#এমনও_প্রেম_হয়
#ইয়ানা_রহমান
#পর্ব:-৫
জিয়ানের সাথে কথা হয়ে এখন মনটা একটু ভালো লাগছে।
যদিও ফোন করেছে দশ দিন পর।
তবুও ওর ভয়েস্, ওর মুখের কথা শুনে ভালো লাগছে, মনটা খুব হালকা লাগছে।
ভালোবাসা কি জিনিস তাই না,
যাকে কখনো
চিনতাম না জানতাম না তার জন্যই মন সারাক্ষণ পুড়ে খাক হয়।
আমরা যাকে ভালোবাসি শুধু তার কথাই সারাক্ষণ ভাবি, তাকে ঘিরেই আমাদের একটা দুনিয়া তৈরি হয়।
সেই দুনিয়ার বাইরে যেতে ইচ্ছে করে না ।
শুধু তাকে নিয়েই সুখ স্বপ্নে বিভোর থাকতে ভালো লাগে।
তার একটুখানি অবহেলায় হৃদয় ভেঙে খান খান হয়ে যায়, চোখের লোনা পানিতে বন্যা বয়ে যায়।
আবার কখনো ভালোবাসার মানুষের অবহেলায় অনেক প্রাণ ঝরেও যায় ।
অকালে তারা প্রাণ হারায় । অবুঝ সে ভালোবাসাগুলো।
আবার ভালোবাসার মানুষের একটু অ্যাটেনশনে মনে খুশির দোলা দিয়ে যায়, দেহে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। তখন চারিদিকে যা দেখি সব ভালো লাগে। মনের ভিতরে বসন্ত উৎসব শুরু হয়। মনের ভিতর নানান রঙের রঙিন ফুল ফোটে। সুরভিত হয় আত্মা।
কেমন না এই ভালোবাসা নামক জিনিসটা।
যেমন আমি সারাক্ষণ জিয়ানের চিন্তায় অস্থির থাকি, ওর ভালো বাসায় বিভোর থাকি।
সারাক্ষণ মোবাইল হাতে নিয়ে থাকি,
কখন জানি ওর ফোন আসে এই ভাবনায়।
অথচ জিয়ানের সাথে সম্পর্ক হওয়ার আগে, কোথায় মোবাইল ফোন থাকতো আর কোথায় আমি।
কোনও কল আসলে বুয়া খালা ডেকে বলতো আপনের ফোন বাজতাছে, তখন গিয়ে কল রিসিভ করতাম। কখনও কখনও ফোনের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে যেত খবর ও থাকতো না।
আর এখন এক মিনিটের জন্যও ফোনটা হাত ছাড়া করিনা ।
পারলে গলার চেইনের লকেট বানিয়ে ঝুলিয়ে রাখতাম মোবাইলটাকে।
কেমন হয়ে গেছি আমি।
সারাক্ষণ ঘরেই থাকি।
এঘর ওঘরেও যাই না। ভালো লাগে না কোথাও।
কোথায় আগের সেই আমি।
সেই হাস্যোজ্জ্বল আমিটাকে আর খুঁজে পাই না।
কোথাও বেরাতে যাই না, বান্ধবীদের সাথে আড্ডাও দেই না।
শপিংএ যাই না। এমনকি ঘরে বসে মুভিও দেখি না।
এই আমি সেই আমি নেই।
আমার আমূল পরিবর্তন হইছে।
আমার দাদুর শরীর ক্রমশই খারাপের দিকে যাচ্ছে। কদিন ভালো থাকে আবার হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়ছে তখন হসপিটালে এডমিট করতে হচ্ছে।
এখন তার শেষ ইচ্ছে আমার বিয়ে দেখবেন।
আব্বু আম্মু দুজনই দাদুকে অনেক করে বুঝালো।
লিয়া এখনও অনেক ছোট, ওর এখনও বিয়ের বয়স হয়নি। ওকে আরো পড়াশুনা করাবে।
কিন্তু দাদু শুনতে নারাজ। অনেক আগেই নাকি উনার কোন আত্মীয়কে কথা দিছিল তার নাতির সাথে আমায় বিয়ে দিবেন।
দাদু বললো,
ছেলের স্বভাব চরিত্র ভালো, উচ্চ শিক্ষিত ছেলে, দেখতে ভালো, বংশ ভালো, ওয়েল স্টাবলিস্ট।
ওরা বিয়ের পর বৌকে পড়াবে এতে ওদের কোন আপত্তি নেই।
তোমরা যদি এখন আমার কথার অবাধ্য হও তবে আমার ওয়াদা বরখেলাপি হয়েই দুনিয়া ত্যাগ করতে হবে।
দাদু যার ফ্যামিলির কথা বলছে আব্বু তাদের চিনে, তারা সব দিক থেকে মানান সই।
কিন্তু লিয়া যে মাত্র ষোল বছরের বাচ্চা মেয়ে। দ্বিধায় পড়ে গেলো সে।
আব্বু আর কিছু বললো না। কি বলবে ভেবে পাচ্ছে না। একদিকে মেয়ের বয়স কম, অন্য দিকে বাবার করা ওয়াদা।
আম্মু দাদুকে অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলো। কিছুই হলো না। ফলাফল দাড়ালো
দাদু খাওয়া দাওয়া,
মেডিসিন নেয়া একদম ছেড়ে দিলেন।
দাদুর অসুস্থতা আরও বেড়ে গেল।
এই অবস্থায় আম্মু আব্বুর আর কিছুই করার থাকলো না।
পাত্রপক্ষ নাকি আমাকে আগেই দেখেছে কোনও একটা বিয়ের অনুষ্ঠানে। তাই নতুন করে দেখার কোন ফর্মালিটি তারা করতে চায় না।
একেবারেই এনগেজমেন্ট করবে বলে ডেট ফিক্স করে।
আমি এসবের কিছুই জানি না।
আম্মু খালি কাদে, আমি দেখি আম্মুর চোখে পানি। সারাদিন মন খারাপ করে থাকে।
জিজ্ঞেস করলে কিছু বলে না।
আমি ভাবলাম আব্বুর সাথে হয়তো কথা কাটা কাটি হইছে।
তাই আমিও জোর করে কিছু জিজ্ঞেস করিনি।
একদিন আম্মু বললো বিকালে কিছু মেহমান আসবে তারা এখানে রাতে ডিনারে করবে।
আমি যেনো আমার ঘর সুন্দর করে গুছিয়ে রাখি আর আমিও যেনো ওয়েল ড্রেসআপ থাকি।
আমি কিছুই বুঝলাম না।
আমিতো সব সময় মোটামুটি ভালো কাপড় চোপড়ই পড়ি।
আমাকে স্পেশাল ড্রেসআপ করতে হবে কেন।
আর ঘর গুছানোর কি হলো!
মেহমান আসবে বসার ঘরে বসবে, ডাইনিং টেবিলে বসে খাবে। এইতো,
কিন্তু আম্মু এগুলি কেন বললো কিছুই বুঝলাম না।
আম্মুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলে আম্মু বললো, তোকে যা বলছি তাই কর। যা সময় বেশি নেই, গেস্ট চলে আসবে কিছুক্ষণ পর।
আমি আমার ঘর মোটামুটি সুন্দর করে গুছালাম,
বেডশিট চেঞ্জ করলাম,পর্দা চেঞ্জ করলাম, বাগান থেকে ফুল এনে ফুলদানি সাজালাম ।
তারপর আমি গোসল করে কাপড় পরে রেডি হলাম।
দেখলাম আমার ভাইবোনও রেডি।
আমি এখনও কিছুই বুঝতে পারছিনা কি এমন মেহমান, আর কারা তারা যাদের জন্য এই সাজ সাজ রব।
স্পেশাল রান্নার আয়োজন।
শোকেস থেকে সবচেয়ে দামি ডিনার সেট নামানো হইছে।
টেবিল ম্যাট থেকে শুরু করে কাটা চামচ পর্যন্ত সব স্পেশাল।
সন্ধ্যার একটু আগে গেস্ট চলে এসেছে। অনেক মানুষ, মহিলা পুরুষ বাচ্চা।
আব্বু তাদের বসতে দিয়ে গল্প করছে তাদের সাথে ।
আমার চাচা ফুফু খালা মামা সবাইকেই বলা হয়েছে।
আম্মু বললো,
তোকে না ডাকা পর্যন্ত ঘর থেকে বের হবি না।
আমার আরেকবার অবাক হবার পালা ।
মেহমানের সাথে দেখা না করলে তারা ভাববে না যে, আমরা অভদ্র আনকালচার্ড!
না ভাববে না,তুই ঘরেই থাক।
সময়মত আমি ডাকবো।
আমাকে কিছুই বলছো না কেন, কি হইছে,
সব খুলে বলো আমাকে।
একটু পর সব বলবো, এখন ঘরে বসে থাক।
মেহমানদের নাস্তার পর্ব শেষ।
আম্মু আমার খালাকে বললো মেকাপে আবার রিটাচ দিতে।
গলায়, হাতে, কানে সিম্পল অর্নামেন্টস পরিয়ে দিলো ফুপু বললো,
চল বসার ঘরে নিয়ে যাই তোকে।
মেহমানদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই।
ঘরে ঢুকে সবাইকে সালাম দিবি বুঝলি ।
আমাকে মেহমানদের সামনে নিয়ে যাওয়া হলো । আমি সবার উদ্দেশ্যে সালাম দিলাম।
কেউ ইশারায় আবার কেউ জোড়ে সালামের জবাব দিলো।
আমাকে একটা সোফায় বসালো।
দেখলাম অনেক লোক। কম করে হলেও আঠারো বিশ জন হবে।
একটু অবাক হলাম। একসাথে এত লোক কারো বাসায় যায়!!
কিছুক্ষণের মধ্যে আমার কাছে সব পরিষ্কার হয়ে গেল । আমার মাথা ভো ভো করে ঘুরছে। জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ছি। কি করবো ভেবে পাচ্ছিলাম না।
আমি বসতেও পারছি না, আমি উঠতেও পারছিনা । অতিরিক্ত টেনশনে আমার কেমন যেনো গা গুলাচ্ছে, বমি বমি লাগছে। চোখে অন্ধকার দেখছি।
ছেলের মা আমার পাশে বসে আমার হাত ধরে রেখেছে।
আমার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে। যেনো ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবো।
উনি বসে সবার সাথে গল্প করে যাচ্ছে।
আমি রীতিমত কাপছি।
ছেলের মা হেসে দিয়ে বললো তুমি কাপছ কেন, ভয় লাগছে তোমার, ভয়ের কিছুই নেই, এইদিন সব মেয়ের জীবনে আসে,
এই কথা বলে আম্মুকে আমার পাশে বসালো।
বললো, আপা আপনি পাশে বসেন, তাহলে ওর ভয় কিছুটা কমবে।
একপাশে আম্মু এক পাশে পাত্রের মা আর মাঝে আমি।
আমার সেখান থেকে উঠে যাবার কোন উপায় নেই।
আমি মাথা নিচু করে বসে কেদে ফেললাম।
নিঃশব্দে কেদে চলেছি, চোখের পানিগুলি গাল বেয়ে টপটপ করে পড়ছে হাতের ওপরে।
কিছুই ভাবতে পারছিনা।
আমি জিয়ানের কাছে প্রমিজ করেছি,
আমি জিয়ানের আর কারো না।
আমি শুধু জিয়ানকে
ভালোবাসি। আর কাউকেই না।
জিয়ান আমার জীবন।
জিয়ান আমার সব।
এইসব ভাবছি আর কেদে চলেছি।
পাত্রের মা হেসে দিয়ে বললো কেদো না মা, আমরা আজকে তোমাকে নিয়ে যাবো না।
শুধু আমার ছেলের জন্য তোমাকে পুত্রবধূ হিসেবে এনগেজড করে যাবো।
এই কথা শুনার পর সবাই একসাথে হেসে উঠলো।
কোনটা পাত্র, কোনটা ভাই বোন, কোনটা বাবা মা আমি কিছুই দেখিনি।
শুধুই নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আর নিশ্চুপ চোখের জলে ভেসে আমার ভাগ্যের বদলে বদলে যাওয়া দেখতেছিলাম।
এবার আমাকে আংটি পরানোর পালা।
আম্মু আমার পাশ থেকে উঠে অন্য আরেকটি চেয়ারে বসলো।
আম্মুর জায়গায় পাত্রকে বসানো হলো।
পাত্রের নাম উদয় ।
উদয়ের মা ওর হাতে আংটি দিয়ে বললো,
উদয় নে আংটি পড়িয়ে দে আমার বৌমাকে।
উদয় আমার হাতে আংটি পড়িয়ে দিলো।
মুহূর্তেই আমি হয়ে গেলাম অন্য কারো ।
আমার এতো কষ্ট হচ্ছিল যে মন চাচ্ছে কোথাও পালিয়ে যাই। নাহলে মরে যাই।
আমার জন্য আর কোন পথ খোলা নেই।
জিয়ান আপনি কোথায়!?
(বানানের ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন)
(চলবে)