আমি সেই চারুলতা পর্বঃ৭

0
2101

#আমি_সেই_চারুলতা
#স্নেহা_ইসলাম_প্রিয়া
#পর্বঃ৭
_______________________

ভোরে হাটতে বেড়িয়েছে শিহাব। সারারাত ঘুমায়নি সে। চারুর ছবি আঁকতে আঁকতেই রাত শেষ হয়ে গিয়েছিলো। কিছুক্ষণ আগেই বৃষ্টি থেমেছে। সম্পূর্ণভাবে আলো ফুটে ওঠে নি। ভেজা মাটির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। ইশ! একেবারে মাতাল করে দেওয়ার মতো গন্ধ। শিহাব আর শাওন দুজনেই গন্ধটা প্রচন্ডরকম ভালোবাসে। ছোট বেলায় বৃষ্টি শেষ হলেই দুজন বেড়িয়ে যেতো ভেজা মাটির গন্ধ নিতে। হাটতে হাটতে বেশ খানিকটা দূরে চলে এসেছে। কিছুটা সামনেই রয়েছে মজিদ। হেটে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। মজিদকে দেখেই শিহাবের মাথায় রক্ত উঠে গেলো। ওর মনে পড়ে গেলো সেদিন ও চারুর সাথে কি করতে গিয়েছিলো। মজিদ এখনো শিহাবকে দেখেনি। শিহাব রুমালটা বের করে মুখে বেধে নিলো তারপর পেয়ারা গাছের একটা শক্ত ডাল ভেঙে মজিদের দিকে এগোলো। পিছন থেকে মজিদের কাধ বরাবর আঘাত করলো শিহাব। ব্যাথায় ককিয়ে উঠলো মজিদ। শিহাব আরো কয়েকটা আঘাত করলো মজিদকে ফলাফল, নিচে পড়ে গেলো মজিদ। কাদায় মাখামাখি হয়ে গেলো সে। বিভিন্ন জায়গায় এলোপাথাড়ি মারতে শুরু করলো। ইতিমধ্যেই ভোরের আলো কিছুটা ফুটে উঠেছে। সেই আলোতে শিহাব মজিদের হাত দুটো দেখলো। কোন হাত দিয়ে সে চারুকে ছুয়েছিলো এইটা মনে করতে পারলো না সে তাই দুই হাতেই এলোপাথাড়ি আঘাত করে চলেছে। কিছুক্ষনের মধ্যেই শিহাব বুঝতে পারলো মজিদের হাত দুটো ভেঙে গেছে। এইবার সে শান্ত হলো। একে বেশি কিছু করা যাবেনা। যতটুকু শিক্ষা দিয়েছে ততটুকুই এখনকার জন্য যথেষ্ট। তবে মজিদ কে হুমকি দিতে শিহাব ভুললো না। মুখে রুমাল বাধা। মজিদ এখন তাকে চিনবে না,
– আমার চারুর দিকে আর একদিন যদি হাত বাড়াবি তো এইবার তো শুধু হাত ভেঙেছি। পরেরবার হাত কেটে রেখে দেবো।

ছাদের উপর দাঁড়িয়ে ছিলো শাওন। মনটা ভীষণ রকমের বিক্ষিপ্ত তার। কিছুতেই শিহাবের সাথে চারুকে সহ্য হচ্ছে না তার। শাওন ভেবেছিলো শিহাব বিয়েতে মানা করে দেবে কিন্তু এমন কিছুই হচ্ছে না। শিহাবও এখন চারুর সাথে কথা বলছে। কই আগে তো কোনো মেয়ের সাথে কখনো কথা বলতো না। আর চারুই বা কেনো শিহাবের সাথে এত কথা বলে? আচ্ছা শিহাবও কি চারুকে পছন্দ করে? অসম্ভব কিছু তো নয় এটা। ছোটবেলা থেকেই এমন হয়ে আসছে। দুজনেরই পছন্দ এক। কিন্তু প্রতিবার তো শিহাব কাঙ্ক্ষিত বস্তুটি শাওনকে দিয়ে দেয়। ও যদি সত্যিই চারুকে পছন্দ করে তাহলে কি চারুকে দেবে না? যদিও চারুকে সেসব জিনিসের সাথে তুলনা করা যায় না। চারু এক অমূল্য রত্ন। সে অমূল্য! হীরে চেনা কোনো জহুরিই তাকে ছাড়তে চাইবে না। কিন্তু শিহাব তো বলতো শাওনের জন্য ও নিজের জীবনটাও দিয়ে দিতে পারে। নাহ! কিছুই ভালো লাগছে না। চারুকে না পেলে সে নিশ্চিত মরে যাবে। নিজের জীবনের চেয়েও বেশি ভালোবেসে ফেলেছে সে চারুকে। শাওন বেড়িয়ে এলো বাড়ি থেকে। ভালো লাগছেনা সেখানে। কেমন দমবন্ধ করা পরিবেশ। আজ চারু তার এত কাছে কিন্তু কাছে থেকেও প্রচন্ড রকমের দূরে লাগছে। নরম ঘাসের উপর দিয়ে হেটে যাচ্ছে শাওন। হঠাৎই কারোর চিৎকারে চমকে উঠলো সে। কেউ একজন জোরে জোরে চিৎকার করছে। কিন্তু এই কাক ডাকা ভোরে বৃষ্টির দিনে কে এত সকালে উঠেছে। গ্রামের মানুষ আরো আধা ঘণ্টা পরে জাগ্রত হবে। প্রতিদিন তো এমনই হয়। শাওন এগিয়ে গেলো সেদিকে। একজন ব্যক্তি এলোপাথাড়ি মেরে চলছে একজন মধ্যবয়স্ক মানুষকে। রুমাল বাধা অবস্থায়ও মানুষটিকে চিনতে দেরি হয়নি শাওনের। শিহাব এভাবে নির্বিচারে কেনো কোনো মানুষকে মারছে? লোকটি অচেতন হয়ে পড়ে আছে।
– ভাইজান!
শিহাব হকচকিয়ে গেলো কারো আগমনে। পিছনে তাকিয়ে দেখলো শাওন। শাওন এত সকালে? ও তো কখনো এত সকালে ঘুম থেকে উঠে না। শিহাব জানতেও পারলো না তার ঘুম কাতুরে ভাইটার চারুকে হারাবার ভয়ে চোখে এখন আর ঘুম আসেনা। সেও তার মতোই সারারাত জেগেই সকালে হাটতে বেড়িয়েছে। বড্ড ভয় হয় তার। সে ঘুমিয়ে গেলেই চারুকে হারিয়ে ফেলবে সে। বড্ড ভয়!
– তুমি এই লোকটাকে মারতাছো ক্যান ভাইজান?
শিহাব মোটেও ঘাবড়ালো না। খুবই সতর্কভাবে উত্তর দিলো,
– এই লোকটা চারুকে বাজে ভাবে ছোয়ার চেষ্টা করেছিলো। আমি চলে আসায় আর সেটা করতে পারে নি। আজ লোকটাকে দেখেই রাগ উঠে গেলো। যতই হোক চারু তোর বউ হবে কিছুদিন পরে। তোর জিনিসে কেউ হাত দেবে আর ভাই হয়ে আমি কি সেইটা চেয়ে চেয়ে দেখবো?
শাওনের কানে আর কোনো কথা ঢুকলো না। বারবার কানে বাজছে সে চারুকে বাজে ভাবে ছোয়ার চেষ্টা করেছিলো। শাওন হাতে একটা ইটের অর্ধ ভাঙা টুকরো তুলে নিলো। এই লোকের বেচে থাকার কোনো অধিকার নেই।

সকাল হতেই ঘুম ভেঙে গিয়েছে চারুর। তবে ঘর থেকে বের হতেই বুঝলো সে অনেক দেরি করে ফেলেছে। বাসার বেশিরভাগ মানুষই ইতিমধ্যে উঠে গেছে এমনকি নাজিমুদ্দিন আর মনোরমাও। তবে হামিদকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। সম্ভবত সে এখনো ঘুম থেকে উঠেনি। হামিদ ছয়টার আগে সাধারণত ঘুম থেকে উঠে না আর এখন বাজে ৫ঃ৪৮। এখনো পনেরো মিনিটের মতো ঘুমানোর কথা হামিদের। চারু নিচে নেমেই মনোরমার পাশে গিয়ে বসলো। চারুকে দেখেই জমিদার গিন্নি বলে উঠলো,
– ঘুম থেইকা উইঠা পড়ছো? কেমন ঘুম হইলো? কোনো অসুবিধা হয় নাই তো?
– জ্বি না৷ খুব ভালো ঘুম হয়েছে।
জমিদার গিন্নি একটু হাসলেন। তার হাতে অনেকগুলো জিনিসপত্র। একা টেনে নিতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তার। নাজিমুদ্দিন বলে উঠলো,
– যা গিয়া ওনারে সাহায্য কর। উনি খুশি হইবো। এই বাড়ির বউ হবি দেইখ্যা অলসের মতো বইয়া থাকিস না।
নাজিমুদ্দিনের কথায় উঠে দাঁড়ালো চারু। ঠিকই তো বলেছে। ভদ্রমহিলা কত কাজ করে যাচ্ছে আর ও এখানে মহারানীর মতো চুপচাপ বসে আছে। শিহাবের বউ না হোক শাওনের বউ তো হবে। নিজের হবু শাশুড়ীর সাহায্য করা উচিত।
– আমাকে দিন। আমি সাহায্য করছি।
– ওমা তুমি করবা ক্যান? তুমি এহন মেহমান। যাও গিয়া বসো।
জমিদার গিন্নির কথা শুনে শাওনের দাদি বলে উঠলেন,
– বউ ওরে মানা কইরো না। ও তো আমাদের বাড়ির বউই হইবো। ও এহন আমাগো পরিবারের সদস্য। এই সংসারের দায়িত্ব তো ওরেই নিতে হইবো। বাড়ির বড় বউ হইবো বইলা কথা। এহনই করুক। সব আগে থেকে বুঝে নিবো।
তার কথায় গলা মেলালেন নাজিমুদ্দিন। তবে মনোরমার ব্যাপারটা পছন্দ হলো না। এখনো তো বিয়ে হয়নি এখনই কেমন পরিবারের সদস্য? মেয়ের বিয়ে দিতে চান না বিধায় এই ছোট ছোট বিষয়গুলোও তার কাছে ভালো লাগছে না।
জমিদার গিন্নির সাথে মিলে চারু নাস্তা বানানোর কাজটা শেষ করে ফেললো। এই বাড়িতে রান্নার কাজটা বাড়ির লোকজনই করে। এ বাড়ির ছেলেরা বাইরের লোকের হাতের রান্না খায় না। বিশেষ করে কাজের লোকেদের হাতের রান্না। শিহাব নিচে নাস্তা করতে এলো না। তাই জমিদার গিন্নি ওর খাবার একটা ট্রে তে সাজিয়ে চারুকে বললো ওদের ওকে দিয়ে আসতে। চারু মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
চারু শিহাবের ঘরে গেলো। কিসব ফাইল পত্র ঘাটাঘাটি করছে সে। এই শীতেও ফ্যান চালু করে রেখেছে সে তাও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। ওর যে খুব পরিশ্রম হচ্ছে তা ওকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
– আসবো?
চারুর গলার আওয়াজে শিহাব একবার দরজার দিকে তাকালো। মাথা ঝাকিয়ে আসার অনুমতি দিলো সে। আবারও ফাইলপত্রে ডুবে গেলো। চারু নামে যে একজন মানুষ তার ঘরে আছে সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপই নেই তার। চারুর একটু অস্বস্তি হচ্ছে। শিহাব এমন একটা ভাব নিচ্ছে যেনো ও চেনেই না চারুকে কিংবা এঘরে ও ছাড়া আর কেউই নেই।
– আপনার মা আপনাকে খাবার দিতে বলেছিলো।
– ওই টেবিলে রেখে যাও।
– কোন টেবিলে?
– জানালার পাশে যে টেবিল আছে সেটায়।
চারু কিছু না বলে চুপচাপ শিহাবের জন্য আনা খাবারটা টেবিলে রেখে চলে যেতে উদ্বুদ্ধ হলেই পেছন থেকে ডেকে উঠলো শিহাব,
– চারুলতা!
– জ্বি! কিছু বলবেন?
– বলবো বলেই ডেকেছি। একটু এখানে আসবে?
চারু শিহাবের কিছুটা সামনে এগিয়ে গেলো। শিহাব ব্যাগ থেকে কোনো একটা প্যাকেট বের করে চারুর হাতে দিলো এবং বলল,
– শুভ জন্মদিন। জীবনের ১৫ টা বসন্ত যেমনই কাটুক না কেনো জীবনের বাকি সময়টা যেনো সুন্দর হয় সেই দোয়াই করি।
– আপনি কিভাবে জানলেন?
শিহাব কিছু না বলে একটু মুচকি হাসলো। এই হাসির অর্থ বোধহয় ছিলো, যাকে ভালোবাসি, সামান্য তার জন্মদিন টা জানবো না?
– যাও।
শিহাবের কথায় চারু দরজার দিকে এগোতেই শিহাব আবার ডেকে উঠলো,
– তোমার নাম চারুলতা?
– জ্বি। হঠাৎ এই প্রশ্ন?
– তেমন কিছু না। আমি কি তোমাকে স্বর্ণলতা বলে ডাকতে পারি?
– কেনো?
– এমনিই। ডাকতে ইচ্ছে হলো।
– আমার নাম চারুলতা আমাকে সে নামে ডাকলেই আমি খুশি হবো।
শিহাব আর কিছু বললো না। চারু ওকে স্পষ্ট মানা করে দিলো এই নামে ডাকতে। চারু হয়তো চায় না শিহাব ওকে অন্য কারোর তুলনায় বিশেষ ভাবে দেখুক। শিহাব আবার নিজের কাজে মনোযোগ দিলো, যেনো কিছুই হয় নি। ফাইলগুলো নিয়ে চারুকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলো সে যেনো এখানে কেউই নেই।
চারু কিছু একটা মনে করে গেলো না। তার চোখ অন্য একটা টেবিলের উপর গেলো। কিছু কাগজ সেখানে। চারু জানে কারো ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দিতে নেই তাও কৌতুহল দমন করতে পারলো না। (গল্পের আসল লেখিকা স্নেহা ইসলাম প্রিয়া) কাগজ গুলো নিয়েই ছোট একটা ধাক্কা খেলো সে। এখানে সব তার ছবি। একটা ছবিতে চোখ আটকে গেলো তার শিহাব জড়িয়ে ধরে রেখেছে তাকে। ছবিটি দেখে লজ্জায় চারুর মাটির সাথে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো যেনো সত্যিই শিহাব ওকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। তখনই টেনে কেউ ছবিগুলো ওর হাত থেকে নিয়ে নিলো,
– কারো ব্যক্তিগত জিনিস ধরার আগে তার অনুমতি প্রয়োজন হয়। এইটা কি ধরনের অভদ্রতা?
– এইগুলো আমার ছবি।
– তো? বেড়িয়ে যাও আমার ঘর থেকে। বের হও।
শিহাবের ধমকে চমকে উঠলো চারু। এমন একটা ব্যাপার যেনো দোষ তার। সে একেছে এই ছবিগুলো। চারু কিছু না বলে চুপচাপ বেড়িয়ে গেলো শিহাবের ঘর থেকে।

মজিদকে কে বা কারা যেনো খুব বাজে ভাবে মেরে ফেলে রেখে গেছে। একই সাথে তার টাকা পয়সা সব নিয়ে চলে গেছে। গ্রামে রাতে ডাকাত পড়েছিলো এই কথা বেশ ভালো ভাবে রটিয়ে গেছে। মজিদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। দুই হাতই ভেঙে গেছে তার। অন্যান্য কয়েক জায়গার হাড়ও ফেটে গেছে। সেড়ে উঠতে অনেকদিন লেগে যাবে। মজিদের ভাষ্যমতে তার কাছে এক হাজার টাকা ছিলো। সেই টাকার সন্ধান পেয়েই হয়তো ডাকাতেরা তাকে মেরে লুটপাট করে গেছে। ঘটনা শুনে শিহাবের ভ্রু কুচকে গেলো। ও বা শাওন কেউ একটা টাকাও মজিদের কাছ থেকে নেয়নি। এই মজিদ গ্রামের লোকের করুনা পেতে চাইছে। এক বা দুই শত টাকা হলেও চলতো পুরো হাজার টাকা ডাকাতির কথা বলে দিলো। অদ্ভুত!
– দেখলা ভাইজান, আগেই কইছিলাম ওরে মাইরা ফালাই। তুমি এমনি এমনিই আমারে আটকাইলা। কত বড় চোরের নাম দিলো আমাগো উপর। আমাগো কি টাকার অভাব কও?
– বাদ দে। কেউ তো আর জানে না আমরা মেরেছি। ও যা খুশি করুক।
– ওরে দেখলেই আমার মাথা গরম হইয়া যায়।
– বাদ দে। আমি আজ ঢাকা চলে যাচ্ছি। কবে আসবো কিছু জানি না।
– ক্যান? হঠাৎ চইলা যাইতাছো ক্যান? তুমি তো অনেক দিন থাকবা কইছিলা।
– আমি চলে৷ না গেলে চারুর সাথে বিয়ে আটকানো যাবে না। তুই সাবধানে থাকিস। কিছু লাগলে বল আমি আসার সময় নিয়ে আসবো।
– কিছু লাগবো না আমার। তুমি সাবধানে যাইয়ো।
শিহাব জমিদার গিন্নির পাশে গিয়ে বসলো। তাকে দেখেই একটু হাসলেন তিনি,
– মা তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।
– কি কথা?
– মা চারুকে বিয়ে করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তুমি অন্য যেকোনো মেয়েকে বিয়ে করতে বললে আমি রাজি হবো কিন্তু চারুকে না।
– ক্যান চারু কোন দিক দিয়া খারাপ?
– আমি কি বলেছি ও খারাপ? ও খুবই ভালো মেয়ে।
– তাইলে বিয়া করবি না ক্যান?
– ওকে আমার পছন্দ হয় নি।
– ক্যান পছন্দ হয় নাই? ও কি অসুন্দর মাইয়া?
– না অসুন্দর হবে কেনো?
– তাইলে?
– মা তুমি চারুর ব্যাপারে অন্য কিছু ভাবতে পারো না?
– অন্য কিছু মানে?
– অন্য কিছু মানে, আমি যখন ওকে বিয়ে করতে চাই না আর তুমি ওকে বাড়ির বউ করতে চাও তাহলে তুমি ওর বিয়ে শাওনের সাথে দিয়ে দাও।
– পাগল হইছস তুই? বড় পোলার লগে যার বিয়া ঠিক করছি ছোট পোলার লগে হের বিয়া দিমু?
– বিয়ে ঠিক হয়নি এখনো।
– যাই হউক। তোর বিয়া করতে ইচ্ছা না হইলে করিস না। আমার পোলারা এত সস্তা না যে এক মাইয়ার লাইগ্যা দুই পোলারে দেহামু।
– মা তুমি ব্যাপার টা এইভাবে দেখছো কেনো? তুমি,
– হইছে। আমারে কিছু বুঝাইতে হইবো না। যদি বিয়া হয় তোর লগেই হইবো। শাওনের সাথে বিয়ার কথা ভাবিস না।
জমিদার গিন্নি আর কিছু বলার সুযোগ দিলো না শিহাব কে। চুপচাপ সেখান থেকে উঠে চলে গেলো। শিহাবের সাথে বিয়ে না হলেও শাওনের সাথে বিয়ে হওয়াটা যে খুব একটা সহজ হবে না সেটা শিহাব ভালোই বুঝতে পারলো।

মনোরমা পায়েস বানিয়েছেন চারুর জন্মদিন উপলক্ষে। দুই ছেলেমেয়ের জন্মদিনে উনি নিজ হাতে পায়েস বানিয়ে তাদের খাওয়ান। এক অদ্ভুত প্রশান্তি পায় তিনি ছেলেমেয়েদের খুশিতে। মনোরমা চারু এবং হামিদ দুজনকেই পায়েস খায়িয়ে দিলেন। প্রতিবার যে শান্তি টা তিনি পান এবার পাচ্ছেন না। মনে হচ্ছে যেনো খুব দ্রুত কিছু একটা ঘটতে চলেছে। কি হবে কে জানে? তবে এতে যে তার দুই ছেলেমেয়ের জীবনে খুব বড় এক ধাক্কা লাগবে তা তিনি অনুমান করতে পারছেন। আজ হঠাৎ এত অশান্তি লাগছে কেনো তার? ছেলেমেয়েদের বিপদে কি তিনি বুকে আগলে রাখতে পারবে এই দুজনকে? আচ্ছা যদি তার কিছু হয়ে যায় তখন কি হবে? চারু আর হামিদ দুজনেই যে ভেসে যাবে। ওদের তো মনোরমা ছাড়া আপন কেউ নেই। হামিদ মোটামুটি সাবলম্বী। নিজেকে সামলে নিতে পারবে কিন্তু চারু? ওর কি হবে? চারু একাধারে ছোট আবার সে মেয়ে। এই পৃথিবীতে মনোরমার কিছু হয়ে গেলে সে কিভাবে বাচবে? মনোরমার উদাসীনতা চোখ এড়ালো না হামিদের।
– কি হইছে মা?
– কি হইবো?
– তোমারে কেমন যেনো দেখাইতাছে। তুমি তো সবসময় আমাগো জন্মদিনে খুশি থাকো। আইজ কি হইলো তোমার?
– কিছু না। হামিদ বাপ আমারে একটা কথা দিবি?
– কি কথা?
– আমারে কথা দে, আমার কিছু হইলে তুই চারুরে দেইখা রাখবি। ওরে আগলায়া রাখবি।
– তোমার কি হইবো মা?
– জানি না রে বাপ। সকাল থেইকা মনডা কেমন করতাছে। মনে হইতাছে তোদের সাথে কিছু উল্টাপাল্টা হইবো কিন্তু আমি ওইটা আটকাইতে পারুম না। তুই নিজেরে সামলায়া নিবি জানি কিন্তু চারুর তো কোনো গতি নাই।
– তোমার কিচ্ছু হইবো না মা। আমরা আছি না।
– তুই আমারে কথা দে আমার কিছু হইলে তুই চারুর খেয়াল রাখবি।
– কিছু হইবো না তোমার মা। তাও আমি কথা দিলাম আমি সবসময় চারুর খেয়াল রাখমু। তুমি চিন্তা কইরো না তো।
– হ বাপ। চারুর খেয়াল রাখিস। আমার পর ওর একমাত্র আপনজন তুই। তোর বাপজান তো আর চারুরে এত ভালোবাসে না। তার কাছে আমি ওর দায়িত্ব দিতে পারমু না। তুই ই আমার ভরসা।
– ধুর মা। তুমি যে কি কও না। কিচ্ছু হইবো না।
পায়েস খাওয়া শেষে উঠে গেলো হামিদ। ঘরে যেতেই দেখলো চারু বই নিয়ে পড়ছে।
– কি করস চারু?
– পড়ছি। তোমার কিছু লাগবে?
– আইজ তো তোর জন্মবার। কি উপহার চাস?
– তুমি যা দাও তাতেই আমি খুশি। আমি কখনো আলাদা কিছু চাই?
– এইবার চা। তুই তো বড় হইলা গেলি। এহনও কি আর আমার পছন্দ করা জিনিস তোর পছন্দ হইবো?
– হবে না কেনো? উপহার তো মানুষ ভালোবেসে দেয়। এখানে চাওয়ার কি আছে?
– আসলে আমার হাতে এহন টাকাপয়সা নাই। তোর কি লাগবো কইয়া রাখ বেতন পাইলে আমি আইনা দিমু।
– আমারে মাছ ধরতে নিয়ে যাবে?
– মাছ ধরতে?
– হুম। এই উপহার দিতে তো টাকা লাগে না।
– আচ্ছা নিয়া যামু। কালকে নিয়া যাই? আজকে আমার কাম আছে।
– কি ব্যাপার বলো তো, হঠাৎ এত ভালো আচরণ? না মানে তুমি তো কখনো আমার সাথে এত ভালো আচরণ করো না। জন্মদিন বলে করছো নাকি?
– হুম। একদিনই তো। কষ্ট হইলেও একটু ভালা মানুষ সাজি।
হামিদের কথার ভঙ্গিতে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো চারু। হামিদও হাসলো তবে পাশের ঘর থেকে নাজিমুদ্দিন চিৎকার করে বললো,
– এমন চিল্লাইতাছোস ক্যান? মাইয়া মানুষ চুপচাপ থাকবি ঘরে লক্ষী আইবো। আমার ঘরে সব-কয়টা অলক্ষী।
নাজিমুদ্দিনের কথায় মন খারাপ হয়ে গেলো চারুর। হামিদও লক্ষ্য করলো সেইটা। তাই তার মন ভালো করার জন্য বললো,
– মন খারাপ করিস না। বাপ জানের মন মেজাজ ভালা না।
– মন খারাপ করার কি আছে? সহ্য হয়ে গেছে আমার। কিন্তু সে আমাকে আজকের দিনেও বকবে সেইটা ভাবি নি।
হামিদ আর কিছু বললো না। তৈরি হয়ে তার কাজের উদ্দেশ্যে চলে গেলো। মাঝে মাঝে নাজিমুদ্দিনের কিছু কিছু কথা তার খুব খারাপ লাগে। আজকের দিনেও চারুকে বকা কি খুব বেশি দরকার ছিলো? চারুর সাথে তার কোনো কালেও মেলে না কিন্তু ওর জন্মদিনে তো হামিদ সবসময় ওর সাথে ভালো আচরণ করে। এতে মেয়েটার মন ভালো হয়ে যায়। মিথ্যেই হোক নাজিমুদ্দিন কি একবার চারুর সাথে ভালো আচরণ করতে পারে না? চারু তো তারই মেয়ে।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে ধরনীর বুকে। অদ্ভুত এক সৌন্দর্য ঘিরে রেখেছে চারপাশেকে। সবাই দ্রুত ঘরে ফেরার চেষ্টা করছে। সন্ধ্যার সময়টা নাকি তেনাদের খুব প্রিয় তাই কেউই এই সময়ে বাহিরে থাকতে চায় না। তাছাড়া যত দ্রুত ঘরে ফিরবে ততই মঙ্গল। চারু উঠোনে গিয়ে বসলো। জন্মদিন উপলক্ষে আজ শিহাব তাকে অনেকগুলো চকলেট দিয়েছে। এর আগে কখনো চকলেট খায়নি চারু। তাছাড়া দেখেও মনে হচ্ছিলো ওগুলো খুব দামি। কে জানে শিহাব এগুলো এই গ্রামে কোথায় পেয়েছে। হয়তো শহর থেকে আসার সময়ই এনেছে। শিহাবকে দেখে চারু মাঝে মাঝেই বেশ অবাক হয়। শাওনের চেয়ে কত আলাদা সে। শিহাব প্রচুর রাগী অপরদিকে শাওন খুব মিশুকে। কথাবার্তা চালচলনে সাধারণ। কেউ হঠাৎ দেখে বুঝতে পারবে না সে জমিদার বাড়ির ছেলে। অপরদিকে শিহাব, তার শরীরের প্রতিটি লোমকূপেও হয়তো আভিজাত্যের ছোয়া। যেকেউ তাকে দেখলেই বুঝতে পারবে সে কোনো বড় পরিবারের ছেলে। শিহাবের কথাবার্তাও বেশ মার্জিত এবং সুন্দর। অপরদিকে, শাওন হাজার চেষ্টা করেও শুদ্ধ বাংলাটা রপ্ত করতে পারেনি। চারুকে বলে সে যেন বিয়ের পর ওকে শুদ্ধ বাংলা শেখায়। কি পাগল এই ছেলেটা। চেহারা দেখলেই কেমন মায়া লাগে। ছেলেদের এত মায়াবী হতে নেই। তাদের জন্য মায়ার কোনো উপমাও নেই। তাদের অতি সাধারণই ভালো লাগে। আচ্ছা চারু কি শাওনের যোগ্য? নিশ্চয়ই যোগ্য, নইলে এত মেয়ে ছেড়ে শাওন কেনো ওকে ভালোবাসবে? কই গ্রামের বাকি মেয়েদের সাথে তো খুব একটা ভাব নেই তার। পাত্তাও দেয় না কিন্তু চারুর পিছনে সবসময় লেগে থাকে সে। শাওনের তো এখানে আসার কথা। আজ চারুর জন্মদিন। আর আজকের দিনে শাওন চারুর সাথে দেখা করবে না এমনটা হওয়া সম্ভবই না। সকালে শাওন ওঠার আগেই চারু চলে এসেছিলো তাই আর দেখা করা হয়নি। শাওন নিশ্চয়ই এখন আসবে। চারুর ভাবনাই সত্যি হলো। কিছুক্ষণের মাঝেই চারুকে ইশারা করলো উঠোনের বাইরে বের হতে। চারু কিছুটা দূর থেকে শাওনকে অনুসরণ করলো। একটা বড় গাছের সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে। এখানেই দেখা হবে ওদের। চারু এগিয়ে গেলো সেদিকে,
– কি রে আমারে না জানায়া চইলা আইলি ক্যান?
– তুমি তো ঘুমাচ্ছিলে। তোমাকে ডাকলে সবাই কি ভাবতো?
– ভাইজান চইলা গেছে।
– কোথায় গেছে?
– ঢাকা। সে বলছে তোরে বিয়া করবো না। কাল সকালেই মা তোর বাপেরে জানায়া দিবো কইসে।
– চলে গেলো কেনো? মানা করলেই তো হতো।
– সে চইলা গেলে মা মানা করতে বাধ্য তাই চইলা গেছে। আমার যে কি খুশি লাগতাছে না। এইবার আমি তোরে পামু।
চারু অবাক হয়ে শাওনের দিকে তাকালো। ভাই চলে গেলো তাতে কোনো কষ্টই হচ্ছেনা তার। আর শিহাব কি না তার জন্যই চারুকে ছেড়ে দিতে রাজি হয়ে গেলো। চারু অবশ্য কিছু মনে করলো না। ওর বয়সই বা কত? এইসব কি ও বোঝে নাকি? কিন্তু সত্যি বলতে শিহাবের জন্যেও তার কিছুটা মায়া কাজ করছে। মানুষটা ভালো। চারুকে যদি সে পছন্দ না করতো তাহলে নিঃসন্দেহে তার সাথে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারতো। শাওন একটা বকুল ফুলের মালা নিয়ে এসেছে চারুর জন্য। বকুল চারুর পছন্দের ফুল। মি মিষ্টি সুভাষ বকুলের। শাওন চারুর হাত ধরে বকুলটা সেখানে পড়িয়ে দিলো।
– ইচ্ছা ছিলো তোর খোপায় পড়ামু এইটা। কিন্তু তুই তো খোপাই করলি না। এই ভরসন্ধ্যায় চুল ছাইড়া ঘুরিস না। যা তাড়াতাড়ি ঘরে যা। কেউ দেখলে তিলরে তাল বানাইতে সময় লাগবো না।
– তুমিও সাবধানে যেও।
শাওন সম্মতি জানিয়ে চলে গেলো। চারু মালাটা হাত থেকে খুলে ফেললো। কেউ দেখলেই সমস্যা। যতটা সম্ভব ঘরে নিয়ে লুকিয়ে রাখলো সেটা। রাতটা আর পাচটা সাধারণ রাতের মতোই কাটলো।

মনোরমা খুব ভোরে উঠে নামাজ পড়ে নিলো। তারপর শুরু হলো তার নিত্যদিনের কাজ। এইসব ভারি কাজ করতে হাপিয়ে উঠেন সে। বাবার বাড়িতে কখনো এইসব করেননি সে। আর বিয়ের পর এসে জীবন টাই বদলে গেছে তার। এতে তার কোনো আক্ষেপ নেই। বাবার সাথে কথা হয় না কতবছর। খুব মনে পড়ে তাকে কিন্তু যাওয়ার উপায় নেই। সে গেলে এই সংসারের কি হবে? চারুও ঘুম থেকে উঠে মায়ের কাজে সাহায্য করলো। রান্নাটা শেষ করে ঘর দুয়ার গোছালো। কিছুক্ষণের মাঝেই হামিদ আর নাজিমুদ্দিন উঠে গোসল করে কাজে যাবে। তাদের গোসলের জন্য পানি ভরে রাখলো। ঘুম থেকে উঠলে খাবার বেড়ে দিলো। চারু হয়তো খুব একটা কাজ করে না কিন্তু তাও অনেক কাজই করে। যদিও মনোরমার কাজের তুলনায় সেসব নগন্য। । (গল্পের আসল লেখিকা স্নেহা ইসলাম প্রিয়া) মনোরমা নিশ্চয়ই এখন গরু দুটোকে ঘাস খাওয়াতে নিয়ে গেছে। কে জানে এত ধৈর্য্য কোথায় পায় সে। হামিদ আগে চলে গেলো। ওর কিছুক্ষণ পরেই নাজিমুদ্দিন। বারোটার দিকে হামিদ খেতে আসবে। এর আগেই দুপুরের রান্না শেষ করতে হবে। দুপুরের রান্না সাধারণত মনোরমাই করে। চারু একটু আধটু সাহায্য করে মাত্র। বিশ্রামহীন কাজ করে মনোরমা রান্না করতে বসেছে দশটার পরে। হামিদের আসার আগেই শেষ করতে হবে। চারু সবজি কেটে রেখেছে। রান্নার এক পর্যায়ে নাজিমুদ্দিন বাসায় এলো। এই সময় সে কখনো বাসায় আসে না। চুলার আগুন নিভিয়ে মনোরমা গেলো তার কাছে। মনোরমা কাছে যেতেই চুলের মুঠি ধরে দেওয়ালের সাথে একটা বাড়ি দিলো সে। ঘটনা এত দ্রুত ঘটে গেলো যে মনোরমা কিছুই বুঝলো না।
– এত অলক্ষী ক্যান তুই আর তোর মাইয়া? আমারে শান্তি দিবি না তোরা হারামজাদি।
– কি করেন? আমারে মারতাছেন ক্যান?
– মারি ক্যান? ওই শু**রের বাচ্চা, জমিদার বাড়ি থেইকা মানা কইরা দিছে তোর মাইয়ারে হেরা নিবো না। কাইলকা কি কইরা আসছস? হেরা মানা করলো ক্যা?
– আমি ক্যামনে বলমু? আমি তো,,
মনোরমা আর কিছু বলার সুযোগ পেলো না। নাজিমুদ্দিন উঠোনেই তাকে ফেলে এলোপাথাড়ি লাথি মারতে শুরু করলো। প্রতিটা আঘাতে চিৎকার করে কাদছে মনোরমা। মনোরমার চিৎকারে চারু দৌড়ে বেড়িয়ে এলো,
– কি হলো বাবা তুমি মা কে মারছো কেনো?
চারু সামনে যেতেই নাজিমুদ্দিন তাকেও কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারলো। চারুর ফর্সা গালে সাথে সাথে দাগ পড়ে গেলো। নাজিমুদ্দিন কোথাও থেকে একটা রড সংগ্রহ করে মনোরমাকে আঘাত করতে শুরু করলো। চারু আটকাতে গেলে সেও বেশ কয়েকটা আঘাতের স্বীকার হলো। চারু কোনো উপায়ন্তর না পেয়ে নাজিমুদ্দিনের পা চেপে ধরলো,
– বাবা দয়া করে মা কে মেরো না। মায়ের কষ্ট হচ্ছে বাবা। তুমি যা শাস্তি দিবে আমাকে দাও। আমার মা কে ছেড়ে দাও। চারুলতার কথা শুনলেন না নাজিমুদ্দিন। খুব জোরে তাকে লাথি দিলো। খেয়াল করে লাথি না দিলেও সেটা একেবারে তলপেট বরাবর লাগলো। আবার মাথাটা আঘাত পেলো মাটির সিড়িটির সাথে। এতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই চারুর সে প্রানপনে চিৎকার করে যাচ্ছে মনোরমাকে বাচানোর জন্য। নাজিমুদ্দিন এলোপাথাড়ি তাকে লাথি দিচ্ছে ও রডের টুকরো টা দিয়ে মারছে। শেষমেষ আঘাত লাগলো মাথায়ও। সাথে সাথে রক্তে রঞ্জিত হলো সম্পূর্ণ উঠোন। চারুর চিৎকারে এতক্ষণে সকল প্রতিবেশি এসে গেছে এখানে তবে মনে হয় খুব দেরি হয়ে গেছে। নাজিমুদ্দিন এখনো অমানুষের মতো মেরে চলেছে মনোরমাকে। সবাই এসে একপ্রকার জোর করে থামিয়ে দিলো তাকে। যাওয়ার আগে চিৎকার করে নাজিমুদ্দিন বলে গেলো,
– এই অলক্ষীরে আমি তালাক দিলাম। আমি নতুন কইরা বিয়া করমু। এমন অলক্ষী আমার দরকার নাই।
নাজিমুদ্দিন চলে যেতেই সকলে ধরাধরি করে মনোরমাকে ঘরে নিয়ে গেলো। টুনির বাপ গেছে কবিরাজ ডাকতে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে মনোরমার শরীর। তার জ্ঞান নেই। চারু তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কেদে চলেছে।

হামিদ বাসায় ঢুকতেই দেখলো অনেক মানুষের আনাগোনা। ভিতর থেকে চারুর কান্নার শব্দ। কি হলো চারু এভাবে কাদছে কেনো? কি হলো ওর? হামিদ দৌড়ে ভিতরে ঢুকলো। চারুর কিছুই হয়নি। বিছানায় শুয়ে আছে মনোরমা। তার রক্তে বালিশ ভিজে আছে। এদিক সেদিক ছড়িয়ে আছে রক্ত। হামিদ দৌড়ে ছুটে গেলো মনোরমার কাছে,
– মা, কি হইছে তোমার মা?
– মা কথা বলে না কেনো? তুমি দেখো না আমার মা কথা বলে না। কিছু করো না।
হামিদ ছুটে গিয়ে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলো। পানি দিয়ে সে মনোরমার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টা চালাচ্ছে। কিছুক্ষণের মাঝেই হালকা একটু চোখ খুললেন মনোরমা।
– মা তুমি ঠিক আছো তো মা।
মনোরমা কিছু না বলে ইশারায় হামিদকে নিজের কাছে ডাকলেন। হামিদ এগিয়ে যেতেই কাপা কাপা ঠোঁটে বলে উঠলেন, তুই ছাড়া চারুর আর কেউ নাই। ওর খেয়াল রাখিস বাপ। হামিদ চিৎকার করে কেদে উঠলো,
– মা তোমার কিছু হইবো না মা। আমি তোমারে ডাক্তারের কাছে নিয়া যামু মা।
মনোরমা কিছু না বলে চারুকে ইশারায় নিজের কাছে ডাকলেন,
– হামিদের দিকে খেয়াল রাখিস মা। তুই ছাড়া ওর আর কেউ নাই।
চারু কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলো। মনোরমা তাকে কিছু বলতে নিষেধ করলো। একহাতে চারুকে এবং অন্যহাতে হামিদকে জড়িয়ে ধরলো শেষ বারের মতো। সন্তানদের বুকের মাঝে আগলে রেখেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন তিনি। মনোরমা চোখ বন্ধ করতেই চিৎকার করে কেদে উঠলো চারু। একই সাথে জ্ঞান হারালো। হামিদ ওর মায়ের হাত ধরলে তাকে ডাকতে শুরু করলো,
– মা, ও মা উঠো মা। তুমি আমাগো রাইখ্যা যাইতে পারো না মা। তুমি ছাড়া আমরা এতিম মা। মা আমাগো এতিম রাইখা যাইয়ো না মা। তুমি গেলে আমার কি হইবো? চারুর কি হইবো? আমরা শেষ হইয়া যামু মা। আমাগো লাইগা তোমার বাচতে হইবো। উঠো মা।
হামিদ এইবার মনোরমা কে ছেড়ে চারুর দিকে গেলো,
– এই চারু উঠ, উঠ চারু। দেখ মা আমাগো রাইখ্যা চইলা যাইতাছে। মায়েরে আটকাবি না চারু? আমরা ক্যামনে থাকমু মা রে ছাড়া? উঠ চারু। মায়েরে যাইতে দিস না।
গ্রামবাসী তাকিয়ে রয়েছে হামিদের দিকে। অঝোরে পানি পড়ছে তার দুচোখ থেকে। মা এবং বোনের বিরহে সে পাগল প্রায়। সে একবার মনোরমার কাছে যাচ্ছে তো একবার চারুর কাছে যাচ্ছে। রুবেলের মা হামিদের দেখাদেখি চারুর মুখে পানি ছিটিয়ে ওর জ্ঞান ফেরালো। জ্ঞান ফিরতেই চারু মনোরমাকে জড়িয়ে কান্না করতে শুরু করলো।
– মা উঠো মা। আমাকে রেখে যেয়ো না মা। তুমি না বলেছিলে তুমি আমাদের সবচেয়ে বেশি ভালোবাসো? আমাদের ছেড়ে কেনো যাচ্ছো মা? তোমাকে আরো বাচতে হবে মা। আমার জন্য, ভাইয়ের জন্য। তোমার নিজের জন্য। তোমার যে এখনো সুখ পাওয়া হলো না গো মা। সুখ এখনো তোমার অপ্রাপ্তির খাতায় রয়ে গেলো যে মা।
নাহ! মনোরমা উঠলো না। চারু হামিদের হৃদয় নাড়ানো কষ্টও মনোরমাকে উঠাতে পারলো না। মাথায় পরপর একই জায়গায় বেশ কয়েকবার আঘাত লেগেছে তাই তার প্রানপাখি উড়াল দিয়েছে। কবিরাজ এসে মৃত ঘোষণা করেছে মনোরমাকে। চারুর সাথে গলা মিলিয়ে কিন্নর কণ্ঠে কেদে উঠলো প্রতিবেশী কয়েকজন। মনোরমার এই করুন মৃত্যু কেউই মানতে পারলো না। হামিদ যেনো পাথর হয়ে গেলো। ওর মা আর নেই ভাবতেই চোখ ছাপিয়ে জল আসছে। আজ থেকে ও এতিম। হাজার কষ্টেও আর কাউকে বলা যাবে না সে কষ্টে আছে। কারোর কোলে মাথা রেখে শোয়া হবে না। কাউকে আর কখনো খায়িয়ে দিতে বলা হবে না। কেউ আর কখনো মাথায় হাত রেখে বলবে না কি হইছে বাপ? নিজের খাবার টা কেউ প্লেটে তুলে দিয়ে বলবে না আমার খিদে নাই তুই খাইয়া নে নাইলে নষ্ট হইয়া যাইবো। অনেক রাতে বাড়ি ফিরলে আর কেউ জেগে বসে থাকবে না ভাত বেড়ে দেওয়ার জন্য। এমন কেনো হলো? এই অসময়ে কেনো চলে গেলো ওর মা? এতটা নিষ্ঠুর কেনো হলো নিয়তি?
গ্রাম বাসীরা সবাই মিলেই কাজ করছে। কাফন কেনা, গোসল দেওয়া ইত্যাদি। কাফনের কাপড় পড়িয়ে খাটিয়ায় শোয়ানো হয়েছে মনোরমাকে। চারু মোট তিনবার জ্ঞান হারিয়েছে। হামিদ শোকে পাথর প্রায়। এই নিষ্ঠুর নিয়তির কাছে হেরে গেলো ছোট্ট দুই প্রান। মনোরমাকে জানাযা দিতে নেওয়া হচ্ছে না নাজিমুদ্দিনের জন্য। সে আসলে জানাযা সহ দাফন কাফনের কাজ শেষ করতে হবে।
– ওই খুনি আমার মারে শেষ বারের মতো দেখবো না। ওর কোনো অধিকার নাই আমার মায়ের উপর। আমার মায়ের জানাযা এহনই হইবো আর তারে ছাড়াই হইবো।
হামিদ এখন শোকাহত তাই কেউই ওর কথা এত গুরুত্ব সহকারে নিলো না। যতই হোক স্বামী ছাড়া কিভাবে স্ত্রীকে দাফন দেওয়া হবে?
নাজিমুদ্দিন ফিরে এলো চারঘন্টা পর। হামিদ আর চারু পাথরের মতো বসে ছিলো। নাজিমুদ্দিন একা ফিরে আসেনি। তার সাথে রয়েছে তার নতুন বউ। এই কথাটা শুনেই হামিদের মাথায় খুন চেপে গেলো।
– চারু দা টা নে। আইজ ওরে খুন করুম আমি। আমার মায়েরা মাইরা নতুন মাইয়া নিয়া ফুর্তি করা শিখাইতাছি আমি তারে।
চারুর অপেক্ষা করলো না সে। নিজেই দা নিয়ে বাহিরে গেলো। চারুও গেলো তার পেছনে। ভিতরে প্রথম স্ত্রীর মৃতদেহ আর বাইরে নাজিমুদ্দিন বউ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পৃথিবীর জঘন্যতম দৃশ্য বোধহয় সেটাই। তবে বাইরে গিয়ে যা দেখলো সেটা চারু বা হামিদ কেউই কল্পনা করেনি। নতুন বউ হিসেবে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদেরই চাচাতো বোন শেফালী। হামিদের হাত থেকে দা টা পড়ে গেলো। কাপা কাপা কণ্ঠে উচ্চারণ করলো
– শেফালী আপা তুমি?
চারু এই জঘন্যতম দৃশ্য সইতে পারলো না। এতগুলো জঘন্য ঘটনা একসাথে দেখতেও পারলো না। সেখানেই চতুর্থবারের মতো জ্ঞান হারালো সে।

বিঃদ্রঃ অনেকেই বলেন অপ্রয়োজনীয় কথা গল্পে বেশি হচ্ছে। গল্পে কোনো অপ্রয়োজনীয় কথাও হচ্ছে না আর এইটা কোনো প্রেমের উপন্যাসও না। গল্পের পরবর্তীতে এই ঘটনাগুলো কাজে দেবে। এইগুলো ব্যাখা না করলে পরবর্তীতে আপনাদেরই সমস্যা হবে। আমার আরো অনেক ঘটনাই ব্যাখা করার ছিলো কিন্তু আপনাদের কারনেই আর করলাম না। আমি এইটাকে কোনো প্রেমের উপন্যাস হিসেবে উপস্থাপন করতে চাই না। যাই হোক, পরবর্তীতে আপনাদের বুঝতে অসুবিধা হলে আমি দায়ী না। হাতের লেখাও খুব একটা পরিপক্ক হয়নি। মন মতো না লেখায় আমি হতাশ কিন্তু এর জন্যও দায়ী আপনারা। আমি চেষ্টা করবো ঘটনা উপস্থাপন না করায় যেনো আপনাদের কোনো সমস্যা না হয়। তবে আপনাদের এইসব কমেন্টে আমি হতাশ। যাই হোক, রিচেক করা হয়নি। হ্যাপি রিডিং।

#স্নেহা_ইসলাম_প্রিয়া

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

To Be Continued….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here