#শেষ_রাত
#পর্বঃ১৬
#সাইয়ারা_হোসাইন_কায়ানাত
‘সাদাফ! তোমার কি মনে হচ্ছে না তুমি অনেকগুলো ভুল ধারণা নিয়ে বসে আছো! প্রথমত আমি তোমাকে ভালোবাসতাম এখন বাসি না। তুমি আমার না হওয়া অতীত। আমার প্রাক্তন। তোমার কারণে আমি আমার বর্তমান আর ভবিষ্যৎ ছাড়তে পারবো না। কিছতেই না। আর দ্বিতীয়ত আমি কখনও-ই তোমার কাছে ফিরে আসবো না। আর আমি কোনো দিনও তুলতুলের আব্বুকে ডিভোর্সের কথা বলবো না।’
‘কিন্তু তুমি তো ধ্রুবকে ভালোবাসো না অনন্যা তাহলে কেন!’
আমার কথা শেষ হতেই সাদাফ গাঢ় স্বরে কথাটা বলল। তার এই কথাটা আমাকে ভাবালো। আমি আপনমনে ভাবতে লাগলাম। আমি ধ্রুবকে ভালোবাসি না তবুও কেন তার সঙ্গে থাকবো! কি কারণে থাকবো? মুহুর্তেই অনেক গুলো কারণ খুঁজে পেলাম। তার মধ্যে সব চেয়ে বড় কারণ হলো পূর্নতা। আমাদের মেয়ে পূর্নতা। ধ্রুব আর আমার মেয়ে।
‘ভালোবাসার থেকেও বেশি কিছু আছে সাদাফ। আর সেটা হলো গুরুত্ব। যা কি-না তোমার আমার ভালোবাসার মাঝে কখনই ছিল না। আমি ধ্রুবকে শ্রদ্ধা করি, বিশ্বাস করি, সম্মান করি। উনিও আমার থেকে দ্বিগুণ আমাকে শ্রদ্ধা করে। আমার অনুভূতি গুলোকে শ্রদ্ধা করে। আমার কষ্ট গুলোকে বোঝে। যখন আমি ভেঙে পরি তখন আমার দিকে ভরসার হাত বাড়িয়ে দেয়। আর সব থেকে বড় কথা হলো আমি আমার পরিবারকে ভালোবাসি। আমাদের মেয়েকে ভালোবাসি। আমি কখনই একজন স্বার্থপর মা হতে চাই না। কারও স্বার্থপর স্ত্রী বা পুত্রবধূ হতে চাইবো না। কখনই না।’
আমি থামলাম। সাদাফ আহত চোখে এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নেয়। বাহিরের কোলাহল আর আশেপাশের টেবিলে বসে থাকা মানুষগুলোর নিম্নস্বরে ফিসফিসে কথার শব্দে কেটে গেল কিছুটা সময়। ডান পাশের টেবিলে বসে থাকা প্রেমিক-প্রেমিকার ঠোঁটে মিষ্টি লাজুক হাসি। মনে মনে হাসলাম আমি। আবারও তাকালাম সাদাফের দিকে। কেউ কেউ নতুন প্রেমে মত্ত আর কেউ বা বিচ্ছেদের দাহনে পোড়াচ্ছে তার মন। আবারও মুচকি হাসলাম আমি। নিয়তির খেলায় হাসলাম।
সাদাফ মাথা নিচু করেই জড়ানো কন্ঠে বলল-
‘আর কোনো আশা নেই!’
আমি খানিকটা সময় চুপ থেকে শান্ত ভঙ্গিতে বললাম-
‘তোমার সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো খুব সুন্দর ছিল। মধুর ছিল। তুমি দীর্ঘ সাড়ে তিন বছর আমার লাইফে ছিলে এ নিয়ে আমার কোনো রিগ্রেট নেই। তবে আমি চাই না ভবিষ্যতে তোমার প্রতি আমার মনে তিক্ততা কিংবা ঘৃণা চলে আসুক। আমি চাই না তোমার জন্য আমার চরিত্রে দাগ লাগুক। বিয়ের পরও প্রাক্তনের সাথে সম্পর্ক রেখেছি বলে মানুষ আমার দিকে আঙুল তুলুক। তুমি যদি সত্যিই আমার ভালো চাও তাহলে আর কখনও আমার সামনে ভালোবাসার দাবী নিয়ে এসো না। কলেজে এসে এভাবে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থেকো না সাদাফ।’
আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। শান্ত চোখে চাইলাম সাদাফের দিকে। সে আগের মতোই মাথা নত করে বসে আছে। আমি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ব্যাগ নিতে নিতে বললাম-
‘জানো তো সাদাফ ভালোবাসার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া অবহেলার মুহুর্ত গুলো বিষের মতো বিষাক্ত হয়। তাই পরের বার কাউকে ভালোবাসলে তাকে অবহেলা করো না। তার কষ্টের সময় কিছু করতে না পারলেও অন্তত তার মাথায় একটু ভরসার হাত রেখো। আসছি। ভালো থেকো।’
আমি বেরিয়ে এলাম। সাদাফকে পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে লাগলাম সামনে। পেছনে ফেলে গেলাম বিষাদময় অতীত। ভার্সিটির সামনে এসেই ধ্রুবকে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলে দেখলাম। মুখোমুখি হলাম আমার বর্তমান আর ভবিষ্যতের সাথে। আমার কপালের সূক্ষ্ণ ভাঁজটা চলে গেল৷ ঠোঁটের কোণে ফুটলো তৃপ্তিময় হাসির রেখা। আমাকে দেখে ধ্রুব সহজ ভঙ্গিতে হেসে বললেন-
‘গাড়িতে উঠে বসুন।’
ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো না আমি কোথায় গিয়েছিলাম। জানতে চাইলো না কোনো কিছুই। আমি চাচ্ছি উনি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করুক। তাই আর আমি গাড়িতে উঠে বসলাম না। দাঁড়িয়ে থাকলাম আগের মতোই। ধ্রুব ভ্রু জোড়া ঈষৎ কুচকে আমার দিকে তাকায়। আমি ক্ষীণ স্বরে বললাম-
‘আপনাকে আমার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলার ছিল। আমার অতীত নিয়ে। আর আমার প্রাক্তন নিয়ে।’
ধ্রুব কিছু বলার আগেই ধ্রুবর পেছনের রাস্তা দিয়ে রাফিন ভাই দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। কন্ঠে অস্থির ভাব নিয়ে হড়বড়িয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
‘কেমন আছেন ভাবি? সাদাফকে দেখেছেন? কতক্ষণ ধরে ওকে খুঁজে যাচ্ছি।’
আমি থমকে গেলাম। অপ্রস্তুত হয়ে তাকালাম ধ্রুবর দিকে। সে আগের মতোই স্বাভাবিক। বাঁকা হয়ে রাফিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ইতস্তত করে করে বললাম-
‘সামনের রেস্টুরেন্টে।’
রাফিন ভাই হন্তদন্ত হয়ে চলে যেতে নিলেই ধ্রুব তাকে ডাকলেন-
‘এই যে শুনুন। ভাবির সাথেই কথা বলে চলে যাবেন! ভাইয়ের সাথে পরিচিত হবে না!’
সাদাফ থতমত খেয়ে যায়। একবার আমার দিকে আরেকবার ধ্রুবর দিকে চেয়ে মিনমিনিয়ে বলল-
‘অহহ আপনিই ধ্রুব? সাদাফ বলেছিল আপনার কথা। আচ্ছা অন্যদিন পরিচিত হবো। আজ একটু তাড়া আছে।’
রাফিন ভাই চলে গেলেন ব্যস্ত পায়ে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম হতভম্ব হয়ে। ধ্রুব গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে অত্যন্ত স্বাভাবিক গলায় বললেন-
‘এখানে না দাঁড়িয়ে থেকে চলুন অন্য কোথাও যেয়ে কথা বলি।’
আমি চুপচাপ ধ্রুবর কথা মতো গাড়িতে উঠে বসলাম। ধ্রুব এবারও কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। কেন রাফিন ভাই আমাকে ভাবি ডাকলেন! কেন সাদাফের খবর আমি জানি! কিছুই জিজ্ঞেস করলেন না। বেশ খানিকটা পথ নিস্তব্ধতায় পাড় হলো। ধ্রুব ড্রাইভিং করছে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। আমি কিছুক্ষণ হাসফাস করতে করতে বললাম-
‘আপনি সব জানতেন তাই না!’
ধ্রুব কোনো জবাব দিলেন না। আমার দিকে ফিরেও তাকালেন না। যেন তিনি একাই এই গাড়িতে বসে আছেন। আমি নামক কোনো ব্যক্তি তার পাশে নেই। তিনি আপনমনেই গাড়ি ড্রাইভ করছেন। হঠাৎই একটা ব্রিজের পাশে এসে গাড়ি থামালেন। আমার দিকে ঘুরে সহজ গলায় বললেন-
‘হ্যাঁ জানি তো। আগে থেকেই জানি।’
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম-
‘সব জেনেও এতদিন কিছু বললেন নি কেন?’
‘কিছু বলেনি কারণ আমার বিশ্বাস ছিল আপনি নিজেই সব কিছু ঠিক করে নিবেন। মনে হচ্ছে সব ঠিক হয়ে গেছে। কি হয়নি ঠিক!!’
ধ্রুব তার ভ্রু জোড়া নাচিয়ে কিছুটা ঝুঁকে এলেন আমার দিকে। আমি সরু চোখে ওনাকে দেখলাম। বরাবরের মতোই তার ঠোঁটে সহজ সরল হাসি। এই হাসির পেছনে যে মানুষটা আরও কত কিছু লুকিয়ে রেখেছেন এক মাত্র আল্লাহ তায়ালা আর তিনি নিজেই জানেন। আমি হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে প্রশ্ন করলাম-
‘সাদাফের সাথেই আমার সম্পর্ক ছিল এটা কবে থেকে জানেন?’
‘বিয়ের আগে আগে থেকেই জানি। তবে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়েছিলাম যেদিন সাদাফ আপনার হাত ধরেছিল ভার্সিটির মাঠে সেদিন। তোমাদের দেখে আমি চলে এসেছিলাম। তোমাদের মাঝে কথা বলতে চাইনি৷ কারও ব্যাক্তিগত আলাপে না যাওয়াটাই বেটার মনে করেছি। আর আপনি নিজেই সামলে নিতেন তাই চলে এসেছিলাম।’
ধ্রুবর কথা প্রচন্ডরকম অবাক হলাম। বিস্মিয়ের চোখের ওনার দিকে চেয়ে গলার স্বর নামিয়ে জিজ্ঞেস করলাম-
‘বিয়ের আগে জেনেছেন মানে? কাছ থেকে জেনেছেন? সাদাফের কথা তো তেমন কেউ জানতো না।’
ধ্রুবর সোজা হয়ে বসলেন। রহস্যময় হাসি দিয়ে বললেন-
‘বলেছে খুব কাছের একজন। আপনার খুব প্রিয় একজন মানুষ।’
আমি মনে মনে ভাবতে লাগলাম কে হতে পারে সেই মানুষ যে কি-না আমাদের সম্পর্কে জানে। সানি? নাহ ও তো ধ্রুবকে চিনতোই না। তাহলে কি ভাইয়া? তবে ভাইয়ার সাথেও তো ধ্রুবর তেমন একটা পরিচয় ছিলো না। তাহলে আর কে হতে পারে? আমি কোনো জবাব খুঁজে না পেয়ে বললাম-
‘বলুন না কে বলেছে আপনাকে এসব?’
চলবে….
[অনন্যার উত্তরে খুশি হয়েছে সবাই? এইদিনের জনই তো সবাই অপেক্ষা করছিলেন। সবাই আপনাদের মতামত জানাবেন। আজ হয়তো পর্ব ছোট হয়েছে সেজন্য দুঃখিত।]