আমি সেই চারুলতা পর্বঃ১১

0
2097

#আমি_সেই_চারুলতা
#Shuvra_Ahmed_Priya
#পর্বঃ১১
_______________________

থানা থেকে ফেরার পর থেকেই চারুলতার কেসটা কেমন যেনো মাথায় ঘুরছে হিমেলের। বিশেষ করে হামিদের কথাটা। কি হয়েছে তার? সে কি শহরে গিয়ে কোনো বিপদে পড়েছে কিংবা চাকরির নাম করে কি হামিদ কোনো ফ্রডের পাল্লায় পড়েছে? কিন্তু হামিদ তো ছেলে, ওকে ফ্রড করে কিছু টাকা পয়সা নেওয়া ছাড়া তো আর কিছুই সম্ভব না। এমন হলেও তো হামিদ ফিরে আসতো কিন্তু হামিদ তো ফেরেনি। কিছুদিন আগে সংবাদপত্রে একটা খবর পড়েছিলো হিমেল, বাংলাদেশ থেকে শক্ত সামর্থ্য পুরুষ বিদেশে কাজের জন্য পাচার করা হয়। হামিদ কি তেমন কোথাও গিয়ে পড়েছে? নাকি হামিদ সত্যিই কোনো ভালো মানুষ ছিলো না। কিন্তু চারুর সাথে হামিদ এত বড় বেইমানি করতে পারে বলে হিমেলের মন মানছেনা। আগে যতই যা হোক না কেনো, মনোরমার মৃত্যুর পর এই দুই ভাইবোনের বন্ধন খুব শক্ত হয়েছিলো। তাহলে তারা আলাদা কেনো হলো? আজ অবধি হিমেলের দেখা সবচেয়ে জঘন্যতম চরিত্র বোধহয় শেফালী আর নাজিমুদ্দিন। আচ্ছা, এইদুজন কি হামিদের নিখোঁজের সাথে জড়িত থাকতে পারে? অবশ্য থাকতেও পারে। অসম্ভব কিছুই নয়। চারুলতা একের পর এক যেভাবে সবাইকে ধাধায় ফেলছে সেখানে এমন কিছু হওয়া অসম্ভব নয়। আর শিহাব আর শাওন থাকতে চারুলতার বিয়েই বা কিভাবে জামাল হোসেনের সাথে হলো? হামিদ না হয় ছিলো না কিন্তু শিহাব আর শাওন তো ছিলো তারাই বা কেনো বাধা দেয়নি? আর চারুর বিয়ের দিন শাওন আত্মহত্যা করতে চাইলো কেনো? সে চাইলেই বিয়েটা আটকে দিতে পারবো। নিজে না পারলে শিহাবের সাহায্য নিতে পারতো কিন্তু এইসব না করে আত্মহত্যার কি মানে? আচ্ছা শাওন কি বেচে আছে? সেদিন কি হয়েছিলো শাওনের সাথে? আচ্ছা শাওনই কি চারুকে সাহায্য করেছে খুনগুলো করতে? যদি এমনই হয় তবে কেউ কেনো আর কখনো শাওনকে দেখেনি। সে গ্রামে থাকলে তো তার জন্য খু*ন করা আরো বেশি সহজ হতো। গ্রামবাসীর কাছে খবর পেয়েছিলো শাওনকে কোন হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিলো। চার বছর আগের কথা, কে জানে সেই রেকর্ড এখনো আছে কি না? এখনো অনেক কিছুই জানার আছে। এর মাঝেই হিমেলের মা ওকে খাওয়ার জন্য নীচে ডাকলো। কেস সম্পর্কিত কিছু তথ্য আজই তার বাড়িতে কুরিয়ার হিসেবে আসার কথা, এখনো আসেনি। আগে বরং খেয়ে নেওয়া যাক তারপর এই কেইস নিয়ে আরো কিছু ভাবা যাবে। এইটা হিমেলের জীবনের প্রথম কেইস। তার ক্যারিয়ারই বোধহয় শুরু হলো, ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে রহস্যময় কেস দ্বারা।
হিমেল নীচে নেমেই টেবিলে খেতে বসে গেলো,
– আজ কি রান্না করেছো?
– তোর পছন্দের খাবারই রান্না করেছি। কাচ্চি বিরিয়ানি।
হিমেলের নাকমুখ কুচকে গেলো। আজকের দিনেই মায়ের বিরিয়ানি রান্না করার ছিলো। সোফায় বসে টোকন বিরিয়ানি খাচ্ছে। এতক্ষণ টোকনকে খেয়াল করেনি হিমেল। টোকন ওর বড় ভাইয়ের একমাত্র ছেলে। বাচ্চা ছেলে তাই মাংস ছিড়তে পারছে না। দাত দিয়ে কামড়ে মাংসগুলো খুলছে। হিমেলের হঠাৎ মনে হয় কাচ্চির মাংসটা শেফালীর মাংস। ওর মা ফ্রিজ থেকে শেফালীর মাংস কেটে এনে বিরিয়ানি টা রান্না করেছে আর টোকন সেটা কামড়ে কামড়ে খাচ্ছে, ছিহ! কি জঘন্য। হিমেলের মনে হলো এখনই সে বমি করে দেবে আর টোকন সেটা অনায়াসে খেয়ে যাচ্ছে। আচ্ছা কেমন হয় যদি ওর মা ওকে খুব আদর করে বিরিয়ানি খাওয়ায় আর তারপর বলে খাসির মাংস পাওয়া যায়নি বিধায় সস্তায় দোকান থেকে মানুষের মাংস এনে সে বিরিয়ানি রান্না করে হিমেলকে খাওয়েছে। টেবিলে ওর মা বিরিয়ানি বাড়ছে। আজ তার পছন্দের বিরিয়ানি টাও তার কাছে খুব ভয়ানক লাগছে। বিরিয়ানিতে মাংসের সাথে এক টুকরা কলিজাও আছে। হিমেলের মনে হচ্ছে কলিজাটা যেনো শেফালীর। চারু খেতে পারেনি বিধায় ওর জন্য রান্না করে পাঠিয়েছে। ছিহ, পৃথিবীর জঘন্যতম অনুভূতি।
– মা আমি বিরিয়ানি খাবো না। মুড নেই, তুমি প্লিজ আমাকে ভাত দাও।
– ভাত কি দিয়ে খাবি? তরকারি তো রান্না করিনি।
– সমস্যা নেই। ডিম ভেজে দাও।
– সূর্য কোনদিকে উঠলো বল তো? তুই খাবি না কাচ্চি বিরিয়ানি?
– রাতে সূর্য ওঠে না মা। ভাত দাও, ভাত খাবো আমি।
হিমেলের মা চুলায় ভাত বসিয়ে দিয়ে হিমেলের পাশে এসে বসলেন,
– কিছু বলবে?
– বলবো বলেই তো এখানে এসে বসলাম। শোন, চাকরি তো হয়েই গেলো। ভালো একটা চাকরি করছিস এখন বিয়েটাও করে নে।
– এক মাস হলো আমি কাজে জয়েন করেছি মা। কিছুদিন যেতে দাও।
– হ্যাঁ, আমি তো আর বলছি না এখনি কর। আগে মেয়ে দেখবো যাচাই বাছাই করবো তারপর না বিয়ে হবে। শোন হাতে দুইটা মেয়ে আছে। দেখ তো কোনটা সুন্দর।
হিমেল ছবি দুটো দেখলো। হলুদ জামা পড়া মেয়েটি খুবই সুন্দরী। একদেখায় পছন্দ হওয়ার মতো মেয়ে কিন্তু তার চেহারায় মায়া নেই। হাসি মুখেও কেমন শক্ত কাঠখোট্টা ধরনের মেয়ে মনে হচ্ছে। অপরদিকে, আর নীল জামা পড়া মেয়েটা উজ্জ্বল শ্যামলা কিন্তু চেহারাটা মায়ায় পরিপূর্ণ। হিমেল হলুদ জামা পড়া মেয়েটাকেই পছন্দ করলো। আজকাল গায়ের রঙ দেখেই সবাই বিচার করে। চেহারার মায়া কজন দেখতে যায়?
– নীল জামা পড়া মেয়েটা একটু কালো আর বাকি সব ঠিকই আছে আর হলুদ জামা পড়া মেয়েটার সব ঠিকই কিন্তু মা টা যেনো কেমন? হাসি মুখে কথা বললেও মোটেও আন্তরিক নয়। যাক গে, আমরা তো মেয়েকে আনবো মা দেখে আমাদের কি? মহিলার আচরণ দেখে আমার তো মনে হয় এই মেয়ের মা পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য মহিলা।
– না মা, ওই মহিলা সবচেয়ে জঘন্য না। তার চেয়েও বেশি জঘন্য শেফালী। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে জঘন্যতম চরিত্র বোধহয় সে।
– শেফালী কে?
– তুমি চিনবে না। বর্তমান যে কেইসটা নিয়ে কাজ করছি সেখানে আসামীর সৎ মা শেফালী। মহিলা জঘন্য খারাপ।
– কি করেছে সে?
হিমেল চুপসে গেলো। সে কি বলবে শেফালী সম্পর্কে? নিজের আপন চাচাকে বিয়ে করেছে এইটা বলবে নাকি সে নিজের আপন চাচাতো ভাইয়ের সাথে জোড়পূর্বক শারীরিক সম্পর্ক করতে চেয়েছে সেটা বলবে? তাছাড়া যে সময়ে শেফালী এইটা করেছিলো তখন শেফালী ছিলো হামিদের সৎ মা। কতটা জঘন্য এ মহিলা। আর তাতে সায় জানিয়েছে কি না নাজিমুদ্দিন নিজে। শেফালীর পরে অপছন্দের তালিকায় নাজিমুদ্দিনের নামও লেগে গেছে। চারু বোধহয় এদের খুব কম শাস্তিই দিয়েছে। এদের আরো জঘন্য শাস্তি হওয়ার ছিলো। হিমেলকে এই অবস্থা থেকে বাচানোর জন্যই হয়তো কুরিয়ার এলো। সে কোনোরকমে খাবার খেয়েই কুরিয়ার টা নিয়ে উপরে নিজের ঘরে চলে গেলো। তেমন বিশেষ কিছু নেই। শাওন সম্পর্কিত কিছু তথ্য আর সকলের ছবি আছে। পার্সেল খুলতেই প্রথম ছবিটা পাওয়া গেলো চারুর। কিশোরী বয়সের প্রানচ্ছল ছবি চারুর। চারু যেমনি সুন্দরী তেমনি মায়াবতী। মুখে একটা হাসি লেগে আছে। তারপরের ছবিটি নাজিমুদ্দিনের। মধ্যবয়স্ক হলেও যৌবনে যে হাজারো মেয়ের দীর্ঘশ্বাসের কারণ তিনি ছিলেন তা বেশ সহজেই আন্দাজ করা যায়। চারুও একেবারে নিজের বাবার চেহারাটাই পেয়েছে। ভাগ্যিস চরিত্রটা নাজিমুদ্দিনের মতো হয়নি। পরবর্তী ছবিটি হামিদের। সেও দেখতে তার বাবার মতোই তবে তার সৌন্দর্য তার বাবাকেও ছাড়িয়ে গেছে। এই মুহূর্তে হিমেলের মনে হলো ছেলেদের বেশি সুন্দর হতে নেই। আচ্ছা, এমনটা মনে হওয়ার কারণ কি? সে কি হামিদকে হিংসে করছে নাকি? অবশ্য করাই উচিত, হামিদকে দেখলে কোনো মেয়েই আর ওর দিকে তাকাবে বলে মনে হয় না। নিজের চিন্তাভাবনায় নিজেই হেসে উঠলো হিমেল। কিসব আজগুবি চিন্তাভাবনা। ছবিটা আরো চারবছর আগের। বর্তমান সময়ের কোনো ছবিই তার পাওয়া যায়নি। এই ছবিটা সদ্য যৌবনে পা দেওয়ার পরে আর হামিদ এখন নিশ্চয়ই সম্পূর্ণ দায়িত্বশীল যুবকে পরিণত হয়েছে অবশ্য যদি সে বেচে থাকে তো। তারপর ছবি আসে মনোরমার। মধ্যবয়স্ক শ্যামবর্ণা মহিলা। তবে একটা চুলেও পাক ধরেনি। তার বোধহয় আরো অনেক বছর বাচার কথা ছিলো। তারপর শেফালী। ছবিটি হাতে নিয়েই ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো হিমেল। এই মহিলাই নাকি চারুকে মাত্র ১ লাখ টাকার বিনিময়ে জামাল হোসেনের সাথে তার বিয়ে দিয়েছিলো। চারুর মূল্য তো কোটি টাকা দিয়েও দেওয়া সম্ভব নয়। কে জানে বিয়ের সময় শাওন বা শিহাব কোথায় ছিলো। তারপর ছবি আসে শাওনের। মায়ায় জড়ানো মুখ তার। যেকেউই মায়ায় পড়তে বাধ্য। চারুর মতো মায়াবিনী শাওনের সাথেই মানানসই তবে ভাগ্য বোধহয় সেটা পছন্দ করেনি। অপরদিকে শিহাব, আভিজাত্যের এত রূপ তা বোধহয় শিহাবকে না দেখলে জানা সম্ভব না। কে বলবে এই ছেলেটার বয়স ৩৪। শিহাবের সাথে বিয়ে হলেও তো খুব একটা খারাপ হতো না। আরো কিছু ছবি ছিলো। দেখতে ইচ্ছে হলো না। সে সরাসরি চলে গেলো হাসপাতালের রেকর্ডে। চারবছর আগের রেকর্ড হলেও এখানে স্পষ্ট করে সব দেওয়া। হিমেল অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো, সেখানে স্পষ্ট করে লেখা আছে শাওন ব্লে*ড দিয়ে হাত কে*টে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু সে সফল হয়নি। এর আগেই হাসপাতালে পৌঁছে যায় আর শাওন বেচে যায় কিন্তু এরপর শাওনের মাঝে কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা যায় তাই ঠিক করা হয় শাওনকে,,,,,,,
লেখাটা অস্পষ্ট। বারবার চেষ্টা করেও লেখাটা পড়তে পারলো না হিমেল। কি হয়েছিলো এরপর? আর শাওনের মাঝেই কি কিসের অস্বাভাবিকতা দেখা গেছে? চারু কি এইসবের উত্তর জানে?

সকাল হতে না হতেই থানায় পৌঁছে গেছে হিমেল। এখনো অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা বাকি। এইসব প্রশ্নের উত্তর বোধহয় চারুই দিতে চাইবে। নির্দিষ্ট সময়ের আগে পৌছানোর কারণে থানায় বেশি পুলিশ ছিলো না। হিমেল সরাসরি চারুকে বন্দি করে রাখা সেই ছোট খুপরি তে প্রবেশ করলো। ও ভেবেছিলো চারু বোধহয় ঘুমাচ্ছে কিন্তু না মেয়েটা জেগে আছে। এমনভাবে জেগে আছে যেনো কত রাত নির্ঘুম সে।
– বাহ! এত সকালেই এসে গেলেন? আপনি একা যে? আপনার সিনিয়র অফিসাররা কোথায়?
চারু এমন ভাবে কথা বলছিলো যেনো ও জানে আজ তাদের আসার কথা।
– শোনো, আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করবো। সরাসরি উত্তর দেবে।
– তাতে আমার কি লাভ? আমি কেনো উত্তর দেবো?
– দেখো মেয়ে, তুমি মামা বাড়িতে বেড়াতে আসোনি যে সব তোমার মর্জিমাফিক চলবে। নেহাৎ তোমার কেইস সাজিদ স্যারের আন্ডারে পড়েছে বলে সে ধৈর্য্য সহকারে তোমার কেইসটা দেখছে। অন্যকেউ হলে এতদিনে রিমান্ডে পাঠানো হতো তোমাকে।
চারু কোনো উত্তর দিলো না। চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে রইলো যেনো সে কিছু শুনতেই পায়নি।
– শাওন বেঁচে আছে সেটা কি তুমি জানো? সেই কি তোমাকে সাহায্য করেছে খুনগুলো করতে?
– শাওন ভাই বেচে নেই। সে খুনগুলো করেনি। যেই ছেলে সামান্য রক্ত দেখলে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যেতো সে কিভাবে খুন করবে বলুন?
– শাওনের হিমোফোবিয়া ছিলো?
চারু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো। শাওনের শুধু হিমোফোবিয়াই ছিলো না সেই ফোবিয়া ছিলো মারাত্মক, সামান্য একটু রক্ত দেখলেই অজ্ঞান হয়ে যেতো সে।
– সে না হয় বুঝলাম শাওনের হিমোফোবিয়া আছে সে খুন করেনি কিন্তু তুমি এইটা কেনো বলছো সে মারা গেছে? আমি হসপিটালের সেদিনের রেকর্ডস চেইক করেছি। শাওন সেদিন বেচে গিয়েছিলো।
– হাসপাতাল থেকে শাওন ভাইয়ের শরীর বেঁচে ফিরেছিলো তার আত্মা নয় কিন্তু ওই নরপিশাচ গুলো শাওন ভাইয়ের শরীর টাকেও বাচতে দেয়নি। তার আত্মার সাথে সাথে তার দেহেরও মৃত্যু হয়েছিলো।
– শাওনকে খুন করা হয়েছিলো?
– হ্যাঁ। ইনডেরেক্টলি খুন করা হয়েছিলো তাকে। হাসপাতাল থেকে বেচে আসলেও তাকে কিন্তু বাচানো যায়নি। সেই খবর কি জানেন?
– তুমি কিভাবে জানলে শাওন মারা গেছে?
– নিজের চোখে দেখেছি তার মৃত্যু। কিভাবে ভুলে যাবো আমি?
হিমেল অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো চারুর দিকে। কাল ও জানতে পারলো শাওন বেঁচে আছে আর আজ শুনছে শাওন মারা গেছে। যদি শাওন মারাই যায় তাহলে কিভাবে?
– আর হামিদ? হামিদের খবর জানো? সেকি বেঁচে আছে?
চারু না বোধক মাথা নাড়লো।
– না আমার ভাই বেঁচে নেই। তার জন্ম হয় নি। তার মৃত্যুও হয়নি। সে বেঁচেও নেই। সে মারাও যায়নি। হামিদ বলতে এই পৃথিবীর বুকে কারো কোনো অস্তিত্ব নেই।
হিমেল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো চারুর কথায়। সে বুঝতে পারছেনা চারু কি বলতে চাইছে।
– মানে? আমি বুঝিনি।
– না বোঝার কোনো কারণ নেই। আমি তো বাংলাতেই বললাম। শুধু হামিদ নয়, আমিও বেঁচে নেই। আমি মরে গেছি। চারুলতা মরে গেছে অনেক আগেই। আজ চারুলতার শরীরে আমি আছি। চারুলতার মৃত্যুর পরপরই তার শরীর আমার দখলে চলে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে চারুলতা বলতে কেউ নেই।
হিমেলের মাথায় কিছুই ঢুকছেনা। চারুলতা বেচে নেই মানে কি? চোখের সামনে জলজ্যান্ত একটা মেয়ে বসে থেকে কি না বলছে সে মারা গেছে। হামিদ মারা গেছে আবার শাওনও কি না মারা গেছে। কিসব অদ্ভুত কথাবার্তা!
– আমাকে কি আপনি সাহায্য করবেন? বিশ্বাস করুন, পৃথিবী থেকে একটা আবর্জনা সরিয়ে ফেলবো আমি। তার কারণে পৃথিবীতে অন্য কোনো দূষণ হবে না। দয়া করে আমাকে একটু সাহায্য করুন। চারুলতার খুনিকে ধরতে আমাকে সাহায্য করুন প্লিজ।
– চারুলতার খুনিকে ধরতে সাহায্য করবো মানে? তাহলে তুমি কে?
– আমি চারুলতা।
– দেখো চারুলতা, তুমি একদম কথা প্যাচানোর চেষ্টা করবেনা।
– আগের বারও তো নিজের মনগড়া কাহিনি বলে আমাকে বলেছিলেন আমি কাহিনি প্যাচাচ্ছি। আসলেই কি আমি সেদিন প্যাচিয়েছিলাম কাহিনি?
হিমেল উত্তর দিতে পারেনা। আসলেই চারু কাহিনি প্যাচায়নি। তার জীবনে ঘটেছিলো অন্য ঘটনা। কিন্তু এইসব কি অবাস্তব কথা? যার কোনো অর্থই নেই।
– আমি তাকে খুন করবো নইলে আমার আত্মাও শান্তি পাবেনা।
– যে দোষ করেছে তাকে আইনের হাতে তুলে দেওয়া উচিত।
– কোন আইনের হাতে তুলে দেওয়া উচিত? যে আইনে কিছু টাকা ঢাললেই কয়েকবছর পর মামলা শেষ হয়ে যায় সেই আইনে?
– তুমি কাকে খুন করতে চাও? কি করেছিলো সে?
– আমি যদি জানতাম তাহলে আজ পুলিশের কাছে আসতাম না।
– যাকে তুমি দেখোইনি সে তোমার কি ক্ষতি করে ফেললো যে তাকে তুমি মারতে এত উতলা?
– চারুলতাকে হত্যার দায় সম্পূর্ণ তার। তার জন্যই আজ আমি এখানে আপনার সামনে বসে আছি।
– বুঝলাম, সে হয়তো এমন কিছু করেছে যাতে তুমি আজ সেখানে। তাই তুমি আজ নিজেকে জীবিত বলে মনে করছো না কিন্তু হামিদকে কেনো মৃত বলছো? কেনো বলছো তার অস্তিত্ব নেই?
– মিথ্যে তো বলিনি। আমার আর আমার ভাইয়ের জীবন এমন না হলেও পারতো।
– হামিদের সাথে আর কখনো দেখা হয়েছিলো তোমার?
চারু নিরুত্তর! অন্যদিকে তাকিয়ে আছে সে। কিছু প্রশ্ন এমনভাবে সে এড়িয়ে যায় যেনো সে প্রশ্নটা শোনেই নি। চারুকে হঠাৎই কেমন বিষন্ন মনে হচ্ছে হিমেলের কাছে। আসলেই কি সে বিষন্ন?
– পুলিশ হওয়াটা বাদ দিয়ে মানুষ হিসেবে তোমাকে একটা কথা বলি চারুলতা। তুমি খুব বড় ভুল করেছো আত্মসমর্পণ করে। তোমার উচিত ছিলো তাকে নিজে খুজে হত্যা করা তারপর আত্মসমর্পণ করা। এদেশের আইন তাকে খুজবেনা কিন্তু তোমাকে ঠিকই শাস্তি দেবে।
– আপনি বাঁচাবেন আমাকে?
– না। সে পথ খোলা নেই আমার। আমি চাইলেও তোমাকে সাহায্য করতে পারবো না। নিয়মের কঠিন বেড়াজালে আটকে আছি আমি।
– ঠিক আছে। আমাকে নাহয় নাই বাঁচালেন। তাকে খুজবেন? খুজে তাকে তার যোগ্য শাস্তি দেবেন? আমি নিজের হাতে তার খুন করতে চাই।
– নাহ, উপর মহল থেকে আদেশ না পাওয়া অবধি আমি সেটাও করতে পারবোনা। সবেমাত্র জয়েন করেছি আমি। এখনো এত পাওয়ার হয়নি আমার।
– আমার জায়গায় আপনার বোন থাকলেও কি আপনি আমাকে বাচাতেন না?
– আমার কোনো বোন নেই চারুলতা। আমি জানি আমি মানষিকভাবে খুবই দুর্বল তাই তুমি আমাকে ব্যাবহার করতে চাও নিজের কাজ আদায়ের জন্য কিন্তু তারপরেও যদি আমার সাধ্যে থাকতো আমি বোধহয় তোমাকে সাহায্য করতাম।
– আমার কেইসটা কি কোর্টে পাঠানো হয়েছে? কি শাস্তি হবে আমার?
– হুম হয়েছে। পাঁচজনকে হত্যা করেছো তুমি। খুব শীঘ্রই তোমার বিচার হবে আর রায় নিঃসন্দেহে মৃত্যুদন্ড।
– মৃত্যুর আগে কি আমি আরেকটা নরকের কীটকে খুন করতে পারবো না?
– মনে হয়না পারবে তবে তোমার জন্য আমার খুবই খারাপ লাগবে। কিছুই করার নেই আমার।
চারুলতা আবার আগের মতো নিশ্চুপ। মৃত্যুর কথা শুনেও যেনো কোনো কষ্ট নেই তার। কষ্ট হবে কিভাবে? মানুষের মৃত্যু তো একবারই হয়। চারুর মৃত্যুও তো হয়ে গেছে। হিমেল বেড়িয়ে এলো সেখান থেকে। সাজিদ সীমা দুজনেই নিশ্চয়ই চলে এসেছে। সেদিকে যেতেই দেখা গেলো সীমা খুব জোরে একজন রোগা পাতলা মানুষকে মেরে কিছু স্বীকার করতে বলছে আর লোকটি কান্না করতে করতে বলছে সে কিছুই করেনি কিন্তু সমস্ত প্রমানই তার বিরুদ্ধে। প্রথম প্রথম সবাই এমন দোষ অস্বীকার করে। এইসব মারের দৃশ্য এখনো অবধি হজম করতে শেখেনি সে। কিছুটা দূরে সরে যেতে চাইলো সে কিন্তু তখনই সীমা তাকে ডেকে নিলো,
– হিমেল আচ্ছামতো এর ধোলাই করো। যতক্ষণ না অবধি সব স্বীকার করে ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে ছাড়বে না।
হিমেল পড়ে গেলো বিপাকে। যেখানে সে এইসব দেখতে পর্যন্ত পারেনা সেখানে তাকে এইসব কাজ করতে দেওয়া হলো। কোনোমতে অযুহাত দেখিয়ে সেখান থেকে বেড়িয়ে এলো সে। তখনই তার কাধে হাত রাখলো সাজিদ,
– মাত্র তো জয়েন করলে। আরো কত কিছু দেখবে। এমন নরম মন নিয়ে তোমার পুলিশে জয়েন করা উচিত হয়নি।
– কিছুদিনের মাঝে সব ঠিক হয়ে যাবে স্যার।
– তাই নাকি?
– স্যার আমি আজ চারুলতার সাথে কথা বললাম। মেয়েটা কেমন অদ্ভুত সব কথা বলছিলো। কাল আমি রেকর্ড চেইক করে দেখলাম শাওন বেচে আছে। চারুলতা বলে শাওনকে নাকি তারপর খুন করা হয়েছিলো। এমনকি হামিদও নাকি বেঁচে নেই। এমনকি ও নিজেও নাকি বেচে নেই।
– হোয়াট? ও বেঁচে নেই মানে কি?
– জানি না স্যার।
– হয় মেয়েটা পাগল হয়ে গেছে নয়তো আমাদের পাগল বানানোর চেষ্টা করছে।
– আমার কিন্তু তা মনে হয়না স্যার।

★★★

রাত একটার সময় বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিলো হামিদ। নাহ, পালায়নি। সকলের সামনে দিয়েই হেটে গিয়েছিলো সে। চারুকেও বলেছিলো খুব শীঘ্রই সে চারুকে নিতে আসবে। হয়তো একসপ্তাহও লাগবেনা তার আগেই সে চলে আসবে। হামিদকে কিছুটা দূরে এগিয়ে দিতে গিয়েছিলো চারু। হামিদ অবশ্য তাকে বেশিদূর নিয়ে যায়নি। নদী অবধি আসার পরেই তাকে বাড়ি চলে যেতে বলেছিলো। নদী থেকে বাড়ির দুরত্ব সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিটের। কিন্তু চারু বাড়িতে ফিরে গেলো না। সে বসে রইলো নদীর পাড়ের সেই গাছের নীচে। এত রাতে কখনোই আগে সে নদীর পাড়ে আসার সাহস করেনি কিন্তু আজ তার ভয় হচ্ছেনা। মনে হচ্ছে তার কিছু হারানোর নেই। এমনকি তার জীবনের মায়াটাও নেই আর যখন কোনো মানুষের জীবনের মায়া থাকেনা সে আর কোনো কিছুতেই ভয় পায়না। তখন তার দ্বারা অসাধ্য সাধন করাও সম্ভব। চারু জানে আজকের পর থেকে যতদিন না পর্যন্ত হামিদ ফিরে আসে ততদিন পর্যন্ত তার জীবন হবে নরকযন্ত্রণার চেয়েও কঠিন কিন্তু তার কিছুই করার নেই। ভয় লাগছেনা, কান্না পাচ্ছেনা, নিজেকে কেমন যেনো অনুভূতিহীন লাগছে তার কাছে। ঠিক এমন সময় তার পাশে এসে বসে পড়লো শাওন। চারু দেখেও না দেখার ভান করে রইলো। এত রাতে শাওনের এখানে আসার প্রশ্নই উঠেনা। হয়তো সে ভুল দেখছে নইলে শাওনের রুপে কোনো ভুত তার সাথে বসে রয়েছে কিন্তু তার পরেও চারুর উঠতে ইচ্ছে করছেনা। বিন্দুমাত্র ভয়ও লাগছেনা। ভুতপ্রেত যাই হোক, শাওনের চেহারাকে ভয় পাওয়ার কি আছে? ইশ! কি মায়াবী চেহারা। ভুত যদি এমন মায়াবী চেহারার হয় তাহলে তাকে ভয় পেতে হবে কেনো?
– হামিদ কই গেলো চারু?
– তোমার তো জানার কথা। তুমি ভুত মানুষ তুমি তো জানবেই।
– ভুত মানুষ মানে? আমারে তোর ভুত মনে হয়? আমার চেহারা কি ভুতের মতন? আর ভুত মানুষ আবার কি? হয় ভূত নয় মানুষ।
– নাহ, তোমার চেহারা ভুতের মতো হবে কেনো? তোমার চেহারা খুবই মায়াবী।
– তোর চেয়ে বেশি না। তুই আমার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর আর মায়াবী।
– তুমি কি সত্যিই এসেছো শাওন ভাই? নাকি আমার কল্পনা?
– কল্পনা হইবো ক্যান? জলজ্যান্ত আমি বইসা রইছি। বিশ্বাস না হলে ছুইয়া দেখ।
শাওন নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো কিন্তু চারুর ছোয়ার ইচ্ছে হলো না। শুয়ে দিলেই যদি শাওন হারিয়ে যায়।
– এত রাতে এখানে কি করতে এসেছো?
– ভাইজান কি যেনো একটা পাঠাইছিলো আমার জন্য। সেইটাই নিতে বাস স্টেশনে গেছিলাম। আসার সময় নদীর পাড়ে তোরে আর হামিদরে দেখলাম।
– এতো রাতে এসে কি দিয়ে গেলো তোমাকে? সকালে দিলেই তো হতো।
– সকালে দিলে কি আর এহন তোরে পাইতাম? তোর কি মন খারাপ চারু?
– নাহ, মন খারাপ হবে কেনো?
– এইযে, হামিদ চইলা গেলো আর তুই এখানে আইসা বইসা রইছস।
চারু কিছু না বলে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। শাওনকে বোধহয় সব বলা উচিত কিন্তু চারু বলতে পারছেনা। কেনো যেনো মনে হয় শাওন তার সমস্যাগুলোর যথাযথ মানে বুঝবেনা। তার এখনো চারুর কষ্ট অনুধাবন করার ক্ষমতা হয়নি। সে শুধু জানে চারুকে পাগলের মতো ভালোবাসতে। ভালোবাসা ছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই। সে চারুর কষ্ট দেখেনা, দুঃখ বোঝেনা তাকে শান্তনাও দেয়না। সে কোনোভাবে চারুর ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত নয়। সে শুধু অসীম ভালোবাসা দিয়ে যায়। চারু খুব করে চায় শাওন তার কষ্টগুলো বুঝে ওকে আগলে রাখুক কিন্তু শাওন সেটা কখনোই করেনা। তার ভালোবাসার প্রতিটা বাক্যে থাকে চারুর সৌন্দর্যের প্রসংসা। ভালোবাসা কেনো সে সৌন্দর্য দিয়ে প্রকাশ করবে? একটু সুখ দুঃখের ভাগীদার হয়ে কি বলা যায় না, চারু যাই হয়ে যাক আমি সারাজীবন তোমার পাশে আছি।
এই মূহুর্তে চারুর মনে হলো এখানে শাওন না থেকে শিহাব থাকলেই বোধহয় ভালো হতো। শিহাব চারুর কষ্টগুলো বোঝে, তাকে নিয়ে চিন্তিত সবসময় তার ভালোটাই শিহাব চায়। ভালো উপদেশ দেয়। এমনকি চারুর মাঝেমাঝে মনে হয় শিহাব তার ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তিত। শিহাবের কোনো কথায় চারুর সৌন্দর্যের প্রসংসা ফুটে ওঠেনা। তার প্রতিটি বাক্যে চারুর মন শান্ত হয়ে আসে। শিহাব তাকে বুঝতে পারে। তার মতামত সুন্দর ভাবে গ্রহণ করে। তার চিন্তাভাবনায় শাওনের মতো বাচ্চামো নেই। সে সবসময় আবেগ পরিহার করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এখানে শাওনের জায়গায় যদি শিহাব থাকতো তাহলে নিশ্চয়ই চারুকে জিজ্ঞেস করতো না মন খারাপ কি না উল্টো চারুর মন ভালো করার চেষ্টা করতো। আচ্ছা শাওন কি শিহাবের মতো হতে পারেনা? কিংবা এখন ওকে এখানে শান্তনা দেওয়ার জন্য শিহাব থাকতো!
চারু নিজের চিন্তাভাবনার কথা মনে করেই চমকে উঠলো। ছিহ! এইসব কি ভাবছে ও? এই মাঝরাতে কি না ও চাইছে ওর পাশে শিহাব বসে থাকুক? শাওনকে তার প্রাপ্তবয়স্ক মনে হচ্ছেনা। হ্যাঁ এইটা ঠিক শিহাব ওকে ভালোভাবে বুঝতে পারে তারজন্য সে কখনোই চাইতে পারেনা এই মাঝরাতে শিহাব তার সাথে থাকুক। সে শাওনকে ভালোবাসে। শাওনেরই উচিত তার পাশে থাকা। তাকে মানষিক প্রশান্তি দেওয়ার কাজ শাওনের। সে কাজ শিহাব কেনো করতে যাবে? তবে কেনো সে মানষিক প্রশান্তির জন্য শিহাবকে খুজছে? সে তো শাওনকে ভালোবাসে তাহলে শিহাবের প্রতি এ তার কেমন অনুভূতি?

বিঃদ্রঃ গল্পটা একদিন পর পর দেওয়া হয়। তাছাড়া এমনিতেও পড়াশুনা চালু হয়ে গেছে এখন প্রতিদিন গল্প দেওয়া সম্ভব না। হ্যাপি রিডিং।

#স্নেহা_ইসলাম_প্রিয়া

(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষেধ)

To Be Continued….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here