাড়িতে এলাম কোথায় একটু ভালো মন্দ কথা বলবি। তা না করে শাশুড়ির মত কথা শুনিয়ে যাচ্ছিস।” স্নেহা কোনো জবাব দিল না। নিরুত্তর রইল। এতক্ষণে দুজন সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে চলে এসেছে। উপরে এসেই স্নেহা বলল,”তোরা কি ট্রেনে এলি? না মানে এত সকালে তাই জিজ্ঞেস করছি।”
“হুম, আমরা রাতের ট্রেনে এসেছি।”
“তা কি মনে করে আসা হলো শুনি? ভুলেই তো গেছিলিস। ফোন টোন আর করিস না।”
“একমাস মত হল বাপের বাড়িতে এসে রয়েছি। তোকে দেখার ইচ্ছে হলো। একা এতদূর আসতেও পারবো না। তাই ওই দুটো বাঁদরকে বললাম। ওরাও রাজি হয়ে গেল।”
“ভাইকেও নিয়ে আসতে পারতিস। ওকে রেখে এলি কেন?”
“বলেছিলাম তো। কিন্তু আসতে চাইল না।”
উপরে হল ঘরে পৌছে স্নেহা আর টিকলি দুজনেই অবাক হলো। কথা বলতে গিয়ে উভয়ই উপরে পৌঁছাতে একটু দেরি করে ফেলেছে। ইতোমধ্যেই, নিলেশ উৎপলের সঙ্গে বেশ জাঁকজমক ভাবে গল্প করতে শুরু করে দিয়েছে। যেন তারা পূর্ব পরিচিত।অথচ এর আগে তাদের কখনো কথা হয়নি। দেখাও তেমন একটা হয়নি। বিয়ে বাড়িতে যেটুকু হয়েছিল সেটুকুই। নতুন অজানা বাড়িতে এসেছে একটু ভয় কিংবা লজ্জা তার চোখে-মুখে নেই। অন্যদিকে আকাশ একটু ভয় পেয়ে রয়েছে। উসখুস বোধ করে চুপচাপ বসে রয়েছে। কোনো কথা বলছে না। তাদেরকে সহজ-সরল ভাবে মিশতে দেখে খুব ভালো লাগলো। টিকলি তাড়াতাড়ি পাশে ব্যাগটা রেখে জামাইবাবুকে প্রণাম করলো। তারপর স্নেহাকে। যতই হোক তারা বয়সে বড়। সম্মান দেওয়া তার কর্তব্য। তার দেখাদেখি আকাশ আর নিলেশও প্রণাম করলো। কিন্তু নিলেশ স্নেহাকে প্রণাম করতে গিয়েই হেসে ফেললো। হাসতে হাসতে বলল,”তোকে প্রণাম না করলে হবে না?” স্নেহা তাড়াতাড়ি ঠোঁটে আঙ্গুল ঠেকিয়ে চুপ করতে বলল। কিন্তু ততক্ষনে যা হওয়ার হয়ে গেছে। সবাই হো হো করে হেসে উঠলো। স্নেহাও না হেসে পারলো না। নিলেশ হাসিমুখে বলল,”বয়সে বড় তো কি হয়েছিস বন্ধু তো। বন্ধুকে প্রণাম করে নাকি!” কিছুতেই প্রণাম করল না। উঠে গিয়ে সোফায় বসল। নিলেশের ব্যবহার সবাই মজা হিসেবে নিলেও স্নেহা মজা হিসেবে নিল না। তার অস্বস্তি হলো। নিলেশ আত্মীয়র বাড়িতে এসেছে, এমন মজা করা উচিত নয়। উৎপল কখনো কিছু বলবে না নিশ্চিত। সবকিছু মজা হিসেবে নিয়েছে। কিন্তু তার শাশুড়ি মজা হিসেবে নেবে না। মুখের উপর কথা বলে দেবে। তখন সবারই খারাপ লাগবে। এমন মুহূর্ত নষ্ট হবে। স্নেহা কথা এড়িয়ে গেল। বলল,”তোরা একটু বস। আমি ওর জন্য খাবার তৈরি করি। অফিস যাওয়ার সময় হয়ে গেছে।”
“আরে দাঁড়াও। খাবার বানাতে হবে না। এখানে বসতো। এদের সাথে গল্প করো। আমি আজকে অফিস যাব না।” এগানো পা পিছিয়ে নিল স্নেহা। একটু অবাক হয়ে বলল,”মানে? কাজে যাবে না কেন?”
“তোমার বন্ধু বান্ধবীরা এসেছে তাদেরকে রান্না করে খাওয়াবে কখন শুনি‌?একা পারবে না তুমি। তাছাড়া অনেকদিন পর দেখা হল।তাদের সঙ্গে গল্প করো ভালো লাগবে। তারা কি প্রত্যেকদিন আসবে? সবাই মিলে মিসে আনন্দ হৈ-হুল্লোড় করব। একদিন অফিস না গেলে কিছু হবে না।” স্নেহা বড্ড খুশি হলো। এই মানুষটা তাকে সব সময় আগলে রেখেছে। কোনো কিছুতে অভাব রাখেনি। এই একমাত্র মানুষই বন্ধু স্বামী প্রেমিক সবকিছুতেই পারফেক্ট। সবার সামনে বউয়ের প্রতি এমন ভালোবাসা দেখাতে গিয়ে একটুও লজ্জা পেল না উৎপল। বরং লজ্জা পেল স্নেহা। মাথা নিচু করে হাসতে রইল। নিলেশ হাসিমুখে বলল,”আরে জামাইবাবু সাব্বাস। কি প্রেম গো তোমাদের। মুগ্ধ হয়ে গেলাম।”
“এই তুই চুপ কর তো। শুধু বকে যাচ্ছিস।” স্নেহা লজ্জা পেয়ে সেখান থেকে চলে গেল। সবার জন্য শরবত বানালো।
শরবত খাওয়ার পর সবাই একসঙ্গে বসে দীর্ঘ সময় ধরে গল্প করল। তারপর উৎপল উঠে বলল,”তোমরা সবাই মিলে গল্প করো। আমি তাড়াতাড়ি বাজার থেকে আসছি।” উৎপল দ্রুত বেরিয়ে গেল। খানিকক্ষণ নিস্তব্ধতা নেমে এলো। সুমি ঘুমিয়ে পড়েছে। নিস্তব্ধতা আরও প্রবল হলো। একটু পর স্নেহা আকাশকে বলল,”কোনো কাজ করিস? না এখনো ঘুরে বেড়াচ্ছিস?”
“না রে আমি সরকারি চাকরি পেয়েছি। আমার এখন অনেক দায়িত্ব।”
“আরও একটু বাড়িয়ে দে। মাসে কত দু’লাখ না তিন লাখ বেতন?” তাচ্ছিল্য করে বলল স্নেহা।
“সত্যি বলছি আমি চাকরি পেয়েছি।”
“থাক আর বলতে হবে না।”
“না রে স্নেহা,ও সত্যি কথা বলছে।” আকাশের কথায় এবার সত্যি সত্যিই অবাক হল। বলল,”কি করে সম্ভব? অনার্স তো মনে হয় সদ্য কমপ্লিট করেছিস?আর এর মধ্যেই চাকরি!”
“আমাদের স্কুলেই শিক্ষাকর্মী হিসেবে ঢুকে গেছি। বাবা ঠিক করে দিয়েছেন। অল্প মাইনে তবে বেশি হতে বেশিদিন সময় লাগবে না।” এবার বিশ্বাস করল। এত মিথ্যা কথা বলবে না। হাসিমুখে বলল,”বাহ্! খুব ভালো লাগলো রে। আকাশ তো অনেক আগে থেকেই বাবার দোকানের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। সেখানে থাকাকালীন তোকে দেখেছি বাবার সঙ্গে যেতে। এই অল্প বয়সে দুজনকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেখে ভালো লাগছে। এবার বিয়ে করে নে।বাবা-মাকে কষ্ট দিবি না একদম।” দুজন বেশ ভদ্র ভাবে মাথা নাড়ালো। হালকা হাসলো। টিকলি কোনো কথা বলল না। বসে বসে সবার কথা শুনলো। একটু পর খুব নরম গলায় আকাশ বলল,”আচ্ছা স্নেহা, আর্য দাদা কই রে? ওই যে ছয় বছর আগে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে এসেছিলাম তারপর তো আর দেখতে পাইনি। কোথায় এখন?” সবাই নড়েচড়ে বসল। মুহূর্তের আনন্দ নড়বড়ে হয়ে গেল। এমন প্রশ্নতে বড্ড অস্বস্তি বোধ করল স্নেহা। ভালো লাগলো না। যতই সব কিছু ভুলতে চাইছে কেউ এসে ঠিক মনে করিয়ে দিচ্ছে।কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না। কথা এড়িয়ে যেতেও সাহস পেল না। স্নেহা কিছু বলার আগেই নিলেশ বলল,”আমিও জানতে চাই। তুই এমনটা কেন করলি? আর্য দাদার মত এত সুন্দর সহজ সরল ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে উত্তরবঙ্গের এসে বিয়ে করলি। কি পেলি বলতো? তোর মিথ্যা স্বপ্নে ওই ছেলেটি কষ্ট পেল।” একটু থেমে আবার বলল,”আমাদের পাড়ায় যে কয়েকটা লোফার ছেলে আছে জানিস তো। তারা কি বলে জানিস? বলে, স্নেহা প্রথমে বিক্রমের টাকা খেলো তারপর আর্য তারপরে একটা চাকরি ওয়ালা ছেলেকে দেখে বিয়ে করে নিল। তোর নামে খুব খারাপ কথা বলে। আমি সহ্য করতে পারি না আবার কিছু বলতেও পারি না।” একটা থমথমে পরিবেশ তৈরি হয়েছে। সবাই স্নেহার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছে উত্তরের প্রত্যাশায়। সে লজ্জা আক্রোশ ঘৃণায় মাটিতে মিশে যাচ্ছে। কি নিদারুন বুকে ব্যথা হচ্ছে। চোখ দুটো ছোট ছোট হয়ে গেল। কথা বলতে গিয়ে আবিষ্কার করল জিভ নড়ছে না। সত্যিই কি সে খারাপ? তার মধ্যে অসংখ্য দোষ রয়েছে? কিছুক্ষণ পর তার ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠল। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলল,”বিক্রমের সঙ্গে যখন আমার সম্পর্ক শেষ হয়ে গেল তখন আমি সম্পূর্ণ দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। আর্যকে অপমান করতেও ছাড়িনি। কিন্তু পরে সেই আমাকে বাঁচাতে শেখালো। আমিও তাকে নিয়ে বাঁচতে চাই ছিলাম। তাইতো তাকে বলেছিলাম আমি সবকিছু মেনে নিয়েছি। বলেছিলাম, আমি আর শুধুমাত্র তার বান্ধবী নয়। হাত ধরতে চাইছিল বারণ করিনি।আমায় দেখতে চাইছিল বারণ করিনি। কোলে মাথা রাখতে চাই ছিল বারন করিনি। বলেছিলাম যদি কোনোদিন আমাকে ছেড়ে চলে যাস তাহলে তার মাথার সব চুল ছিঁড়ে ফেলবো। কিন্তু আমি তাকে ছেড়ে চলে এসেছি। আমিও প্রেম করেছি।প্রথম প্রেম কতটা অনুভূতিপ্রবণ কতটা যন্ত্রণাদায়ক ভালো করে জানি। তারপরও আমি কি করে ঠকাতে পারি?”
“তাহলে ছেড়ে চলে এলি কেন? কোনো তো কারণ থাকবে?” এবার নিলেশের কথা শুনে বেশ গরম হয়ে গেল স্নেহা। তার বাক্য ব্যয়ের মধ্যে অন্য কারোর বাক্য ব্যায় একদমই ভালো চোখে দেখে না। বেশ জোরে কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,”ছেড়ে আসতাম না তো কী করতাম? আমি জেনে গিয়েছিলাম আর্য থ্যালাসেমিয়া বাহক। সবকিছু জানার পর দুজন আগুনে ঝাঁপ দিতাম। তুই আমার আর আর্যর কথা বাদ দে। আর্যর বাবার কথা ভাব। যে মানুষটা ছোট্টবেলা থেকে লড়াই করে যাচ্ছেন। জীবনে সুখ হাতরে বেড়াচ্ছেন। ওই মানুষটা নিজের ছেলেকে ঘিরে কত স্বপ্ন দেখেছেন। শেষ জীবনে একটু সুখী হবেন। কিন্তু আমার আর আর্যর যদি বিয়ে হতো তাহলে তাদের পুরো পরিবার শেষ হয়ে যেত। আমরা পড়াশোনা করে সবকিছু জেনে শুনে ভুল করতাম। সবাইকে কি উত্তর দিতাম?” স্নেহার জোরালো কণ্ঠস্বরে সবাই চুপ করে গেল। একটু ভয় পেল।সবার মন নরম হলো। সবাই ব্যথা পেলেও নিলেশ ব্যথা পেল না। উল্টে স্নেহার সঙ্গে তর্ক জুড়ে দিল। বলল,”আর্য আগে থেকে জানতো তুই থ্যালাসেমিয়া বাহক। তারপর, সে জানতে পেরেছে নিজেও থ্যালাসেমিয়ার বাহক। কিন্তু তারপরও পিছুপা হয়নি। ভালোবেসে গেছে। তোকে বিয়ে করতে চেয়েছে। সে সমাজকে ভীষণ ভয় পায়। কিন্তু ভালোবাসার কাছে সমাজকে তুচ্ছ মনে করেছে। সবকিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসতে চেয়েছে, তুই কি করলি? ছেড়ে চলে এলি। সত্যি আমি এটা মন থেকে মানতে পারিনি। ভালোবাসার কাছে রোগ শুধুমাত্র একটা অজুহাত।”
“ওর ভালোবাসা সত্য। সে সত্যি একজন প্রেমিক। কিন্তু সে কখনও বাস্তবতা বোঝার চেষ্টা করেনি। বাস্তবকে না মানলে তার মূল্য ওই দশ পয়সা পাঁচ পয়সার কয়েনের মত হয়ে যাবে। যার অস্তিত্ব রয়েছে কিন্তু কোনো কাজে লাগবে না। বিয়ের আগে অনেক স্বপ্ন দেখানো,অনেক কথা দেওয়া, কথা নেওয়া হয়, কিন্তু বিয়ের কয়েক মাস পর কোনো কিছুই সম্ভব হয় না। যখন বিয়ের পর এমন কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হব, তখন সবাই কথা শুনিয়ে যাবে। বড্ড বিরক্ত হয়ে উঠবো তখন কিন্তু কেউ পাশে থাকবে না। মাথায় হাত বুলিয়ে ভরসা দেওয়ার মত মানুষও থাকবে না।চেনা মানুষও দূরে সরে যাবে।”
“তুই টাকা দিয়ে মানুষ বিচার করছিস?” নিলেশের কথায় এবার ভীষণ রাগ করলো স্নেহা। অদ্ভুতভাবে মুখ ভ্যাংচিয়ে বললো,”কোথায় টাকা দিয়ে মানুষ বিচার করলাম?”
“টাকা দিয়ে মানুষ বিচার করা আর একজন মানুষকে দিয়ে অন্যজনকে বিচার করা দুটোই এক। তুই তাই করছিস।” স্নেহার কিছু বলার আগেই সিঁড়ি বিয়ে কারোর উঠে আসার শব্দ ভেসে এলো। স্নেহা চোখের জল মুছে ফেলল। সবাই দ্রুত প্রসঙ্গ পাল্টে গেল। থমথমে পরিবেশ আবার মুখরিত হয়ে উঠলো। উৎপল বাজার থেকে ফিরে এসেছে। তাদের দেখে হাসি বিনিময় করল। নিজের রুমে গিয়ে স্নেহাকে ডাকলো। তাদেরকে বসতে বলে উঠে গেল। স্নেহা উঠে যাওয়া মাত্র টিকলি নিলেশকে বলল,”কেন মিছামিছি ওর সঙ্গে ঝগড়া করছিস? এখন নিশ্চয়ই আর্য স্নেহার কাছে ফিরে আসবে না, স্নেহাও নিশ্চয়ই আর্যর কাছে ফিরে যাবে না। তাহলে কেন ওই বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে? সে তো সবকিছু ভুলে নতুন করে সব কিছু শুরু করেছে। তাকে তার মত থাকতে দে। এ বিষয়ে আর কথা বলিস না।”
“আমি শুধুমাত্র আমার যুক্তি দিয়ে কথা বলেছি।সে আমার যুক্তিকে যুক্তি দিয়ে হারিয়ে দিক আমি হার মেনে নেব।” টিকলি কোনো উত্তর করলা না। আকাশও চুপচাপ বসে রইল। কিছুক্ষণ পর উৎপল আর স্নেহা ফিরে আসলো। পাশাপাশি বসে আবার জমিয়ে আড্ডা দিল।বেশ অনেকক্ষণ জমিয়ে আড্ডা দেওয়ার পর উৎপল বলল,”এবার আমার পাল্লা শেষ। তোমরা বসে আড্ডা দাও আমি দুপুরের রান্না করছি।”
“সে কি! তুমি রান্না করতে যাবে কেন? আমি আর স্নেহা আছি তো।” টিকলি বলল।
“তোমরা ছোটবেলার বন্ধু। অনেকদিন পর একসঙ্গে দেখা হলো জমিয়ে আড্ডা দাও। রান্নার কাজ আমার উপর ছেড়ে দাও।” উৎপল বেশ হাস্য উজ্জ্বল ভাবে জবাব দিয়ে বেরিয়ে গেল। সবাই তার ব্যবহারে মুগ্ধ হলো। বিয়ের দিন বুঝতে পারেনি এই মানুষটা এত সুন্দর হবে। খুব দায়িত্বশীল ব্যক্তি।ওর ব্যক্তিত্ব অনেক উঁচু পর্যায়। কিভাবে কাছের মানুষকে আরও কাছে করা যায় ভালো করে জানে। নিলেশ বলল,”স্নেহা, তোর বর তো দেখছি বেশ অন্যরকম। নিজে থেকে অনেক দায়িত্ব নিয়ে নিচ্ছে। এমন মানুষ পাওয়া মুশকিল রে।”
“এই যে তুই কয়েক মিনিট আগে বললি আর্য ভীষণ কষ্ট পায়। কষ্ট শুধু সে নয়, কষ্ট আমিও পাই। আমিও তো রক্তে মাংসে গড়া মানুষ। আমারও হৃদয়ে রয়েছে। আমারও যন্ত্রণা হয়। কাউকে কথা দিয়ে কথা রাখতে না পারার যন্ত্রনা আমাকে পুড়িয়ে মারে। তবুও তো বেঁচে থাকতে হবে। এই বেঁচে থাকার অবলম্বন উৎপলই। আমাকে নতুন করে বাঁচতে শিখিয়েছে।প্রথম তৃতীয় চতুর্থ যতই প্রেম হোক না কেন শেষ মানুষটা যদি সঠিক হয় তাহলে সবকিছু ভোলা সম্ভব।”

দুপুরের খাবার শেষ হতে প্রায় বিকাল হয়ে গেল। খাওয়া-দাওয়ার পর উৎপল বিছানায় গা এলিয়ে দিল। কিন্তু নিলেশ কিংবা আকাশ কারোরই ঘুমোতে মন চাইল না। আলিপুর দুয়ারে স্নেহার বাড়ি, যা পশ্চিমবাংলায় ভ্রমণ কেন্দ্রের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া পাহাড়ি এলাকায় প্রথম এসেছে। একটু ঘুরে দেখলে ভালো হয়। বিকেলের দিকে সবাই মিলে ছাদে গিয়ে বসলো। নিচে চোখ বেশি দূর যায় না পাহাড়ে আটকে পড়ে। তবে ছাদের উপর এমনটা নয়। চোখ বহুদূর পর্যন্ত গেল। আলিপুরদুয়ার চা শিল্পে বিখ্যাত হলেও আশেপাশে কোনো চা বাগান দেখা গেল না। ছাদ থেকে জয়ন্তী নদী দেখা গেল। এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে। দূরে কাছে ছোট-বড় পাহাড় দেখা যাচ্ছে। পাহাড়ি গাছগুলো সতেজ ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মনোরম পরিবেশ। আশেপাশের ঘরবাড়ি খুব বেশি নেই। বাড়িগুলো ফাঁকা ফাঁকা দূরত্বে অবস্থিত। বাড়ির ছাদে অসংখ্য গাছ রয়েছে। এক কোণে নুড়ি পাথরের ভর্তি রয়েছে। মেঘ গুলো যেন খুব কাছে। আকাশে বেশ কয়েকটা পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। নীল আকাশ আর সাদা মেঘ লুকোচুরি খেলছে। প্রায় সময় বৃষ্টি হলেও আজ বৃষ্টি লেশ মাত্র দেখা গেল না। ঝলমলে পরিবেশ।যেন এক দক্ষ শিল্পীর আঁকা ছবি। এমন পরিবেশ সবাইকে মুগ্ধ করল। আকাশ স্নেহার কাছে গিয়ে বলল,”তোর বাড়ি ত খুব সুন্দর জায়গায় রে। এখানে না খেতে দিলেও থাকা যাবে। পাহাড় নদী-নালা গাছপালা সব কিছুই রয়েছে।”
“আরও কিছুটা দূরে ভুটান সীমান্ত রয়েছে। এখানে মাঝেমধ্যে হাতি গন্ডারও দেখা যায়।”
“সত্যি!”
“হ্যাঁ রে। বাইরে বেরোলেই দেখতে পাবি।”
আরও কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতায় কাটলো। কেউ কারোর সঙ্গে কোনো কথা বলল না। নিজেদের মত করে চোখ এদিক ওদিক ঘুরিয়ে প্রকৃতির সৌন্দর্য অনুভব করল। নিজেদের মত করে ছন্দ সাজালো। গুন গুন করে গান গাইলো। হারিয়ে গেল সৌন্দর্যে। বিকেল যদি এমন সৌন্দর্য্যপূর্ণ হয়, তাহলে প্রভাত এবং গোধূলিতে কতটা না সৌন্দর্য পূর্ণ হয়ে ওঠে এ গ্রাম!স্নেহা একটুখানি ছাদে ঘোরার পর ইট সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো অনেকটা উঁচু জায়গায় গিয়ে বসলো। এখানে বসে রাতের আকাশ এবং রাতের পাহাড় দেখতে সুন্দর লাগে। তাই খুব সুন্দর করে বাঁধানো রয়েছে। একে একে তারাও ফিরে এসে পাশে বসলো। সবার মুখে স্নিগ্ধতা আর মুগ্ধতায় ভরপুর। চোখ মুখ ভরে এই অপরূপ সৌন্দর্যের সাক্ষী রইল। দীর্ঘ সময় পর আকাশ ভরাট কন্ঠে বলল,”অনেক দিনের পর ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। মনে আছে বর্ষাকালে আমরা মাঠে কীভাবে জলকাদা মাখতাম? দিঘির জলে সাঁতার কাটতাম? মারামারিও কম করিনি!” সবার মুখ হাসিতে ভরে উঠলো। কত সুন্দর জীবন ছিল। কোনোরূপ চিন্তা সন্দেহ একঘেয়েমি ভালো না লাগা কিছুই ছিল না। শুধু শান্তি আর শান্তি। নিলেশ মৃদু কণ্ঠে বলল,”তোদের মনে আছে আমরা ফুল তোলার জন্য কত ঝগড়া করতাম।কি পাগলামি না করেছি। এমনকি টিকলির বিয়েতেও ফুল তোলা নিয়ে ঝগড়া হলো। অথচ আজ বাগানে সারি সারি ফুল ফোটে, কেউ ফুল তোলে না। বাড়িতে দশ বার বললেও হুঁশ ফিরে না।”
“সেইসব দিনগুলো খুব সুন্দর ছিল। স্কুলে যাওয়া স্কুল থেকে আসা। বিকেলে সাইকেল নিয়ে ঘোরাফেরা। ঘুড়ি উড়ানো। বাড়ির সামনে খেলাধুলা। আরও কত কি। অথচ আজকে আমরা কে কোথায় হারিয়ে গেছি। ওই মুহূর্তগুলো আজও মনকে শান্ত রাখে। তখন সব সময় একে অপরের খোঁজ নিতাম। এখন তা আর হয় না। তবুও নিজেদের মধ্যে কোনোরকম ঝামেলা না করে সবাই একসঙ্গে এসেছিস এটাই ভালো লাগলো।” স্নেহা কথা শেষ হওয়ার পর পর আকাশ উঠে গিয়ে গাছপালা দেখতে রইল। কিছুক্ষণ পর নেলেশও উঠে পরল। সামনের দিকে তাকিয়ে পাহাড় দেখতে রইল। পেছনে টিকলি আর স্নেহা বসে রইল। দুজন বসে পুরনো অতীত গুলো মনে করলো।
“আচ্ছা স্নেহা, আমরা চাইলে কি ওই সব দিনগুলো ফিরে পাবো? যদি পেতাম তাহলে আমি সবকিছু ছেড়ে দিয়ে গ্রামে চলে যেতাম।”
“কেন রে? শ্বশুরবাড়ি ভালো লাগে না?”
“ভালো লাগে। তবে বেশি ভালো না। সারাদিন সারারাত কাজ করার পরও সবসময় শুনতে হয়, আমি সারাদিন কী করি? সেই তো বাড়িতে রান্নাবান্না আর কি? এসব কথা শুনতে শুনতে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি।”
“তোকে তো বিয়ের দিনই বলেছিলাম, সবকিছু মেনে নিবি না। কেন মেনে নিচ্ছিস সবকিছু?”
“না মেনে উপায় কি? কোথায় যাব বলতো? মন থেকে না চাইলেও অনেক কাজ করতে হয়।”
“তোকে তখন বারবার বলেছিলাম এই বয়সে বিয়ে করিস না। আমার একটা কথাও শুনলি না। জীবনটাকে নষ্ট করে ফেললি। একবার তো নিজের কথা ভাবতে পারতিস। তখন যদি পড়াশোনা করতিস কিংবা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর বিয়ে করতিস, তাহলে, আজকে কি সবকিছু সহ্য করে নিতিস? কখনো করতিস না। আসলে তুই ভয় পাস। যদি কিছু বলতে গিয়ে সংসার ভেঙ্গে যায়, তাহলে কোথায় যাবো? কোথায় থাকবো? এই ভয়ে তুই কিছু বলতে পারিস না। বাপের বাড়িতে ফিরে গেলে সেখানে নানা মানুষ নানা ধরনের কথা শোনাবে। এই ভয় তোকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে মারছে, তাইতো?” টিকলি কোনো জবাব দিল না। স্নেহা চরম সত্য কথা বলে ফেলেছে। তার উত্তর অজানা নয়। তবুও চুপ রইল‌। এভাবে সবকিছু মেনে নেওয়া যায় না তবুও মেনে নিতে হয়। তাকে কিছু বলতে না দেখে স্নেহা আবার বলল,”এই যে তোকে এত কথা বলে দিচ্ছি কিন্তু আমি নিজেও নিজের বেলা প্রয়োগ করতে পারছি না। আমি নিজেও তো প্রতিষ্ঠিত নই। প্রেম-ভালোবাসা এগুলোর পেছনে ছুটতে ছুটতে অনেকগুলো বছর শেষ করে ফেলেছি। তবে আমি তোর মত সবকিছু সহ্য করি না। সবকিছু নিজের ঘাড়ে চাপিয়ে নি না। আমি সমাজকে ভয় পাই না। তোর বয়স কত হবে বল? চব্বিশ- পঁচিশ, এর বেশি তো নয়। অথচ দেখ তুই তোর যৌবন শরীর সবকিছু হারিয়ে বুড়ি হয়ে গেছিস। কিন্তু কেন? এই বয়সে রক্ত তাজা থাকার কথা। অথচ তো শরীরে ঠিকঠাক রক্তই নেই।সব কিছু শুকিয়ে গেছে। আমার এ সব কথায় কোনো লাভ নেই। নিজের ভালো যদি নিজেই না বুঝিস,তাহলে কি হবে?তুই যে নিজের জীবন দিয়ে শ্বশুরবাড়ির সবাইকে আপন করে সুন্দর করে গুছিয়ে রেখেছিস্, এর প্রতিদান কি কেউ দেবে? কেউ দেবে না। আজকে সংসার ভেঙ্গে যাক। কালকে তোকে বাপের বাড়িতে রেখে দিয়ে যাবে। আবার নতুন মানুষ নিয়ে চলে আসবে। তাকে নিয়ে সবকিছু নতুনভাবে শুরু করবে। তখন তুই শুধু অতীত নয়,খারাপও হয়ে উঠবি। তুই তাদের চোখে সম্পূর্ণ একটা খারাপ চরিত্র হয়ে উঠবি। তোকে এগুলো বলছি কেন জানিস, কারণ, আমি নিজে এগুলো উপলব্ধি করতে পেরেছি।আমি যখন বিক্রমের সঙ্গে সম্পর্কে ছিলাম তখন তাকে বলেছিলাম,তোমায় ছাড়া বাঁচবো না।এক ঘরে দুজন থাকবো। আজকে আমি দিব্যি বেঁচে আছি। মরে যায়নি। আরও কত কথা দিয়েছিলাম, একটাও পূরণ করিনি। তবুও বেঁচে আছি। ব্যথা-যন্ত্রণা সবকিছু সহ্য করে এগিয়ে যাচ্ছি।” স্নেহা থামলো। তার কথাগুলো শুনে বড্ড অবাক হলো টিকলি। নিজের জীবনে ভুল গুলো কত সুন্দর ভাবে স্বীকার করে নিচ্ছে।শুধু অন্যকে দোষ দিয়ে নিজের দায়িত্ব শেষ করে দিচ্ছে না। নিজের ভুলগুলো খুঁজে বের করছে।
সংসারের একঘেয়েমি কথা বেশি ভালো লাগলো না টিকলির। প্রসঙ্গ পাল্টে গেল।একটু পর হেসে বলল,”তোর যে বিয়ে হয়েছে আর্য জানে?” এবার আর কোনো রকম অস্বস্তি হলো না। ধীরেসুস্থে বলল,”জানারই কথা, রিম্পির সাথে বিয়ের পর অনেকবার কথা হয়েছিল। তার দাদাকে নিশ্চয়ই সবকিছু বলেছে।”
“জানিস তো টিকলি, ওই ছেলেটাকে দেখে আমি বারবার অবাক হই। এত সহজ সরল ছেলে আমি কখনো দেখিনি। তাকে ঠকানো দুঃসাহস আমার নেই। আমি যদি আগে থেকে সবকিছু জানতাম তাহলে কখনো সম্পর্কে জড়াতাম না। ও আমাকে বড্ড ভালোবাসে। কিন্তু আমি তাকে হারালাম। ভালোবাসার মানুষটির কাছে থাকতে পারলাম না। আমার এই অগভীর হৃদয়ে কত দুঃখ কষ্ট ব্যথা লুকিয়ে আছে তোকে বলে বোঝাতে পারবো না। শুধু হাসতে হয় তাই হাসি। ভালো থাকতে হয় তাই ভালো আছি। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমি যেন উৎপলকেও ঠকাচ্ছি। আমি ওর ভালবাসার যোগ্য নই।”
“আবার ওই সব কথা শুরু করেছিস তোরা। ওই সব কথা মনে করে কি পাচ্ছিস বল? দুঃখ ছাড়া অন্য কিছু রয়েছে?” নিলেশের কথায় চমকে উঠল স্নেহা। পাশে কখন এসে দাঁড়িয়ে পড়েছে বুঝতে পারেনি। তাকে এ সমস্ত কথা বলতে চাইছিল না স্নেহা। বললেই নানা ধরনের যুক্তি বের করে তর্ক শুরু করবে। সবাই চুপ করে গেল। একটু পর টিকলি নরম কন্ঠে বলল,”আর্য তোকে আর ফোন করে না?”
“বললাম না সে আমায় খুব ভালোবাসে। আমার কথায় কখনো ‘না’ বলে না। তাকে বলেছিলাম আমায় আর ফোন করতে না। সেদিন থেকে সে নিজে থেকে একবারও ফোন করেনি। যতবার করেছি আমি নিজে করেছি। কোনোরকম দোষ না চাপিয়ে নিরবে সরে গেছে। কোনো অভিযোগ রেখে যায়নি। এমন মানুষ কাছে পাওয়াটা সৌভাগ্য। আর আমি কাছে পেয়েও নিতে চায়নি। এবার বোঝ আমি কতটা অলক্ষী?”
সুমি ঘুম থেকে উঠে পড়ায় টিকলি তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেল। নিলেশ স্নেহার পাশে এসে বসল। আকাশ প্রকৃতিতেই মগ্ন আছে। জীবনের টানাপোড়েন কিংবা জীবনের গল্প শুনতে ভালোবাসে না।বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হতে যায়। সূর্যি মামা আর কিছুক্ষণ পর বিদায় নেবে।
“জানিস স্নেহা, আমি ইচ্ছে করে তোকে সকালে এতগুলো কথা শোনায়নি। আমার যা মনে হয়েছিল আমি তাই বলেছিলাম। আর্য দাদা ছেলে,তাই, আমি হয়তো,একটা ছেলে হয়ে তার কষ্টটা বুঝতে পেরেছিলাম। কিন্তু তোর কষ্টটা সহজে বুঝতে পারিনি। এখন বুঝতে পারছি। হয়তো তোর কষ্ট ব্যথা ততটা প্রবল নয়, তবুও ব্যথা ব্যথাই হয়।”
“আমি কিছু মনে করিনি। আর কি জানিস তো,জীবনে শুধুমাত্র প্রেম-ভালোবাসা কিংবা পুরনো মানুষ হারিয়ে গেলে কষ্ট হয় না। জীবনে আরও অসংখ্য কারণ রয়েছে,এ গুলোর জন্য কষ্ট হয়। প্রেম ভালোবাসা তো সমুদ্রে অসংখ্য পাথরের মধ্যে একটা পাথর। আমার বিবাহিত জীবনের আগে প্রেম ভালোবাসা ছিল তাই এখন কষ্ট পাচ্ছি। কিন্তু টিকলির তো কোনোরকম প্রেম ভালোবাসা ছিল না, তাহলে সে আজ কষ্ট পাচ্ছে কেন? সবার জীবনে কিছু না কিছু কষ্ট থাকে। সুখের সঙ্গে কষ্টকেও বয়ে বেড়াতে হয়।” নিলেল স্নেহার কথা বোঝার চেষ্টা করল। তার কথায় যুক্তি রয়েছে। অনেক ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে। কিছু একটা ভাবল সে। এই অল্প বয়সে কিছু অভিজ্ঞতা সাজিয়ে সহজ-সরল ভাবে বলল,”তোকে আমি এখন একটা হাসির জোকস শোনালাম। তুই হা হা করে হাসলি। আমি দ্বিতীয়বার একই জোকস শোনালাম। তুই আবার হাসলি। আমি আরও বার কয়েকবার একই জোকস শোনালাম। তুই কি আর হাসবি? হাসবি না বরং আমার উপর বিরক্ত হয়ে উঠবি।তোর অতীতে কিংবা বর্তমানে এমন কয়েকটি মুহূর্ত রয়েছে যে মুহূর্তকে তুই মনে করে চোখ ভিজিয়ে ফেলিস, কষ্ট হয়, ব্যথা পাস, সবকিছু ছেড়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে। ওই মুহূর্তটিকে একবার ভেবে যতটা কষ্ট পেয়েছিস, দশবার ভেবেও ঠিক ততটা কষ্ট পাচ্ছিস। কিন্তু কেন? তোকে যখন আমি একটা হাসির জোকস দু’বারের বেশি শোনালাম তখন তুই বিরক্ত হয়ে উঠলি,অথচ নিজের কষ্ট বারবার অনুভব করার পরও তার প্রতি বিরক্ত আসছে না! তুই যদি ভালো জিনিস বেশিক্ষণ নিতে না পারিস, তাহলে খারাপ জিনিস বেশিক্ষণ নিচ্ছিস কেন? চোখের জল মুছে ফেল। অতীতে কি ছিল, কি হারিয়েছিস? ওইগুলো ভেবে লাভ নেই। বরং বর্তমানে কি আছে? কি পেলে খুশি হবি? ওই গুলোর খোঁজ কর। ওইগুলো আঁকড়ে ধরে নতুন করে বাঁচার চেষ্টা কর।”

পর্ব ২৬ আসছে
সময়ের অভাবে দ্বিতীয় বার পড়া হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার চোখে দেখবেন। ধন্যবাদ।।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here