কল্পনার_কলমদানি ১

কল্পনার_কলমদানি
চন্দ্রা
গল্প: “রঙ মিশেলে সেই দশমীর বিকেল”

তুমি এসো,
তপ্ত গ্রীষ্মের পর সেই শীতলতা মাখা বৃষ্টির মতো এসো,
উত্তরী হাওয়া মোড়ানো রাতের পর প্রথম সকালের একফালি রোদের মতো এসো,
আমায় ফাল্গুনী বসন্তের একমুঠো পলাশের লালে রাঙিয়ে তুলতে এসো,
হৈমন্তিকার ভোরে উষ্ণতার আবরণে আমায় আবৃত করতে এসো,
আর যদি পারো! তবে এসো বৃষ্টি কদমের গুঁড়ো পাঁপড়ি হয়ে,
এসো! আমার পায়ের আলতা সাজানোর কারণ হয়ে,
এসো! আমার উপন্যাসের অসমাপ্ত অধ্যায় হয়ে,
আমার অনন্ত কালের সহযাত্রী হয়ে………………।

তার সাথে আমার আলাপটা ঠিক ওই হিন্দি ভাষার “ইত্তেফাক” টাইপ । আসলে কখোনো পারফেক্ট কাউকে আমার ভালো লাগেনি । আমি সবসময় চাইতাম , আমার “সে” হবে অপূর্ণ । পারফেক্ট জেন্টলম্যান নয় । যার জীবনে আমার কোনো গুরুত্ব থাকবে । তার কোনো কমতি শুধুমাত্র আমাকে দিয়েই পূর্ণ হবে । এমন মানুষ আমার মোটেও পছন্দ নয় যার পেছনে কয়েক হাজার মেয়ে পড়ে থাকবে । আর তাদের মধ্যে সে আমাকে বেছে নেবে । উঁহু !
তাই হয়ত কলেজ শেষ হবার পরেও আমার ফেসবুক স্ট্যাটাস “সিঙ্গেল” । যেখানে পূজোর চারটে দিন আমার বান্ধীরা নিরুদ্দেশ হয় তাদের মনের মানুষের হাত ধরে, আর আমার পূজো কাটে পাড়ার বারোয়ারি পূজোর ঢাকের বাদ্যি শুনে । তবে খারাপ লাগে না । কেন জানিনা ঘুরতে যাব । এটা ওটা , অত সবে আমার মন কখোনোই বেশি টানে না । কে জানে ……?! ওই সবার থেকে আলাদা প্রকৃতির হয়ত । আর না হলে অবশ্যই আমি ভিন গ্রহের প্রাণী । তাই হ্যান্ডসাম লুক , চওড়া বুক, গালে সেট করা দাঁড়ি এসব আমার ক্রাশ খাওয়ার কারণ কখোনোই হয়নি । এদের দেখলে নিজের মাঝেই অস্বস্তি শুরু হয় । আমি নিজেও পরিপূর্ণ নই । তাহলে তেমন খুঁজি কি ভাবে…..?! এই কারণেই হয়ত বান্ধবীদের আড্ডাতেও আমি কিছুটা বেমানান । আমার শেষ বিকেলের গোধূলি বেলা ছাদের কোনে সেই শিউলির সুবাসেই কাটে । যেখানে আমার আবেগী বয়সি মনের দুয়ারে কেউ ফিসফিসিয়ে বলে , সে আসছে……সে আসছে…..!
আর তাই তো আমার ডায়েরির পাতায় কলমের আঁচড়ে লিখি,

তীব্র বিশ্বাসগুলো নিঃশ্বাসের সুরে গেয়ে যায়,
বুকভেদী দীর্ঘশ্বাস ফেলে খাগের কলমের আঁকিবুকি,
চোখভাঙা জলধারা আটকে রাখার রেশ,
দাঁত কামড়ে প্রসারিত ঠোঁটের কোনে,
শুধুই যে তোমার নাম!
ছায়া পথের গতিপথে নিঃশব্দ চলাচলে,
মেঘ চুঁইয়ে নিংড়ে আসা ঠান্ডা স্রোতে,
কান পেতে শোনা মৃদুভাসী বাতাসের আওয়াজে,
ঝরা পাতার সনে মাটির মিলন ক্ষণে,
শুধুই যে তোমার পদধ্বনি!

আসছে সে! আসছে…….!

তো এবার ফিরে আসি সেই তপ্ত দুপুরের রোদে । দিনটা দূর্গা পূজোর পঞ্চমী । তো এবছর বান্ধবীদের সাথেই বেড়িয়েছি । ওদের অভিসার শুরু হবে সপ্তমী থেকে আর শেষ হবে দশমীতে সিঁদুর খেলে । তাই এবারের পঞ্চমী বান্ধবীদের সাথে । বাড়ি থেকে বেশ দূরেই ঠাকুর দেখতে এসেছি আমরা । শহরের অলিগলি ঘুরে এই দুপুরের রোদে বেশ ক্লান্ত আমরা । পেটের ভেতরের চুইচুই ডাক গর্জে বলছে “খাবার চাই!” । পেটের ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা নেই । বসলাম এক রেস্টুরেন্টে । আজকাল ইয়ং জেনারেশন এর সার্বভৌম পছন্দের খাবার বিরিয়ানি । এসির হাওয়ায় কাঁচের ভেতর থেকে তপ্ত শহরটাকে দেখতে বেশ ভালোই লাগছে । বাইরে জমজমাট রাস্তার ঠিক ওপারে হঠাৎ তাকিয়ে পড়লাম । একটা রয়্যাল এনফিল্ড দাঁড়িয়ে । কিন্তু আমি ওটা দেখছি না । আমার দৃষ্টি বাইকের গায়ে হেলান করে দাঁড়ানো মানুষটার দিকে । শ্যামবর্ণ গায়ের রঙ । ঠিক কালো নয় বেশ হলদেটে । মাথার এলোমেলো চুলগুলো কপালের একাংশ ঢেকে রেখেছে । চোখ দুটো ফোনের স্ক্রিনে । ব্লু জিন্সের সাথে গায়ে লাল রঙের টিশার্টের উপরে একটা নেভি ব্লু শার্টের বোতাম গুলো হাট করে খোলা । পায়ে সাদা রঙের শু ।
কিন্তু আমার দৃষ্টি তখন এসব ছাড়িয়ে তার চোখ দুটো দেখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে । টেবিল ঘিরে বসে থাকা আমার বান্ধবীরা তখন বিরিয়ানি তে মত্ত । আর আমি বিরিয়ানি সামনে রেখেও উঠে যেতে রাজি শুধু তার চোখ দুটো দেখার জন্য । বুঝতে পারছি না । বিরক্ত লাগছে । কখন যে এখান থেকে বেরিয়ে রাস্তায় যাব সেটাই ভাবছি । অস্মিতার ধাক্কায় এবার খাওয়ার মুখে তুলতে হল । কিন্তু তাকিয়ে আছি রাস্তার দিকে । মনে মনে ভগবানকে ডাকছি আমরা বেরোনোর আগেই যেন চলে না যায় …..?! উফ ! জীবনে প্রথমবার এই অবস্থা আমার । কোনো রকমে গোগ্রাসে খেয়ে যাচ্ছি ।
রেস্টুরেন্ট থেকে বেরোতেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম । সে এখোনো রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে । বান্ধবীরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে এখন ঠিক কোনদিকে যাওয়া যায়….?! আমি ওদের মধ্যে দাঁড়িয়ে ও চোখ দুটো রাস্তার ওপারে ।
কিন্তু বিরক্ত লাগছে। প্রচন্ড বিরক্ত লাগছে। আরেহ্, একটা বার তো মাথা তুলে তাকাবে। কি এতো দেখছে ফোনের স্ক্রিনে….?! কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই কেউ তাকে ডেকে উঠল “কুশল”। সে মুখ ঘুরিয়ে তাকালো। আমি এক মুহূর্তের জন্য দেখলাম তাকে। দম আটকে ফেললাম। চার পাঁচ জন ছেলের সাথেই সে কথা বলছে। আর আমি অবাক চোখে তার ঠোঁট নাড়ানো দেখছি।
আমার বান্ধবীরা এর মধ্যেই আমাকে টেনে নিয়ে যেতে লাগল উল্টো দিকে। আমি তবুও মুখ ঘুরিয়ে দেখছি তার দিকে। সে এখোনো ওই ছেলেগুলোর সাথেই কথা বলছে। আমি মনে মনেই নিজের নামের সাথে তার নামটা মিলিয়ে দেখলাম, “কুশল-মিথিলা”। মিল হচ্ছে কি….?! কে জানে….?! তবে আমার তো লজ্জা করছে। ভয়ঙ্কর লজ্জা।

সেদিনের পর আজ দ্বিতীয় দিন। মানে আজ সপ্তমীর ভোর। রাতের প্রহর কাটতে শুরু করেছে। কিন্তু আমার চোখে ঘুম নেই। এই দুদিনেই তাকে নিয়ে কয়েক হাজার স্বপ্ন দেখে ফেলেছি। উঁহু চোখের নীচে ডার্ক সার্কেল পড়েনি। চোখে ঠিক ঘুম না থাকলেও গভীর তন্দ্রাচ্ছন্নতায় তাকে ঘিরেই স্বপ্ন দেখেছি। আর বারবার জেগে উঠেছি। লজ্জায় বালিশ আঁকড়ে একা একাই হেসেছি। আচ্ছা একটু বেশি বেশিই হয়ে যাচ্ছে না….?! হবে হয়ত। তবে বেশ লাগছে নিজের এই পাগলামি। নতুনত্ব আছে…!

লাল রঙটা বেশ ভালোই মানায় আমাকে। লাল রঙের কারিকুরি করা চুড়িদার, কপালের দুই ভ্রুর মাঝে ছোট্ট লাল রঙের টিপ, চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে গাঢ় বাদামি রঙের লিপস্টিক। সাথে খোলা চুলে খুব একটা খারাপ লাগছে না। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে নিজেই কম্প্লিমেন্ট দিয়ে কাঁধের স্লিং ব্যাগটা নিয়ে বেরিয়ে এলাম। সোজা স্টেশন। ট্রেনে উঠে গন্তব্য পঞ্চমীর দিনের সেই রাস্তার মোড়। আজ জীবনে প্রথমবার বাড়ি থেকে মিথ্যে বলে বেড়িয়েছি। বলেছি বান্ধবীদের সাথে আজ ঘুরতে যাওয়ার প্ল্যান আছে। কিন্তু আমি যাচ্ছি “তাকে” দেখতে। জীবনে প্রথমবার আমার যুবতী মন পাগলামি করছে। আজ তাকে একটু আস্কারা দিয়েই দেখি। এর আগে অবশ্য স্কুল থেকে পালিয়েছি বেশ কয়েকবার। ওই ইলেভেন টুয়েলভে। না না বন্ধু দের সাথে ঘুরতে যাইনি। টিউশন পড়া থাকত। কিন্তু স্কুলের সব ক্লাস শেষ হবার পর বেরোলে পড়তে যেতে অনেক দেরি হবে। তাই পালিয়ে আসতাম। ধরা পড়েনি এমন নয়। তবে বাড়ি আসার পর বান্ধবীরা খবর দিত তোর গার্ডিয়ান কল হয়েছে। ধূর! এসব শোনার পর তিন চারদিন স্কুল মুখো হতাম না। রোজ অহরহ স্টুডেন্ট স্কুল থেকে পালিয়ে যেত। ম্যাডাম আর কত হিসেব রাখবে…?! তিন চার দিন মুখ না দেখলে এমনিতেই সব ভুলে যেত। আর আমি আমার কাজ চালিয়ে যেতাম। …….সেই স্কুলের পর আজ যাচ্ছি। কে জানে কিসের আশায়…?! একবার ও ভাবিনি তাকে দেখতে পারব না। সত্যিই তো যদি ওখানে তাকে না পাই তো কি করব জানি না! আমি তো শুধুই এই ট্রেনের গতিতে ছুটে চলেছি। আমার পায়ের নীচে আজ সরষে লেগেছে।

ঠিকঠাক রাস্তা চিনে আসতে আমি ঘেমে পুরো জল। আজকেও রোদের বড্ড তেজ। কিন্তু আমি তো চাইছি বৃষ্টি। হোক না অঝোর ধারায় এক পশলা। কিন্তু চাইলেই তো আর সবকিছু পাওয়া যায় না। এদিকে মন্ডপে মন্ডপে সপ্তমীর ঢাকে কাঠি পড়েছে। সকাল সকাল কলা বৌ স্নান করিয়ে পূজো শুরু হয়েছে।
আমার গন্তব্য আমার থেকে কয়েক মিটার দূরে। আমি থমকে দাঁড়িয়ে আছি। আগের দিনের জামা কাপড় না পড়ে থাকলেও আমার তাকে চিনতে একটুও অসুবিধা হল না। ওই যে দাঁড়িয়ে কুশল। আজকেও কয়েকজনের সাথে আড্ডা দিচ্ছে। এরাই আগের দিন ছিল কি’না জানি না। আমি তো শুধু তাকেই দেখেছি। সে যাক্, কিন্তু এখন তো বুকটা ঢিপ ঢিপ করছে। কেন এসেছি সেটাই জানি না। তাকে দেখব বলেই এসেছি। কিন্তু এখন নিজেকে কেমন যেন বোকা বোকা লাগছে। এতদূর বাড়ি থেকে মিথ্যে বলে এসে শুধু দেখেই চলে যাব….?! নাহ্ , আজ মনে কেমন যেন শয়তানি বুদ্ধি ভর করছে। ভয় ও লাগছে। আবার আস্কারাও চাইছে। কি করা যায় …?! কি করা যায় …..?! ভাবতে ভাবতেই মনে হল, ধূর দিয়েই ফেলি মনকে আস্কারা। আমার একুশ বছরের জীবনে এই প্রথম কারোর দিকে দুবার ঘুরে তাকিয়েছি। পাগলামি করছি। সেই মানুষটাকে এমনি এমনি থোড়াই যেতে দেব…..?! উঁহু, কভি নেহি! তাই বেশ আত্মবিশ্বাস নিয়ে হেঁটে চললাম। আমার দৃষ্টি সোজা তার দিকে। গটগট করে হেঁটে গিয়ে দাঁড়ালাম “তার” সামনে। ওরা সবাই কিছু নিয়ে কথা বলছিল, আমাকে দেখেই সবাই আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি ততটা পাত্তা দিচ্ছে না। আমি তো সোজা তাকিয়ে আছি কুশলের অবাক চোখের দিকে। ও বাইকে হেলান দিয়েই দাঁড়িয়ে ছিল। আমাকে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ও কিছু বলার আগেই আমি বলে ফেললাম, আই লাভ ইউ! আমি তোমাকে ভালবাসি!
কুশল সহ ওই বাকি ছেলেগুলো সবাই অবাক। আমার দিকে গোল গোল চোখ নিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে আছে। আমি সবার দিকে একবার তাকিয়ে কুশলের আরো কাছে সরে দাঁড়ালাম। বেশ জোরেই আবার ও বললাম, শুনেছ?! ভালোবাসি তোমাকে।
ও এখোনো গোল গোল অবাক চোখে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে।

ক্রমশ…..
ভেবেছিলাম একটা পর্বেই শেষ হবে। হল না। দুই কি তিন পর্বের ছোট গল্প হবে। শুভ বিজয়া।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here