#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_২৫
#মিদহাদ_আহমদ
‘সামান্যতম মানবিকতা মানুষের মাঝে নাই? কাকে বলছিলে?’
হতভম্ব হয়ে গেলো বদরুল। আমতা আমতা করে জিজ্ঞেস করলো,
‘মা আ আ নে…’
‘মানে সামান্যতম মানবিকতা নাই?’
চোখ বড় বড় করে তাকালো তানিয়া। বদরুলের চোয়াল বেয়ে ঘামের বিন্দু বিন্দু ফোঁটা জমাট বাধতে লাগলো। আকস্মিক এই অঘটন ঘটে যাবে এর ধারণাও করতে পারেনি সে। এ যেনো হুট করে উড়ে আসা সাইক্লোন সবকিছু তছনছ করে দিতে এসেছে৷ তানিয়া শব্দ করে গ্লাসটা টেবিলে রেখে বদরুলকে জিজ্ঞাসা করলো,
‘কার সাথে কথা বলছিলে?’
তানিয়ার শব্দ করে গ্লাস রাখা দেখে বদরুল মনে মনে জাগ্রত হওয়া ভয়টা আরও নিরেট হয়ে উঠলো। সে বললো,
‘না মানে…’
‘অফিসের কেউ?’
এবার যেনো হিতাহিত জ্ঞান ফিরে পেলো সে৷ তারমানে তানিয়া কিছু শুনতে পায়নি? মনে সাহস সঞ্চার করতে লাগলো বদরুল। মুখ আটকালো না মিথ্যা বলতে। খই ফুটার মত বললো,
‘আরে হ্যাঁ। অফিসের সহকারী একজন। সে লোন নিবে বিশ লাখ৷ ম্যানেজার সিগনেচার দিচ্ছেন না এখানে৷ মানে দেখো মানুষের মাঝে সামান্যতম মানবিকতা নাই। একটা সিগনেচার করে ইস্যু করে দিলেই তো হয়৷ দেখো আজ আমাদের লাগছে না, কাল আমাদের লাগতে পারে না? এজন্যই বলছিলাম মানবিকতা আজকাল আর কারো মধ্যে নেই৷ সবকিছু একেবারে ডুবে গিয়েছে দুনিয়া থেকে। সবাই এমন হয়ে যাচ্ছে যেনো। তাইনা?
‘তাই?’
‘কেন? তাই তো। সন্দেহ আছে কিছু?’
‘অহ আচ্ছা। চলেন মিস্টার। খাবার রেডি করা আছে টেবিলে। টেবিলে খাবেন নাকি এখানে এনে দিবো? কাল সকালে আবার দাওয়াত আছে আপনার শ্বশুর বাড়িতে।’
‘আচ্ছা তুমি যাও। আমি বাথরুম থেকে আসছি।’
‘আচ্ছা আসো।’
বদরুল তাড়াতাড়ি বাথরুমে গিয়ে ঢুকলো। বুকে থু থু দিলো। একদলার মতো থু বেরিয়ে এলো যেনো। তার সেদিকে খেয়াল নেই। এ যেনো এক মরুতে জেগে উঠা পানির ফুয়াড়ার মতো অনুভূতি! লুকিং গ্লাসে নিজেকে দেখতে দেখতে মুখে পানি ছিটা দিলো। চোখ দুইটা যেনো মুহূর্তেই লাল রক্তের বারুদ হয়ে গিয়েছে। ভাগ্যিস তানিয়া শেষ মুহূর্তে এসে শুধু শেষের কথা শুনেছে। তাও পুরোপুরি না। যদি তানিয়া আজ শুনে ফেলতো তার কথা? কী অনর্থই না হয়ে যেতো।
মিনিট দুয়েকের মাথায় বদরুল টেবিলে গিয়ে খেতে বসলো। মনে মনে ভাবলো, এমন ভুল আর করা যাবে না। এরকম থাকলে কখন যে সবকিছু খোলে যাবে তানিয়ার কাছে!
খেতে খেতে তানিয়া তার স্বামীকে বললো,
‘জানো আমি প্ল্যান করেছি বাবা মায়ের থেকে সব সম্পত্তি আনার পর আমরা দুজনে সিঙ্গাপুর যাবো এক মাসের ট্যুরে। সবকিছু বেশিবেশি খরচ করবো। কোন রেস্ট্রিকশন থাকবে না। এর পরের বছরেই আমরা দুজন হজ্ব করে ফেলবো। কেমন?’
ভাত খেতে খেতে বদরুল বললো,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ। কেন নয়? অবশ্যই হবে। তুমি যেমন চাচ্ছো তেমন হবে।’
আমার খাবার রান্না শেষ করতে করতে রাত তিনটা বেজে গেলো। এদিকে আসিফ একটা সিগারেট ধরিয়ে রান্নাঘরে এসে পায়চারি করতে লাগলো। জিজ্ঞেস করলো আর কতক্ষণ৷ একেবারে যেনো শিশু বাচ্চা এসে বারবার জানতে চাইছে রান্নার আর কতক্ষণ বাকি। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার রান্না হয়ে গেলো৷ রুমে হাড়ি নিয়ে গেলাম। মেঝেতে বসে দুজনে খেয়ে নিলাম।
সকালে আমার ঘুম ভাঙ্গে আসিফের ডাকে। আমি দেখলাম আসিফ আমার সামনে চা আর সেমাই নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারপর সে বললো,
‘ঈদ মুবারক। আপনি কি এবার উঠবেন বিছানা থেকে? সকাল সাত টা বাজে।’
আমি তড়িঘড়ি করে উঠে গেলাম। আজ আমাদের প্রথম ঈদ৷ আসিফ নামাজে যাওয়ার আগে আমার উচিত ছিলো তাকে সেমাই করে খাওয়ানোর৷ কিন্তু না। আমার আগে সেই উঠেছে৷ নামাজের আর এক ঘন্টা বাকি। আমি নাস্তা সেড়ে গোছল করে আসলাম। আসিফকে বিদায় দিলাম নামাজের জন্য। আসিফ বের হতে না হতেই মায়ের নাম্বার থেকে কল। রাগে কষ্টে ফোন রিসিভ করলাম না। যে মানুষটা এভাবে আমাকে দূরে ঠেলে দিল, কী দরকার তার সাথে কথা বলার? কী দরকার তাকে ঈদ শুভেচ্ছা জানানোর?
আবারও রিং বেজে উঠলো। আমি ইগনোর করলাম। শাড়ি গায়ে জড়াতে লাগলাম। কল মায়ের নাম্বার থেকে অনবরত আসতেই লাগলো। আসতেই লাগলো। টানা পনেরোটা তো হবেই। বাথরুমের লুকিং গ্লাসের দিকে তাকিয়ে সাজছিলাম আমি৷ আজ আমাকে সত্যিই ভীষণ সুন্দরি লাগছে। তারপর ফোন উঠালাম। ফোনের ওপাশে আমার ছোট ভাইয়ের কন্ঠ। ছোট ভাই হুলস্থুল করে বলছে আমাকে,
‘আপা জলদি আসো। আপা জলদি আসো। আব্বার শরীর ভালো না। আব্বার শরীর ভালো না।’
আমি শুনতে পাচ্ছিলাম অপর পাশে আমার মায়ের আহাজারি আর কান্নার আওয়াজ। মা আমার পাগলের মতো কান্না করছেন। আমি মুহূর্তে ভাষা ভুলে গেলাম যেনো। আমার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছে না। কিছুক্ষণের মধ্যে আসিফ বাসায় চলে এলো নামাজ থেকে। সে আসতেই তাকে জড়িয়ে ধরলাম আমি। আসিফ জিজ্ঞেস করলো কী হয়েছে। বললাম বাবা অসুস্থ। ছোট ভাই কল করেছে। আমার মুখ থেকে এই কথা শুনে আসিফ আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করলো না৷ সে নিচে নেমে গেলো। গাড়ি একটা এনে আমরা বাড়ির পথে রওয়ানা হলাম। ঘন্টা দুয়েকের মাঝে আমরা বাড়িতে এসে পৌঁছালাম। মায়ের নাম্বারে কল দিলাম। কল রিং হচ্ছে কিন্তু বন্ধ৷ বাড়িতে এসে দেখি তালা দেয়া। কেউ নেই। পাশের বাড়ির চাচিকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানালেন, আমার শাশুড়ি নাকি এসে আমার বাবাকে এম্বুল্যান্স করে শহরে নিয়ে গেছেন। আমি একেবারে তব্দা খেয়ে বসলাম। আমার শাশুড়ি এখানে? আমি মায়ের নাম্বারে কল করলাম আবারও। রিসিভ হচ্ছে না। আমি শাশুড়ির নাম্বারে কল দিলাম। শাশুড়ি কল রিসিভ করতেই বলে উঠলেন,
‘কী? এইতো আমাকে দরকার পড়লো তাইনা? তোমার মা তো কান্নাকাটি করে আমাকেই কল দিলেন৷ আমিই তাকে আনলাম হসপিটালে। রক্ত মাংসের মানুষ তো। পাষাণ আর হতে পারি না৷ আমরা নূরজাহান হসপিটালে আছি এখন। ঈদের দিন সকালে যে শাশুড়িকে কল করে অন্তত সালাম আদাব করা লাগে, এই আদবটুকুও জানো না নাকি?’
শাশুড়ি কল রাখলেন। আসিফ জিজ্ঞেস করলো,
‘মা কী বলেছেন?’
আমি ভাঙ্গা গলায় হসপিটালের নাম বললাম। আর কিছু বললাম না। আসিফ সিএনজিতে উঠে আবার শহরের দিকে গাড়ি ঘুরাতে বললো। রাস্তায় যেতে যেতে শুধু ভাবছিলাম আমি, একটা মানুষ এরকম কীভাবে হতে পারে! একটা মেয়ের বাবা অসুস্থ জেনেও কথা শুনাচ্ছে! একটুও বেগ নিচ্ছে না তার ভয়ার্ত কথাগুলো!
ঘন্টাখানেকের মাথায় আমরা হসপিটালে এসে পৌঁছালাম। আমি দেখলাম শাশুড়ি আমাকে ক্রস করে হসপিটালের গেইট দিয়ে বের হচ্ছেন৷ আমাদের গার্মেন্টস এর ম্যানেজার ওনার সাথে। উনি তাকে বলছেন,
‘সম্পর্কের খাতিরে তো কিছু যাকাতের টাকা দিয়েও পাশে থাকতে হবে৷ তুমি থাকো। কোন টাকা পয়সা লাগলে দিও। ডাক্তার যা করতে বলে তাই করো।’
আসিফও শুনলো তার মায়ের এই কথাগুলো। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম সে বিষ খেয়ে বিষ হজমের মতো নির্বিকার হয়ে আছে। কোন প্রতিবাদ করছে না। অন্য সময় হলে আসিফ ঠিকই কথা বলতো কিছু না কিছু৷ শাশুড়ি আমাদের সামনে করেই বাইরে গিয়ে কারে চড়ে বসলেন। মনের ভেতরে সুচের মতো বিধলো ওনার কথাগুলো। আমার অসুস্থ বাবাকে সামনে রেখেও ওনার মুখ থেকে এসব আটকালো না? আমি তো এতদিন সব চুপ করে সহ্য করেছি শুধুমাত্র ওনার জন্য। ওনার ছেলের জন্য। কারণ আমি জানি, একজন মায়ের কাছে তার বাচ্চার চেয়ে বড় কোন প্রাপ্তি আর নেই। আমার মাও তো আমার ভালো থাকার জন্য আমার খারাপ হবে জেনেও এই বড় ঘরে বিয়ে দিয়েছেন। আমার মায়েরও তো একটাই শখ ছিলো, তার মেয়ে বড় ঘরে যাবে, বড় ঘরে থাকবে।
ভেতরে যেতেই দেখি মা কান্না করছেন বসে। ছোট ছোট ভাই দুইটা মাকে ঘিরে বসে আছে। বাবা আইসিইউ তে৷ আসিফ ডাক্তারের কাছে গেলো। জিজ্ঞেস করলো আর কিছু দরকার কিনা৷ উন্নত চিকিৎসার জন্য অন্য কোথাও নিতে হবে কিনা। ডাক্তার জানালো তারা দেখছে। আমি মাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা কোন কথা বলতে পারছে না। একেবারে শেষ হয়ে যাওয়া মানুষের মতো বসে আছে। এ যেনো বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া কোন এক আগন্তুক বসে আছে থমকে। পথ যেনো একেবারে আগলে রেখেছে ভয়ার্ত কোন আর্তনাদে।
আমি নিজেকে সামলে নিলাম। আমার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে না আর। রাস্তায় পুরোটা সময় কান্না করেছি কিন্তু এখানে এসে কান্না যেনো আমার থেকে দূরে সরে আমাকে শক্ত সামর্থ্যবানের মতো করে তুলেছে। মাকে বললাম
‘দেখো মা, বাবার কিচ্ছু হবে না। বাবা এভাবে আমাদের একা করে যাবে না। দেখবা বাবা ঠিকই আবার আগের মতো হয়ে যাবে। আমাদের কাছে ফিরে আসবে। ‘
হায় আল্লাহ! আমি কি জানতাম আমার এই চাওয়াটুকু উপরওয়ালা রাখবে না। উপরওয়ালা প্রতিবারের মতো আমাকে এবারও যেনো প্রত্যাখ্যান করে দিলেন নিজের কাছ থেকে।
ডাক্তার এসে জানালো, আমার বাবা আর নেই। মস্তিষ্কে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হওয়ার কারণে তাঁকে আর বাঁচানো সম্ভব হয়নাই। ডাক্তার একেবারে সামনাসামনি এসে কথাটা বলে দিলো। মা শব্দ করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেদে উঠলেন৷ হাত দিয়ে ধরে রাখলেন আমার ছোট ছোট দুই ভাইকে। আমি একেবারে চুপ থেকে গেলাম। এ কোন নিয়তি প্রভু! তুমি এ কোন দিন আমাকে দেখাচ্ছো। আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি একেবারে চলে গেলো গেলো এমন। আসিফ আমাকে ছাড়িয়ে আনলো মায়ের থেকে। একটু সামনে নিয়ে চেয়ারে বসালো৷ আমি একেবারে চুপ। আমার চোখ দিয়ে কান্না বের হচ্ছে না। আসিফ আমার হাত ধরতেই আমি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলাম। আসিফকে জড়িয়ে ধরলাম। আসিফ আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
‘নুপুর, তোমাকে শক্ত হতে হবে। তোমাকে তোমার মায়ের ভরসা হতে হবে। তোমাকে শক্ত হাতে তোমার ভাইদের জন্য কিছু করতে হবে। এভাবে তোমাকে ভেঙ্গে যেতে আমি দেখতে পারবো না। তুমি এভাবে যদি ভেঙ্গে যাও, তাহলে তোমার মা ভাইকে কে দেখবে?’
আসিফ আমাকে মায়ের পাশে এনে বসালো৷ আমি মায়ের হাত দুটো শক্ত করে ধরলাম। আমার ছোট ভাই দুইটাকে নিজের সাথে করে বাইরে নিয়ে গেলো আসিফ। তারা দুইটা সকাল থেকে কিছু খায়নি। হয়তো খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছে!
ঘন্টাখানেকের মাথায় সব ফর্মালিটি পূরণ করে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বাড়ির উদ্দেশ্যে। আমাদের সেই মাটিমাখা গন্ধওড়া ছোট গ্রামের ভেতরে আমার বাবা লাশ হয়ে গেলেন৷ এইতো দুইদিন আগেও আমার বাবা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন,
‘ মারে তোকে বিয়ে দিয়ে তোর সব স্বপ্নকে আমি একেবারে চিরদিনের জন্য আটকে দিলাম এক বন্ধনের বাধনে। আমাকে ক্ষমা করি।’
মনেমনে বাবাকে সেদিন ক্ষমা করিনি আমি৷ কিন্তু কে জানতো, বাবাকে আজ আমাকে নিজেই ক্ষমা করে দিতে হবে!
বাড়িতে গিয়েই আমি অবাক হলাম। আমার শাশুড়ি এসে হাজির। গরু কেটে শিন্নি করার বন্দোবস্ত হয়ে গিয়েছে। পাশের ঘরের চাচি আমার মাকে নিয়ে ঘরে ঢুকতেই বললেন,
‘নুপুর তোর শাশুড়ি সাদা শাড়ি নিয়ে এসেছেন। কিন্তু সেই শাড়ি এখন তোর মাকে পরানো যাবে না। বিধবার বাপের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা শাড়ি সবার আগে বিধবার গায়ে দিতে হয়।’
আমার মায়ের চোখ দিয়ে পানি গড়াচ্ছে। আমার কোন বোধশক্তি নেই যেনো। চুমকি খালা এসে কানে কানে আমাকে বললেন,
‘নাখফুল অগুতা খুলিলা তুই। খুলিয়া রাখিদে যেছাখানো। মাইনষে আইয়া দেখলে বাদ ফাইবো৷ আর লগালগ হাড়ি অখান বদলা। দেখ কিলান লাগের ই লাল রঙা হাড়ি ইকান দেখিয়া৷ তোর মারে ক ই উরি দিয়া কান্দন যেনো না দেয়৷ কিতা আর করবায় আল্লার মাল আল্লায় নিছইনগিয়া।’
আমার এমন দিন আসলো আল্লাহ, যে আমার নিজের হাতে আমার মায়ের নাকফুল খুলে ফেলতে হবে!
কেউ একজন ফিসফিস করে বললো,
‘আল্লাহ দেখো মেয়েকে নাকফুল দিলেন তো মেয়ের মায়ের নাকফুল নিলেন। আল্লাহর লীলা বুঝা দায়৷’
সবার কথাগুলো স্পষ্ট হয়ে কানে এসে লাগছিলো শুধু৷ কোন কথা বলার উপায় ছিলো না। আমার মা একা হয়ে গিয়েছেন। আমার ছোট ছোট ভাই দুইটার মাথার উপরের ছায়া নাই হয়ে গিয়েছে। এই এহেন অবস্থায় আমার মায়ের পাশে থাকবে কে?
কেউ কেউ তারিফ করছেন আমার শাশুড়ির। বলছেন, বড় ঘরে বিয়ে দিলে নাকি এই লাভ৷ আজ আমার বাবার মারা যাওয়ার সাথে সাথে আয়োজন হচ্ছে, শিরনি হচ্ছে৷ আমার বাবার ভাগ্য নাকি বড়োই প্রসন্ন!
ঈদের দিন আসরের নামাজের পর আমার বাবার জানাজা হলো। শুনেছি জানাজার আগে বাবা সুদে যে টাকাটা এনেছিলেন মতিন মেম্বারের কাছ থেকে আমার বিয়ের সময়ে, সুদ আসল মিলিয়ে সেই টাকাটা হয়েছিলো ছয় লাখ। বাবা মিটিয়েছিলেন এক লাখ। আরও লাখ পাঁচেক বাকি। এই টাকাটার একটা ফায়সালা না করলে সে বাবাকে কবর দিতে দিবে না। আমার শ্বশুর এগিয়ে এসে নাকি বলেছেন তিনি সব টাকা বাবার জানাজার পর পরিশোধ করে দিবেন।
ঘটনাটা শুনে যতোটা না খুশি হয়েছি তারচেয়ে বেশি অবাক হয়েছি। আমার শাশুড়ি এসে আমার বাবার শিরনি করছেন, আমার বাবার কাছে মানুষের পাওয়া টাকা শোধ করছেন আমার শ্বশুর। লোকের মুখেমুখে আমার বাবার মৃত্যুশোকের জায়গায় উচ্চারিত হচ্ছে আমার শ্বশুরবাড়ির জয়গান। অথচ আমার শ্বশুর শাশুড়ি এসব কেন করছেন তার কোন কারণ আমার জানা নেই। বাবার জানাজার পর আমার মা নিস্তেজ হয়ে গেলেন৷ শরীর একেবারে বসে এসেছে যেনো। আমি মায়ের মাথায় পানি দিলাম। ছোট ছোট ভাই দুইটা একেবারে বুঝছেই না কিছু। তারা দুইটা ব্যাট বল নিয়ে মারামারি করছে। আসিফ এসে তাদের নিয়ে গেলো।
এদিকে রাতে ঘুমানোর সময়ে আসিফের কানে ভেসে আসছিলো তার শ্বশুরের জানাজা পড়ানো ইমাম সাহেবের সেই একটা বাক্য। ইমাম সাহেব তাকে বলেছিলেন,
‘বাবা কুদ্দুস মিয়ার বড়ো শখ ছিলো তার মেয়ে একজন ডাক্তার হবে। আমাদের সে বলতো, তার মেয়ে একদিন আমাদের জন্য কাজ করবে। দেশের জন্য কাজ করবে। যেদিন তার মেয়ের বিয়ে তোমার সাথে হয়, তার পরের জুম্মায় একদিন কুদ্দুস মিয়াকে রসিকতা করে বলেছিলাম, মেয়েকে তো বিয়ে দিয়ে দিলা। ডাক্তার তো আর হলো না সে। সেদিন কুদ্দুস মিয়া বলেছিলো আমাকে, সে তোমাকে জানাবে তার মনের ইচ্ছাটা। খুব আত্মতুষ্টির সাথে বলেছিলো সে, তার মেয়ে জামাই নিশ্চয়ই তার মনের কথাটা রাখবে। আজ তোমাকে এই কথাটা বলার একটাই কারণ, সেদিনের রসিকতার জন্য আমি মনেমনে খুব কষ্ট পাচ্ছি রে বাবা। মানুষটা আজ ঈদের দিনে হুট করে আমাদের ছেড়ে চলে গেলো আল্লাহর কাছে।’
অথচ আসিফের কাছে আসিফের শ্বশুর ওনার মনের কথাটা বলেননি একবারও। মানুষ তার ভেতরে চেপে রাখা কষ্ট, ইচ্ছা, স্বপ্ন সবকিছু চাপিয়ে কী সহজে চলে যায় দুনিয়া থেকে! মানুষের জীবনের যে কোন ভরসা নাই। কখন উতান হয়, কখন পতন হয়, কখনোবা উবে যায় বাতাসের দোলে, তার কোন খোঁজ নাই৷ চিঠি নাই, আসার আগমনী নাই। মানুষ তার নিজের ভেতরে ভেতরেই অনন্তের পথে পাড়ি জমিয়ে নেয়। কাওকে কিচ্ছু বলে না। টুপ করেই যেনো সে চলে যায় তার আপন ঠিকানায়।
[প্রিয় মানুষজন, একটা হেল্প দরকার। আমার লেখা একটা গানের জন্য সুরকার প্রয়োজন। লোকধারার গান। কিন্তু গানটার জন্য সুর নির্ধারণ করতে পারছি না৷ গ্রুপে অনেক গুণীজন আছেন৷ জানামতে কয়েকজন আন্তর্জাতিক মানেরও শিল্পী আছেন যাঁরা নিয়মিত টিভির পর্দায় গান গেয়ে থাকেন৷ আমি কাওকে বলছিনা নিজ থেকে। কারণ তাঁরা আমার গান করবেন এমন যোগ্যতা বা স্পর্ধা দুটোর একটিও আমার নেই। তার পরও কেউ যদি থেকে থাকেন, আমাকে প্লিজ জানাবেন। অথবা আপনাদের পরিচিত কেউ যদি থেকে থাকেন তাহলে আমাকে জানাবেন। আমি আপনাদের মেসেজের প্রত্যাশায় রইলাম। আমার লেখা একটা লোকধারার গানে কেউ সুর দিবেন, কভার করবেন এমনটা আমার অনেক দিনের ইচ্ছা। আশাকরি এই গ্রুপ থেকেই কেউ না কেউ আমি পেয়ে যাবো। আপনাদের অপেক্ষায় রইলাম। ভালোবাসি।]
(চলবে)