#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-১৪
.
.
বিকেলে ঘুরতে যাওয়ার উত্তেজনায় যেন আর তরই সইছিলো না ত্রয়ীর। ইনানকে নিয়ে কতো ভাবনা উঁকি দিচ্ছিলো ওর মনে। একে তো উত্তেজনা, তবে তার উপর আবার ইনান ও প্রিয়ার ব্যাপারটা নিয়ে বুকে এক চিনচিনে ব্যথা অনুভব করছিলো। মনটা যেমন নেচেও উঠতে পারছে না, আবার স্থির হয়ে বসেও থাকতে চাইছে না।
সকাল থেকেই ত্রয়ী ইনানের সাথে বেড়াতে যাওয়ার প্রহর গুনছে। কখন যে এই প্রতীক্ষার অবসান ঘটবে!
___________________________________________________
বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গেছে। ত্রয়ী মাত্রই গোসল সেরে টাওয়াল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বারান্দায় বের হচ্ছিলো। তখনি কোত্থেকে যেন হন্তদন্ত হয়ে ওর সামনে ইয়াদ হাজির।
প্রথমদিকে বেশ চমকে উঠে ত্রয়ী। ও ওর চুল মোছার হাত থামিয়ে হা হয়ে থমকে যায়। ইয়াদ দাড়িয়ে গিয়ে দম নিতে নিতে ত্রয়ীকে বলে,
-ত্রয়ী আপু। ত্রয়ী আপু। ইনান ভাইয়া.. ইনান ভাইয়া ডাকছিলো তোমাকে। আমি সেটা বেমালুম ভুলেই গিয়েছিলাম।
কিছুক্ষণ থেমে ও আবার হাত দেখিয়ে বলতে থাকে,
-উফ বাবা গো! পিটুনি খাওয়ার আগে বলে দিলাম কিন্তু..
ত্রয়ী হেসে দেয় ইয়াদের কান্ড দেখে। ও মাথা কাত করে জবাব দেয়,
-আচ্ছা ঠিক আছে।
ইয়াদও মাথা নাড়িয়ে আবার ওখান থেকে দৌড়ে চলে যায়। নিচে ওর বন্ধুবান্ধবরা ওয়েট করছে যে।
ত্রয়ী চুল শুকানো বাদ দিয়ে তখনি ইনানের রুমের দিকে রওনা হয়। ও গিয়ে ইনানের কাচের দরজার হালকা করে নক দেয়।
ভেতর থেকে জবাব আসে,
-কে? আসুন ভেতরে।
ত্রয়ী দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে। ইনান কারোর সাথে বেডে আধশোয়া অবস্থায় ফোনে কথা বলছিলো। ত্রয়ীকে দেখেই ওর চোখ আটকে যায়।
ওর ভেজাচুল থেকে এখনো টপটপ করছে পানির ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো ইনানের। খোলা ঠোঁট দু’টো একত্র করে একটা ঢোক গিললো সে।
হঠাৎ টুক করে ওর হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। ত্রয়ী বিস্ফোরিত চক্ষে এক পলকে ফোনের পড়ে যাওয়ার দিকে তাকালো। ভাগ্যিস! বেডের উপর পড়েছে। নাহলে ফ্লোরে পড়লে হয়তো এতক্ষণে এন্ড্রয়েড ফোনটা একদম ডেড হয়ে যেতো।
ইনান কথা থামিয়ে হা হয়ে তাকিয়ে আছে ত্রয়ীর চুল আর চেহারার দিকে। ত্রয়ীর বেশ অস্বস্তিবোধ হয়। সেই সাথে লজ্জাও। ও চোখ নামিয়ে ফেলে। ইনানের হুশ ফিরতেই ফোনটা কুড়িয়ে নিয়ে ভ্রু কুচকে বলে,
-ওহ আচ্ছা তুমি?
ত্রয়ী অস্ফুটস্বরে উত্তর দেয়,
-জ্বি।
-তা কখন ডেকেছিলাম? পুরো ঘন্টাখানেক দেরি। ১টা বেজে গেলো।
ত্রয়ী ইয়াদের দেরির ব্যাপারটা বুঝতে পারে। সে-ই তো ভুলে গিয়েছিলো বলার কথা। কিন্তু সেটা আর ইনানের সামনে প্রকাশ করে না,
-দুঃখিত আসলে কাজ ছিলো৷ তারপর গোসলে চলে গিয়েছিলাম।
-আচ্ছা যাক! যে কারণে ডেকেছিলাম- খাওয়া দাওয়া সেরে চটজলদি তৈরি হয়ে নাও।
ত্রয়ী চমকে তাকায় ইনানের দিকে,
-কেন?
-কেন মানে? বলেছিলাম না তোমায় বেড়াতে নিয়ে যাবো?
-কিন্তু সেটা তো বিকেলে! এখন তৈরি হবো কেন?
ইনান ওর দিকে চোখ পাকিয়ে বলে,
-যেটা বলছি করো। যাও। একটু পরই বের হবো আমরা।
ত্রয়ী আর কিছু বলতে পারে না। শুধু অবুঝ বাচ্চাদের মতো মাথা নিচু করে এপাশ ওপাশ হেলিয়ে ওখান থেকে চলে আসে।
___________________________________________________
একটু পরেই ওদের খাবারের ডাক আসে। প্রথম ধাপেই এসে ইয়াদ ও ইফতিহা খেতে বসে যায় এবং সেই সাথে ইনান ও ত্রয়ীও চেয়ার টেনে খেতে বসে। তাদের সাথে মোস্তফা হকও ছিলেন।
রাবেয়া হক ওদের খাবার বেড়ে দিচ্ছিলেন। মাঝখানেই ইয়াদ ইনানকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
-ভাইয়া ত্রয়ী আপুকে তখন ডেকেছিলে কেন? কোনো বিশেষ দরকার ছিলো?
ইনান খাবার থেকে মুখ তুলে বেশ বিরক্ত ভাব নিয়ে ইয়াদের দিকে তাকায়। এই ইয়াদটা একদম পেট পাতলা স্বভাবের। ছোট থেকে মহাছোট বিষয়গুলোও সবার সামনে না বললে ওর পেটের ভাত হজম হয় না।
সে ইয়াদের কথার কোনো জবাব না দিয়ে রাবেয়া হককে ডেকে বলে,
-মা, ঐদিন বলছিলে না ত্রয়ীকে নিয়ে কোথাও ঘুরিয়ে নিয়ে আসতে? তো আজ বের হবো আমরা। একটু পরেই।
ত্রয়ী যেন অনেকটাই লজ্জাবোধ করছিলো সেসময়। রাবেয়া হক উনার হাতের কাজটা রেখে ইনানের দিকে হাসিমুখে তাকান,
-বেশ তো। তাহলে তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া সেরে নিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে বেরিয়ে পড় তোরা।
পাশ থেকে ইয়াদ বেশ উৎসুকভাবে জিজ্ঞেস করে,
-তা ভাইয়া, কোন জায়গা সিলেক্ট করলে?
-ভোলাগঞ্জ। কয়েকঘন্টা ঘুরেফিরে সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসবো।
এবার ইফতিহাও ওদের সাথে সঙ্গ দেয়,
-আরে বাহ। আমাদের স্কুল থেকেও এবার পিকনিকে ভোলাগঞ্জ নিয়ে গেছিলো।
ত্রয়ী চুপচাপ খাচ্ছে। আর ভোলাগঞ্জ নিয়ে ভাবছে। প্রথমই যেন শুনলো নামটা। ওখানে গিয়ে কী দেখবে সেটাও জানে না। সিলেট নিয়ে ওর তেমন জ্ঞান ধারণা একদমই নেই কিনা। যাকগে! ইনানের সাথে ঘুরতে যাবে, এটাই ওর কাছে বড় কথা। আর কিচ্ছু নিয়ে ভাবনা নেই ওর।
ইনান খেতে খেতে ইফতিহা আর ইয়াদকে জিজ্ঞেস করে,
-তোরা যাবি আমাদের সাথে?
ইয়াদ চটপট জবাব দেয়,
-না বাবা আমার ফুটবল ম্যাচ আছে আজ, যেতে পারবো না।
ইনান এবার ইফতিহার দিকে তাকায় উত্তরের আশায়। ইফতিহা বলে,
-না ভাইয়া আমিও তো গিয়ে এলাম এবার। তুমি বরং আপুকেই ঘুরিয়ে নিয়ে আসো।
-ঠিক আছে।
এদিকে মা ও ছেলে মেয়েদের আলাপচারিতায় জনাব মোস্তফা হক কোনোরকম তাল মেলাচ্ছে না। তিনি উনার মতো চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছেন।
শুধু একটাবার রাবেয়া হকের সাথে উনার চোখাচোখি হয়েছিলো। আর উনার স্বামীর চোখ দেখেই চুপসে যায় রাবেয়া হকের চেহারাখানা। এই দৃষ্টিতে কোনো চাপা অগ্নিমূর্তি তো নিশ্চিত লুকিয়ে কিনা, সে বিষয়ে আশঙ্কায় পড়ে যান ইনি।
___________________________________________________
কিছুক্ষণের মধ্যেই বেরিয়ে পড়ে ওরা।
ত্রয়ী হোয়াইট প্লাজুর সাথে হাটুর একটু নিচ অবধি ডার্ক ব্লু কালারের একটা রাউন্ড ড্রেস পড়েছে। আর সেই সাথে জড়িয়ে নিয়েছে লম্বা চওড়া সাদা ওড়নাটা।
ইনান বরাবরের মতোই নর্মাল ড্রেস আপে আছে। আর সেই সাথে ওর সানগ্লাস। সে এক পলক ত্রয়ীর দিকে তাকিয়ে একটা প্রসন্ন হাসি দেয়। কিন্তু ত্রয়ী সেই হাসির কোনো মানে খুজে পায় না।
ইনান কদমতলী থেকে একটা রিকশা ডেকে ত্রয়ীকে উঠতে বলে। তারপর ও নিজেও উঠে পড়ে রিকশায়। বাহন চলতে থাকে আপন গতিতে।
ত্রয়ী বেশ কৌতুহল নিয়ে ইনানকে জিজ্ঞেস করে,
-আচ্ছা আমরা ভোলাগঞ্জ কেন ঘুরতে যাচ্ছি? মানে সেখানে কী আছে? আসলে আমি জানিনা তেমন।
ইনান হাসে। বলে,
-সাদা পাথরের নাম শুনেছো? অথবা রোপওয়ে বা রজ্জুপথ?
সাদা পাথরের কথা শুনেই চমকে যায় ত্রয়ী। এ প্রথম শুনলো যেন। সিলেটে আছে এমন? ও জানতোই না।
মাথা নেড়ে না-সূচক উত্তর দেয় ত্রয়ী। ইনান আবারো হেসে জবাব দেয়,
-আমরা এসবই দেখতে যাচ্ছি ওখানে। কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার ধলাই নদের উৎসমুখে। এ জায়গা তো ‘সাদা পাথরের দেশ’ নামে প্রচুর বিখ্যাত। তারপর কতো সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য, গেলেই বুঝতে পারবে।
ত্রয়ী বেশ খুশি হয় শুনে। ওর উত্তেজনা যেন দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ও একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকে ইনানকে,
-আচ্ছা তো ডিরেক্ট ভোলাগঞ্জ পৌঁছাবো আমরা এখন? আর যেতে কতক্ষণ লাগবে?
-ধুর পাগলি রিকশা দিয়ে কি ওখানে যাওয়া যাবে নাকি? আমরা এখন আম্বরখানা যাবো। তারপর ওখান থেকে সিএনজি করে ভোলাগঞ্জ বাজার। তারপর সেখানের ফেরিঘাট থেকে নৌকায় করে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে যাবো। সব মিলিয়ে এই ধরো দু’ঘন্টার মতো লেগে যাবে।
-ওহ আচ্ছা।
বলেই ত্রয়ী একটা চওড়া হাসি দেয়। ওর মনে আজ প্রচুর লাড্ডু ফুটছে। প্রচুর।
____________________________________________________
বেশ কিছুক্ষণের মধ্যেই আম্বরখানা পৌঁছায় ওদের রিকশা। সেখান থেকে ভোলাগঞ্জের ১০ নম্বর এল সি ঘাটের উদ্দেশ্যে একটা সিএনজিতে উঠে ওরা।
ত্রয়ী একদমই ওয়েট করতে পারছে না। ও খুব দ্রুত ওদের গন্তব্যে পৌঁছে যেতে চাচ্ছে। আর সেখানে ওর ইনানকে নিয়ে অনেক অনেক সময় কাটাবে। একা একা।
ও সিএনজি থেকে দূর আকাশের দিকে তাকায়। গুড়িগুড়ি মেঘ জমছে দেখা যায়। বৃষ্টি হবে নাকি? ও চিন্তায় পড়ে যায়।
ইনান ওকে ওভাবে ভ্রু কুচকে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলে,
-আকাশ দেখছো? নাকি মেঘ?
ত্রয়ী ঠোট উল্টে বাচ্চাদের মতো বলে,
-দুটোই। আচ্ছা, মাঝপথে বৃষ্টির নাগাল পাবো না তো আমরা?
ইনান বেশ জোরে জোরে হাসতে থাকে এবার আর বলে,
-কে জানে পেতেও পারি! তোমায় নিয়ে তো যতোদিনই বের হলাম, ততোদিনই বৃষ্টিতে ভিজতে হলো।
-এহ! এমন ভাবে বলছেন যেন কতোদিন জানি বেড়াতে নিয়ে গেছেন আমায়! আজ নিয়ে তো মোটে দু’দিনই।
ইনান হাসতে থাকে। ত্রয়ী বিরক্ত হয়ে ওর দিকে তাকায়,
-এতো না হেসে বলুন আর কতক্ষণ লাগবে যেতে?
-বাজারে যেতে তো দেড় ঘন্টার মতোন লাগবে। যাই হউক, এতো চিন্তা করো না তো। শ্বেত পাথরের ভূমিটা ভালোভাবে দর্শনের জন্য দেড়-দুই ঘন্টাই যথেষ্ট। সেজন্যই তো বিকেলের প্ল্যান ক্যান্সেল করে দুপুরে বের হলাম। হাতে মোট পাঁচ-ছয় ঘন্টা সময় নিয়ে।
ত্রয়ী চরম খুশিতে ইনানের একটা হাত জড়িয়ে ধরে। কিন্তু পরক্ষণেই যখন ওর হুশ ফিরে যে কি করে ফেললো ও, তখনি ওর হাতটা ছেড়ে দিয়ে একটা ছোটখাটো ঢোক গিলে। দুজনেই বেশ বিব্রত হয়ে হালকা সরে বসে। চুপচাপ হয়ে যায় উভয়েই।
____________________________________________________
ফেরিঘাটে পৌঁছে ত্রয়ীকে নিয়ে একটা টি স্টলে যায় ইনান। জিজ্ঞেস করে,
-ত্রয়ী, চা খাবে?
-এই সময়?
-আমার ইচ্ছে করছে খেতে। প্রতিবারই খাই এখানে আসলে। তুমি খাবে?
-আচ্ছা ঠিক আছে।
ইনান মাথা নাড়িয়ে এগিয়ে যায়।
“মামা, দুটো চা!”
একজনকে ডেকে বলে সে। লোকটা হেসে বেশ গালগল্প করতে থাকে ইনানের সাথে। পরিচিত হয়তো!
ত্রয়ী আনমনে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে। লুকিয়ে লুকিয়ে ইনানের হাসিমুখটা পর্যবেক্ষণ করছে আর মনে মনে গান বাঁধছে ওকে নিয়ে,
“আজ মন চেয়েছে, আমি হারিয়ে যাবো..
হারিয়ে যাবো আমি তোমার সাথে!”
.
.
চলবে।