ওয়েডিং স্টোরি পর্ব-১৭

0
1344

#ওয়েডিং_স্টোরি
#পর্ব_১৭
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

গ্রামের সরু পথ। রাস্তার দুদিকে ধানের ক্ষেত। বাংলা বৈশাখ মাসের ধান কাটা পর্ব চলছে। ক্ষেতের একপাশে ছয় থেকে সাতজন কৃষক ভাত খাচ্ছেন। কাজের ফাঁকে সামান্য বিশ্রাম আরকি! আভাদের গাড়ি ছুঁটে চলেছে অবিরত। আভার কানে হেডফোন। গান বাজছে,
“দেখেছি রুপসাগরে মনের মানুষ কাঁচা সোনা। ”

বরাবরই বাংলা গানের প্রতি আভার দুর্বলতা বেশি। তবে আগে এমন ছিলো না। বছরখানেক আগেও হিন্দি গান মানেই ছিলো আভার জন্যে আস্ত এক ভালোলাগা। তবে বয়স বাড়ার সাথেসাথে অন্যান্য পছন্দের সাথেসাথে গানের পছন্দও বদলে গেলো।
হঠাৎ আভার ফোনে মেসেজ টোন বাজলো। আভা ফোনের স্ক্রিন অন করে চোখের সামনে ধরলো। আহনাফের মেসেজ। আভা ঠোঁটে হাসি টেনে মেসেজ দেখলো। আহনাফ লিখেছেন, ” কোথায় তুমি? ”
আজকে হঠাৎ-ই গ্রামের বাড়িতে আসার পরিকল্পনা হয়েছে। বাবার মন দাদুমনির অসুখ শুনেই কু ডাকা শুরু করেছে। তাই কালবিলম্ব না করে মুহূর্তের মধ্যেই ব্যাগপত্র কাধে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছেন নিজেদের গ্রামের বাড়ির উদ্দেশ্যে। বরাবরই বাবার তাড়াহুড়োর কারণে নাকে মুখে ঘর তালা দিয়ে বের হয়েছে ওরা। আহনাফকে জানানোর সময় ছিলো না। তার ফলাফলস্বরপ এখনকার এই মেসেজ। আভা ছোট্ট করে মুঠোফোনের কিবোর্ড চাপলো,”গ্রামে যাচ্ছি। ”
ফিরতি বার্তা পাঠানোর কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই আহনাফের পক্ষ থেকে আরো একটা মেসেজ আসলো। লেখা, ” গ্রামে যাচ্ছো, ভালো কথা। তাহ, আমাকে জানিয়েছো গ্রামে যাওয়ার কথা? ”
আভার বিরক্ত লাগলো। গ্রামে যাচ্ছে, জানানোর সময় থাকলে তো জানাবে। আহনাফের এই ছোট্ট বার্তায় রাগ স্পষ্ট। এই ছেলের নাকের ডগায় রাগ ঝুলে থাকে। যখন তখন যার তার উপরে রাগ ঝাড়া উনার প্রতিদিনকার রুটিন। আভা ছোট্ট করে একটা শ্বাস ফেলে কিবোর্ড চাপলো,” গ্রামে যাচ্ছি, এটা বলার কি আছে? আসলে হুট করে প্ল্যান হয়েছে। বলার সময় পাইনি। ”

আভা বার্তা পাঠিয়ে হেডফোনের আওয়াজ বাড়িয়ে দিলো। পূর্বে গানের আওয়াজ অর্ধেকে ছিলো। এখন সর্বোচ্চ আওয়াজে গান বাজছে। আবারো “টুং” করে শব্দ হলো হেডফোনে। আভা মেসেজ পড়লো,” আমি প্রায় এক ঘন্টা ধরে তোমার বাসার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ভেবেছিলাম বারান্দা দিয়ে একঝলক দেখে নিবো তোমায়। কতদিন তোমাকে দেখিনি তার খবর রাখো? না, তা রাখবে কেনো? তোমার খবর তো থাকে কোনসময় কোন লোকে আমাদের দেখে ফেললো, কোন পিলার আমাদের দেখে হাসলো, কোন বিলবোর্ড আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে, এসব।রিডিকিউলাস।”

পুরো মেসেজ পড়ে আভার এই মুহুর্তে দু রকম অনুভুতি হচ্ছে। প্রথমত, আহনাফের এক ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকা। মানুষটা সারাদিন হসপিটাল করে বিকেলে তার জন্যে অপেক্ষা করছিলো। নিশ্চয়ই পা ব্যাথা করছে।মানুষটা বড্ড উন্মাদ। আভা সেসব ভেবেই হেসে ফেললো। আভার হঠাৎ হেসে উঠার শব্দে আভার বাবা সামনের সিট থেকে পিছন ফিরে তাকালেন। ভ্রু জোড়া কুঁচকে আভার দিকে তাকালেন উনি। আভা এতে খানিক বিব্রত অনুভব করে চটপট মুখখানা মলিন করে ফেললো। দাদুমনি অসুস্থ বিধায় কারো মন মেজাজ এখন ভালো নেই। তাই এই মুহূর্তে হাসাটা হলো চূড়ান্ত অন্যায়। আভাকে নীরব থাকতে দেখে আভার বাবা পুনরায় সামনে মুখ ঘুরালেন।
বাবা মুখ ফিরাতেই আভা কোলের উপর থেকে ফোন হাতে নিলো। আহনাফের উদ্দেশ্যে পাল্টা মেসেজ করলো, “কতদিন মানে কি?আমাদের পরশু দেখা হয়েছে। ”

সঙ্গেসঙ্গে আহনাফ মেসেজ করলো, ” বাহ্! সেটার খবরও রাখো দেখছি। তোমার দিল এত পাষাণ কেনো? হ্যাঁ? পরশু দেখা হয়েছে, সেটা তোমার কাছে বড় কিছু হয়ে গেছে। এদিকে আমি প্রতিনিয়ত তোমাকে দেখার জন্যে ছটফট করছি,সেটা চোখে পড়ে না? হাও রুড!”

আভা মেসেজ দেখে দুমিনিট থম ধরে বসে রইলো। আসলে যখনই আহনাফ এমন আবেগপূর্ণ কোনো কথা বলে আভা তার উত্তরে কি বলবে খুঁজে পায়না। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। সমস্ত কথা কণ্ঠনালীতে এসে আটকে গেছে। কন্ঠনালী ভেদ করে বেরুনোর রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। আভা যখন হরেক বাক্য সাজাতে ব্যস্ত তখন আহনাফ মেসেজ করলো, ” এই বউফ্রেন্ড, চলে এসো না আমার সম্রাজ্যে। চিরদিনের জন্যে। কথা দিচ্ছি,আমার রাজ্যে রানী করে রাখবো তোমায়। এই দূরত্ব আর সহ্য করা যাচ্ছে না। আমার উপর দয়া করো এবার। তোমার নামের রোদ্দুরে পুড়ে খা খা হয়ে যাচ্ছি আমি। এবার তোমার হাতের একটু শীতল পরশ দরকার। খুব বেশিই দরকার, বউফ্রেন্ড। ”

আভার প্রাণটা ধক করে উঠলো। হঠাৎ করেই তার গলা শুকিয়ে এলো। তবে তৃষ্ণাটা যে পানির না সেটা স্পষ্ট। তবে কিসের তৃষ্ণা? অনুভূতির? আভা কাপা হাতে কিবোর্ড লিখলো, ” সময় আসলে এমনিই আপনার কাছে চলে আসবো। ততদিন নাহয় রোদ্দুরে পুড়তে থাকুন। ইদানিং খুব বেশি ফর্সা হয়ে যাচ্ছেন। কালো হওয়াটা দরকার। তাই আমার রোদে পুড়েই নাহয় কালো হয়ে যান। গ্রেট আইডিয়া, তাইনা?”

আভার ঠোঁটে হাসি। হাসিটা যেনো ঠোঁট থেকে সরছেই না। আচ্ছা, এই হাসির কারণটা তবে কে? আহনাফ?
মেসেজের টোনে আভার ধ্যান ভাঙলো। পড়লো সে বার্তাটা,
” দিস ইজ নট ফেয়ার, বউফ্রেন্ড। শাস্তি দিচ্ছ ? আমার শাস্তির ধরনটা সামনে এলে সামলাতে পারবে তো? ”

আভা নীরব হেসে সিটে গা হেলালো। চোখদুটো বুজে নিতেই দুচোখে ভর করলো রাজ্যের ঘুম। এই মুহূর্তে ঘুমটা খুব দরকার আভার জন্যে। কিছু তপ্ত অজানা অনুভূতি নিজের মধ্যে লুকিয়ে ফেলার জন্যে ঘুমটা প্রয়োজন। অতঃপর আভা ঘুমিয়ে পড়লো।
______________________
সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নামতেই বাড়িতে হইচই শুরু হয়ে গেছে। আভাদের বাড়িয়ে আসার খবর শুনে দাদুমনি খুব অদ্ভুত ভাবেই অনেকটা সুস্থ হয়ে গেছেন। হয়তো সুস্থ থাকার ভান করছেন। ছেলে উনার প্রচুর রেগে আছে। আজ হয়তো উনাকে বগলদাবা করে শহরে নিয়েই ছাড়বে। কিন্তু দাদুমনি সেটা চাইছেন না। তাই লেংড়া পা নিয়েই হেঁটে বেড়াচ্ছেন ঘরময়।
আভাদের খাতির যত্ন করতে কয়েকজন চাচী মিলে রাতের খাবার তৈরি করছেন। রান্নার ঘর থেকে মাটির চুলোর জ্বলন্ত ধোয়ার গন্ধ ভেসে আসছে। আগুনের গন্ধ মুখ পেরিয়ে নাকে যেতেই বুকের ভিতরটা চঞ্চল হয়ে আসছে। চারদিক কেমন যেনো গ্রাম গ্রাম গন্ধ আসছে। গরুর গোবরের গন্ধ, শেয়ালের হাকডাক, গ্রামের হইচই সব মিলিয়ে হলুস্থুল কাণ্ড। আভা উঠানে দাঁড়িয়ে সমবয়সী মেয়ের সাথে গল্প করছেন। মাথার উপর সরু চাঁদ সসম্মানে আকাশের ঠিক মধ্যেখানটায় বসে আছে। চাঁদের চারপাশে লুটোপুটি খাচ্ছে শত তারা। আভা হাঁটতে হাঁটতে চাচাতো বোনদের সাথে কথা বলছে। চাচাতো বোনদের মধ্যে অন্যতম হলো, সাথী। যাকে আভা খোঁচা দিয়ে পদ্মা সেতু বলে ডাকে। সাথীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে মিম, বর্ষা, বৃষ্টি আর তাহমিদা।

আচমকা সাথী বলে বসলো,
— ” এই আবা, তোর হবু বরের ফটো আছে? দেখা না। আমিও দেখি কত বদসুরত দেখতে। ”

আভা সাথীর মাথায় ঠাস করে এক চাটা মারলো। এতে সাথী ন্যাকামি করে মাথায় হাত ঘষে আভার দিকে তাকালো। আভা বললো,
— ” আমার নাম আভা। আবা না। একবার অন্তত আমার নামটা ঠিকমত উচ্চারণ কর। আমার এত সুন্দর নামের বারোটা বাজাই দিলি। ”

সাথী নাক মুখ কুঁচকে বললো,
— ” তোর শুদ্ধ ভাষা তোর কাছেই রাখ। আবা বললেই কি আর আভা বললেই বা কি। নাম ধরে ত ডাকছি। খচ্চর তো বলি নাই, শুকরিয়া আদায় কর। এবার তোর জামাইর পিক দেখা। ওতো লুকাইয়া লাভ নেই। আমরা তোর জামাইরে খেয়ে ফেলবো না। দেখা এখন। ”

আভা সাথীর দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকালো। তবে এতে সাথীর মধ্যে কোনো ভাবাবেগ দেখা গেলো না। বড়ই অদ্ভুত! আভা ফুস করে এক নিঃশ্বাস ছেড়ে বললো,
— ” আমার কাছে তার কোনো পিক নেই। পারলে মোবাইল চেক করতে পারিস। ”

#চলবে
আশা করি, গঠনমূলক কমেন্ট করবেন। গল্প সম্বন্ধে নিজের অনুভূতি কমেন্টের মাধ্যমে জানাবেন। ধন্যবাদ।

আগের পর্ব
https://www.facebook.com/105343271510242/posts/227373832640518/?app=fbl

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here