নিরবতা পর্ব-২

0
6132

#নীরবতা
#নাইমা_জাহান_রিতু
#পর্ব_২

-“আমার জিনিস কইরে?”
শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বোনের দিকে একনজর তাকিয়ে মুবিন বললো,
-“প্রতিবারই তোর জন্য কিছু না কিছু আনতেই হবে?”
-“তা আনতে হবে না? দুটো নয় তিনটে নয় তোমাদের একমাত্র আদরের ছোট বোন আমি।”
-“আহারে! তাতে যেন উনি সব উদ্ধার করে ফেলেছে!”
-“এমন করলে কিন্তু হবে না। ভালোই ভালোই কী এনেছো দেখিয়ে দাও।”
ক্লান্ত শরীর বিছানায় মেলে ঠোঁট ভর্তি হাসির ফোয়াড়া ছেড়ে বোনের দিকে তাকালো মুবিন। ভার্সিটি থেকে সকাল সকাল রওনা হলেও গ্রামে পৌছাতে পৌছাতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল পড়ে গেছে। ভাইয়ের বিয়ের খবর হঠাৎ করে পাবার ফলে টিকেট কাটার মতো সময় না পাওয়াতে অর্ধেক পথ দাঁড়িয়েই আসতে হয়েছে তাকে। যার ফলে কোমরটা ব্যথায় চিনচিন করছে। তবুও এসবের মাঝে ছোট্ট বোনটির একেকটি কর্মকাণ্ড যেন শান্তির অপর নাম। হাজারো ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফেরার পর বোনের প্রতিটি মুখের ধ্বনি নতুন উদ্যমে চলার শক্তি বয়ে আনে। এরই নাম বুঝি ভাইবোনের ভালোবাসা!
-“তুমি কী সত্যিই আমার জন্য কিছু আনো নি?”
বোনের অসহায় মাখা মুখের দিকে চেয়ে এপর্যায়ে মুবিন বললো,
-“ব্যাগ খুলে দেখ…”
ভাইয়ের অনুমতি পাওয়া মাত্র ব্যাগ খুলে একেএকে সব বের করতে শুরু করলো অনা। কিছু চকলেটসহ একটি বই হাতে নিয়ে সে এগিয়ে এল মুবিনের দিকে। মুখে একরাশ বিরক্তি ফুটিয়ে বললো,
-“আমার সাজগোজের জিনিস কই? তাছাড়া বই এনেছো কেনো? আমি কী এসব পড়ি?”
-“পড়িস না?”
-“উহু.. তবে থাক! চৈতালি বই পড়তে ভালোবাসে। ওকেই না হয় বইটি দিয়ে দিব।”
-“চৈতালি টা কে?”
-“আরে.. চৈতালি আমার বান্ধবী। তুমি কেনো যে ওর নাম মনে রাখতে পারো না!”
-“অহ.. হ্যাঁ। মনে পড়েছে।”
-“বেশ হয়েছে। এবার চলো। নিচে হলুদ নিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে। মেজভাইকে এক চিমটি হলুদ লাগিয়ে দিয়ে এসো তো!”
শরীর সায় না দিলেও বোনের কথামতো বিছানা ছেড়ে উঠে একটি টিশার্ট পড়ে নিল মুবিন। তারপর আয়নায় একবার নিজের চেহারা দেখে চোখে চশমা চাপিয়ে এগুলো বোনের পিছুপিছু। আজকাল পড়াশোনার চাপ খুব বেড়ে গেছে। রাত জেগে পড়লেই মাথার যন্ত্রনায় ছটফট করতে হয় সারাদিন। এমবিএটা কোনোমতে শেষ করলেই এসবের হাত থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। ভেবে নিজেকে বুঝ দিয়ে আসলেও আজকাল বুঝেও শরীর টিকছে না। পড়াশোনার সকল অধ্যায় কবে চুকবে কে জানে!
-“মুবিন ভাই না? কেমন আছেন?”
একপলক পাশ ফিরেই চোখ সরিয়ে নিল মুবিন। অস্পষ্ট গলায় জবাব দিল,
-“ভালো..”
-“ভালো থাকলেই ভালো। তা দিনকাল ভালো যাচ্ছে তো? শুনলাম আপনার নাকি ভার্সিটির কোন মেয়েকে মনে ধরেছে!”
চৈতালির কথা শেষ হতেই মুবিনের ফর্সা টসটসে মুখ নিমেষেই কুচকে লাল হয়ে এল। কঠিন কিছু কথা চৈতালির উদ্দেশ্যে শোনাতে গিয়েও নিজেকে সামলে নিল সে। কয়েক কদম এগিয়ে গিয়ে ভাইয়ের মুখে হলুদের ছোঁয়া লাগিয়ে তার পাশে বসলো মুবিন। উদাস মনে আশেপাশের পরিবেশের দিকে দৃষ্টি দিতেই মাথা বেয়ে শরীরে পানির উপস্থিতি টের পেয়ে পিছন ফিরে তাকাতেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো অনা এবং চৈতালি। কী হলো এটা? তাকে ছাড়া আর কেউ কী নজরে আসেনি তাদের?

রঙ এবং পানি খেলার মাঝ থেকে উঠে মৌমিকে সঙ্গে নিয়ে নিজের ঘরে চলে এল মাজহারুল। গম্ভীর প্রকৃতির এই মানুষটিকে হাসিঠাট্টার দুনিয়া একদমই টানে না। বরং দুই মেরু এক হওয়ামাত্র তা বিকর্ষণে লেগে যায়। মেয়েকে বিছানায় বসিয়ে আলমারি খুলে লেহেঙ্গা বের করলো সে। তারপর তা মেয়ের কাছে রেখে পা বাড়ালো তার পিতা আলাউদ্দীন শেখের ঘরের দিকে। হঠাৎ করেই বিষয়টি মাথায় এসেছে তার। মনভুলো স্বভাবের কারণে হয়তো খানিকবাদে তা মাথা থেকে বেরিয়েও যাবে। তার আগেই না হয় একবার এবিষয়ে বাবার সঙ্গে আলোচনা করে আসা যাক…
-“আব্বা, আসবো?”
আছরের নামাজ সেরে তসবিহ জপছিলেন আলাউদ্দীন শেখ। অবশ্য বছর দুই আগে হজ্ব করে আসার পর থেকে তার নামের পূর্বে একটি হাজী শব্দ যোগ হয়ে পুরো নাম হয়েছে হাজী আলাউদ্দীন শেখ। গ্রামে প্রভাবশালী হবার কারণে তাকে সম্মান থেকেই হোক বা ভীতি, সকলে তাকে হাজীসাব নামেই ডেকে আসছেন। নামাজ কালাম অথবা দান দক্ষিনায় তার কমতি না থাকলেও মুখের ভাষায় কিছুতেই নিজেকে আয়ত্তে আনতে পারছেন না তিনি। ইচ্ছে না থাকা সত্বেও মাথা ঠান্ডা রাখায় ব্যর্থ হওয়াই বেশকিছু সময় মুখের ভাষা নোংরা করে ফেলছেন। অবশ্য তাতে খুব বেশি একটা চিন্তিত বলে মনে হচ্ছে না তাকে। তার সকল চিন্তা আপাতত এসে আটকে আছে মেজ ছেলের বিয়েতে। বড় ছেলের বিয়ের দুবছরের মাথায় ছেলের বউ তাকে ফেলে চলে যাবার পর থেকেই পাড়ায় একপ্রকার ছিঃ ছিঃ পড়ে গিয়েছিল তাদের নিয়ে। তবে তার হজ্ব সেরে আসার পর তা কমলেও সেই একই চিন্তা খেয়ে যাচ্ছে তাকে। আবারও একই অঘটন ঘটবে না তো!
-“আব্বা, আপনি যা করছেন তা কী আরেকটিবার ভাবা যায় না? মেয়েটির বয়স খুবই কম হয়ে যায়।”
বড় ছেলের কথায় জায়নামাজ ছেড়ে দৃষ্টি সরিয়ে তার দিকে তীক্ষ্ণ ছুড়ে আলাউদ্দীন শেখ বললেন,
-“তোমার পত্নীর বয়স কী কম আছিলো?”
-“জ্যোতির কথা থাক আব্বা।”
-“কেন? তা থাকবো কেন? তুমি কী চাইতোছো তোমার ভাইও তোমার মত পত্নীহারা হোক। লোকজন ছিঃ ছিঃ করুক তোমার ভাইরে নিয়া?”
-“না…”
-“তাইলে এইখান থাইকা যাও। নিজে যেইখানে নিজের পত্নীরে ধইরা রাখবার পারো নাই সেইখানে তোমার মুখে এইসব কথা মানায় না।”
বুকচিরে বেড়িয়ে আসা একটি দীর্ঘশ্বাস গোপন করলো মাজহারুল। ধীর গলায় সে বললো,
-“এটা বাল্যবিবাহ হচ্ছে। আপনার নামে কেসও হয়ে যেতে পারে।”
-“হেহে.. শালার পুত পুলিশগো ভয় দেখাও আমায়? এসব পকেটে নিয়া আমি ঘুরি। যাও এখন। তোমার ব্যর্থ মুখখানা নিয়া এবার তুমি বিদায় হও।”
শান্ত পায়ে বাবার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে নিজের ঘরে ফিরে এল মাজহারুল। এই স্বল্প সময়ের মাঝেই মৌমি লেহেঙ্গার নিচের পার্টটি টানাটানি করে পড়ে ফেলেছে। যদিওবা তা ঠিক জায়গা মতো নেই। তবুও দেখতে মন্দ লাগছে না। মেয়েটির চেহারা অবিকল হয়েছে জ্যোতির মত। জ্যোতির মত ছোট ছোট দুটি চোখ, তরতরা নাক, খাড়া দুটি কান। তার এবং জ্যোতির বিবাহিত জীবন অল্পদিনের হলেও মাঝেমধ্যে প্রায়ই তাকে খরগোশের বাচ্চা বলে ডেকে উঠতো মাজহারুল। ডাক শুনে নাক ফুলিয়ে আহ্লাদে গদগদ করলেও আড়ালে কী হাসতো জ্যোতি?

গরমের ভেতর শেরওয়ানি গায়ে চাপিয়ে বসে থাকা যেখানে দায় হয়ে পড়েছে সেখানে চারপাশে কিছু উটকো ঝামেলা নিয়ে খানিকক্ষণ বসে মেজাজ সপ্তমে উঠে গেছে মেসবাহর। সাধেই কী গ্রামের মেয়েদের পছন্দ নয় তার? কী আছে তার মাঝে? সে কী চিড়িয়াখানার কোনো প্রাণী? তাকে ঘিরে কেনো এত হৈচৈ? আর কেনই বা সকলে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে তাকে ঘিরে রয়েছে? হাতের মুঠ চেপে নিজেকে সামলানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে পাটি ছেড়ে উঠে দরজার দিকে এগুলো মেসবাহ। চাঁদের আলোয় উঠোনে তার বাবা আলাউদ্দীন শেখকে স্পষ্ট দেখা না গেলেও বোঝা যাচ্ছে কারো হাত ধরে তাকে কোনো ব্যপারে আস্বস্ত করছেন তিনি। ভুল না হলে লোকটিই মেয়ের বাবা। কী কথা হচ্ছে তাদের মাঝে? নিশ্চয়ই তার মেয়েকে আজীবন খুশি রাখার প্রতিজ্ঞা করছেন তার বাবা। তবে তা কী আদৌ সম্ভব তার পক্ষে? তাছাড়া খুশি কী এক পাক্ষিক জিনিস? যা শুধু দিয়েই গেলাম কিন্তু বিনিময়ে কিছুই পেলাম না?
-“বাপজান কিছু বলবা?”
আলাউদ্দীন শেখ মেসবাহর কাঁধে হাত রেখে প্রশ্নটি করতেই আস্থা খুঁজে পেল সে। বাবার দিকে চেয়ে ঢোক চেপে বললো,
-“আব্বা, মেয়ের বয়স খুবই কম। আপনার প্রতি সম্মান রেখে আমি আপনার পছন্দসই মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। তবে এই বাচ্চা মেয়েকে বিয়ে করতে আমার মন কোনোভাবেই টানছে না।”
ছেলের কথায় চোয়াল শক্ত হয়ে এল আলাউদ্দীন শেখের। রূঢ় গলায় তিনি বললেন,
-“চুপচাপ পিড়িতে যাইয়া বইসা পড়ো। বড়ডা মানসম্মান যা ডুবাই দিছিলো তা কামাইতে আমার বহুদিন লাগছে। তুমিও তার পথে হাইটো না।”
-“বড়ভাই তো ইচ্ছা করে কিছু করেনি। তার ভাগ্যে যা লেখা ছিল তা হয়েছে। তাছাড়া বিয়েতো সে আপনাদের পছন্দমতোই করেছিল। আর আব্বা, আপনি আমাকে এত টাকা খরচ করে বাইরে থেকে লেখা পড়া শিখিয়েছিলেন কী আজ এতবড় একটি অন্যায় করার জন্য?”
-“বেশি নাইচো না বাপজান। ভদ্র পোলার মতো যাইয়া পিড়িতে বসো। নয়তো আমার জুতা তোমার পিঠে। আল্লাহর কসম মাটিতে একখান পড়বো না।”
বাবার এমন কথায় খানিকটা চমকালেও নিজেকে সামলে নিল মেসবাহ। এরপর আর কিছুই করার বা বলার উপায় না পেয়ে নিরুপায় হয়ে আবারও ঘরে ফিরে এল সে। আশেপাশের সকলের দিকে একপলক তাকিয়ে পাটির উপর জবুথবু হয়ে বসতেই কাজীর প্রবেশ ঘটলো সেই ঘরে। নিরব দৃষ্টিতে কাজীর মুখের কথা শুনে একসময় শান্ত গলায় সে বলে উঠলো,
-“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here