#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-৩১
.
.
রিসাকে হলুদ লাগিয়ে তিশানরা রওনা দেয় নিজ গন্তব্যে। রাত অনেক হয়ে গেছে। বাড়ি ফিরে তিশানের হলুদের প্রোগ্রাম করতে হবে। হলুদের আয়োজন সবটাই করা হয়ে গেছে। এখন শুধু বর সেখানে পৌঁছানোর অপেক্ষায় আছে সবাই।
তারা বাড়ি পৌঁছালো রাত এগারোটার দিকে। ত্রয়ী ক্লান্ত। তার ইচ্ছে করছে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে। কিন্তু পারছেনা তার ভাইয়ের হলুদের প্রোগ্রামের জন্য। ইনান নিজের রুমে যায় কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়ার জন্য। ত্রয়ী রিসাদের বাড়ি থেকে ফিরে শাওয়ার নেয় ক্লান্তি দূর করার জন্য। সে চট করে হট কফি বানিয়ে নেয়। তারপর খোলা বারান্দায় গিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস নেয়।
ইতোমধ্যে হলুদের প্রোগ্রাম শুরু হয়ে গেছে। তবে ত্রয়ী, ইনান দু’জনের কেউই এখনো সেখানে যায়নি। ইনান নিজের রুমে রেস্ট নিতে নিতে ঘুমিয়ে পড়েছে। আর ত্রয়ী বারান্দায় দাঁড়িয়ে কফি খাচ্ছে।
ইফতিহা ত্রয়ীকে ডাকার জন্য ত্রয়ীর রুমে আসে। রুমে না পেয়ে বারান্দায় যায় সে। হালকা কেশে বলে,
– আপু, স্টেজে ডাকছে তোমায়।
ত্রয়ী মাথা ঘুরিয়ে ইফতিহাকে দেখে মৃদু হাসে। তারপর নরম গলায় বলে,
– আসছি। তুমি যাও।
ইফতিহা মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। এক কদম এগুতেই ত্রয়ী তাকে পিছু ডেকে জিজ্ঞেস করে,
– ইফতিহা, তোমার ভাইয়া কি স্টেজে?
– না আপু। ভাইয়ার মেবি মাথাটা ধরেছে, তাই ঘুমোচ্ছে।
ত্রয়ী শুকনো মুখ করে বলল,
– ওহ আচ্ছা।
ইফতিহা মিটমিট করে হাসছে ত্রয়ীর শুকনো মুখ দেখে। মনে মনে আওড়ায় সে,
– ভাইয়া খুব ভাগ্যবান, তোমার মতো একটা মেয়ে পেয়েছে নিজের জীবনে। সেইসাথে, আমিও ভাগ্যবতী, তোমাকে ভাবী হিসেবে পাবো বলে।
ইফতিহার হাসি দেখে ত্রয়ী ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
– কী ব্যাপার? হাসছো কেন?
ইফতিহা নিজের হাসি সংযত করে আমতা আমতা করে বলল,
– না কিছু না। এমনি।
ইনানের চিন্তায় ত্রয়ীর মস্তিষ্ক থমকে গেছে। তাই ইফতিহার সাথে আর কথা না বাড়িয়ে ইনানের রুমের উদ্দেশ্যে পা বাড়ায় সে।
ইফতিহা থম মেরে কিছুক্ষণ সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। নিশান ছুটে আসে ত্রয়ীকে খোঁজার জন্য। এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ইফতিহা ত্রয়ীর রুম থেকে বের হওয়ার সময় নিশানের সাথে খুব জোরে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নেয়। কিন্তু সে আটকা পরে যায় কারো একটা হাতের সাথে।
ভয়ে ভয়ে চোখ খুলে সে নিজেকে আবিষ্কার করে নিশানের বাহুডোরে। লজ্জায় সংকুচিত হয়ে যায় তার চোখ। পাতলা মসৃন ঠোঁট দু’টো অজানা ভয়ে কাঁপতে থাকে। চোখ খিচে রাখে সে।
নিশান ইফতিহার এমন কান্ডে হকচকিয়ে যায়। ধীরে ধীরে তাকে নিজের বাহুডোর থেকে মুক্ত করে দাঁড় করায়।
নিশান ইফতিহাকে ছাড়তেই সে ছিটকে খানিকটা দূরে সরে দাঁড়ায়। তারপর মাথা নিচু করে মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,
– দুঃখিত। আমি তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে খেয়াল করিনি আপনি যে এদিকে আসছেন।
– আরে দুঃখিত হতে হবে না। আমিও তাড়াহুড়ো করছিলাম তাই তোমাকে খেয়াল করিনি। দু’জনেই বেখেয়ালি ছিলাম। এটার জন্য এতো সংকোচ করতে হবে না।
নিশানের ভদ্রতা দেখে ইফতিহা অবাক হয়। আজ যেনো অন্যরকম কিছু অনুভব করছে সে। মনের দরজায় মনে হচ্ছে কেউ হালকা করে কড়া নাড়ছে। এসব কিছু ভাবতেই ইফতিহার পুরো গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠে। পুরো শরীরে হিমেল হাওয়া বয়ে যায়। ইফতিহা মাথা তুলে তাকায় নিশানকে কিছু একটা বলার জন্য।
কিন্তু তাকিয়ে সে হতাশ হয়। নিশান নেই। চারপাশে তাকায়। সে কোথাও কেউ নেই। ইফতিহা চুপসে যায়। হঠাৎ করে মন খারাপ হয়ে যায়। চুপচাপ হয়ে ফিরে আসে হলুদের স্টেজে। চারদিকে তাকিয়ে সেই মানুষটাকে খোঁজার চেষ্টা করে। কিন্তু পাচ্ছে না, সে কোত্থাও নেই।
হঠাৎ করে তার চোখ যায় দূরের ল্যাম্পপোস্টের দিকে। ল্যাম্পপোস্টের মৃদু আলোতে তার খুঁজে না পাওয়া মানুষটার ঝাপসা চেহারা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে সে কারো সাথে হাত নাড়িয়ে কিছু একটা বোঝানোর চেষ্টা করছে, কিন্তু বোঝাতে সক্ষম হচ্ছে না। এমন দৃশ্য দেখে ইফতিহা নিজের অজান্তেই হেসে ফেলে।
খুব মনোযোগ দিয়ে সে এমন দৃশ্য দেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু কেন এমন করছে? সে উত্তর তার জানা নেই!
_________________________________________________________
ত্রয়ী ভয়ে ভয়ে ইনানের রুমে প্রবেশ করে। ফ্ল্যাট থমথমে হয়ে আছে। ইনান ছাড়া কেউ নেই এখন ফ্ল্যাটে। সবাই হলুদের স্টেজে ব্যস্ত। ত্রয়ীর ইনানের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আনমনে মানুষটাকে দেখায় ব্যস্ত সে। কিছুক্ষন পর হদিস হয় ইনানকে নিয়ে নিচে যেতে হবে। সবাই অপেক্ষা করছে তার জন্য। ত্রয়ী ইনানের পাশে বসে।
শীতল গলায় ডাকে,
– শুনছেন? শুনছেন? শুনছেন…
একবার, দু’বার, কয়েকবার ডাকার পরও ইনানের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না দেখে সে ইনানের হাতের উপর হাত রাখে। ঘুমের ঘোরে কারো একটা হাতের স্পর্শ পেয়ে ইনান আরো জোরে হাতটা আঁকড়ে ধরে। ত্রয়ী তা ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টা করতে থাকে। কিছু মুহুর্ত পর ইনানের হাত থেকে তার হাত ছাড়িয়ে আনে।
তারপর কানের কাছে মুখ নেয় ইনানকে ডাকার উদ্দেশ্যে কিন্তু ডাকতে পারেনা। অদ্ভুত এক মায়া কাজ করছে ইনানের ঘুমন্ত চেহারায়। সে মায়া তাকে জাগাতে মানা করছে। ত্রয়ী আর ডাকে না। ইনানের কপালের উপর আঁচড়ে পড়ে চুলগুলোতে একবার হাত বুলিয়ে উঠে দাঁড়ায় নিচে যাওয়ার জন্য। এভাবে বেশিক্ষণ একা একা ইনানের কাছে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ!
ত্রয়ী ব্যস্ত পায়ে দু’কদম সামনে এগোতে পিছন দিক থেকে ইনান তার হাত ধরে ফেলে। ত্রয়ী চোখ বন্ধ করে ফেলে।
মনে মনে বিড়বিড় করে,
– তবে কি মানুষটা জেগেছিলো? ইচ্ছে করেই এতোক্ষন সাড়া দেয়নি?
বিড়বিড় করতে করতেই সে ঘাড় ঘুরিয়ে ইনানের দিকে তাকায়। সন্দেহের অবকাশ ঘটে তার। ইনান ঘুমোচ্ছে, গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন সে। তাহলে হাত ধরেছে কীভাবে?
মনে এমন প্রশ্ন উঁকি দিতেই ত্রয়ী মাথা নিচু করে ইনানের মুখের কাছে তার মুখ এগিয়ে নেয়।
ইনান ঠোঁট নাড়িয়ে কিছু একটা বলছে, ত্রয়ী তা বুঝার জন্য তার কান পেতে দেয় ইনানের ঠোঁটের কাছে। ইনান ঘুমের ঘোরে বলছে,
– শুধু পালিয়ে পালিয়ে বেড়াও। একটা বার তো আমাকে একটু আদর করতে পারো। তা না করে শুধু লজ্জাবতী হয়ে পালিয়ে যাও।
ইনানের এই অদ্ভুত কথায় ত্রয়ী হতচকিত হয়ে যায়। ইনান যে ঘুমে সেটা শতভাগ নিশ্চিত সে। কারণ, ইনান জেগে থাকলে কখনই এমন সরাসরি আদরের কথা বলতো না। ঘুরিয়ে প্যাচিয়ে বলতো কথাটা।
ত্রয়ীর হাসি পাচ্ছে খুব এমন কথা শুনে। ইনান জেগে থাকলে অবশ্য এতক্ষণে সে নেতিয়ে যেতো। কিন্তু ঘুমে আছে বলেই সে হাসছে। আর বলছে,
– নির্লজ্জ, ঘুমের মধ্যেও নির্লজ্জপণা করে যাচ্ছে। অসভ্য একটা।
ত্রয়ী আবার উঠে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। এবার সত্যিই খুব দেরি হয়ে যাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো তার খোঁজে এখানেও কেউ চলে আসবে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ইনান তার হাত ছাড়ছে না। ঘুমের মধ্যে মানুষের শক্তি কি দ্বিগুণ হয়ে যায়? নাহলে, ইনানের হাত থেকে সে নিজেকে ছাড়াতে পারছে না কেন?
এমনি সময় তো কতো সহজে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। ত্রয়ী দেখলো, ইনান আবারও কিছু একটা বলছে।
ত্রয়ী মুখ নিচ করে শুনতে থাকে। ইনান বলল,
– আদর না দিলে আজ ছাড়বো না। কিছুতেই ছাড়বো না।
ত্রয়ীর অবচেতন মন কী করবে বুঝতে পারছেনা। ইনান তাকে ছাড়ছে না, অথচ, এই মুহুর্তে তার এখান থেকে প্রস্থান করাটা খুব জরুরি।
ত্রয়ী কিছু একটা ভেবে দরজার দিকে তাকায়। তারপর হুট করে নিজের ঠোঁট দু’টো ছুঁইয়ে দেয় ইনানের কপালে। নিজের চুমুতে নিজেই কেঁপে উঠে। পুরো গায়ে শীতল রক্তের শ্রোত বয়ে যায়।
ইনানের কেমন অনূভুতি হচ্ছে তা বুঝতে পারছে না ত্রয়ী। বোঝার চেষ্টাও করছে না সে। এতোক্ষণে ইনান হাত ছেড়ে দিয়েছে। ত্রয়ী নিজেকে ছাড়া পেয়ে দৌড়ে পালায় সেখান থেকে।
________________________________________________________
তিশানের গায়ে হলুদ লাগানো প্রায় শেষ পর্যায়ে। এমন সময় ত্রয়ী উপস্থিত হয় সেখানে। স্টেজের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ত্রয়ী শুনতে পায় এলাকার কিছু বয়স্ক মহিলা আলোচনা করছে, কারো বিয়ের হলুদ যদি বিয়ের উপযুক্ত ছেলে বা মেয়ের গায়ে লাগে, তাহলে তার না-কি বিয়ের ফুল ফোটে।
এমন কথা শুনে ত্রয়ী মিনিট কয়েক থমকে দাঁড়ায় সেখানে। চোখ বুজে কল্পনা করতে থাকে, তার নিজের বিয়ে হচ্ছে ইনানের সাথে। খুব হৈচৈ হচ্ছে সেখানে। ত্রয়ী কনে সেজে বসে আছে ইনানের পাশে। ইনান আড়চোখে তাকে দেখছে। এমন কল্পনায় ত্রয়ী ডুবে আছে।
হঠাৎ করে তনয়ার গলার আওয়াজ পেয়ে ত্রয়ী কল্পনা থেকে বেরিয়ে আসে। চোখ খুলে দেখে মা তার দিকে তীক্ষ্ণ নজরে তাকিয়ে আছে। ত্রয়ী ঢোক গিলে। মা চটে আছে, সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে।
তনয়া কড়া গলায় বলল,
– কোথায় ছিলি এতোক্ষণ?
ত্রয়ী তোতলানো গলায় বলে,
– মা, আমি রুমে ছিলাম।
– মিথ্যা বলবি না, তুই রুমে ছিলিনা। আমি নিজে গিয়ে তোকে তোর রুমে খুঁজে এসেছি।
মায়ের কথায় ত্রয়ী থম মেরে যায়। ধরা পড়ে গেলো সে, এখন কী বলবে?
– কী হলো চুপ করে আছিস কেন? বল, কোথায় ছিলি?
তনয়ার হুংকারে ত্রয়ী ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে। মিইয়ে যাওয়া গলায় বলে,
– তুমি যখন খুঁজেছিলে তখন হয়তো আমি ওয়াশরুমে ছিলাম।
তনয়া আবারও হুংকার দিয়ে কিছু একটা বলতে যাবে, ঠিক তখনি নিশান এসে আটকায় তাকে।
-আহ, আম্মু! ছেড়ে দাও তো। দেখছো আজ একটা আনন্দের দিন। এই দিনেও ওকে বকা দিচ্ছো? বাদ দাও, যেখানে ছিলো, ছিলো। এখন তো এসে গেছে। ভাইয়া অপেক্ষা করছে ওর জন্য। ছেড়ে দাও।
তনয়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিশানের দিকে তাকিয়ে চলে যায় সেখান থেকে।
মা চলে যাওয়ার পর ত্রয়ী হাফ ছেড়ে বাঁচে। বুকের উপর হাত রেখে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর হেসে নিশানের উদ্দেশ্যে বলে,
– থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ ভাইয়া! এর জন্য তুই আমার থেকে একটা কিটক্যাট পাবি।
নিশান হেসে বলে,
-আমাকে কিটক্যাট পরেও দিতে পারবি। এখন আগে চল ভাইয়াকে হায়ে হলুদ লাগাবি।
ত্রয়ী মাথা নাড়িয়ে বলে,
– হ্যাঁ চল।
– আর শোন, এমন ভাবে লাগাবি যাতে ভাইয়ার সারা শরীরের একটা ফোটাও জায়গা ফাকা না থাকে।
চোখে টিপ্পনী কেটে নিশান ত্রয়ীকে কথাখানা বলে।
নিশানের দুষ্টুমি বুঝতে পেরে ত্রয়ীও চোখের ইশারায় তাকে আশ্বস্ত করে। তারপর দু’ভাই-বোন খিলখিলিয়ে হেসে তিশানের দিকে এগিয়ে যায়।
.
.
চলবে।