বেখেয়ালি মনে পর্ব-৪০

0
465

#বেখেয়ালি_মনে
#লেখনীতে- Ifra Chowdhury
পর্ব-৪০
.
.
নিশান এমন কান্ড দেখে নিজেও ওর বাবা আর ত্রয়ীর পেছন পেছন যায়। আলফাজ সাহেব ত্রয়ীকে টানতে টানতে হসপিটালের বাইরে নিয়ে গেছেন। নিশানও তাদের পিছু ডাকতে ডাকতে ছুটছিলো। এদিকে ত্রয়ী ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে। ও ইনানের কাছ থেকে একদম দূরে সরবে না। বাবাকে থামতে দেখে নিশানও ওদের পাশে এসে থেমে দাঁড়ায়।

আলফাজ সাহেব ত্রয়ীর হাতটা ছেড়ে আলতো ভাবে দুই কাধে হাত রাখেন,
-মা শুনো, নিজেকে সামলাও। ইনানের অবস্থা এখন কেমন, জানোই তো। ও যখন চায় না, তুমিও ওর পাশে অতো যেও না। নাহলে উত্তেজনায় ওর কন্ডিশন আরো খারাপ হয়ে যেতে পারে। আর তোমাকেও যদি কিছু করে টরে বসে? বুঝেছো ত্রয়ী? বাবা ভালোর জন্যই বলছি কিন্তু।
নিশান পাশেই চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। সে-ও এসে ত্রয়ীর মাথায় হাত বুলিয়ে আলফাজ সাহেবের কথার সাথে তাল মেলায়।

ত্রয়ী কিছু উত্তর না দিয়েই ওর বাবাকে জড়িয়ে ধরে। আর কান্নামাখা কন্ঠে বলতে থাকে,
-বাবা, আমি ইনানকে খুব ভালোবাসি বাবা। ওকে প্লিজ সুস্থ করে তুলো। ও সুস্থ না হলে আমিও নিজেকে সামলে রাখতে পারবো না বাবা। প্লিজ ইনানকে ফিরিয়ে দাও আমায়।
আলফাজ সাহেব অন্যপাশে দৃষ্টি রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছেন। মেয়ের কথাগুলোর কোনো জবাব নেই উনার কাছে। ত্রয়ী উনাকে জড়িয়ে ধরেই আছে।

চারপাশের মানুষেরা হাসপাতালে আসতে-যেতে ওদের বাপ-মেয়ের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে যাচ্ছেন। কেউ সরাসরি নজর দিচ্ছে, কেউ আড়চোখে! নিশানের ব্যাপারটা মোটেই ভালো লাগছে না। ও এখান থেকে প্রস্থান করতে চাইছে। ও ওর বাবাকে বলে ত্রয়ীকে নিয়ে চারপাশে হাটাহাটি শুরু করে। আলফাজ সাহেব চলে যান মোস্তফা হকের খোঁজে।

ইনানদের বাসা হসপিটাল থেকে ততোটা কাছে নয়, তাই নিশানেরা কাছেই একটা হোটেলে উঠেছে থাকার জন্য। মোস্তফা হক ওদের জোরাজুরি করেছিলো উনাদের বাসায় গিয়ে আতিথেয়তা গ্রহণ করার জন্য, কিন্তু আলফাজ সাহেবই রাজী হন নি।
এদিকে হসপিটালে অসুস্থ ইনানকে রেখে তারা অযথাই বাসায় গিয়ে অতিথি সেবা পাবে, ব্যাপারটা তো ভালো দেখায় না। আর রাবেয়া হক ও ইফতিহা নিজেও তো সারাক্ষণ হসপিটালে ইনানের পাশেই অবস্থান করে। মোস্তফা হক আর ইয়াদ শুধু মাঝেমধ্যে দরকারে বাড়িতে আসা যাওয়া করে।

নিশান আর আলফাজ সাহেবও এজন্যই থাকার জন্য ধারেকাছে এক হোটেল নির্বাচন করেছেন। যাতে সহজেই হসপিটালে যাতায়াত করা যায় এবং যেকোনো প্রয়োজনে দ্রুত পৌঁছানো যায়। নিশান এখন ত্রয়ীকে নিয়ে হোটেলে যাওয়ার কথাই ভাবছে। কারণ ওর কাদতে কাদতে পুরো নাজেহাল অবস্থা। কখন জানি ত্রয়ী নিজেও অসুস্থ হয়ে পড়ে। তাই নিশান ওকে হোটেলে নিয়ে বিশ্রামে রাখতে চাইছে। কিন্তু ত্রয়ী রাজী হচ্ছে না।

অবশেষে, খানিক বাদে ইফতিহা এসে ত্রয়ীকে মানিয়ে নিতে সফল হয়৷ সেই সাথে ত্রয়ীর কান্নাটাও থামছে ধীরে ধীরে। ইফতিহা আর নিশান এখন ত্রয়ীকে নিয়ে তাদের হোটেলে রওনা হয়৷

_____________________________________________________

ত্রয়ী হোটেলে এসে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে। ইফতিহা পাশে বসেই ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নিশান এক কোণের একটা চেয়ারে অসহায়ভাবে বসে আছে। ওর প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। ইফতিহা বুঝতে পারছে সেটা। ওর মুচকি মুচকি হাসিও পাচ্ছে নিশানের অবস্থা দেখে। কিন্তু সে হাসতে পারছে না। আটকে রাখছে।

আসার সময় নিশান একটু পরপরই বলছিলো খাওয়ার কথা। হোটেলে এসে ওদের রুমে আসার আগেই তাই খাবার অর্ডার করে এসেছে। হোটেলের ম্যানেজার নিচে ওদের ডাইনিং সাইডেই খেতে বসতে বলছিলো, কিন্তু ত্রয়ীর অবস্থা দেখে উপরে ওদের রুমেই খাবার পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য বলে এলো।

এদিকে প্রায় ৪৫ মিনিটের মতো হয়ে যাচ্ছে!
এখনো খাবার আসার নাম গন্ধও নেই। এমনিতেই খিদের চোটে কিচ্ছু ভালো লাগছে না, তার উপর রুম সার্ভিসের এমন গাফিলতি দেখে ওর মেজাজ আরো গরম হয়ে যাচ্ছে। ক্ষুধার্ত পেটটাকে নিয়ে আর কতক্ষণ এভাবে বসে থাকা যায়? নিশান হুড়মুড় করে উঠে দাঁড়ায় চেয়ার থেকে।

শব্দ শুনে ইফতিহা চমকে তাকায়। তারপর মাথা ঘুরিয়ে ত্রয়ীর দিকে খেয়াল করে ওর ঘুমের কোনো রকম ব্যাঘাত ঘটলো কি-না। নিশান ব্যাপারটা বুঝে রাগী মেজাজেও খুব বাচ্চাদের মতো নিজের জিভ কাটে। আরেকটু হলেই ত্রয়ীর ঘুম ভেঙে যেতো! কিন্তু ভাঙে নি। নিশান, ইফতিহা দুজনেই একত্রে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।

যাই হউক, নিশানের খিদেটা আবারো নড়েচড়ে উঠে। পেটেও ইতোমধ্যেই কেমন গুড়গুড় শব্দ শুরু হয়ে গেছে। নিশান কপাল কুচকে পেটে হাত রেখে বুলাতে থাকে। তারপর নাকটা ফুলিয়ে দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলে,
-আজ ওদের একদিন কি আমার একদিন! এতো দেরি লাগে খাবার পাঠাতে? এক্ষুনি গিয়ে খবর নিচ্ছি!
ইফতিহা নিশানের কান্ড দেখে হেসে ফেলে। নিশান যেতে যেতেও থেমে গিয়ে ইফতিহার দিকে ভ্রু কুচকে তাকায়। তারপর আবার রাগে হুড়মুড় করে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে যাওয়ার উদ্দেশ্য হাঁটা লাগায়।

নিশান তড়িঘড়ি করে দরজাটা খুলে বাইরে ছুটবে, তখনি হুট করে কিছু জিনিস পড়ার শব্দ হয়। আর নিশানও ছোটখাটো চিৎকার দিয়ে লাফিয়ে উঠেছে মনে হলো। ইফতিহা মুহুর্তেই উঠে গিয়ে কী হয়েছে দেখার জন্য দরজার কাছে যায়। যেতেই দেখে হোটেলের এক বয় খাবার দিতে এসেছিলো। আর তার সাথেই নিশানের ধাক্কা খেয়ে খাবার দাবার অর্ধেকই উলটে পড়ে গেছে।

ইফতিহা আর ত্রয়ীর জন্য নিশান দু’বাটি অন্থন-স্যুপ অর্ডার করেছিলো। এখন উভয়েরই অসাবধান বশত ধাক্কার চোটে গরম গরম ঐ দুই বাটি উলটে নিশানের পুরো ডান হাতে ছড়িয়ে পড়ে গেছে। নিশান দ্রুত হাত সরিয়ে কঁকিয়ে উঠে। ইফতিহা দৌড়ে নিশানের হাতটা নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিতে চায়। কিন্তু নিশান ধরতে দেয় না। ওর খুব জ্বালা করছে। ইতোমধ্যে লালও হয়ে যাচ্ছে হাতটা।
ওদিকে ওদের রুমে খাবার দিতে আসা ছেলেটা ক্রমাগত ‘সরি’ বলেই যাচ্ছে। ও একদম ভড়কে গেছে। ও বুঝতেই পারে নি এমন কিছু হয়ে যাবে। নিশানের খুব রাগ উঠছে। কিন্তু কিছু বলতেও পারছে না। ঐ ছেলেটারও তো কোনো দোষ নেই। নিশানই তো তাড়াহুড়ো করে বের হতে গিয়ে এই কান্ডটা বাঁধালো।

ইফতিহা দ্রুত ছেলেটাকে একটা বার্নল ক্রিম আনতে পাঠিয়ে নিশানকে টেনে ওদের ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। তারপর ওর ডান হাতে অনবরত ঠান্ডা পানি ঢালতে থাকে আর ফুঁ দিতে থাকে। এদিকে নিশান একদম চুপ মেরে গেছে। এতক্ষণ হাত জ্বলে যাওয়ার জন্য ব্যথায় মেজাজটা একদম মাটি হয়ে গেছিলো। কিন্তু এখন ইফতিহার এমন যত্ন নেওয়া দেখে নিশান একদম মুগ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ওর এমন অস্থিরতা দেখে নিশানের মনে একটা জিনিস পুরোপুরি গেঁথে যায় যে, ইফতিহাও তাহলে নিশ্চিত নিশানকে পছন্দ করে। অথবা.. ভালোবাসে!

একটু পর ঐ ছেলেটা ক্রিম নিয়ে আসতেই ইফতিহা সেটা নিয়ে নিশানের হাতে ধীরে ধীরে লাগিয়ে দিতে থাকে। আর ছেলেটাও আবারও ওর গাফিলতির জন্য ক্ষমা চেয়ে সব সাফ করে নতুন করে খাবার আনতে যায়।

এবার খুব তাড়াতাড়িই ছেলেটা খাবার দিয়ে যায়। নিশান এদিকে মনমরা হয়ে বসে আছে। ওর হাত যে জ্বালা করছে, এখন খাবার কীভাবে খাবে? চামচ নিয়ে খেতে গিয়েও ব্যর্থ হয় সে। হাতটা সত্যিই জ্বলছে খুব। আর এদিকে খিদেটাও প্রচুর পেয়েছে। পেটটা চোঁ চোঁ করছে। ইফতিহা ব্যাপারটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারে। ও কিছুটা আমতা আমতা করে মাথা নত করে নিশানকে বলে,
-আপনার কোনো সমস্যা না থাকলে, আমি আপনাকে খাইয়ে দিতে পারি। দেবো?
নিশান কথাটা শুনে একদম হা হয়ে যায়। এটা তো মেঘ না চাইতেই জল! নিশান খুশিতে গদগদ হয়ে একটা চওড়া হাসি দিয়ে বলে,
-অবশ্যই! থ্যাংক ইউ সো মাচ! মারাত্মক উপকার হবে আমার। প্লিজ দাও?
-আচ্ছা।

অতঃপর ইফতিহা নিশানের পাশে বসে নিজ হাতে ওকে খাইয়ে দিতে থাকে। নিশানের কাছে কেন যেন সব স্বপ্নের মতো লাগছে। যদিও সে বুঝতে পারছে এটা বাস্তবেই হচ্ছে। তাও মানুষের ভাবনা বলে কথা! ও ভাবছে, ইফতিহার এমন যত্ন, এতো খেয়াল যদি ও সারাজীবন পেতো! আহ! কি ভাগ্যবান হতো সে! ভাবতে ভাবতে সে এক পর্যায়ে ইফতিহাকে বলেও ফেলে,
-আমাকে আজীবন এভাবে আদর-যত্ন করার দায়িত্ব নেবে ইফতিহা? আমার যেকোনো ছোটখাটো বিপত্তিতেই এতো অস্থির হবে? খাইয়ে দেবে এভাবে?
অসুস্থ আমিটার সেবাযত্ন করবে এমন করে? খুব লোভ হচ্ছে আমার! তোমাকে পেতে। তোমার ভালোবাসা পেতে! দেবে আমায়?
কথা দিচ্ছি, আমিও তোমায় ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখবো! একদম নিজের করে আগলে রাখবো আজীবন।
ইফতিহা নির্বাক হয়ে আছে। ও কোনো উত্তর খুজে পাচ্ছে না। খুব লজ্জা লাগছে ওর। নিশানের পাশেই ত্রয়ী ঘুমাচ্ছে। আচ্ছা ওরও কি একটা বার লজ্জা লাগলো না? ওর ছোট বোনটা যে এভাবে পাশেই ঘুমাচ্ছে, হ্যাঁ ঘুমাচ্ছে ঠিকই, তা-ও যদি জেগে যেতো? নিশানের কি বিব্রতবোধ হতো না? ইফতিহার তো হতো। খুব হতো! আর এখনও তা-ই হচ্ছে।

খাওয়া প্রায় শেষ। ইফতিহা আর এক মুহুর্তও দাড়িয়ে থাকতে পারে না ওখানে। ওর হৃদস্পন্দন মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। সে একটা কথাও না বলে জলদি ওখান থেকে সরে পড়ে। নিশানের মুখ ধুয়ে দিয়ে নিজেও চলে যায় ওয়াশরুমে।

______________________________________________________

আজ তিন দিন হলো ইনানকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করা হয়েছে। শারীরিক ক্ষত দিন দিন প্রায় মিলিয়ে গেছে সব। কিন্তু মানসিক অবস্থার অবনতি বৈকি উন্নতি হয় নি। ওরা সবাই ঢাকায় ফিরে এসেছে। আর এদিকে ত্রয়ী আর ইনানের সম্পর্কের কথাও ঐদিনের ঘটনার জন্য সবার জানাজানি হয়ে গেছে।

তবে একদিক দিয়ে ত্রয়ী নিশ্চিন্ত। ও অবাধে এখন ইনানের বাসায় আসা যাওয়া করতে পারে। কোনোরকম ভয় ছাড়াই! ওর মা বাবা যখন কিছু বলে নি, তার মানে তারাও মেনে নিয়েছে ওদের সম্পর্কটা! অবশ্য ত্রয়ীও আর এই জানাজানির বিষয়টা নিয়েও আর কারোর সাথে ঘাটাঘাটি করতে যায় নি।

কিন্তু অবশেষে ইনানের মানসিক অসুস্থতাটাই ওদের সম্পর্কে কাল হয়ে দাঁড়ায়! ত্রয়ী দিনে ১০০ বার ইনানের কাছে গিয়ে ওর খোজ নিতো। কথা বলতে চাইতো। আর অন্যদিকে ইনান ত্রয়ীকে মোটেই সহ্য করতে পারতো না। তবে ইনান বুঝতো, ও কাউকে ভালোবাসে, আর ঐ মেয়েটা ওর কাছে অন্য কোনো মেয়েকেই ইনানের আশেপাশে সহ্য করতে পারতো না। তাই সে ত্রয়ীকেও নিজের আশেপাশে ঘেষতে দিতো না। কিন্তু আফসোস! ওর ঐ ভালোবাসার মেয়েটা যে ত্রয়ীই ছিলো, সেটা ইনানের অসুস্থ মস্তিষ্ক বুঝে উঠতে পারতো না। যার ফলস্বরূপ, ত্র‍য়ীকে দেখামাত্রই ইনান আরো উত্তেজিত হয়ে পড়তো আর ওর পাগলামিও শুরু হয়ে যেতো!

মোস্তফা হক ব্যাপারটা ভালোভাবে নিতেন না। তিনি চান, উনার ছেলের যেন কোনোরকম মানসিক চাপ না পড়ে, ও যাতে জলদি সুস্থ হয়ে যায়। কিন্তু ত্রয়ীর দেখা মিললেই আর ইনানেরও ওর ভালোবাসার মানুষটাকে মনে করার চেষ্টা করতে থাকলে ক্রমাগত ওর ব্রেইনে প্রেশার পড়তে থাকে। যার দরুন ইনানের অসুস্থতা যেন আরো বাড়ছে বলে মনে হতো মোস্তফা হকের। তাই তিনি এদিক দিয়ে ইনানের এখনকার অবস্থার জন্য ত্রয়ীকেই দায়ী করতে থাকেন।

আলফাজ সাহেব আর তনয়াকেও উনি সাবধান করে দেন ত্রয়ীকে যাতে আর ইনানের আশেপাশে না দেখে। দরকার হলে উনারা যেন উনাদের মেয়েকে ঘরে বেঁধে রাখেন! বন্ধি করে রাখেন। ত্রয়ীর মা বাবার খুব খারাপ লাগে বিষয়টায়, একটা ক্ষোভও সৃষ্টি হয় উনাদের। মেয়েকে আটকে রাখার জন্য উনারাও উঠে পড়ে লাগেন৷ ত্রয়ীর সারাদিনই কাদতে কাদতে অবস্থা একদম শোচনীয়। খাওয়া দাওয়া করে না, শুধু ইনানের কাছে যাওয়ার জন্য কাদে। এখন মেয়ের এই অবস্থার জন্যও ওর মা বাবা ইনান আর ওর পরিবারকে দায় দিতে থাকেন।

দুই পরিবারে মনোমালিন্য সৃষ্টি হতে থাকে। ক্ষোভের কারণে উভয় পরিবারেই ঝগড়াও হয়, ইনান আর ত্রয়ীকে নিয়ে। ওদের মা বাবা কেউই আর ওদের সম্পর্কটাকে মেনে নিতে পারছেন না, বিয়ের কথা দূর! শুধুমাত্র রাবেয়া হক ব্যতিক্রম ছিলেন। কিন্তু উনিও তো উনার স্বামীর কারণে কিছু বলতে পারতেন না।

ত্রয়ীর মা বাবা ইনানের মতো এক মানসিক রোগীর কাছে কোনোভাবেই বিয়ে দেবেন না। আর মেয়ের ভবিষ্যত নষ্ট করতে চান না উনারা। ত্রয়ী যে সারাদিন ইনানের কাছে পড়ে থাকতে চাইতো, তাই তারা ওদের আলাদা করার জন্য অবশেষে ইনানের পরিবারকেই ওদের বাসা ছেড়ে দিয়ে নতুন বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্য তাড়া দিতে থাকে। কয়েকদিনের মধ্যেই ইনানের বাবাও এখান থেকে চলে যান। উনিও হয়তো তা-ই চাইছিলেন! কে জানে।

এভাবেই দূরত্ব বেড়ে যায়, দুই পরিবারের মধ্যে। ইনান আর ত্রয়ীরও আর যোগাযোগ করা হয়ে উঠে না। কিন্তু ভেতর ভেতর দু’জনেই পুড়তে থাকে, ভালোবাসায় এমন অদ্ভুত বিচ্ছেদের অনলে। একজন পাগলের মতো ঝাপসাভাবে অন্যজনকে কল্পনা করে, আর অন্যজন স্পষ্টভাবেই অনুভব করতে থাকে সবকিছু। আর ভাসতে থাকে তাদের চোখজোড়া, অজস্র অশ্রুতে।

____________________________________________________

বর্তমান!

ত্রয়ী আর আফতাহি একটা পার্কের বেঞ্চে বসে আছে। গত পাঁচ বছরে ত্রয়ীর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর একটা সারসংক্ষেপ শুনালো আফতাহিকে। আফতাহি নিরব শ্রোতার মতো সব শুনলো। ত্রয়ীকে অজ্ঞান দেখেই আফতাহি ওকে এখানে এনে বসিয়ে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফেরায়। আর ওর মনের ভেতর আফতাহিকে বলার মতো কোনো কথা চাপা আছে কিনা জিজ্ঞেস করতেই ত্রয়ী ওর জীবনে ইনান আর ওর ভালোবাসা নিয়ে সব কথা খোলাখুলি বলে দেয়।

ত্রয়ী একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে এবং একটু দম নিয়ে বলে,
-আমি ইনানকে ভালোবাসি। খুব বেশি ভালোবাসি। এই ভালোবাসার ভাগ আমি আর অন্য কাউকেই দিতে পারবো না। সারাজীবনের জন্যই আমার ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার শুধু ইনানেরই। ক্ষমা করবেন আমায়, আমি আপনাকেও ভালোবাসতে পারবো না। ইন ফ্যাক্ট, কাউকেই না। আমি আপনাকে শুধু আমার পরিবারের চাপে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছি। আমায় মাফ করবেন প্লিজ। আমি ইনানকেই ভালোবাসি শুধু। ওকেই ভালোবাসি শুধু। আর কাউকেই না। আমি শুধুই ইনানের। শুধুই ইনানের।

কথাটা শেষ করেই কান্না ভেঙে পড়ে ত্রয়ী। আফতাহি ওর রুমালটা বের করে ত্রয়ীর দিকে এগিয়ে দেয় আর কান্না না করার জন্য অনুরোধ করে। আর জবাব দেয়,
-শুনুন।
একটা লম্বা শ্বাস নেয় আফতাহি। তারপর আবার বলতে থাকে,
-হ্যাঁ আপনার একটা অতীত থাকতেই পারে, মনের মানুষ থাকতেই পারে। কিন্তু সে তো আর আপনার নেই, ও কী অবস্থায় আছে, তা-ই জানেন না আপনি। এখন যখন পরিবারের জন্য বাধ্য হয়ে আপনাকে বিয়ে করতেই হবে, তাহলে এবার আমি নিজে আপনাকে বলছি, আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই। আমার আপনার ঐ অতীত নিয়ে কোনো সমস্যা নেই। আমার আপনি হলেই চলবে। আর আমার-আপনার ভালোবাসার ব্যাপারটাও আমিই দেখে নেবো।

আফতাহির এমন একটা উত্তর শোনার জন্য ত্রয়ী মোটেও প্রস্তুত ছিলো না। ও স্তব্ধ হয়ে তাকায় আফতাহির দিকে। ত্রয়ী ভেবেছিলো, এসব কথা খুলে বললে, ইনানের কথা শুনে আফতাহি নিশ্চিত ওকে বিয়ে করার কথাটা মানা করে দেবে। কিন্তু না! আফতাহি তবুও ওকে বিয়ে করতে চাইছে। কেন? বুঝে উঠতে পারছে না ত্রয়ী। ওর শেষ অস্ত্রটাও তাহলে কাজে আসলো না। ভেবেই ওর একটা কষ্ট চেপে রাখা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।
.
.
চলবে..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here