#এমনও_প্রেম_হয়
#লেখা__ইয়ানা_রহমান
#পর্ব:-৩
আমি খুব খুশি মনে নাফিসার বাসা থেকে ফিরলাম।
ফ্রেশ হয়ে পড়তে বসলাম।
আজ আমার পড়ায় নতুন গতি এসেছে।
খুশির নতুন মাত্রা যোগ হইছে। সব কিছুই ভালো লাগছে।
তিন ঘণ্টা টানা পড়লাম এর মাঝে একবারও টেবিল থেকে উঠিনি।
মা এসে অনেকগুলি ফ্রেঞ্চ ফ্রাইস আর এক মগ কফি দিয়ে গেলো।
আমাকে জোড়ে সোরে পড়তে দেখে মা খুব খুশি হলো।
বললো এবার একটু ব্রেক নে। কফিটা খা । এনার্জি পাবি, ভালো লাগবে।
আমি ফ্রেঞ্চ ফ্রাই আর কফি খেয়ে আবার পড়ায় মনযোগ দিলাম।
অনেক রাত অব্দি পড়ে শেষে উঠে ডিনার খেয়ে রাতে শান্তির একটা ঘুম দিলাম।
ঘুমের মধ্যে জিয়ানকে নিয়ে অনেক মধুর একটা স্বপ্ন দেখলাম।
স্বপ্নে দেখলাম, আমি আর ও একটা লেকের ধারে পাশাপাশি বসে আছি,
আমি ওর কাঁধে মাথা রেখে হেলান দিয়ে বসে আছি। ও গিটার বাজিয়ে আমাকে গান শোনাচ্ছে।
“”আবার এলো যে সন্ধ্যা ,,
শুধু দুজনের ,,
চল না ঘুরে আসি
অজানাতে ,,
যেখানে নদী এসে
থেমে গেছে “”
সুখ স্বপ্নে বিভোর আমরা দুজন। এই সুন্দর স্বপ্নটা দেখতে দেখতে রাত পার হয়ে গেল ।
ঘুম ভেঙে গেল,
সুন্দর স্বপ্নটা আমার মনে শান্তির ছোয়া দিয়ে যাচ্ছিলো। আর স্বপ্নের আমেজটা ছেয়ে রইলো আমার সারা হৃদয় জুড়ে।
বিছানা থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে, ওযু করে এসে ফজরের নামাজ আদায় করে নেই।
তারপর নিজের হাতে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে পড়ার টেবিলে বসি।
চা খেয়ে একটানা পড়তে থাকি।
তারপর মা নাশতা রেডি করে আমাকে ডাক দিলে টেবিলে গিয়ে সবার সাথে বসে নাশতা খেয়ে এসে আবার পড়তে বসে পড়লাম।
এখন প্রায় সারাদিন ই
পড়ার টেবিলে থাকি।
ও আমাকে যা যা করতে বলছে আমি সেই কথাগুলি মন থেকে মানার ও রাখার চেষ্টা করি।
মাঝে মাঝে জিয়ানের সাথে কথা হয়। আগের মত রোজ কথা হয় না।
জিয়ান রোজ কথা বলতে নিষেধ করেছে। বলেছে ভালোভাবে পরীক্ষা দাও তারপর আমরা চুটিয়ে প্রেম করবো।
আমি মাঝে মাঝে অস্থির হয়ে ওকে ফোন দিয়ে ফেলি।
আমি ফোন দিলে ও কেটে দিয়ে কল ব্যাক করে।
বলে, আমার বাঘিনীর কি খবর!
এখন আমার বাঘিনীকে কাছে পেতে খুব ইচ্ছে করেছ। আদর করতে ইচ্ছে করেছ। আর আদর পেতেও ইচ্ছে করছে।
আমি বললাম আমারও একই অবস্থা। আপনাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
আপনাকে খুব কাছে পেতে ইচ্ছে করছে।
খুব অস্থির লাগছে ।
জিয়ান বললো, কোন সুযোগ নেই দেখা করার।
সুযোগ থাকলেও
আমি সুযোগ নিতাম না।
আমি কখনোই সেলফিস টাইপের না।
তোমার ক্ষতি হবে এমন কিছু আমি কখনোই করবো না ।
সব আদরগুলি জমা করে রাখছি, সময় হলে দিবো।
কদিন বাদেই তোমার পরীক্ষা।
এখন তুমি শুধুই কনসেন্ট্রেশন করবে পড়ায় আর কোন কিছুতে না। তোমার রেজাল্ট হতে হবে
এক্সিলেন্ট।
তোমার ভালো রেজাল্টের খবরে সবচেয়ে বেশি খুশি হবো আমি।
আমি আপনাকে খুব ভালোবাসি জিয়ান।
আপনি আমাকে ভুলে যাবেন নাতো ?
প্রশ্নই আসে না_
আমিও তোমাকে খুব ভালোবাসি। এতদিনে এই চিনলে আমাকে! তুমি পড়ালেখা শেষ করো,
আর আমিও পড়ালেখা শেষ করি তারপর
যে কোনভাবেই আমি তোমাকে আপন করে নিব। কিছুতেই আমি তোমাকে হারাতে চাই না। তোমাকে হারাতে দিবো না।
তোমাকে হারালে আমি নিজেও বাঁচবো না।
আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমার হরিণী আমার জান।
তুমি আমার প্রতি কোন অবিশ্বাস মনের মধ্যে স্থান দিবে না।
পারিবারিক ভাবেই আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই।
তা যদি না পারি তবে পালিয়ে যাবো তোমায় নিয়ে।
তবুও আমার তোমাকেই চাই। যে কোন মূল্যে আমি তোমাকে চাই।
তুমি আগে পড়াশুনাটা ভালোভাবে শেষ করো। তারপর আরো দুচারটা কথা বলে দুজন দুজনের থেকে বিদায় নিয়ে ফোন রাখলাম।
আগের মত এখন আর কথা হয় না ।
সপ্তাহে একদিন কি দুই দিন ওর সাথে কথা হয়,, তাও খুব কম সময়। ও নিজেও খুব ব্যাস্ত থাকে।
স্কলারশিপ নিয়ে দেশের বাইরে পড়তে যাবে , সেই জন্য খুব ব্যস্ত থাকে।
এভাবেই চলতে থাকলো আমার পরীক্ষার আগের দিন গুলি।
পরীক্ষার আগের দিন ওর সাথে অল্পক্ষণ কথা হলো ।
বললো ঠিক মত যেন পরীক্ষা দেই।
আর এই কয়েকদিন আমি যেন ফোন না দেই।
আমি এই কথা শুনে রেগে যাই।
ও হেসে দিয়ে বলে ,
ওরে পাগলী আমি তোমার ভালোর জন্যই বলেছি।
যাতে তুমি পড়াশুনায় কনসেন্ট্রেশন করতে পারো। তোমাকে ঠিকমত পড়াশুনা করতে হবে।
নিজেকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যাতে আমাদের দিকে কেউ আঙ্গুল তুলতে না পারে।
কেউ যেন বলতে না পারে ভালোবাসার কারণে আমরা গোল্লায় গেছি।
নষ্ট হয়ে গেছে আমাদের জীবন।
আমরা আমাদের ভালোবাসাকে অপমান করবো না। কারো কাছে
অপমানিত হতেও দিবো না।
আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
আমরা দুজন কেউ কাউকে ঠকাবো না ।
ধোঁকা দিব না।
আমি চিরদিন তোমার থাকব। তুমি শুধু ঠিকমত পড়াশুনাটা চালিয়ে যাও।
আজ থেকে আমার এসএসসি পরীক্ষা শুরু।
মা আমার সাথে গেল পরীক্ষার সেন্টারে। অনেক লোকের ভিড় সেখানে। সবাই যার যার
গার্জিয়ানের সাথে দাড়িয়ে আছে। সময় হলে গেট খুলে দিবে। তখন আমরা ভিতরে ঢুকবো।
আমার প্রিপারেশন খুব ভালো ছিল।
তাই মনটা খুব ফুরফুরে লাগছে।
ওদিকে মনটা খুব চাইছে একবার জিয়ানকে দেখতে । কিন্তু সেটা কোনভাবেই সম্ভব না। ওকে এখানে কোথায় পাবো ?
ভাবতে দেরি কিন্তু সত্যি হতে দেরি হলো না।
একটু দূরে ভিড়ের মাঝে জিয়ান দাড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে আছে।
হঠাৎ মনটা খুশিতে লাফিয়ে উঠলো।
এযে মেঘ না চাইতেই জল।
জিয়ানকে দেখে আমি খুব খুশি হলাম।
মনের খুশির ষোল কলা পূর্ণ হলো।
লোক চক্ষুর আড়ালে একটা ছোট্ট ফ্লাইং কিস করলো। তারপর
ইশারায় গুড লাক উইশ করে সেখান থেকে চলে গেলো।
আমিও পরীক্ষার হলে ঢুকে গেলাম।
এক এক করে আমার সব পরীক্ষা প্রায় শেষ। শুধু একটা পরীক্ষা বাকি।
পরীক্ষা চলা কালীন জিয়ানের সাথে আর কথা হয়নি।
লাস্ট পরীক্ষার দিন সকালে ওকে পরীক্ষার হলের সামনে দেখলাম।
অনেকদিন পর ওকে দেখলাম।
ওকে দেখে খুব খুশি হলাম।
ও ইশারায় কাছে ডাকলো।
খুব কৌশলে আর সাবধানতা অবলম্বন করে ওর কাছে গেলাম।
ও বললো, পরীক্ষা শেষ হলে আমাকে একটু সময় দিও। আমি এখানেই থাকবো।
বলে চলে গেলো।
আমি হলে ঢুকে পড়লাম।
পরীক্ষা ভালোভাবেই শেষ হলো।
আজ পরীক্ষা শেষ হয়ে গেলো তাই সবাই সবার সাথে গল্প করতে ব্যস্ত।
কিন্তু আমার গল্পে মন নেই। পরীক্ষার হল থেকে বাইরে বেরিয়ে আসতে আসতে ভাবছি,
বাইরে মা দাড়িয়ে আছে।
আবার জিয়ানও দাড়িয়ে আছে।
কিভাবে ওর সাথে কথা বলবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
মাকে কিভাবে ম্যানেজ করবো? কি বলবো তাকে?
আমি নিজেও জিয়ানের সাথে কথা বলার জন্য ব্যাকুল হয়ে আছি।
নানান চিন্তা করতে করতে গেট দিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম।
বাইরে আম্মুকে কোথাও দেখছি না ।
আম্মুকে ফোন দিলাম_
আম্মু তুমি কোথায়?
আম্মু বলল_
তুই হলে ঢোকার পর আমি বাসায় চলে এসেছি। হঠাৎ তোর দাদুর অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেছে।
তোর আব্বু ফোন দিছিল তাই আমি চলে আসছি।
তুই একটা রিক্সা নিয়ে চলে আয়।
আমি আম্মুর চিন্তা হতে মুক্ত হতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম।
আশেপাশে জিয়ানকে খুঁজতে লাগলাম।
দেখলাম একটু দূরেই ওকে দেখা যাচ্ছে। একটা গাড়ীতে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে আছে।
আমি ওর দিকে এগিয়ে গেলাম।
ওর দুহাতে আমার হাত রাখলাম।
জিজ্ঞেস করলো, কেউ নিতে আসেনি এখনও?
মা সকালে পৌঁছে দিয়ে বাসায় চলে গেছে। এখন ফোন করে বলেছে একাই বাসায় চলে যেতে। হঠাৎ দাদু খুব অসুস্থ হয়ে পড়েছে।
পরীক্ষা কেমন হলো?
আমি বললাম, সবগুলি পরীক্ষা খুব ভালো হইছে।
এখন বলেন আপনি কেমন আছেন ?
আমি ভালো আছি ।
আর তুমি কেমন আছো?
আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
এই কদিনে আমাকে ভুলে যাননি তো আবার!
ভুলে গেলে আজ আসলাম কিভাবে?
চলো কোথাও বসি ।
আচ্ছা চলেন।
আমরা গিয়ে একটা ফাস্টফুডের দোকানে বসলাম।
জিয়ান আমার জন্য একটা বার্গার একটা পেস্ট্রি আর জুস অর্ডার করলো ।
নিজের জন্য নিল শুধু জুস।
আমি খেতে চাচ্ছিলাম না।
বললাম, আমাকে তাড়াতাড়ি যেতে হবে।
দাদু ভীষণ অসুস্থ।
কি হয়েছে তোমার দাদুর?
দাদু অনেকদিন ধরেই অসুস্থ,
এখন একটু বেশি অসুস্থ্য থাকে।
তাহলে তোমাকে আর বেশিক্ষণ আটকে রাখবো না ।
জিয়ান নিজ হাতে আমাকে খাইয়ে দিল।
বললো, শোন যে জন্য ডেকেছি,
তুমি তো জানো আমি স্কলারশিপের জন্য চেষ্টা করছিলাম।
আমার স্কলারশিপ হয়ে গেছে।
আমি কানাডার লাসেল ইউনিভার্সিটিতে পড়তে যাচ্ছি।
স্কলারশিপ আরও আগেই হাতে পেয়েছি,
তোমার পরীক্ষা চলছিল তাই তোমাকে বলিনি।
আমি কাল চলে যাচ্ছি। রাত এগারোটায় আমার ফ্লাইট।
শুনে আমি কেদে ফেললাম_
আমি কি আপনাকে হারিয়ে ফেলেছি !!
কি বলছো এইসব
আবোল তাবোল?
আমরা কেউ কখনো কারো কাছ থেকে হারাবো না।
আমরা এখন যেমন আছি তেমনই থাকবো। ফোনে কথা বলবো অনেক সময় ধরে। আর ভিডিও কল ও দিবো।
তুমি কোন চিন্তা করবে না। আর ঠিকমত পড়াশুনা করবে।
আর বাকি সব কাজ এখন যেমন চলছে তেমনি চলবে।
আমার শরীর কেমন যেনো অবশ হয়ে আসছে। আমি উঠতে পারছি না। গায়ে মোটেও শক্তি পাচ্ছি না।
জিয়ান বললো, তুমি এমন করো না।
আমার খুব খারাপ লাগছে। এভাবে ভেঙে পরো না।
আমি তোমারই থাকবো সারাজীবন।
আমি তোমার কাছে কিছুই গোপন করিনি। যেদিন স্কলারশিপের জন্য অ্যাপ্লাই করেছিলাম, সেইদিনই তোমাকে জানিয়েছি।
এটা তো হুট করে কিছু হয়নি।
ও আমার হাত ধরে সান্তনা দিতে থাকে ।
আমি কাদতেও ভুলে গেলাম।
কেন জানি মনে হচ্ছিল আমি জিয়ানকে হারিয়ে ফেলেছি।
জিয়ান বললো, চলো তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।
কাদতে কাদতে খুব কষ্ট করে বললাম,
না আপনাকে যেতে হবে না,
আমি একাই যেতে পারবো।
তাহলে চলো রিক্সায় তুলে দেই।
রিক্সায় উঠলাম বাসায় যাওয়ার জন্য।
রিক্সার পিছনের ফাঁকা জায়গা দিয়ে বারবার ওর দিকে ফিরে তাকালাম।
কষ্টে আমার ভিতরটা ভেঙ্গেচুরে তছনছ হয়ে যাচ্ছে।
দেখলাম জিয়ানও কাদঁছে। ওর দুই চোখে পানি গড়িয়ে পড়ছে। ও হাত নেড়ে বাই জানাচ্ছে।
রিক্সা ছুটে চলেছে, যতদূর দেখা যায় আমি পিছন ফিরে জিয়ানকে দেখতে লাগলাম।
সারা রাস্তা আমি কাদলাম। এক অসহ্য যন্ত্রণা আমাকে কাবু করে ফেলছে। আমি কিছু ভাবতে পারছি না। হাত পা কেমন যেনো অসাড় হয়ে আসছে। মনে হচ্ছে আমি জ্ঞান হারাবো।
(চলবে)
(বানানের ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন )