#অন্তহীন💜
#পর্ব_৩৪
#স্নিগ্ধা_আফরিন
ভাতের লোকমা টা মুখে নেওয়ার আগে হাত থেকে পরে গেলো প্লেটে। মায়ের কথা টা শ্রবণেন্দ্রিয়তে পৌঁছাতেই ঝংকার দিয়ে উঠলো বা পাশের চিত্তে।চিন চিন করে উঠলো অসহনীয় যন্ত্রনায়। কোনো রকম হাতটা ধুয়ে ছুটে গেল বাবার রুমে। চৈতির কান্নায় বুকটা ফেটে যাচ্ছে। খাবার মুখে নিয়ে ছিল শুধু।গিলতে পারলো না।গলা দিয়ে নামলো না যে। প্রহনের পিছু পিছু সে ও ছুটলো বাবা তুল্য শ্বশুড়ের রুমে।
দরজার কাছে আসতেই শরীর টা যেন অসাড় হয়ে গেল প্রহনের। মিসেস ইয়াসমিন রেদোয়ান চৌধুরীর বুকের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছেন আর বিড় বিড় করছেন,”শুনছো উঠো না প্রহনের আব্বু। কথা দিচ্ছি তোমার বই পড়া নিয়ে আর কখনো কিচ্ছু বলবো না।”
প্রহন এগিয়ে গেল মায়ের দিকে। রেদোয়ান চৌধুরীর অচল দেহটা পড়ে আছে বিছানায়।
প্রহনের গলায় কথা আটকে যাচ্ছে।
কান্না পাচ্ছে খুব।কোথা থেকে চৈতি দৌড়ে এসে রেদোয়ান চৌধুরী কে জাপটে ধরলো। কান্না করে দিয়েছে সে। প্রহন কে দেখে মিসেস ইয়াসমিন বসা থেকে উঠে জাপ্টে ধরলেন।
“কী থেকে কী হয়ে গেল প্রহন।বাবা এত তাড়াতাড়ি কেন আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন? আমি তো একেবারে একা হয়ে গেলাম। আমার ভালোবাসা হারিয়ে গেল দুনিয়া থেকে।”
কী করবে প্রহন বুঝতে পারছে না সে। নিজেকে সামলাবে,নাকি চৈতি আর মাকে সামলাবে? মাথায় কাজ করছে না।
চৈতি হঠাৎ কান্না থামিয়ে দেয়। রেদোয়ান চৌধুরীর বা হাতের কব্জি ধরে ছিল সে।
“বাবা বেঁচে আছে ভালো মা। উনার হাতের রগ কাঁপছে।”
চৈতির কথায় চমকে উঠলো প্রহন। সাথে খুশি ও হলো। নিজের কাছ থেকে মিসেস ইয়াসমিন কে ছাড়িয়ে দ্রুত বাবার কাছে গেল। হাতের নাড়ি ছুঁয়ে দেখলো খুব ধীর গতিতে কাঁপছে। বুকের বা পাশে হাত রেখে অনুভব করার চেষ্টা করলো হৃদস্পন্দন হচ্ছে কিনা। খুবই ধীর গতিতে কাঁপছে হৃদয়।
মিসেস ইয়াসমিন এর দিকে তাকিয়ে চোখে মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,”আব্বুর কিচ্ছু হয়নি আম্মু। তুমি দ্রুত এম্বুল্যান্সকে ফোন করো। দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”
মিসেস ইয়াসমিন মাথা নেড়ে সায় দিলেন। দ্রুত মোবাইল নিয়ে ফোন করলেন। চৈতির দিকে তাকিয়ে প্রহন বললো,”অনেক অনেক ধন্যবাদ তোমাকে চৈতি। তুমি যদি না বলতে হয়তো বাবার সত্যি কিছু হয়ে যেত।”
চৈতির চোখ থেকে টুপ টুপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে গাল বেয়ে। নিজের বাবার মতই এই মানুষ টা ও সে অনেক বেশি ভালোবাসে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই তিন টা মানুষ তার অতি থেকে ও অতি প্রিয় হয়ে গেছে। তাদের কিছু হয়েছে ভাবলেই তো দম আটকে আসে। দিশেহারা মনে হয়।
_________
আইসিইউ রুমের এর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন মিসেস ইয়াসমিন। পায়চারি করছেন তিনি। তার পাশেই বসে আছে চৈতি। প্রহন সরদার সাহেব কে ফোন করে সব কিছু জানাতে ব্যস্ত। এই বিপদে তারাই হয়তো পাশে থাকবে।চাচারা তো সেই কবেই নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ব্যস্ত।বড় ভাইয়ের খোঁজ রাখার প্রয়োজন বোধ করে না তারা।মরলো নাকি বাঁচলো এতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না।
রেদোয়ান চৌধুরীর শরীরের অবস্থা প্রচন্ড খারাপ হওয়ায় তাকে ইমার্জেন্সি আইসিইউ তে নেওয়া হয়।” বুকের ব্যথায় জ্ঞান হারিয়েছেন তিনি। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি ও খুব ধীরে। হৃদয় স্পন্দন প্রক্রিয়া ও কমে গেছে। অনভিজ্ঞ যে কেউই তাকে দেখলে মৃত মনে করবে।”
ডাক্তারের কাছ থেকে এই সব কথা শুনে মিসেস ইয়াসমিন মৃত মনের প্রান ফিরে পেলেন যেন।
“আব্বু এখন কেমন আছেন ডক্টর?”
“আপনার আব্বুর জ্ঞান ফিরেনি এখনো। তবে আমরা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। আপনার আব্বু হার্টের পেশেন্ট যেহেতু উনার একবার হার্ট সার্জারি হয়েছে সেহেতু আপনাদের উচিত ছিল তাকে দেখে রাখার। ভাগ্যে ভালো যে কিছু হওয়ার আগে হাসপাতালে নিয়ে এসেছেন।আপনারা যদি তাকে মৃত মনে করে রেখে দিতেন তাহলে হয়তো আজ সত্যি সত্যি তিনি মারা যেতেন।”
ডাক্তারের কথা শুনে মায়ের দিকে এক নজর তাকালো প্রহন।ডাক্তার চলে গেছে।
মিসেস ইয়াসমিন এখন ও কান্না করছেন।ইশশ আজ যদি চৈতি অনুভব করতে না পারতো তাহলে কি হতো? আল্লাহর কাছে হাজার হাজার শুকরিয়া আদায় করছেন তিনি।দিক না মানুষ টা কম সময়।তাতে কি? বেঁচে থাকবে,পাশে থাকবে,এক সাথে থাকবে এটাই তো অনেক।
সরদার সাহেব কে দেখে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো চৈতি। সজীব সাদিক আর জুনাইদা ও এসেছে। সরদার সাহেব কে দেখে মনে কিছু টা সাহস পেল প্রহন।বাবা নামক ছায়াটা মাথার উপর থেকে চলে যাওয়ার ভয়ে ভীত ছিল সে।প্রিয় জন হারানোর যে যন্ত্রনা তা কি আর সবাই বুঝে?যার যায় সেই বুঝে তার কী গেল।অন্যরা তো মিথ্যে শান্তনা দেয় শুধু।
“প্রহন আমি বাড়ি যাবো।”কান্না ভেজা কঠিন গলায় বলা কথা শুনে পাশ ফিরে মায়ের দিকে তাকালো প্রহন।
প্রত্ত্যথে বললো,”আর কিছুক্ষণ থাকো। আব্বুর জ্ঞান ফিরলেই চলে যেও।”
প্রহনের কথা শুনলেন না মিসেস ইয়াসমিন।এক রোখা জেদ করে আবারো বললেন,”আমি থাকবো না।এখনি বাড়ি যাবো। তুই আমাকে আর চৈতি কে নিয়ে চল।”
“কিন্তু আম্মু, আমি চলে গেলে এখানে কে থাকবে? আমার তো এখানে প্রয়োজন পড়তে পারে।”
প্রহনের কথা শুনে শান্ত হলেন মিসেস ইয়াসমিন।
সরদার সাহেব সজীবের দিকে তাকিয়ে বললেন,”সজীব, চৈতি আর আপাকে নিয়ে বাড়িতে দিয়ে আয়।”
জুনাইদার দিকে তাকিয়ে বললেন,”তুমি আর একা থেকে কী করবা? তুমি ও যাও সাথে।”
সজীব তিন জনকে নিয়েই চলে গেল বাড়িতে। এই দিকে রেদোয়ান চৌধুরীর জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত অশান্ত মনটা শান্ত হচ্ছে না প্রহনের। সম্পূর্ণ ভয়টা ও দূর করতে পারছে না মন কে।
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লো সে।
.
ঘড়ির কাঁটা টিকটিক করে ঘুড়ছে।১২টা বেজে ৩৪ মিনিট।গগনে আজ চন্দ্রিকা নেই। স্নিগ্ধ, মোহনীয় নজর কাড়া চাঁদের আলো নেই ধরিত্রীতে।থেমে থেমে ডাহুক পাখির ডাক ভেসে আসছে দূর থেকে।এত রাতে ও নগরী শান্ত হয়নি। হাসপাতালে এত মানুষ থাকার অনুমতি নেই দেখে প্রহন বাদে আর সবাইকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে সে।
একাই রয়ে গেল হসপিটালে।
একটা শান্ত নিরিবিলি রুম। মৃদু আলো জ্বলছে শুধু।ড্রিম লাইটের লালচে প্রভায় একজন মধ্যবয়স্ক নারীর অবয়ব স্পষ্ঠ। তাহাজ্জুদের নামায পড়ার জন্য দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। এই মহা বিপদে এক মাত্র আল্লাহই তার ভরসা। নিজের ভুলের জন্যই ছেলে মেয়ের রাতের খাবার টুকু ও খাওয়া হয়নি।ভয়ে ছিলেন তিনি খুব। রেদোয়ান চৌধুরীর কখন কী হয়ে যায় সেই ভয়েই থাকেন মিসেস ইয়াসমিন। বুকের ভেতরকার সেই ভয় থেকেই আজ কী একটা ভয়ানক কথা বলে ফেলেছেন তিনি। ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে মনে।
তাহাজ্জুদ নামাজের মাধ্যমে নাকি মহান আল্লাহ কে নিজের খুব কাছে পাওয়া যায়।সব সময় না পড়লেও মাঝে মধ্যে রেদোয়ান চৌধুরী কে সাথে নিয়ে তাহাজ্জুদের নামায আদায় করতেন। আল্লাহর দরবারে দুই হাত পেতে নামাজে দাঁড়িয়েছেন আজ। সুস্থতার মালিক যে তিনি।
গভীর রাত।
দেয়াল ঘড়িটা টুং টুং করে শব্দ করে উঠলো। ঘড়ির শব্দে কিছু টা ভয় পেলেন মিসেস ইয়াসমিন। সালাম ফিরিয়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলেন ৩টা বেজে গেছে।
জুনাইদা আর চৈতি বেশ কিছুক্ষণ জেগে ছিলেন।শেষে ঘুমের সাথে যুদ্ধ করে জেগে থাকতে না পেরে ঘুমিয়ে পড়ে। সরদার সাহেব আর সজীব সাদিক ও ঘুমিয়ে গেছেন।পুরো বাড়িটা নিস্তব্ধ।নিশি রাতে একা জেগে নামাজ পড়ে নিজের প্রিয় মানুষটার প্রান ভিক্ষা চাচ্ছেন মিসেস ইয়াসমিন।নিরব কান্নায় ভিজে যাচ্ছে গাল।অশান্তি ঝড় বয়ে যাচ্ছে মনের গভীরে।
আজ কেন জানি ভয় হচ্ছে না। শুধু মনের ভেতর একটাই চিন্তা মানুষ টা আগের মতো সুস্থ হয়ে যাবে তো?ঠিক হয়ে যাবে তো?
হসপিটালের করিডোরের শেষ প্রান্তে বসে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে প্রহন। হাসপাতাল টা ও চুপচাপ হয়ে গেছে। কখন বাবার জ্ঞান ফিরবে সেই চিন্তায় চিন্তিত সে।
বাবা মানেই তো একটা বিশাল আকাশ মাথার উপরের। হারিয়ে গেলে যে সব কিছু উলোট পালোট হয়ে যাবে। শেষ হয়ে যাবে।সব শান্তি!
#চলবে,,,
(এত সুন্দর সুখি পরিবারটা কে নষ্ট করতে মন চাইলো না 😊)