বেখেয়ালি মনে পর্ব-২১

0
606

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-২১
.
.
রিসার বাড়িতে যাওয়ার জন্য সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। ত্রয়ী শাড়ি পড়ার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। হিমা বিদেশে বড় হলেও শাড়ি পড়তে জানে দারুন করে। ত্রয়ীর বারবার ব্যর্থ হয়ে যাওয়া দেখে হিমা এগিয়ে এসে ত্রয়ীকে শাড়ি পড়িয়ে দেয়। মেরুন রঙের শাড়ি পড়েছে ত্রয়ী। খোলা চুল, কানে বড় বড় দুল। ঠোঁটে গাঢ় লিপস্টিক, চোখে কাজল।

আয়নায় নিজেকে দেখে ত্রয়ী নিজেই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। অন্যরকম লাগছে নিজেকে। এই প্রথম শাড়ি পড়েছে সে। তাও ইনানের জন্য। সেদিন হিমা যখন শাড়ি পড়ে ইনানের সামনে গিয়েছিলো তখন ইনান তাকে ড্যাবড্যাব চোখে গিলেছে। যা ত্রয়ীর মোটেও পছন্দ হয়নি। তাই সে নিজেই আজ শাড়ি পড়েছে।

ত্রয়ী ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। ইনান বাসার মেইন গেইটে দাঁড়িয়ে আছে। হাত দু’টো নাড়িয়ে কারো সাথে কথা বলছে। তা দেখে ত্রয়ী মিটমিটিয়ে হাসছে। হঠাৎ করেই সে ইনানের চোখাচোখি হয়ে যায়। দ্রু চোখ সরিয়ে নেয়। লজ্জায় নাকের পাটা লাল হয়ে গেছে। নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। যা দেখতে ঘাসের উপর শিশির কণার মতো লাগছে।

ইনান ইশারায় ত্রয়ীকে নিচে নামতে বলে। সে দ্রুত নিচে আসে। মেইন গেইটের পাশে দু’টো গোলাপের গাছ। একটিতে সাদা গোলাপ ধরে আছে, অপরটিতে হলুদ গোলাপ। ইনান একটা সাদা গোলাপ নিয়ে ত্রয়ীর কানের পাশে গুজে দেয়। ইনানের স্পর্শ পেয়ে ত্রয়ী কেঁপে উঠে। বুকের ধুকপুকানির শব্দ সেকেন্ডে দ্বিগুন বেড়ে যায়। শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। সর্বাঙ্গে শিহরণ দিয়ে উঠে। আর দু’য়েক মিনিট সে ইনানের সামনে থাকলে নিশ্চিত জ্ঞান হারাবে। তাই দ্রুত সেখান থেকে প্রস্থান করে ত্রয়ী।

ইনান আটকাতে চেয়েও আটকায় না। হয়তো বিবেক বাধা দিয়েছে তাকে। নয়তো কিছুই নয়।

রিসাদের বাসায় সবাই পৌঁছে গেছে। রিসা সাদা রঙের লেহেঙ্গা পড়েছে। চুলগুলো স্ট্রেইট করা। সিম্পল সাজে অপরূপ লাগছে মেয়েটাকে। রিসার পাশে ত্রয়ী বসেছে। তিশান বসেছে নিশানের পাশে। খুব বেশি নার্ভাস লাগছে আজ তিশানের।

নিশান কনুই দিয়ে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলে,
– ভাই, তুই এতো ঘামছিস কেন?

তিশান রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে,
– তুই যেদিন বিয়ে করবি সেদিন বুঝবি।

নিশান আর কিছু বলার আগেই রিসার বাবা বিয়ে নিয়ে কথা শুরু করেন।
বড়দের মাঝে কথাবার্তা হওয়ার পর এনগেজমেন্ট পার্টি শুরু হয়।

তিশান রিসাকে রিং পড়িয়ে দেওয়ার পর তাদের দু’জনকে পাশাপাশি সোফায় বসানো হয়।

ত্রয়ী আনমনে বসে কিছু একটা ভাবছে। তা দেখে ইনান ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে বলে,
– বোকাপাখি, এভাবে বসে আছো কেন? ওদিকে কাপল ডান্স শুরু হয়ে যাচ্ছে। তুমি দেখবে না?

ত্রয়ী ফ্যালফ্যাল করে ইনানের দিকে একবার তাকিয়ে আবার নিজের ভাবনায় মন দেয়।
ইনান আর কিছু না বলে ত্রয়ীর সামনে থেকে সরে যায়।

হঠাৎ করেই রুমের লাইট অফ হয়ে যায়। তারপর শুরু কাপল ডান্স। রিসা-তিশান সবার প্রথমে ডান্স করে। তারপর বাকিরা।

ইনান চুপচাপ এক কোণায় বসে ত্রয়ীর কথা ভাবছে। ত্রয়ীর এমন নীরবতা ওকে ভাবাচ্ছে খুব। ইনান দ্রুত পায়ে আবার ত্রয়ীর কাছে আসে। এসে দেখে ত্রয়ী সেখানে নেই। হন্তদন্ত হয়ে ইনান ত্রয়ীকে খুঁজতে থাকে, কিন্তু সে কোথাও নেই।

ছাদে গিয়ে ইনানের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ত্রয়ী ছাদে। ইনান ওর কাছে এগিয়ে যেয়ে বলে,
– ত্রয়ী! তুমি এখানে কেন?
মাতাল কন্ঠে ত্রয়ী জবাব দেয়,
– আপনার জন্যই তো এখানে দাঁড়িয়ে আছি আমি।
একথা বলেই সে ইনানের শার্টের কলার ধরে ফেলে।
– তুমি ড্রিংক করেছো?
ধমকের সুরে কথাটা বলে ইনান।

ধমকের তাণ্ডবে ত্রয়ী কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
– হ্যাঁ, আপনি তো শুধু আমায় ধমকাতেই পারবেন। ভালোবাসতে তো পারবেন না।

ত্রয়ীর মুখে ভালোবাসার কথা শুনে ইনান ভড়কে যায়। মুহুর্তেই নিজেকে সাবধান করে ফেলে সে। ত্রয়ী এখন নেশার ঘোরে যা নয় তা-ই করে ফেলতে পারে। তাই সে ত্রয়ীর হাত থেকে শার্টের কলার ছাড়াতে বৃথা চেষ্টা করতে থাকে।

তা দেখে ত্রয়ী বাচ্চাদের মতো খিলখিল করে হেসে ফেলে। বলে,
– উহু, আমি আপনাকে ছাড়বো না। একমুহূর্তের জন্যও ছাড়বো না । আপনি শুধু আমার, শুধুই আমার।

ইনান থতমত খেয়ে বলে,
– ত্রয়ী, প্লিজ এমন বাচ্চামো করো না। ছাড়ো আমাকে। বাসা ভর্তি লোক। কেউ দেখে ফেললে কেলেংকারী হয়ে যাবে।

ত্রয়ী ইনানের ঠোঁটে ওর আঙ্গুল চেপে ধরে বলে,
– হুসসসসস! কেউ দেখবেনা। কেউ আমাদের আলাদা করতে পারবেনা।

তারপর হুট করেই আবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে,
-আপনি জানেন, আমি প্রিয়া আপুকে একদম সহ্য করতে পারিনা। ওকে আপনার পাশে দেখলে আমার পুরো শরীরে আগুন জ্বলে উঠে। ইচ্ছে করে একদম ওকে খুন করে ফেলতে।

ত্রয়ীর এমন কান্ডে ইনান কী বলবে কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। নিজেকে ওর হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও ছাড়াতে পারছে না। নেশা করে একদম মাতাল হয়ে আছে সে।

হঠাৎ কারো পায়ের আওয়াজ শুনে ইনানের দম বন্ধ হয়ে আসে। চোখ বন্ধ করে আল্লাহকে ডাকা শুরু করে। ইনানের কাঁধে হাত রেখে ইফতিহা বলে,
– ভাইয়া, তুমি এখানে? আর আমি তোমাকে সারাবাড়ি খুঁজে অস্থির হয়ে গেছি।

ইফতিহার কন্ঠ শুনে ইনান চোখ খুলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর ইফতিহাকে ত্রয়ীর খেয়াল রাখতে বলে ও নিচে চলে যায়। মিনিট পাঁচেক পরে নিশানকে নিয়ে ছাদে আসে ইনান।

ত্রয়ী এতোক্ষণে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশান আর ইফতিহা মিলে ওকে গাড়ির কাছে নিয়ে যায়। ত্রয়ীর ড্রিংক করার ব্যাপারটা বাসার সবার কাছে চেপে যায় নিশান। সবাইকে বলে,
– ত্রয়ী হালকা অসুস্থ হয়ে গেছে তাই তাকে বাড়ি নিয়ে যাচ্ছে।
ইনান, ইফতিহা ও নিশানের সাথে বাড়ি ফিরে যায়।

__________________________________________________________
মাঝরাতে ঘুম ভাঙে ত্রয়ীর। মাথাটা খুব ভার হয়ে আছে। চোখ খুলে নিজেকে আবিষ্কার করে সে নিজের রুমে। অথচ তার থাকার কথা এনগেজমেন্ট পার্টিতে। সন্ধ্যার পর কি হয়েছে কিছুই মনে পড়ছে না। শুধু এটুকুই মনে আছে সে, জুস খেয়েছিলো তারপর থেকে সবটা ঘোলাটে তার কাছে।

ত্রয়ী সাত-পাঁচ আর না ভেবে চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে আসে। ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ায়। রাতের আকাশে আজ তারা নেই। ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে পুরো আকাশ। ত্রয়ী হঠাৎ করে আবিষ্কার করলো, গুড়িগুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির পানি ধরার বৃথা চেষ্টা কর‍তে লাগলো সে। কিছুক্ষন দুষ্টুমিতে মেতে থাকলেও পরক্ষনেই মাথা ব্যথা চেপে ধরে তাকে।

আলতো পায়ে রুম থেকে বের হয় সে। বাসার ড্রইংরুমে মৃদু আলো জ্বলছে। রাত দুইটা কি তিনটা বাজে। সবাই ঘুমে বিভোর হয়ে আছে। তবে তিশানের রুম থেকে মৃদু হাসির শব্দ আসছে। হয়তো হবু বউয়ের সাথে প্রেমালাপে ব্যস্ত সে।

ত্রয়ী পা টিপে টিপে কিচেন রুমে ঢুকে চট করে কফি বানিয়ে নেয়। ত্রয়ী রান্না না পারলেও চা, কফি বেশ ভালোই বানাতে পারে।

কফি নিয়ে নিজের রুমের ব্যালকনিতে আসে। কফি মগে এক চুমুক দিয়েই নিজে নিজে আওড়ায়,
– ইশ! যদি উনার নাম্বার থাকতো তাহলে এখন কল দিয়ে উনার রাতের ঘুমটাও উড়িয়ে দিতাম।

পরক্ষনেই আবার ভাবে,
আচ্ছা উনিও কি আমার কথা ভাবে? আমি যেমন তার কথা ভাবি।

এসব ভাবনার ছেদ করে হঠাৎ পুরুষকন্ঠ থেকে গান ভেসে আসে ত্রয়ীর কানে,

“বেঁচে থেকে লাভ কি বল,
তোকে ছাড়া আর..
খুঁজেছে জবাব অচল, মন কোথা কার।
জানি স্বপ্ন তার পাতায় কত কি,
কত যত্নে দেখেছি আর লিখেছি।
যা চলে তুই, ও.. সব ভুলে তুই,
যা চলে তুই, ওও.. সব ভুলে তুই..”

গান শুনে ত্রয়ী উপরের দিকে তাকায়। এই কন্ঠ যে তার চেনা। বড্ড চেনা!

গানের প্রতিটা লাইন ত্রয়ীর শিরা-উপশিরায় শিহরণ দিয়ে উঠে। মনের কোণে উঁকি দেয় ভালোবাসা নামক নতুন অধ্যায়।
.
.
চলবে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here