#বিন্নি_ধানের_খই
#পর্ব_৪৮
#মিদহাদ_আহমদ
আমি শ্বশুরকে চা দিয়ে আরেক কাপ চা ননাসের জন্য নিয়ে তার রুমের সামনে গেলাম। দেখলাম ভেতর থেকে দরজা লক করা। সচরাচর এমন সন্ধ্যার সময় তিনি দরজা লক করেন না। আমি ডাক দিলাম। কোন শব্দ নাই। আবার ডাক দিলাম। কয়েকবার ডাক দিয়ে কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে আমি চা নিয়ে রুমে চলে এলাম। ভাবলাম হয়তো ওয়াশরুমে গিয়েছেন তিনি৷ আমিও ফ্রেশ হয়ে কল দিলাম মাকে। মা কল রিসিভ করে আর কথা বলতে পারছেন না যেনো। কাশতে কাশতে শেষ৷ মা বললেন,
‘গিয়েছিলি আজ তোর ননদের বাড়িতে?’
‘হ্যাঁ মা গিয়েছিলাম। তুমি আবার ঠান্ডা লাগিয়েছো? এখন যদি শ্বাসকষ্ট হয় আবার?’
‘না রে মা। আচ্ছা আমি রাখি এখন৷ আজান দিবে। গাইল ছিয়া সামলে রাখতে হবে ‘
‘গাইল ছিয়া? এখন কী করছো এসবের?’
‘জমিরের বাড়ির নিচে যে ধান হয়, ওখানের জমি বর্গা দিয়েছিলেন তোর বাবা। কাল বিকালে চাউল তিন বস্তা এনে দিয়েছে৷ গতবার দিয়েছিলো সাত বস্তা। মানুষটা নাই দেখে সব লোক যেনো সবকিছু খেতে শুরু করেছে৷ করুক গিয়ে। আমরা তিন মা ছেলের ঘর তিন বস্তা চালে অর্ধেক বছর চলে যাবে।’
‘আচ্ছা এটা তো বুঝলাম। তুমি চাল কুটতেছো কেন মা? তুমি না অসুস্থ’
‘মেয়ের বাড়ি পিঠা দিবো না? কী বলে বোকা।’
মায়ের সাথে কথা বলে আমি কল রাখলাম। বুঝতে পারলাম না আসলে হচ্ছেটা কী! মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলে কেন বাবা মায়েরা ভাবে যে মেয়ের বাড়িতে আজীবন এইটা সেইটা দিতে হবে! আর না দিতে পারলে মেয়ের অপমান হবে? এমন ভাবাটাই মেয়েদের জন্য আসল অপমানের কারণ না?
টেবিলে চায়ের কাপের দিকে নজর গেলো৷ মনে পড়লো ননাসকে চা দেয়া হয়নি। উঠে গেলাম। ওভেনে চা গরম করে আবার ননাসের রুমের সামনে গেলাম। দরজা বন্ধ এখনও। ডাক দিলাম৷ কয়েকবার ডাক দিলেও কোন সাড়াশব্দ নেই৷ আমি ভয় পেয়ে গেলাম। সিঁড়ির কোণার বক্সে চায়ের কাপ রেখে দুই হাত দিয়ে দরজায় থাবা দিতে লাগলাম৷ ভাবলাম হয়তো ঘুমিয়ে আছেন। পরক্ষণে কী যে মনে হলো আমি মাকে ডাক দিলাম। মা আসছেন না দেখে নিচে গেলাম। মা নামাজ পড়ছেন। শ্বশুর জিজ্ঞেস করলেন,
‘কী হয়েছে নুপুর?’
‘বাবা তানিয়া আপা দরজা খুলছেন না৷ একটু আসেন তো।’
শ্বশুর তড়িঘড়ি করে উপরে উঠে এলেন। কান্নাভেজা গলায় শ্বশুর ডাকতে লাগলেন,
‘ও তানিয়া, তানিয়া মা আমার দরজা খোল। ঘুমে নাকি তুই? চা খাবি না?’
কোন শব্দ নাই৷ আমার আতঙ্ক আরও বেড়েই চলছে৷ কোন বোধশক্তি কাজ করছে না। কিছু বুঝতে পারছি না যেনো। ভাবলাম কল দিবো আসিফকে৷ এর মাঝে শ্বশুর মাটিতে বসে গেলেন ধপাস করে৷ বিলাপ করে ডাকতে লাগলেন
‘ও তানিয়া মা, তানিয়া দরজা খোল।’
শাশুড়ি নামাজ পড়ে তড়িঘড়ি করে উঠে এলেন। সাথে করে চাবি নিয়ে এলেন রুমের। শাশুড়ি চাবি দিয়ে দরজা খুললেন। সামনে যা দেখলাম, তা দেখার জন্য আমরা মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না৷ তানিয়া আপা ফ্যানের সাথে ঝুলানো। মুখ দিয়ে থু আর ফেনা ঝরছে। শ্বশুর কাঁপতে কাঁপতে গিয়ে পায়ে ধরলেন ননাসের। আমি কোনকিছু বুঝতে পারলাম না৷ মুহূর্তেই চেয়ার টেনে বিছানার উপর তুললাম। শ্বশুরকে অভয় দিয়ে বললাম
‘বাবা আপনি আপার পায়ে ধরে রাখেন। আমি ছুটাচ্ছি তাকে ‘
শাশুড়ি জমে শক্ত হয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তার যেনো কোন চেতনাশক্তি কাজ করছে না এমন। আমি অনেক কষ্টে গিট্টূতা খুললাম। শ্বশুর কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে ধরে ছিলেন৷ আমি ননাসের বাহুতে ধরে রাখলেও আমি ভারক্ষমতা হারিয়ে তাকে ছেড়ে দেই। ননাসের মাথা গিয়ে খাটের একপাশে লেগে রক্তক্ষরণ শুরু হয়৷ আমি তার হাতে পার্লস দেখি। বুঝতে অসুবিধা রইলো না, পার্লস আর যৎসামান্য আছে৷ হসপিটালে যেতে যেতে কি হবে বুঝতে পারলাম না৷ আমি বাইরে গিয়ে ড্রাইভারকে গাড়ি বের করতে বলি। সাথে ড্রাইভারকে নিয়ে এসে ননাসকে নিয়ে নিচে আনি৷ গাড়িতে তুলে হসপিটালে যাই৷ আসিফকে কল করে জানাই। শ্বশুর শাশুড়িও আমার সাথে চলে আসেন হসপিটালে। ডাক্তারকে দেখতে বললে আসে আরেক বাধা। নার্সরা জানিয়ে দেয় যে সুইসাইড কেইস পুলিশ ছাড়া তারা গ্রহণ করবে না। এদিকে আমি বারবার ননাসের নিথর দেহের দিকে তাকাচ্ছি৷ পার্লস আছে আছে নাই নাই। নার্সদের বলতে লাগলাম, পার্লস থাকার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ডাক্তারের কাছে না নিলে অঘটন ঘটে যাবে৷ আমি যেই না এই কথাটা বললাম শ্বশুর হাউমাউ করে বাচ্চাদের মতো কান্না শুরু করে দিলেন৷ বলতে লাগলেন,
‘ও আমার তানিয়া, তোর থেকে প্রথম বাপ ডাক শুনেছি আর আজ তুই একী করলি!’
আমি শ্বশুরকে চেয়ারে বসালাম৷ ঠিক তখনি কোতোয়ালি থানার এস আই সহ আসিফ হসপিটালে এলো। এস আই নার্স আর ডাক্তার ডেকে বলে দিলেন কেইসটা তিনি হ্যান্ডেল করবেন। রোগীকে নিয়ে যেতে। আসিফ আসতেই শাশুড়ি তাকে জড়িয়ে ধরলেন। এই প্রথম শাশুড়ি কান্না করলেন৷ বুঝতে বাকি রইলো না, মা বাবারা তাদের পেটের সন্তানদের কাছে নিজের দুর্বলতা আর ভরসা যেভাবে করতে পারেন সেভাবে পুত্রবধূর সামনে পারেন না। আসিফ তার মাকে সামলে নিলো৷ পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
‘কিচ্ছু হবে না আপার। দেখে নিও মা কিচ্ছু হবে না৷ তুমি চিন্তা করো না।’
ডাক্তার ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো ননাসকে। কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বাইরে এসে বললো রোগীর অবস্থা শংকটে একেবারে। পার্লস রেট নাই বললেই চলে৷ এই মুহূর্তে তাকে লাইফ সাপোর্টে নিতে হবে।
শ্বশুর কান্নায় ভেঙ্গে বললেন,
‘লাইফ সাপোর্ট থেকে আর আমার মেয়ে জিন্দা বের হবে না। আর আমার মেয়ে শ্বাস নিয়ে বের হবে না।’
আসিফ আমাকে আড়ালে নিয়ে জিজ্ঞেস করলো কী করবে। আমি কোনকিছু ভেবে চিন্তে না বলে বললাম লাইফ সাপোর্টে নিয়ে নিতে। উপরের দিকে তাকিয়ে মনে মনে উপর ওয়ালার কাছে বললাম তিনি যেনো তার গায়েব থেকে সবকিছু ঠিক করে দেন। এখন তার গায়েবি ইচ্ছা ছাড়া আর কোনকিছু সম্ভব না৷ আমি এভাবে আমার চোখের সামনে কাওকে চলে যেতে দেখতে পারবো না।।
আসিফ তামান্নাকে কল করলে তামান্নার ননাস কল ধরে বলে যে তামান্না রান্নাঘরে আছে। আসিফ তামান্নার ননাসকে বলে যে তানিয়া সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। এখন সে লাইফ সাপোর্টে আছে। যদি সম্ভব হয় তাহলে তামান্নাকে নিয়ে হসপিটালে আসতে। বাঁচবে কিনা না এইটা সিওর না।
তামান্নার ননাস যেই না এই কথা শুনলো ওমনি গিয়ে তার মাকে বললো,
‘হুনছোনি গো আম্মা অইছে কিতা? তোমার ঝিয়ারি বেটিয়ে গলাত ফাস দিছইন। খাইল যাইতোগিয়া রাজীব। এখন বুঝিল তামান্নারে লইয়া যাইতাম। ভালা অইছে ফোন আমি ধরিলাইছি। তুমি তাইরে চউকো চউকো রাখিও। দেখিও দেন মোবাইল কান্দাত ফায়না যেলা। আমার ভাইগুতা খাইল ভালায় ভালায় যাউক গিয়া বাদে তাইর যেছাতা খরউক। আমরার বংশত ইলান হুনছোনি খেউ গলাত দড়ি লাগাইতে। দোহাই আল্লাহর ইতা টাউনি ফুড়িন বিয়া করাইয়া আনিয়া তুমি এখ মুছিবতো ফড়ছো গো মাই।’
লাইফ সাপোর্টে দুইদিন থাকার পর ডাক্তার জানালো ননাসের অবস্থা কিছুটা ইম্প্রুভের দিকে। কিন্তু মাথায় চোট পাওয়ায় সাথেসাথে সেখানে রক্তক্ষরণ হয়েছে৷ সন্ধ্যায় শাশুড়ি মা আর শ্বশুর ননাসকে দেখতে গেলে একেবারে অচেতন অবস্থায় দেখে আসেন। ওইদিন রাতেই ডাক্তার ননাসকে কোমায় ট্রান্সফার করে দিলো। কোমার কাছাকাছি দুটি শব্দ হলো ‘ব্রেইন ডেথ’ আর ‘ভেজিটেটিভ স্টেট’। ব্রেইন ডেথ হলো মস্তিষ্কের স্থায়ী ক্ষতি বা মস্তিষ্কের সব কার্যক্রম থেমে যাওয়া। আর ভেজিটেটিভ স্টেট হলো রোগীর মস্তিষ্ক সজাগ থাকে, কিন্তু চেতনা দিয়ে বা স্বেচ্ছায় কিছু করতে পারে না। ডাক্তার জানালো আপার পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে। কোন কোমায় আছেন এইটা এই মুহূর্তে জানাতে পারছে না। এখন সব উপরওয়ালার হাতে।
এদিকে বদরুলের মা কে লন্ডন থেকে বদরুলের মামী কল দিয়ে বললেন,
‘আপা জানেন তো আমার মেয়ে ব্রিটিশ সিটিজেন৷ একইভাবে আমার মেয়ের এখনও বিয়ে শাদী হয়নি৷ আপনার ছেলের এরইমাঝে বিয়েও হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আপনার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ে দিলেও আপাতত আমি চাচ্ছি না তারা কন্টিনিউ করুক ‘
খোদেজা বেগম যেনো আকাশ থেকে পড়লেন। কী বলবেন বুঝতে পারলেন না৷ মুহূর্তেই বলে বসলেন,
‘আমরা উকিলকে বলে দিয়েছি বদরুলের দরগা মহল্লায় কেনা ৫২ লাখ টাকার ফ্ল্যাটটা বউমার নামে রেজিস্ট্রি করে নিতে।’
ওপাশ থেকে মেয়ের মা বললো
‘অহ আচ্ছা। সত্যি সত্যি তো আপা?’
‘কেন রুমানা? আমি মিথ্যা বলবো কেন বলো? আমার একমাত্র ছেলের বউ তোমার মেয়ে। আর সম্পর্কে সে আমার আপন ভাইজি। তাকে দেয়া আর আমার ছেলের নামে থাকা দুটোই তো এক হলো৷ তাইনা?’
‘এহ হে! তা অবশ্য ভুল বলেননি আপা।’
‘কোন ভুল না৷ আমি সন্ধ্যার পর পরই কমলা ভান্ডার জুয়েলার্সে যাচ্ছি বউমাকে দশ ভরির সীতাহার বানিয়ে দেয়ার জন্য৷ বিয়েতে তো তেমন কিছু দেয়াই হয়নি।’
‘অহ আচ্ছা। সে আপনার ভাইজি আর পুত্রবধূ৷ যা ইচ্ছা দেন। আসলে আপা বুঝছেন ই তো সিটিজেনশিপ ওয়ালা মেয়ে আমার। আবদার একটু বেশি থাকেই। আজকালকার দুনিয়া দেখছেন ই তো। আর ভাগনা আমার এমনিতেই এক বিয়ে করে ফেলেছে এর মধ্যে। তাই এসব বলছি আমি আরকি। আমি রাখছি আপা এখন।’
‘ রুমানা শুনো, ভাগনা তো এখন মেয়ে জামাই তোমার। তাকে ইংল্যান্ডে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করো।’
‘যেমন দিবেন তেমন পাবেন আপা।’
এই বলে কল কেটে দিলো মেয়ের মা।
এভাবে মেয়ে সওদা হওয়া শুরু হলো আবার নতুন করে। চিরায়ত চলে আসা সওদার এক নতুন নিয়ম। শাড়ি ভিসায় সিলেটিদের ইংল্যান্ড যাওয়া অব্যাহত থাকা যেনো পুরোনো সিলসিলাকে বাঁচিয়ে রাখা। সিলসিলা মরে না, রক্তে মিশে যায়।
(চলবে)