#এমনও_প্রেম_হয়
#ইয়ানা_রহমান
#পর্ব:-২৯
উদয় খুব জ্বর নিয়ে বাসায় ফিরলো। সাথে প্রচণ্ড মাথা ব্যাথা আর পেট ব্যাথাও আছে।
.
বমি হচ্ছে বারবার। পেটে ব্যাথা আছে ঠিকই কিন্তু পেটের কোন অংশে ব্যাথা সেটা বুঝতে পারছে না।
.
একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখানো হলো।
ডাক্তার রোগীর হিস্ট্রি শুনে অনেক রকম টেস্ট করানোর জন্য লিখে দিলেন।
.
জ্বর, মাথা ব্যাথা, বমি পেট ব্যাথা কমার জন্য সাধারণ ওষুধ লিখে দিলেন। তবে উল্লেখযোগ্য কোন ওষুধ দিলেন না। বললেন, টেস্টের রিপোর্ট দেখে তারপর ট্রিটমেন্ট শুরু করবেন।
.
জ্বর কিছুটা কমে আবার বেড়ে যায়। পেটে হাল্কা ব্যাথা আছে। বারবার বমি হচ্ছে। তবে আগের চেয়ে কম।
.
সবগুলি টেস্ট করানো হলো। টেস্টের রিপোর্ট পাওয়ার পর লিয়া আর উচ্ছাস উদয়কে নিয়ে ডক্টরের চেম্বারে গেলো। আয়ুশকে ওর দাদীর কাছে রেখে গেলো। কাদছিল খুব তবুও সাথে নেয়নি।
রিমিকেও বলে এলো আয়ুশকে যেনো একটু দেখে রাখে।
.
ডক্টর রিপোর্ট দেখে একটু চিন্তিত হলেন।
উদয়কে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি ড্রিংক করেন?
.
উদয় বললো, না আমি কখনোই ড্রিংক করিনি।
আপনার জন্ডিস হইছিল কবে?
.
উদয় বললো, অনেক আগে একবার জন্ডিস হয়েছিলো। তখন একটু জ্বর মাথা ব্যাথা, বমি হয়েছিলো। কিন্তু এমন সিরিয়াস কিছু হয়নি।
.
তখন ডাক্তারের পরামর্শ মত কিছু টেস্ট করেছি সাথে বিলুরুবিন টেস্টও করিয়েছিলাম।
.
ডক্টরের অ্যাডভাইস মত ট্রিটমেন্ট করিয়েছি। কিছুদিন পর শরীর সুস্থ হয়ে গেছে।
.
সুস্থ হবার পর আবার বিলুরুবিন টেস্ট করিয়েছি। রিপোর্টে দেখেছি বিলুরবিনের মাত্রা খুব কম। এতে বুঝে নিয়েছি জন্ডিস সেরে গেছে।
.
এর পর আর কখনো জন্ডিস হয়েছে বলে মনে পড়ে না।
.
ডক্টর বললো, সেই সময়কার জন্ডিস সম্পূর্ন ভালো হয়নি, আর সেটা আপনি বুঝতে পারেন নি হয়তো। অনেক সময় টেস্টের রিপোর্টও ভুল আসে।
.
এখনকার টেস্টের রিপোর্ট অনুযায়ী আপনার লিভারে সমস্যা আছে। আর সেই কারণে আপনার জ্বর আর বমি কমছে না।
.
হেপাটাইটিস বি আর সি ভাইরাস আছে কিনা দেখতে টেস্ট লিখে দিলেন। আর এন্ডোস্কোপি করতে বললেন।
.
আমরা একটু চিন্তিত হয়ে ডক্টরকে জিজ্ঞেস করলাম এই টেস্টগুলি কেন? আর এন্ডোস্কোপি কেনো?
আপনি কি আমার হাসবেন্ডের অসুখের কোন খারাপ দিক ইঙ্গিত করছেন?
.
ডক্টর বললো, তেমন কিছুই না তবে যদি হেপাটাইটিস বি অথবা সি ভাইরাস আক্রান্ত হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে ট্রিটমেন্টে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। বি আর সি ভাইরাস অ্যাটাক করলে লিভার খুব দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। আর এন্ডোস্কোপি করতে হবে আলসার আছে কিনা দেখার জন্য।
.
টেস্ট করিয়ে রিপোর্ট নিয়ে আবার ডক্টরের চেম্বারে গেলাম। এর আগে এন্ডোস্কোপিও করানো হলো। ডক্টর নিজের
হাতেই উদয়ের এন্ডোস্কোপি করলেন।
.
ডক্টর রিপোর্ট দেখে বললেন, পেশেন্টের হেপাটাইটিস বি/ সি কোন ভাইরাস নেই। এন্ডোস্কোপি রিপোর্টও ভালো।
.
কিছু মেডিসিন আর কিছু অ্যাডভাইস দিয়ে দিলেন।
.
ডক্টর উদয়কে সর ছাড়া দুধ, কুসুম বাদে ডিমের সাদা অংশ, মাছ খেতে বললেন।
যে কোন ফল, খাশি বা গরুর মাংস আর তেলে ভাজা খাবার খেতে একদম নিষেধ করে দিলেন। আরো বললেন যে সব খাবারে গ্যাস হয় সেগুলি এড়িয়ে চলবেন। ব্যাস তাহলেই হবে। কোন টেনশন করবেন না। আপনার তেমন কিছুই হয়নি। যেটুকু সমস্যা আছে সেটুকু সেরে যাবে যদি একটু নিয়ম মেনে চলেন।
.
কিছুদিন মধ্যেই উদয় সুস্থ হয়ে গেলো। আল্লাহর কাছে লাখো কোটি শোকরিয়া জানালাম।
.
রাতে ঘুমাতে গেলে উদয় বললো, তুমি খুব ঘাবড়ে গেছিলে তাই না? ভেবেছিলে আমি এবার বুঝি আর বাঁচবো না।
.
বাজে কথা কেনো বলেন ভালোবাসি তো। এসব কথা শুনলে খারাপ লাগে।
তবে মিথ্যে বলবো না সত্যিই আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম। কিছুতেই আমি আপনাকে হারাতে চাই না।
আপনার হাত ধরে অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে যেতে চাই। আপনার ভালোবাসা পেতে চাই। আপনাকে ভালোবাসতে চাই। আপনি নেই এই কথা আমি কল্পনাতেও ভাবতে পারি না। বলতে বলতে লিয়ার চোখ অশ্রু সজল হয়ে উঠলো।
.
উদয় পরম মমতায় লিয়ার চোখের পানি মুছে দিলো। কপালে গাঢ় চুমু দিলো। আমিও তোমার সাথেই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বেচেঁ থাকতে চাই।
আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই তোমার কোলে মাথা রেখে।
.
আমিও জীবনের বাকি দিনগুলি আপনার সাথে হেসে খেলে কাটাতে চাই। আপনার ভালোবাসায় সিক্ত হতে চাই। আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকতে চাই আপনার সাথে। কোনভাবেই আপনাকে ছাড়া আমি বাঁচতে চাই না।
.
আমার আয়ুশের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য আয়ুশের বাবা নামক বট গাছটার যে খুব দরকার।
আমার আয়ুশ আপনার হাত ধরেই জীবনের সামনের দিনগুলিতে গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে যাবে। পিতৃ স্নেহে বেড়ে উঠবে ধীরে ধীরে। ওর মানসিক বিকাশে পরিবারের আনন্দঘন পরিবেশ লাগবে। বাবা মা দাদা দাদু, চাচা ফুপু সবার আদরে বেড়ে উঠবে আমার আয়ুশ।
.
উদয় লিয়াকে বুকে টেনে নিলো। ভালোবেসে এক হয়ে পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিলো।
লিয়া উদয়ের বুকে বিড়ালের মত গুটিসুটি মেরে ওকে জড়িয়ে ধরে পড়ে রইলো।
উদয় ওর পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। এরপর ভালোবাসাবাসির সুখের রাজ্যে হারিয়ে গেলো ওরা।
.
রিমির বিয়ের ডেট এগিয়ে এলো। বাড়িতে সাজসাজ রব। অনেক কেনাকাটা করলো ননদ ভাবি মিলে। প্রায় প্রতিদিন শপিং করতো দুজনে। রিমির নিজের জন্য ওর বরের জন্য দোকানের সেরা জিনিসগুলি বেছে বেছে কিনে আনলো ওরা। বাসার সবার জন্য কেনাকাটা করলো।
.
খুব জমকালো আনন্দের মধ্য দিয়ে রিমির বিয়ে হয়ে গেলো।
বিয়ে শেষে রিমির বিদায় দিতে গিয়ে লিয়া খুব কাদলো। ও রিমিকে খুব ভালোবাসে, নিজের বোনের মত মনে করে। রিমি ছিলো ওর সুখ দুঃখের সাথী।
.
রিমি আপুর হাসবেন্ড ও তার ফ্যামিলি আমেরিকায় থাকে। সেখানে তাদের বিজনেস আছে। আপুকেও সাথে করে নিয়ে যাবে ওখানে।
.
আপু চলে গেলে একদম একা হয়ে যাবে সে। আপু চলে যাওয়ার পর গল্প করে সময় কাটানোরও কেউ থাকবে না। তাই লিয়ার খুব মন খারাপ। রিমি আপু আমেরিকায় চলে গেলে সহজে দেশে আসবে না। বাংলাদেশে হলে মাসে দুইমাসে হলেও একবার আসতো। এখনতো যাবে সেই সাত সমুদ্র তের নদীর ওই পারে। সেখান থেকে আসতে গেলে বছর পেরিয়ে যাবে অথবা তারও বেশি।
রিমিও খুব মমতায় আয়ুশকে লিয়াকে জড়িয়ে ধরে কাদলো। কেঁদে কেঁদে সবার কাছ থেকে বিদায় নিলো। উদয় আর লিয়া অশ্রুশিক্ত নয়নে রিমিকে গাড়িতে তুলে দিলো।
রিমি চললো স্বামীর বাড়ির পথে। পিছনে ফেলে গেলো সব আপনজনদের। স্বামীর বাড়ির নতুন মানুষগুলিই হবে এখন থেকে ওর আপনজন।
.
ওদিকে জিয়ান খুব মন খারাপের মধ্য দিয়ে দিনগুলি পাড় করছে।
.
পড়াশুনায় আগের মত মনোযোগ নেই। খাওয়া দাওয়াও ঠিকমত করে না। উদভ্রান্তের মত চলাফেরা করে।
উস্কু খুস্কু চুল, মলিন মুখ, উদাস দুটি চোখ, কোন কিছুতেই চঞ্চলতা নেই। খাবার না খেলেও বেশ কয়েকবার কফি খাওয়া হয়ে যায় টেনশন কাটাতে। যেটা সে বেশি মাত্রায় আগে কখনোই খেতো না।
.
ওর বন্ধুরা কি হয়েছে সেটা জানার অনেক চেষ্টা করছে কিন্তু জিয়ান কোন কথাই বলেনি কাউকে।
.
নিজের জীবনের ব্যর্থতার গল্প সে কাউকে শোনাতে চায় না। শুনিয়ে কি হবে তাতে কি কষ্ট কিছু কমবে? নাকি আমার হারানো ভালোবাসা ফিরে পাবো! তাহলে আর নিজের জীবনের অতি ব্যক্তিগত কথা অন্যদের সামনে তুলে ধরে নিজেকে হেয় করা কেন? অন্যের হাসির পাত্র হতে চায় না।
দুর্ভাগ্যকে মেনে নিয়ে কোন রকমে দিনগুলি পার করছে জিয়ান।
.
লিলিয়ান নামে একজন ব্রিটিশ তরুণী জিয়ানের সাথে একই ভার্সিটিতে পড়াশুনা করে। ওর এক বছর জুনিয়র। বন্ধুরা সবাই মেয়েটিকে লিলি বলে ডাকে।
.
লিলি বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। ওরা খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী। লিলির বাবা প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী।
.
লিলির বাবা মায়ের ডিভোর্স হয়ে গেছে সে যখন ছোট ছিল তখন।
স্বামী স্ত্রী দুজনের বনিবনা না হওয়াতে মিউচ্যুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং এর মাধ্যমে ডিভোর্স হয়ে যায়।
লিলিকে ওর বাবা নিজের কাছেই রেখে দিয়েছে। সে দ্বিতীয়বার আর বিয়ে করেনি।
লিলির মা অন্যত্র বিয়ে করে নিয়েছে।
তাই লিলি ওর মাকে দেখতে পারে না। লিলির ধারণা ওর মা ভীষন স্বার্থপর। ওকে ছোট বেলায় একা রেখে চলে গিয়ে নিজের সুখের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছে তাই ওর মায়ের সাথে আর কখনো দেখা করতেও যায়নি। লিলির বাবাই ওর দুনিয়া।
.
লিলি দেখতে বেশ সুন্দরী। টল ফিগার, নীল চোখ, ধনুকের মত বাকা ভ্রু যুগল, খাড়া সরু নাক, উচ্চতায় প্রায় জিয়ানের সমান। ঘাড় পর্যন্ত লেয়ার কাট দেয়া গোল্ডেন চুল। বেশ স্মার্ট সে। যে কোন পুরুষ লিলির প্রেমে পড়তে চাইবে, সে এতটাই গুড লুকিং।
.
জিয়ানের সাথে ওর কয়েকজন ফ্রেন্ডের খুব ভাব, তাদের মধ্যে লিলিয়ান একজন।
লিলি এক বছরের জুনিয়র হলেও জিয়ানের খুব ভালো ফ্রেন্ড সে।
.
লিলি জিয়ানকে খুব পছন্দ করে। মনে মনে ভালোও বাসে কিন্তু কখনো জিয়ানকে বলেনি নিজের মনের কথা।
মনে মনে ভাবে যদি মুখে বলি ভালোবাসি তখন যদি বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়! বন্ধুত্ব হারানোর ভয়ে আর বলা হয়ে উঠে না।
হয়তো কোনদিন জিয়ান ওর ভালোবাসা বুঝবে, নিজ থেকেই বলবে ভালোবাসি।
কিন্তু জিয়ান সে পথে হাঁটেনি কখনো। কারণ জিয়ানের একমাত্র ভালোবাসা লিয়া।
ওকে এখনও মন থেকে, মাথা থেকে দূরে সরাতে পারেনি। ভুলতে পারছে না কিছুতেই।
.
জিয়ানের মন খারাপ দেখে লিলিয়ানের খুব খারাপ লাগে। বারবার জিজ্ঞেস করেও মন খারাপের কারণ উদ্ধার করতে পারে নি। তাই সে একটু বেশি সময় জিয়ানের পাশেপাশেই থাকে যেনো ওর মন ভালো করতে পারে। মন খারাপের কারণ যাই হোক না কেন, একসময় অন্ধকার কেটে গিয়ে ঝলমলে আলোর দেখা পাবে। এই আশায় জিয়ানের আশেপাশেই থাকে।
.
লিলিয়ান জিয়ানের জন্য প্রতিদিন কোন না কোন খাবার রান্না করে নিয়ে আসে। ওকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে কিন্তু জিয়ানের খাওয়ার দিকে কোন মনোযোগ নেই। ও যেনো তিলে তিলে নিজেকে শেষ করে দিতে চাইছে।
.
জিয়ানের বন্ধুরা পড়াশুনা আর কাজের ফাঁকে সবসময় জিয়ানকে আগলে রাখে। ওকে সময় দেয়।ওর প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখে। আর রাখবেই বা না কেনো , জিয়ান ছেলেটাই যে সবার মনের মত। সে বন্ধুদের হাসি আনন্দে মাতিয়ে রাখে। সবার কষ্টে, বা মন খারাপের সময় পাশেই থাকে। কারো টাকার সমস্যা হলে টাকা দিয়ে হেল্প করে। সে বন্ধুদের সব রকম হেল্প করে শুধু রান্না করা ছাড়া। কারণ জিয়ান রান্নার কাজটা একেবারেই পারে না।
ইউটিউব দেখে মাঝে মাঝে ট্রাই করে কিন্তু সেটা কেনো জানি খাওয়ার যোগ্য হয় না। তাই বন্ধুরা ওর রান্না নিয়ে অনেক হাসি ঠাট্টা করে।
.
উইক এন্ড হলে সবাই প্ল্যান করে জিয়ানের মন ভালো করতে ওকে নিয়ে ঘুরতে যায়।
ঘুরতে গিয়ে বিপাকে পড়ে, প্রচণ্ড স্নো ফল শুরু হয়। কনকনে ঠান্ডায় জমে যাওয়ার অবস্থা।
(চলবে)