#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-৩৩
.
.
বিয়ে বাড়িতে পৌঁছে ত্রয়ী একবারের জন্যও ইনানের মুখোমুখি হয়নি। এদিকে ইনান তাকে হন্তদন্ত হয়ে খুঁজে মরছে। তিশান আর রিসার বিয়েটা খুব ভালো ভাবেই সম্পন্ন হয়েছে। সন্ধ্যার কিছুটা পরেই রিসাকে নিয়ে তিশানের বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হয়েছে বর যাত্রীরা।
বাড়ি এসেই ইনান ত্রয়ীর রুমে গিয়ে বসে রয়েছে। যাতে ত্রয়ী রুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই ইনান তার সাথে দেখা করতে পারে।
কিন্তু ইনানের এই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়েছে। ত্রয়ী রুমে আসেনি। তবে কোথায় বসে আছে? কে জানে!
শ্বশুর বাড়িতে রিসার পা পড়ার সাথে সাথেই নানা রকম নিয়মের মধ্যে দিয়ে তাকে প্রায় দু’ঘন্টার মতো সময় অতিবাহিত করতে হয়েছে। রাত বারোটা নাগাদ রিসাকে তিশানের রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। তার এক ঘন্টা পর তিশান রুমে প্রবেশ করে।
রিসার মন মেজাজ বিগড়ে আছে। তিশান একবার রিসার দিকে তাকিয়ে আবার মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। সে বুঝতে পারছে তার বউ খুব রেগে আছে তার উপর। রেগে থাকাই স্বাভাবিক! একে তো মেয়েটা এ বাসায় নতুন। তারপর আবার পুরো এক ঘন্টা সে একা একা একটা রুমে বসে অপেক্ষা করছে তার স্বামীর জন্য। অথচ, তার স্বামী কি না বন্ধু-বান্ধব নিয়ে আড্ডায় মেতেছিলো।
তিশান কিছু না বলে তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে চলে যায়। রিসা তিশানের এসব কান্ড দেখছে আর ফুলছে।
মিনিট দশেক পরে তিশান শাওয়ার নিয়ে এসে দেখে রিসা ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘুমন্ত চেহারা’টা দেখে তিশানের খুব মায়া হচ্ছে। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সে আর তাকে জাগাতে পারছে না।
ধীরে ধীরে রিসার কাছে গিয়ে তার গয়না গুলো খুলে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দেয় সে। তারপর রুমের লাইট অফ করে রিসার পাশে শুয়ে পড়ে। আলতো করে রিসাকে নিজের কাছে টেনে এনে কপালে একটা চুমু খায়। বিবাহিত জীবনে এই প্রথম স্পর্শ করলো সে তার বউকে। তারপর শক্ত করে জড়িয়ে ধরে তিশান ও ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেলো। শুরু হলো এক জোড়া কপোত-কপোতীর নতুন সংসার!
______________________________________________________
বর্তমান!
ত্রয়ী কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলো তার খেয়াল নেই। নিশানের ডাকে তার ঘুম ভাঙ্গে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসে সে। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে সে নিশানের দিকে। নিশান বোনের চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে গোপনে নিঃশ্বাস ছাড়ে। মেয়েটা বোধহয়, কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। চোখ ফুলে আছে।
নিশান নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
– যা, ফ্রেশ হয়ে আয়। আফতাহি চলে এসেছে। তোর জন্য অপেক্ষা করছে।
ত্রয়ী নিশানের কথা কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। আফতাহি কে? সে কেন তার জন্য অপেক্ষা করছে?
বোনের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে নিশান আনমনে হাসলো।
তারপর বলল,
– আজ তোকে ছেলে পক্ষের দেখতে আসার কথা। ভুলে গেলি?
ত্রয়ীর এতক্ষণ পর মনে হলো আজ দুপুরে তার বাবা ছেলেপক্ষের আসার কথাটা তাকে বলেছিলো।
চোখ কচলাতে কচলাতে সে বলল,
– ওহ! ভুলে গিয়েছিলাম। তুমি যাও ভাইয়া। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
নিশান উঠে দাঁড়ায় চলে যাওয়ার জন্য। এমন সময় তনয়া প্রবেশ করে রুমে। তার হাতে একটা সিল্কের শাড়ী।
শাড়ী দেখে অবাক হয়ে ত্রয়ী বলল,
– আম্মু, শাড়ী কেন আবার?
তনয়া শীতল গলায় বলল,
– এটা আফতাহি এনেছে তোর জন্য। এই শাড়িটা পড়েই ওদের সামনে যাবি। বুঝলি?
ধূসর পাড়ের কালো রঙা একটা শাড়ী। ত্রয়ী কালো রঙটা দেখেই একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। হৃদয় পুড়ছে তার, বুকের ভেতর টা কেউ একজনের জন্য তোলপাড় করা শুরু করে দিয়েছে। এই রঙটা যে তার খুবই প্রিয় ছিলো!
ত্রয়ী তার মনের ভেতরের হাজার যন্ত্রণা চাপা দিয়ে হাসিমুখে শাড়ীটা মায়ের হাত থেকে নেয়। নিতে ইচ্ছে করছে না, তবুও নিলো। কী দরকার অতীতের কথা তুলে এখন নতুন করে অশান্তি করার? তার থেকে ভালো, যা হচ্ছে তা হতে দেওয়া। যে মানুষটাকে সে কোনোদিন পাবেই না, তাকে ঘিরে বর্তমানে অশান্তি ডেকে আনার কোনো মানেই হয় না।
______________________________________________________
আফতাহি ঘন্টাখানেকের মতো ড্রইংরুমে বসে অপেক্ষা করছে তার হবু বউকে এক নজর দেখার জন্য। এবার মনে হচ্ছে, অপেক্ষার পালা শেষ হতে চলেছে। ত্রয়ী আসছে ড্রইংরুমের দিকে। সাথে নিশান আর রিসা। তিশান আফতাহির সাথেই বসা ছিলো। ত্রয়ীকে দেখে উঠে দাঁড়ায় সে।
রিসা ত্রয়ীকে আফতাহির পাশে বসিয়ে দেয়। ত্রয়ী মাথানিচু করে আছে। এখনও সে পাত্রের মুখ পানে তাকায় নি। তাকাতে ইচ্ছেও করছে না। যে মানুষটাকে সে কোনোদিন ভালোবাসতেই পারবে না, তাকে দেখেই বা কি হবে?
ত্রয়ী পাশে না তাকিয়ে সামনের দিকে তাকায়। তার বাবার পাশে বসা লোকটাকে উদ্দেশ্য করে সালাম দেয়। শাহীন সাহেব সালামের জবাব দেয়।
তারপর আলফাজ খান কে উদ্দেশ্য করে বলে,
– তোর মেয়ে তো অনেক বড় গেছে। সেই ছোট বেলায় দেখেছিলাম।
উনার কথা শুনে সেখানের উপস্থিত সবাই হাসে। তবে আফতাহি হাসলো কি না তা বোঝা গেলো না।
শাহীন সাহেব হাসি থামিয়ে ত্রয়ীর উদ্দেশ্যে জিজ্ঞেস করে,
– তা মা, কোন ইয়ারে পড়ছো তুমি?
– অনার্স থার্ড ইয়ারে আঙ্কেল।
– বাহ, বেশ বেশ!
শাহীন নামের ভদ্রলোকটি আবার ত্রয়ীর বাবার উদ্দেশ্যে বলল,
– তাহলে বন্ধু আর দেরি কিসের পাত্র-পাত্রী দু’জনেই যখন এখানে উপস্থিত, তাহলে এনগেজমেন্টের কাজটা সেরে ফেলি।
এনগেজড এর কথা শুনে ত্রয়ীর বুকে ছ্যাত করে উঠে। চোখ মুখ খিচে গোপনে শ্বাস নিচ্ছে সে। দমবন্ধ লাগছে। মনে হচ্ছে শরীরের প্রতিটা শিরা-উপশিরায় বরফের ন্যায় কিছু ছুটে চলছে। এক দলা কান্না গলায় এসে আটকে কাছে।
সে অসহায় দৃষ্টিতে নিশানের দিকে তাকিয়ে আছে। এই বাড়িতে এই একটা মাত্র লোক আছে যে ত্রয়ীকে বুঝে। নিশান ত্রয়ীর চাহনি বুঝতে পেরে চোখের ইশারায় তাকে শান্ত হতে বলে। কিন্তু ত্রয়ী পারছেনা শান্ত হতে।
কীভাবে সে শান্ত হবে? তার মন যে শুধুমাত্র তার ইনানের কাছেই আটকে আছে।
নিশান কিছু একটা বলতে যাবে ঠিক ঐ মুহুর্তেই আফতাহি বলল,
– বাবা, আমি কিছু বলতে চাই।
আলফাজ সাহেব হেসে বলল,
– তুমি যা বলতে চাও, নির্দ্বিধায় বলতে পারো।
– এনগেজমেন্ট টা আরেকটু সময় নিয়ে করা যায় না? আই মিন, আমরা দু’জন দু’জনকে বোঝার জন্য কিছুটা সময় চাইছি।
আফতাহির কথা শুনে আলফাজ খান আর শাহীন সাহেব দু’জন দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। এতোক্ষণ পর ত্রয়ী আড়চোখে আফতাহির দিকে তাকিয়েছে।
আলফাজ সাহেব কিছু বলার আগেই নিশান বলল,
– হ্যাঁ বাবা, আমার মনে হচ্ছে আফতাহি ঠিক কথা বলছে। ওদের দু’জনকে কিছুটা সময় দেওয়া উচিত আমাদের। এতে করে দু’জন দু’জনকে একটু জেনে নিতে পারবে।
আলফাজ সাহেব এমন সিদ্ধান্তে খুশি নন। এটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
কিন্তু তার বন্ধু শাহীন বলল,
– ঠিক আছে। তবে তাই হোক। তোমাদেরকে আগামী এক মাস সময় দেওয়া হলো। তোমরা দু’জন দু’জনকে এই একমাসের মধ্যে যতটুকু জানার জেনে নিও। কিন্তু এক মাস পর আর এমন এনগেজড এর আয়োজন করা হবে না। সরাসরি বিয়ের আয়োজন করা হবে তখন। কি বলিস আলফাজ?
আলফাজ সাহেব জোর করে মুখে হাসি এনে বলল,
– তুই যা ভালো মনে করবি, তাই হবে বন্ধু।
তারপর আবারও দুই বন্ধু হাসিতে মেতে উঠেছে।
ইতোমধ্যে ত্রয়ী ড্রইংরুম প্রস্থান করেছে। নিজের রুমে এসে একটা স্বস্তির প্রশ্বাস নেয় সে।
নিশান পিছন দিক থেকে বলল,
– কি এবার খুশি তো?
ত্রয়ী তাচ্ছিল্যর সুরে বলল,
– আমার আর খুশি! এক মাস পর তো সেই অন্যের অধীনে চলে যেতেই হবে।
নিশান আর ত্রয়ীর কথার মাঝখানে নিশানের ফোন টা বেজে উঠে। সে ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে ইফতিহা ফোন করেছে।
নিশান কিছু ইতস্তত বোধ করে বলল,
– তুই রেস্ট নে। আমি একটু আসছি।
ত্রয়ী ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। নিজের দিকে তাকাতেও এখন আর তার ইচ্ছে হয়না। পাঁচটা বছর সে নিজের একটুও যত্ন নেয় না।
কাছের মানুষগুলোও এই পাঁচ বছরে অনেক টা পালটে গেছে। শুধু নিশান ছাড়া। তিশান তো এখন ত্রয়ীকে সহ্যই করতে পারেনা। আলফাজ সাহেব পিতৃত্যের দায়ে কথা বলে তার সাথে। তনয়া সে তো এখনও সুযোগ পেলে এতো বড় মেয়ের গায়ে হাত তোলে। রিসা অবশ্য কখনও কিছু বলেনা। তবে তারও বা কি করার আছে? স্বামী-শ্বশুর যা বলতে তাকে তো সেটাই মানতে হবে।
ত্রয়ীর আজ সেই ছোটো বেলার কথা মনে পড়ছে। কতো আদরের-ই না সে ছিলো। সবার চোখের মণি ছিলো। আর আজ? নিয়তি, ভাগ্য ওকে সবার চোখের বিষ করে দিয়েছে।
অতীত মনে করে তার চোখ ঘোলা হয়ে গিয়েছে। বেহায়া চোখের পানিগুলোও এখন আর কথা শুনে না, কারণে অকারণেই ঝরে পড়ে!
.
.
(চলবে…)