টিট ফর ট্যাট পর্ব-২১

0
3100

#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum
#পর্ব_২১

— সত্যিই আপনি এভাবে যাবেন?

নিচু কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম নীরবের দিকে। বাসার নিচে কাঠফাটা রোদের তেজের সাথে আমার প্রশ্ন যেন গুলিয়ে পৃথিবীর সমস্ত বিরক্তি তৈরি করলো। নীরবকে না চাইতেও গিলতে হলো সেই বিরক্তি। এবার উগলানোর সময়। সে দাঁতের সহায়তায় নিজের নিচের ঠোঁট চেপে ধরলো। কপালে এক ঝাঁক এলোমেলো চুল। মুখ পুরোটাই লালময়। চোখে ভাসা বিরক্ত নিয়ে সে বলল

— পাঁচ বার এই প্রশ্নটা করেছো তুমি। শোন? রাস্তার মানুষদের না অনেক কাজ আছে। তোমার স্বামীর দিকে তাকিয়ে থাকার মতো সময় তাদের নেই। এতো ঈর্ষা কইরো না। চুপচাপ দাড়িয়ে থাকো নয়তো চলে যাও। আমি আসতে বলিনি আমার সাথে।

— ঐ দেখেন মেয়েগুলো তাকিয়ে আছে। আপনি বিশ্বাস করেন না কেন আমার কথা? এলোমেলো চুলে আপনাকে আউলা ঝাউলা সুন্দর লাগে।

জড়তা-সংকোচ ছাড়া কথাগুলো বলে মুখ ফিরিয়ে নীরবের থেকে। সে বিস্ফোরিত নয়ন মেলে তাকিয়ে আছে। আমার বিরক্ত লাগছে প্রচুর। এতোটাই বিরক্ত আমি যে পারলে নীরবের মাথার ব্যান্ডেজ আমিই খুলে দিতাম। ক্ষতটাও আমিই ক্লিন করে দিতাম। মাথার সমস্ত চুলগুলো এলোমেলো। এমন দশায় তার সৌন্দর্য বেড়ে গেছে। এই মুহূর্তে যদি কেউ আবার নাতনির জন্য বিয়ে নিয়ে আসে তাহলে আমার কি হবে? এ কথা তো কেউ ভাববে না। বউয়ের সম্মুখে বরের বিয়ে! রাগে, দুঃখে রাস্তায় গড়াগড়ি খেতে ইচ্ছে করে।

— নীলিমা, আমার মাথায় ব্যাথা। এই পরিস্থিতিতে আমি কিভাবে চিরুনি দেবো মাথায়? আচ্ছা চলো তুমিই আমার ট্রিটমেন্ট করো। আমি হেল্প করবো। পারবে?

— না দরকার নেই। আপনার তো ইচ্ছে কোনো বৃদ্ধ মহিলা আসুক। আপনার বউ খুঁজে দিক। আপনার রূপের প্রসংশা করুক। আচ্ছা পৃথিবীতে আসার আগে কি আল্লাহ কে বলা যেতো না, হে আল্লাহ আমাকে এতো সৌন্দর্য দিও না। কিছু সৌন্দর্য তুমি আমার থেকে আমার বউকে দিয়ে দিও।

মুখ ফুলিয়ে কথাটা বলে উঠলাম। নীরব অবাক নয়নে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। মিনিট খানেক পর হঠাৎ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়েই হুট করে হেসে উঠলো । আমি কুয়াশাচ্ছন্ন মুখে তাকিয়ে রইলাম। সে বেশ খানিকক্ষণ হাসলো। অতঃপর হাসি থামিয়ে চাইলো আমার দিকে। তবুও ঠোঁট দুটো এখনো হাসির চিহ্ন বহন করছে। সে আচমকা আমার এক হাত নিজের হাতে বন্দী করে হাটতে লাগলো সম্মুখ পানে। বলল

— নীলিমা তোমার কাজ আর কথা আমার রাগ স্থায়ী হতে দেয় না। কই আমি রাগ করে থাকবো তোমার উপর। তুমিই উল্টো রেগে বম হয়ে যাও।

নীরবের কথায় আমার মন ততটা গলে ঢলে পরলো না। আমি গোমড়া মুখে হাঁটছি তার সাথে। হাঁটতে হাঁটতে তাকে শুধালাম

— ওদিকে কেন যাচ্ছেন। রিক্সা তো পেছন দিকে।

— আগে আমার ক্লিনিকে যাবো। দেখি তুলতুলের কি অবস্থা।

— এই সত্যিই তুলতুল আসবে? ও আসলে তো আমার পরীক্ষা দেওয়া হবে না। নভেম্বরে পরীক্ষা হওয়ার কথা।

আমার কথায় নীরব হঠাৎ থেমে গেলো। চুপসে গেলো তার মুখ। হুট করে বলে উঠলো

— আরে পরীক্ষা হবে না। অটোপাশ দেবে দেখে নিও।

আমি নীরবের কথায় এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলাম। ভুল করে এখন ভুজুংভাজুং বোঝানো হচ্ছে? কড়া চোখে তাকিয়ে বললাম

— একদম আউল ফাউল বোঝাবেন না।

— ঢং করবা নাতো। নিজেই তো রোমান্টিক মুডে বলছিলা তোমার এক জোড়া তুলতুল চাই। সন্তান আল্লাহর নিয়ামত। সে আসলে আসুক।

নীরবের কথায় একটু আগে ছুড়ে মারা তেজ আবার আমার গায়েই ঘুরে এসে লাগলো। সত্যিই তো! আমিই তুলতুলের প্রসঙ্গ তুলেছিলাম। কথার মোড় ঘুরাতে হবে। এটা নিয়ে তর্ক করলে আমি হেরে যাবো। ভাবনা চিন্তা নিয়ে গম্ভীর সুরে বললাম

— আচ্ছা ঠিক আছে। চলুন। সে আসলে আসুক। আর অটোপাশ যেন হয়ে যায়। আমিন।কিন্তু ডক্টর আপনি কি শিউর তুলতুল আসছে?

আমার কথায় নীরব হাসলো। এলোমেলো চুলে তার মুখের মুচকি হাসি ভীষণ মধুময় লাগলো। সে বুকে হাত রেখে সিনেমার স্টাইলে বলল

— এই পিত্রিহৃদয় বলে।

আমি তার অভিব্যাক্তিতে হেসে দিলাম। হঠাৎ করে আমারও যেন মাতৃহৃদয় জাগ্রত হলো। কেমন হবে ছোট একটা দেহ যখন আমি গর্ভে লালন করবো? তিল তিল করে বেড়ে উঠবে সে। আচমকা একদিন ভয়ংকর যন্ত্রণা দিয়ে সে পৃথিবীর বুকে পদার্পণ করবে। পৃথিবীর সব আনন্দ তখন আমার আর নীরবের কাছে এসে ধরা দেবে। ছোট ছোট হাত পা নিয়ে খেলবো আমি। কোলে নিয়ে আদর করতে করতে হুট করে সে ভিজিয়ে দেবে আমার কোল। আমি তখন ভীষণ বিরক্ত হবো কি? ইশ ভাবতেই অদ্ভুত এক অনুভূতি ছুঁয়ে যাচ্ছে আাময়। আমি হাসিমাখা মুখে নীরবের দিকে চাইলাম। তার এক হাতের বাহু আকড়ে ধরে বললাম

— আচ্ছা আমি কিন্তু বাচ্চা কোলে নিতে পারি না। আপনি পারেন? আমায় শিখিয়ে দেবেন কিন্তু।

আমার কথায় নীরব নিঃশব্দে হাসলো। চোখ মুখ শুকনো তার। এখনো কাটেনি অসুস্থতার ছায়া। সে নরম সুরে বলল

— একটু আগেই তো রেগে ছিলে। এখন আবার এতো উল্লাস মনে। বউদের মন বোঝা এতো কঠিন কেন নীলিমা?

— জানি না। কিন্তু বউরা স্বামীদের মন বোঝে। একেবারে পানির মতো। এই যে এখন আপনার শরীর খারাপ কিন্তু মন ভালো রাইট?

আমার চটপটে কথায় নীরব মুখে হাসি রেখেই বলল

— হান্ড্রেড পার্সেন্ট রাইট। একটু মাথা ব্যাথা করছে। কিন্তু বউয়ের সাথে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে অনেক ভালো লাগছে। রোদটাও কমে আসছে দেখো।

নীরবের কথায় আমি আকাশপথে চাইলাম। সূর্যের তেজ নুইয়ে আসছে। বৃষ্টি হবে হয়তো। আমি নীরবের দিকে তাকিয়ে বললাম

— বৃষ্টি হবে মনে হয়।

— হুম।

শব্দটা বলে আমি আর নীরব হাটতে লাগলাম। দুজনেই চুপ। এক অনির্দিষ্ট সময়ের নীরবতায় অদ্ভুত উচাটন মনে বিরাজ করছে। আমি অনুভব পুরো রেখেছি নীরবের প্রতি। সেও কি আমাকে অনুভব করছে? ভাবছিলাম এমন কিছুই। হঠাৎ নীরব আমার ভাবনা অজান্তে সঠিক বুঝাতে বলে উঠলো

— আমি যখন ঘুমের ওষুধ খেয়েছিলাম বুঝিনি। তারপর বাইক নিয়ে চলে গেলাম বাজারে। যাওয়ার সময় হঠাৎ দেখি মাথা ঝিমঝিম করছে। চোখে আবছা দেখতে লাগলাম। তখন আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম নীলিমা। আমি বুঝতে পারছিলাম এমনটা তো ভুল ওষুধ বা বেশি ঘুমের ওষুধ খেলে হয় কিন্তু আমার কেন হচ্ছে? ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ দেখি একটা ট্রাক আসছে। আমি বাইক সাইড করতে পারছিলাম না। একসময় শুনলাম খুব জোরে একটা শব্দ হলো। আমি বোধ হয় তখন ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে নিচ্ছি। মাথায় তখন প্রচুর ব্যাথা আমার। সেই সময় একটা বার আমার তোমার কথা খুব মনে পরলো। মনে হলো আমি বোধ হয় আর আমার নীলিমার কাছে যেতে পারবো না। আম্মুকে মনে পরলো। তারপর কালেমা পড়তে শুরু করলাম। পুরোটুকু পরতে পারছিলাম কিনা জানি না আমি।

কথাগুলো বতে গিয়ে হুট করে জবান বন্ধ করে দিলো নীরব। ঠোঁট কামড়ে ধরলো। চোখে তার জল চিকচিক করছে। গলার স্বরটা ভারি ছিল। আমি অবুঝের মতো তাকিয়ে আছি। অজান্তে কখন চোখের অশ্রু নেমে গাল ছেড়েছে বুঝিইনি। আমি শক্ত করে নীরবের হাতটা ধরলাম। নীরব একটু সময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আবার বলল

— তোমার ভয় করেনি নীলিমা? তুমি নাকি আমার হাতের মাপটাও নিতে দাওনি, বড়ই পাতা ফেলে দিছো, দা নিয়ে এসে পুলিশদের তাড়িয়ে দিয়েছো।

আমি অধোমুখী হয়ে মৌন থাকলাম। জানি না কিভাবে পেরেছি আমি। সেই মুহূর্ত এখন মনে ভেসে উঠলে আমার বুক ফেটে কান্না আসে। স্বামীর নিস্তেজ দেহটা যখন চোখে ভাসে তখন এক চিৎকার দিয়ে মাটির বুকে মুখ লুকাতে ইচ্ছে করে। বোধ হয় আরেকবার সেই পরিস্থিতিতে আমায় দাঁড় করিয়ে দিলে আমি কষ্টে বুক ফেটে মারাই যাবো। অচেতন হয়ে লুটিয়ে পরবো মাটিতে।

— অনেক কান্না করছিলে তখন?

— আমার সহ্য হচ্ছে না এসব কথা।…… আসলে আপনি ইচ্ছে করেই বলছেন। বুঝেছি। রিকশা ভাড়া বাঁচানোর জন্য। এতো কিপ্টামি কি থেকে শিখেছেন?

চোখের পানি সন্তর্পণে মুছে ভেজা গলায় কৃত্রিম রাগ নিয়ে বললাম। তাকে ফেলে একাই পা চালিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। মূলত সবই অসত্য। তাকে মাথায় চাপ না দেওয়ার ধান্দা। মাথা ব্যাথা বেড়ে যাবে। যা হয়েছে তা পেরিয়ে গেছে। পেছন ফিরে চেয়ে দুঃখ টেনে আনার কোনো প্রয়োজন তো দেখি না আমি। ভাবতে ভাবতে হাঁটছি। হঠাৎ কানে বেজে উঠলো নীরবের হাসির শব্দ। দ্বিতীয় বার কর্ণপাত হলো তার কথা

— নীলিমা তুমি খুব চালাক। তবে দেখতে লাগে একেবারে আলাভোলা মেয়ে।

চলবে….

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। নীলিমার কনসিভের আর বিয়ের দিন একই। কারণ মেয়েদের কনসিভের দিন হিসাব করা হয় শেষ পিরিয়ডের পর থেকে। নীলিমার শেষ পিরিয়ড যদি হয় বিশ থেকে পঁচিশ দিন আগে তাহলে কনসিভের দিন কেন বিশ পঁচিশ দিন হবে না। সব খোলাখুলি বলার জন্য আমি দুঃখিত কিন্তু অনেকেই তো এটা জানতে চাইলেন। সে যাই হোক, জেনে রাখা ভালো। অনেকেরই এইরকম হলে পারিবারিক সমস্যা নাকি হয়।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here