#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_২২
#মিদহাদ_আহমদ
‘তুমি তানিয়া আপাকে কেন ডেকেছো?’
কোন জবাব দিলো না আসিফ৷ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে নিজে নিজে বলে বসলো,
‘কিছু একটা করতে হবে। কিছু একটা করতে হবে আমার।’
আমি আসিফের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। আসিফ আমার দিকে ফিরে তাকালো। তারপর সে বললো নিজ থেকে,
‘কি? কিছু হয়েছে?’
‘তুমি আপাকে কেন আসতে বললা?’
‘আসতে বলেছি কারণ সে সব ঠিক করে দিয়ে যাবে।’
‘মানে?’
‘কোন মানেটানে নাই। যা বলছি তাই।’
আমার মাথায় বাজ পড়ে গেলো। আসিফকে সরাসরি বলে বসলাম,
‘এই মদের নেশা তোমাকে মানুষ থেকে অমানুষে পরিণত করে ফেলেছে। তুমি কোন বোধশক্তির মানুষ নও। তুমি নিজে কখন কী করো তার কি কোন কন্ট্রোল আছে নিজের উপর?’
‘তোমার কি কোন সমস্যা নুপুর?’
আমি আশ্চর্য হয়ে চেয়ে রইলাম আসিফের কথা শুনে। তার দিকে অবাক চোখে চেয়ে বললাম,
‘তুমি আসলেই কি চলে যাওয়ার কথা ভাবছো?’
আসিফ জবাব দিলো না। তানিয়া আপার নাম্বার থেকে কল এলো। আসিফ কল রিসিভ করলো৷ লোকেশন জানিয়ে দিলো আবার৷ আধা ঘন্টার ভেতরে আমার ননাস আর ননাসের জামাই আমাদের চার তলার ছাদের উপর ছোট এক রুমের বাসায় এসে হাজির। তারা বাসা এসে ঢুকতেই আসিফ আমাকে ডাক দিয়ে বললো,
‘দিয়ে দাও। এক্ষুণি দিয়ে দাও।’
‘কী?’
আসিফ আমার হাত ধরে আমার আঙুল থেকে ডায়মন্ডের আংটিটা খুলে নিলো। আমার ননাসের হাতে আংটিটা দিয়ে বললো,
‘এইটা নিয়ে যাবার জন্যই বলেছিলাম এখানে আসতে৷ এখন আসতে পারো তোমরা।’
ননাস আসিফকে বললো,
‘কী আইটা?’
‘আংটি। তুমি দিয়েছিলে না নুপুরকে? নিয়ে চলে যাও।’
ননাস আসিফকে ধরে বললেন,
‘ভাই! তুই আমাদের খুব আদরের ছিলি ছোটবেলা থেকে। জানি না সেই আদরের ছোট ভাই দিনকে দিন এমন পরিবর্তন হয়ে গেলো কীভাবে! জানিস, তোকে নিয়ে আমাদের কত স্বপ্ন ছিলো? কত আবেগ ছিলো?’
‘হুম। সব শেষ। আমি কোন স্বপ্ন পূর্ণ করতে পারিনি। এখন তুমি তোমার দেয়া আংটিটা নিয়ে চলে যাও আপা। আমি ভালো আছি। একা আছি। দেখি কিছু করতে পারি কিনা। আর না করতে পারলে কোন সমস্যা নাই। না খেয়ে, ক্ষুদার্ত হয়ে, অনাহারে মারা যাবো। তবুও তোমাদের ঘরে আর যাবো না।’
ননাসের স্বামী আসিফকে বললেন,
‘এইতো শালাবাবু ঠিক বলেছো। লাইফে নিজে কিছু করা আর অন্যের উপর থেকে করা দুটোর মধ্যে ফারাক অনেক।’
তারপর দুলাভাই ননাসের দিকে চেয়ে বললেন,
‘দেখে নিও, সে ঠিকই এবার কিছু একটা করবে। আর করবে না শুধু, ভালো ভাবেই করবে। এইটা আমার একান্ত বিশ্বাস।’
ননাসের চোখ বেয়ে পানি নামলো। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন,
‘কিছু খেয়েছো তোমরা?’
আমি না সূচক মাথা নাড়ালাম। ননাস তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট টিফিন ক্যারিয়ার বের করলেন। তারপর আসিফকে ফ্লোরে বসিয়ে বললেন
‘তোর পছন্দের ভূণা খিচুড়ি আর ডিম করে এনেছি। খেতে হবে৷ না করলে চলবে না। নুপুর, তুমিও বসো।’
এমন সময়ে কলিংবেল বেজে উঠলো। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুললাম। এক মধ্য বয়সী মহিলা দাঁড়ানো। তিনি বললেন,
‘কিতাগো মাই? নয়া আইছো দেখাত আইলাম। কিতা করইন তোমার জামাইয়ে? ভিতরে জুতা লইয়া আইরাম। আমার জুতা ছাড়া হাঁটার অভ্যাস নাইনু এরদায়।’
উনি বাড়িওয়ালির স্ত্রী৷ আমি উনাকে ভেতরে নিয়ে এলাম। বসানোর মতো কোন জায়গা নেই। কোন আসবাবও নেই৷ জিজ্ঞেস করলেন,
‘ঘরো কিতা লাখড়ি সেট নাইনি? তোমার বিয়াত আইছেনানি কিতা?’
আমাকে কাটিয়ে ননাস বললেন,
‘আন্টি সব আছে। আমরা আসলে পুরোপুরি সেট করিনাই তো। আজকালকের ভেতরে সব এসে যাবে।’
‘অহ আইচ্ছা। তুমি খে এইনোর?’
‘সে আমার ভাইয়ের বউ হয়।’
‘আইচ্ছা তে আইজ যাইগিয়া। আইমুনে বাদে।’
বাড়িওয়ালি মহিলা চলে গেলেন। আসিফ আমার ননাসকে বললো,
‘এসব দেখানো ভালোবাসার প্রয়োজন নাই আপা। তোমাকে আংটি দিনে ডেকে এনেছি। আংটির দাম কত আমার জানা নেই, তবে দামি হবে। আমি কারো কোন দায় নিয়ে থাকতে চাই না।’
‘বোনের ভালোবাসা দায় হবে কেন? জানিস আমি বুঝতে পেরেছি ভালোবাসা কী জিনিস? যেই নুপুরকে আজ এতটা দিন আমি খারাপ ভেবে এসেছিলাম সেই নুপুর আমার জন্য কথা বলেছে তোর দুলাভাইয়ের সাথে। আর তাকে আমি কী না কী বলেছি! আমার লজ্জায় শেষ হয়ে যেতে ইচ্ছে করছে এখন। এই নুপুর আমার হয়ে কথা বলেছে। আর আজ আমি আমার চোখের সামনে দেখছি, নুপুর আমার বিগড়ে যাওয়া ভাইকে আলোর পথে আনছে৷ ভালোবাসায় মানুষ কী না পারে!’
আমার ননাসের কথাগুলো শুনে আমার চোখে অশ্রু চলে এলো। আসিফ ননাসকে বললো,
‘আংটি নিয়ে চলে যাও আপা।’
দুলাভাই বললেন,
‘দেখো শালাবাবু, জীবন সব সময় থমকে যায় না। মাঝেমধ্যে জীবন নতুন করে চালাতে হয়৷ আর এই চালানোর জন্য মাথা ঠান্ডা করে কাজ করতে হয়৷ বসে থাকলে হয় না, থমকে গেলেও হয় না। সব সময় ভরসা রাখতে হয় নিজের উপর। ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করতে হয়। আজ আমি এখানে এসেছি কেন জানো? কারণ এই মেয়েটা। তোমার স্ত্রী সম্পর্কে আমার শালা বউ হলেও, সে আমার চোখমুখ খুলে দিয়েছে। আমাকে বুঝিয়েছে সম্পর্কের মানে টা কী! আর তার জন্যই আজ আমরা দুজন নতুন বাসায় উঠেছি। পরিবার থেকে বের হয়ে এসেছি।’
‘কী বলছো দুলাভাই? কী এসব আপা?’
‘হ্যাঁ রে আসিফ৷ তোর দুলাভাই আর আমি বাসা থেকে বের হয়ে এসেছি। আভিজাত্য আর টাকায় শান্তি আছে কিনা জানি না, এবার নাহয় সাধারণ ভাবে বেঁচে দেখি৷ দেখি জীবনের মানে কোথায় দাঁডায়। এই মানুষটাকে সাথে করে কীভাবে থাকতে পারি।’
দুলাভাই তার পকেট থেকে একটা হাজার টাকার ব্যান্ডেল বের করলেন৷ তারপর আসিফের হাতে দিয়ে বললেন,
‘এখানে এক লাখ টাকা আছে। মনে করো আমি তোমাকে ধার দিয়েছি। আমাকে এক বছরের মধ্যে ফেরত দিয়ে দিতে হবে। আর সুদ হিসাবে আমাকে একটা পারফিউম আর তোমার বোনকে আড়ং এ এক্সক্লুসিভ একটা ড্রেস দিয়ে দিলেই হবে। নতুন সংসার, নতুন ঘর, নতুন জীবন। সব নতুন করে শুরু করো শালাবাবু। এই টাকাটা তুমি ধরো ‘
আমি ননাসের দিকে তাকালাম। তার চোখ যেনো আকুতি করে বলছে তার ভাইকে, ‘টাকাটা নিয়ে নে’
অন্যদিকে আমি চিন্তায় বিভোর হচ্ছি, আসিফ যদি আবার নেশা শুরু করে তখন?
দুলাভাই এক প্যাকেট সিগারেট বের করে আসিফের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন,
‘এইটাও রাখো’
(চলবে)