#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-৩০
.
.
রিসার বাসায় তিশানের পুরো গ্যাং এসেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে নিশানের দু’জন বন্ধু। ইনান, ইয়াদ আর ইফতিহাও । নিশান, হিমা, ঝুমা, ত্রয়ী ওরা চার জনও এসেছে। তিশানকে কেউ আনতে চায়নি। তবুও, তিশান সবার আগে এসে গাড়িতে বসে ছিলো। এ কারণে, তিশান বেহায়া উপাধি অবধি পেয়েছে সবার কাছ থেকে।
রিসা সাজছে এই মুহুর্তে ত্রয়ীরা এসে রিসার পাশে বসে। সবাইকে দেখে রিসার চোখে মুখে খুশির ঝিলিক দিয়ে উঠে।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে থেকে উঠে এসে রিসা বলে,
– কেমন আছো তোমরা?
ত্রয়ী হেসে বলে,
– এই তো ভালো আছি ভাবী। তুমি কেমন আছো?
– এইতো ভালোই।
ত্রয়ী ও রিসার কথার মাঝখানে রিসার ভাই, বোন এসে উপস্থিত হয়। ওরা দু’জন রিসার কানে কানে কিছু একটা বলে আবার দৌড়ে চলে যায়।
হিমা, ত্রয়ীকে হালকা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলে,
– ভাবীর ভাই বোনেরা নিশ্চয় কোনো প্ল্যান করছে।
ত্রয়ী হিমাকে ইশারা দিয়ে চুপ করে থাকতে বলে। ভরা মজলিসে এভাবে ফিসফিস করে কথা বলাটা অভদ্রতা। ত্রয়ী নতুন কুটুম বাড়িতে এসে কোনো অভদ্রতা করতে চাচ্ছে না।
রিসার সাথে কথা বলে সবাই হলুদের স্টেজে চলে যায়। আর কিছুক্ষণ পর-ই রিসার হলুদ ছোঁয়া। সবাই হৈ-হুল্লোড়ে মেতে আছে।
_____________________________________________________
হঠাৎ রুমের সব লাইট’স বন্ধ হয়ে যায়। অন্ধকার রুমের মাঝখান থেকে একটা পুরুষালী কন্ঠ ভেসে আসে। কন্ঠটা শুনে সবার দৃষ্টি চলে যায় রুমের মাঝ বরাবর। ইতোমধ্যে ড্রইংরুমে লাল-নীল আলোকবাতি জ্বলে উঠেছে। আবছা আলোতে রুমের মাঝখানে নিশানকে দেখে সবাই চমকে যায়। নিশানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে রিসার বোন নীলা।
বড়রা সব ওদের মতো অন্যদিকে কাজে ব্যস্ত। হলুদের মেইন ফাংশন নিয়ে। আর এদিকে আলাদাভাবে অন্যান্য ছোট-বড় ইয়াং ছেলেমেয়েরা তাদের মতো আমোদ প্রমোদে মেতে আছে। সবার চোখে মুখে তিশান-রিসার বিয়ে নিয়স ফুর্তির আমেজ।
কিছুক্ষণের মধ্যেই নিশান সবার উদ্দেশ্যে বলে,
– এটেনশন গাইজ! ভাবীর গায়ে হলুদ ছোঁয়ানোর আগে আরেকটা কাজ করতে হবে।
সেখানের উপস্থিত সবাই চোখ বড় বড় করে নিশানের দিকে তাকিয়ে তার কথা শুনছে।
নিশান কয়েক সেকেন্ড থেমে আবার বলে,
– কাজ টা হলো আমাদের সবাইকে কাপল ডান্স করতে হবে। তবে এখানেও কিছু শর্ত আছে। আর শর্ত গুলো বলবে, আমাদের সবার বেয়ান নীলা চৌধুরী।
নিশান সরে যাওয়ার পর নীলা এসে বাকি কথাগুলো বলে,
– কাপল ডান্স কীভাবে করবো? এই প্রশ্ন টা সবার মাথাত ঘুরপাক খাচ্ছে তো? কারণ, এখানে উপস্থিত অধিকাংশের বয়ফ্রেন্ড বা গার্লফ্রেন্ড নেই। আর থাকলেও হয়তো তারা এখানে উপস্থিত নেই। তাই বলতে গেলে এখন এখানে দুলাভাই আর আপু ছাড়া সবাই সিঙ্গেল।
সিঙ্গেল শব্দটা শুনে ইনান, ত্রয়ীর দিকে আড়চোখে তাকায়। ত্রয়ী মনোযোগী শ্রোতা হয়ে নীলার কথা গুলো শুনে যাচ্ছে। ইনানের দিকে তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। ইনান কিছুক্ষন ত্রয়ীর দিকে আপন মনে হেসে উঠে দুপুরের কথাটা মনে করে। তারপর আবার নীলার কথায় মন দেয় সে।
নীলা বলছে,
এখানে উপস্থিত সকল ছেলের চোখ বেঁধে দেওয়া হবে। মেয়েরা সবাই ছেলেদের সামনে দাঁড়াবে। আর ছেলেরা তখন তাদের পার্টনার পছন্দ করে নিবে।
আমার কথা কী সবাই বুঝতে পেরেছেন?
সবাই একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে একযোগে বলে উঠে,
– ব্যাপার টা বেশ লাগছে। বুঝতে পেরেছি আমরা সবাই।
সবাই যখন উল্লাসে মাতোয়ারা তখন ত্রয়ীর মুখে চিন্তার ছাপ। ইনান দূর থেকে ত্রয়ীর চিন্তিত মুখ দেখে ওর কাছে এগিয়ে এসে বলে,
– আমার রাজকুমারী এতো কী চিন্তা করছে হুম?
ইনানের কন্ঠ পেয়ে ত্রয়ীর ভাবনায় ছেদ ঘটে। সে বলে,
– আচ্ছা আপনার চোখ বেঁধে দিলে আপনি যদি অন্য কোনো মেয়েকে আপনার পার্টনার হিসেবে চুজ করে ফেলেন, তখন কী হবে?
ত্রয়ীর কথা শুনে ইনানের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি আসে। সে দুষ্টুমির ছলে বলে,
– আসলেই তো! তখন কী হবে?
ত্রয়ী কাঁদো কাঁদো গলায় বলে,
– তখন আপনি অন্য মেয়ের সাথে ডান্স করবেন। আর আমাকেও অন্য কোনো ছেলের সাথে ডান্স করতে হবে। এটা আমি করতে পারবো না। আমি চাইনা আপনি ছাড়া অন্য কোনো পুরুষ আমাকে স্পর্শ করুক। আর আপনাকেও আমি অন্য কোনো মেয়েকে স্পর্শ করতে দিবো না।
এই কাপল ডান্সের আইডিয়া টা খুব ব্যাড। আমি এতে পার্টিসিপেন্ট করবো না। আর আপনিও করবেন না ওকে?
ত্রয়ী ইনানকে নিয়ে এতোটা ভাবে, এটা দেখে ইনান গোপনে নিঃশ্বাস ছাড়ে। তারপর ত্রয়ীকে আশ্বস্ত করে বলে,
– এমন কিচ্ছু হবেনা বোকাপাখি। তুমি আমার উপর ভরসা রাখো, দেখবে সব ঠিক হবে।
– যদি না হয়?
– ইশ লে! আমার জানটা, আগেই কেন নেগেটিভ ভাবছো? সবসময় পজিটিভ ভাববে। তাহলে দেখবে সব কিছু পজিটিভ-ই হবে। বুঝলে বোকাপাখি?
ত্রয়ী মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে।
ইতোমধ্যে চোখ বাঁধা শুরু হয়ে গেছে। ইনান ত্রয়ীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চোখ বাঁধাতে চলে যায়। নীলা এসে ত্রয়ীয়ে তার রুমে নিয়ে যায়। যেসব মেয়েরা ডান্স করবে তারা সকলেই নীলার রুমে বসে আছে। ত্রয়ী যাওয়ার সাথে সাথেই নীলা সবাইকে সেম পারফিউম লাগিয়ে দেয়। যাতে কোনো ছেলে কোনো মেয়ের পারফিউম এর ঘ্রান দিয়ে চিনতে না পারে।
______________________________________________________
পারফিউম লাগানোর পর মেয়েরা এসে লাইন ধরে দাঁড়ায়। এক জন করে ছেলে এসে তার পার্টনার চুজ করে নিবে।
প্রথমে, তিশান আসে। সে রিসাকে পার করে চলে গিয়ে নীলাকে চুজ করে নেয়। এদিকে রিসা তা দেখে জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়তে, নিশান আসে। সে সবার প্রথমে যে মেয়েটা দাঁড়িয়েছে তাকে বেচে নেয়। ইফতিহার হাত ধরতেই ইফতিহা কেঁপে উঠে। এই প্রথম কোনো অচেনা ছেলে হাত ধরেছে। বুকের ভেতরটায় কেমন ধক করে উঠে তার। নিশান তার পার্টনার হিসেবে ইফতিহাকে চুজ করেছে।
তৃতীয়ত, ইনান আসে। ইনান একবার সব মেয়ের সামনে রাউন্ড দেয়। তারপর আবার ব্যাক করে এসে ত্রয়ীর সামনে দাঁড়ায়। খুশিতে ত্রয়ীর চোখ মুখ জ্বলজ্বল করতে থাকে। এই বুঝি ইনান তার হাত ধরবে এটা ভেবেই তার বুকের ভেতর ঢিপঢিপ করতে থাকে। মনে শতরঙের প্রজাপতি ডানা মেলতে শুরু করে। ঠিক ঐ মুহুর্তে ইনান ত্রয়ীর সামনে থেকে সরে গিয়ে হিমার হাত ধরতে যায়।
এমন দৃশ্য দেখে ত্রয়ীর কান্না পেয়ে যায়। পারফরম্যান্স করবে না ভেবে ডান্স ফ্লোর থেকে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। এক পা বাড়াতেই ইনান হ্যাচকা টানে ত্রয়ীকে নিজের কাছে টেনে নেয়।
ইনান হঠাৎ করে টান দেওয়াতে ত্রয়ী নিজেকে সামলে নিতে পারেনা। হুমড়ি খেয়ে ইনানের বুকে নিজের মুখ লুকায়। ইনানের গরম নিঃশ্বাস গুলো ত্রয়ীর চুলের উপর পড়ছে। ত্রয়ী ধীরে ধীরে মুখ তুলে ইনানের দিকে তাকায়। আবেগে আপ্লুত হয়ে দু’ফোটা চোখের জল বিসর্জন দেয় সে।
একে একে সবাই তাদের পার্টনার চুজ করার পর ডান্সের জন্য রেডি হয়ে নেয়। ছেলেরা চোখ বেঁধেই ডান্স করবে এমনটাও শর্ত দেওয়া হয়।
ত্রয়ী এখন ডান্সের প্রোগ্রাম টা বেশ ভালোভাবে উপভোগ করছে। নিজের মানুষটাকে ক’জন মানুষ-ই বা পার্টনার হিসেবে পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি মজার বিষয় হচ্ছে, বিয়ের বর-কনে তারা দু’জনে আলাদা আলাদা পার্টনার এর সাথে ডান্স করবে।
ত্রয়ী তার ভাইটার জন্য আফসোস করছে, ডান্স শেষ হওয়ার পর তার কপালে যে কী আছে, তা উপরওয়ালা আর রিসা জানে।
বেচারার বিয়ে করার শখ রিসা আজ মিটিয়ে দিবে মনে হচ্ছে। রিসার চোখ মুখে তা স্পষ্ট।
রিসার মুখের অবস্থা দেখে ত্রয়ী মিটমিটিয়ে হাসছে।
মিনিট পাঁচেক পড়ে ডান্স শুরু হয়।
“ওরে মনওয়া রে, ওরে মনওয়া রে..
ওরে মনওয়া রে, ক্যায়সা হ্যায় তু বাতা।
ও মন, হারিয়ে বসে আছি দেখ,
প্রথমবারেরই দেখায়,
কত না হলো তোলপাড়।
দু চোখ, দেখেছে তোকে আজ যেই,
হারিয়ে ফেলেছি খেই,
আমিও আমার কথা।
খেয়ালী দিন, মায়াবী রাত,
এক নিমেষে।
তাকালি তুই, আমি হঠাৎ,
অন্য দেশে ও ও.. মন,
হারিয়ে বসে আছি দেখ..
প্রথমবারেরই দেখায়,
কত না হলো তোলপাড়।
ওরে মনওয়া রে, ওরে মনওয়া রে,
ওরে মনওয়া রে, ক্যায়সা হ্যায় তু বাতা..”
এই গানে সবাই ডান্স করছে। ডান্সের তালে তালে ত্রয়ীর খোলা চুলগুলো বারবার ইনানের চোখে মুখে এসে লাগছে। এতে ইনানের বিরক্ত লাগার বদলে খুব বেশি ভালো লাগা কাজ করছে।
ইনান তার মুগ্ধ নয়নে তার বোকাপাখি কে দেখছে। ত্রয়ী বারংবার লজ্জায় চোখ সরিয়ে নিচ্ছে।
.
.
চলবে।