টিট ফর ট্যাট পর্ব-২২

0
2921

#টিট_ফর_ট্যাট
#Alisha_Anjum

নীলিমা,

প্রথম শব্দ হওয়ার কথা ছিল প্রিয় বা এর সমতুল্য কোনো শব্দ। কিন্তু আমি কোনোটাই ব্যাবহার করতে পারলাম না। কেন পারলাম না নীলিমা? কেন আমার সুপ্ত ভালোবাসা আমি আগে বুঝিনি? কেন তুমি স্বামীর ঘর বাঁধার পর আমি হলাম তোমাতে মত্ত? কেন এসেছিলে তুমি? কি দরকার ছিল নীলিমা আমাকে এমন দহনে দাগ্ধ করার? শুধু মাত্র টিট ফর ট্যাট বোঝাতে? তুমি জানো, যখন তুমি নীরবের হাত ধরে ঘুরে বেড়াও, রাতে দিনে হৈ হুল্লোড় করো নীরবের রুমে, আমার তখন কেমন লাগে? একটা উপমা দিয়ে বোঝাই তোমায়। ধরো আজরাইল একটা মানুষের খুব নিকটে। একদম সামনে। তাকে বলছে তাার জান কবজ হবে এখন। মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত হতে বলা হচ্ছে তাকে। ধীরে ধীরে বুকের ভেতরে আত্মাটার দিকে হাত এগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ঠিক সেই সময় যেমন অনুভূতি হয় মৃতপ্রায় ব্যাক্তিটার আমারও ঠিক একই যন্ত্রণা হয় নীলিমা। দহন জিনিসটা কি বোঝতো? বোঝো না তুমি। তোমার স্বামীর ভালোবাসায় সব প্রশমিত হয়ে গেছে। কিন্তু আমায় নব উদ্যোগে নব দহন দগ্ধ করছে দিন দিন। সুধা অনেক ভালো। কিন্তু আমি হয়তো তোমার মতো অন্য জনের ভালোবাসা দিয়ে এই দহনে প্রলেপ ছড়িয়ে চাপা দিতে পারবো না কষ্ট। পারবো না আমি। একটা কথা জানো নীলিমা? অনেক কম কথা বলা হয় না। আর বেশি কথা ব্যাক্ত করা যায় না। আমার হৃদয়ে লক্ষ কোটি কথা। কিন্তু শেষ মুহূর্তের সময়ে আমি শুধুই অসহায়। কোন কথাটা অন্তরে রেখে কোন কথাটা শোনাবো তোমায়? লিখতে চেয়েছিলাম খুবই অল্প কিছু। কিন্তু দেখো মূল কথাটা অব্যাক্ত থাকতেই কত বড় হয়ে গেছে চিঠিটা।

ভালো থাকো তুমি। আমি আর পারলাম না তোমায় সামনে রেখে দিনের পর দিন পার করতে। তোমার চোখে চোখ পরলে নিশ্বাস থমকে যায় আমার। হৃদস্পন্দন গতি হারিয়ে ফেলে।

অনেক সুখী হও নীরবের সাথে। তোমাদের নব অতিথিকে আমার পক্ষ হতে অনেক অনেক শুভেচ্ছা রইলো। জেনে রাখো নীলিমা, আমি তোমার মাঝে কোনো মায়া দেখিনি, আহামরি কোনো সৌন্দর্য পাইনি তবে তোমার বিড়াল চোখের চাহনিতে হারিয়ে গেছি আমি। ভুলে গেছি নিজেকে। অনিচ্ছায় বুকফ্রেমে বন্দি হয়েছে তোমার কাজল মাখা চোখের চাহনি।

ইতি
পরাস্ত প্রেমিক / #টিট_ফর_ট্যাট জেনে যাওয়া আমি।

নিঃশব্দে নয়ন নাড়িয়ে একদমে পড়ে গেলাম চিঠিটা। পড়া সমাপ্তি হতেই ঝট করে মাথা তুলে চাইলাম সম্মুখে। হৃদ হেলেদুলে যাচ্ছে। পাশে সুধা। মা ও যাচ্ছে সঙ্গে। নীরব যাচ্ছে তাদের এগিয়ে দিতে। আরো যাচ্ছে সুধার মা বা আত্মীয়। এয়ারপোর্টের ঐ দ্বার পর্যন্তই নীরবও তাদের পথ। আমার পা কেটে গেছে একটু আগে। হাঁটা অসম্ভব বিধায় বসে আছি বহু সিট ফেলে রাখা একটা সিটে। আমার বুকটা হু হু করে উঠলো। আবারও নজর দিলাম হাতের চিঠিটায়। স্পষ্ট অনুভব হয় চিঠিটা সিক্ত। কোন জলে সিক্ত এটা? হৃদের আঁখি জলে? সে কি লেখার সময় অশ্রু নেমেছিল তার চোখ বেড়ে? ভাবতে ভাবতে আমার আপন চোখ জলে টইটম্বুর হয়ে উঠলো। তিন দিন আগে পারিবারিক সমাবেশ বসে সব বিষয় নিয়ে। জেরিনকে জেলে দেওয়া হয়। আমি চেয়েছিলাম নিজ হাতে ওকে মেরে মৃতপ্রায় করতে। কিন্তু পারিনি নীরবের জন্য। যেদিন নীরবের কপালের ক্ষত ক্লিন করতে আমি আর সে ক্লিনিকে ছিলাম সেদিনই বিচার হয়ে যায়। নীরব স্বইচ্ছায় এমন করে। সে ইচ্ছে করে আমাকে নিয়ে সেদিন বেরোয় তার ক্ষত ক্লিন করার একদিন বাকি থাকা সত্ত্বেও। বাসায় এসে যখন সব অবগত হলাম তখন তুমুল ঝগড়া হয়েছে আমার নীরবের সাথে। আমি জেরিনকে কিছুতেই ছাড় দিতাম না। কিন্তু নীরব আগেই গুরুজনদের জানিয়ে দিয়েছে আমারা সেখানে অনুপস্থিত থাকবো। তার ভয় ছিল আমি হয়তো জেরিনকে মেরেই ফেলবো রাগে। এ নিয়ে নতুন আরো একটা ঝামেলা হবে। নীরব তা চায় না। তার কথা, “আমি তো সুস্থ আছি নীলিমা? আর নতুন ঝামেলার কি দরকার। ওরা যা পেরেছে করেছে। জেরিনের দশ বছর জেল হয়েছে। ” কিন্তু আমার মন মানেনি। তবে অসহায় আমি শাশুড়ি মায়ের নতুন মিনতি আর নীরবের দয়াময় কথায় কিছু করতে পারিনি। জেরিনের মা বাবার কান্নারত সাফাই তো ছিলোই। সেই এক ঝামেলা এভাবেই আবছা হয়ে মিটে যায়। অতপর দ্বিতীয় ধাপে নতুন করে আমার আর হৃদের সম্পর্কে প্রশ্ন তোলা হয়। সেখানে নীরব আলোচনা এগোতে না এগোতেই বলে দেয়, “আমায় নীলিমা বলেছে এসব। যা হয়েছে সব আমি মেনে নিয়েছি। যা হয়েছিল এসবের পরেও আমি নীলিমাকে ভালোবাসি। নীলিমা জেদ করে বিয়ে করলেও আমি তার স্বামী। ”
নীরবের এমন বাণীর কাছে সকলে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাদের আর নতুন করে কিছু বোঝানোর প্রয়োজন হয়নি।

এরপর সুধার বিয়ে নিয়ে প্রশ্ন উঠালে সেও সকলের সম্মুখে কোনো প্রকার সংকোচ ছাড়াই পরিষ্কার কন্ঠে বলে, “আমার কোনো প্রবলেম নেই এসব নিয়ে। আমি হৃদকেই কালেমা পড়ে, কবুল বলে ধর্মীয় রীতিতে বর হিসেবে গ্রহণ করতে চাই।” সুধার একথায় আমি এক বিশুদ্ধ নির্মল ভালোবাসা খুঁজে পেয়েছি। সে সত্যিই হৃদকে প্রচন্ড ভালোবাসে। অত্যন্ত বুদ্ধিমতি, শান্ত একটা মেয়ে সুধা।

— সবাই চলে গেলো। আম্মুও গেলো। ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

ভাবনার মাঝে হঠাৎ নীরবের কন্ঠ কানে এলো। সে ধপ করে বসে গেছে আমার পাশে। আমি কল্পনা ছেড়ে বাস্তবে পদার্পণ করতেই বিভ্রান্তির দরিয়ায় পরলাম। হাতে মেলে ধরা চিঠিটা। নীরব নিশ্চয়ই এখনি প্রশ্ন করবে এটা কি? তাকে বললে কি বিষয়টা দৃষ্টিকটু হবে? কিন্তু আমি যে কথাও দিয়েছি তাট অগোচরে কিছু করবো না। বলেই দেবো। হয়তো সে মন খারাপ করবে কিন্তু পরবর্তীতে কষ্ট পাবে না।

— চিঠি দিয়েছে?

ভাবনার মাঝে দ্বিতীয়বার নীরবের কন্ঠ। মৃদু কেঁপে উঠলাম আমি। নিশ্চয়ই এটা এক নির্লজ্জ এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি। ছোট ভাইয়ের বউকে বড় ভাই চিঠি দিয়েছে!

— হুম। দেখবেন?

— নাহ। বাসায় পৌছানোর আগেই ফেলে দিও কোথাও।

আসনে বসা তার মাথা চেয়ারের মতো সিটে ঠেস দেওয়া। চোখ বন্ধ। আমি তার কথার প্রত্যুত্তরে বললাম

— ঠিক আছে।

বেশ কিছুক্ষণ মৌনতা দখল নিয়ে রইলো। সে বন্ধ চোখে বসে রইলো আর আমি হাতের মুঠোয় চিঠিটা মুড়িয়ে নিয়ে। এরপর আবারও নীরব প্রথম কথা বলে উঠলো

— এখন যাবে কিভাবে? পা তো কেটে গেলো।

— হাঁটতে পারবো।

আমার জবাব শুনে নীরব চোখ খুলল। পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বলল

— চাচ চাচি সবাইকে চলে যেতে বলেছি। আমার তো গাড়ি নেই তোমায় নিয়ে যাবো কিভাবে?

নীরবের কথাগুলো আজ গম্ভীর। আমি ভদ্র মেয়ের মতো নত মাথায় বললাম

— আপনার হাত পা থাকতে আমার গাড়ির প্রয়োজন নেই।

নীরব হেসে উঠলো আমার কথায় আমার পায়ের দিকে নজর দিতে দিতে বলল

— কথাগুলো যা বলো না! অভিমানও পালিয়ে যায়। দেখি কতটুকু কেটেছে?…. এই নীলিমা তুমি কি আদৌ জুতো পায়ে দিয়ে এসেছিলে? রাস্তায় একটা স্পিরিটের বোতলে পা লেগে কেটে গেলো কিভাবে?

— এতো বোঝা লাগে? আমি ভুলে বাসার স্যান্ডেল পায়ে দিয়ে এসেছিলাম। পরে গাড়িতে উঠে দেখি আমার জুতো নর্মাল। পরে এয়ারপোর্টে নামার আগে ঐ জুতো গাড়িতেি ফেলে নেমে পরছি। বোরখা তো একটু বড়। পা দেখা যায়।

— ইশ! কি বুদ্ধি রে! মন চায় তুলে আছার মারি।

নীরব শান্ত কন্ঠে রাগ ঝাড়লো। আমি বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে একটা হাসি দিলাম। পা দিয়ে বেশ রক্ত আসছে। নীরব বলল

— এয়ারপোর্ট ভাসিয়ে ফেলো রক্ত দিয়ে। উঠো। আমাকে শক্ত করে ধরো। সিনেমার হিরো হইলে যেখানে সেখানে কোলে নেওয়া যেতো।

উঠে দাড়িয়ে নীরবের হাতটা শক্ত করে ধরলাম। বেচাড়া আমার কোমড় ধরতে গিয়েও ধরছে না। অনেক মানুষের মাঝে চক্ষুলজ্জা! আমি মুচকি হাসতে হাসতে তার হাতে ভর করে হাঁটছি। এয়ারপোর্ট ছেড়ে বাইরে এলাম। সে নিকটস্থ একটা ওষুধের দোকানে গিয়ে নিজের ডাক্তারি অনুশীলন করলো আমার পা দিয়ে। সুন্দর যত্ন করে পা বেঁধে দিলো শুভ্র কাপড়ে। তারপর একটা রিক্সা ডাকলো। দু’জনেই চড়ে বসলাম তাতে। হাওয়া এসে লাগছে চোখে মুখে সাথে যেন মনেও। অনন্য এক আনন্দ মন মাঝারে। নীরব সম্মুখে দৃষ্টি ফেলে রেখেছে। কি আর বলবো নতুন করে? সে সব সময় সুন্দর। তার সৌন্দর্য দেখে আমার মাঝে মাঝে ঈর্ষা হয়। অবুঝের মতো ভাবি। আমি তো তিনটা বাচ্চা নেবো। বাচ্চা নিলে মেয়েদের বয়স্ক লাগে। তাহলে তো সে অনেক সুন্দরই থাকবে কিন্তু আমি অসুন্দর হয়ে যাবো। আমাকে কি তখন পাত্তা দেবে উনি? ভাবতেই আমার মনঃক্ষুণ্ন হলো। গোমড়া মুখে তাকালাম নীরবের দিকে। তাকাতেই আবার হুট করে মন খারাপ উধাও হয়ে গেলো। ঝাঁক ঝাঁক মায়া বাসা বাধলো মনে। হঠাৎ কিছু ভেবে তাকে বললান

— এই ডাক্তার আমাকে একটু শক্ত করে ধরুন তো! তার আগে আপনার রুমালটা দিন।

আমার কথায় নীরব ভ্রু কুঁচকে ফেললো। একটু পর বিনাবাক্যে পকেট থেকে রুমাল বের করে হাতে দিলো আমার। আমার খুব মায়া হলো তার মুখটা দেখে। এখনো তার শরীর ঠিক হয়নি। মাঝে মধ্যেই মাথার ব্যাথায় চুপসে যায়। এখনও তেমন। একদম চুপচাপ। চোখমুখে ব্যাথার চিহ্ন আমি ঠিকই দেখতে পাই। নিশ্চয়ই অতি গরমে তার মাথা ব্যাথা করছে এখন। আমি নজর ফিরিয়ে নিলাম। নীরব শক্ত করে ধরলো আমার দু বাহু। আমি কেটে যাওয়া পা অন্য পায়ের হাঁটুতে রাখলাম। ধীরে ধীরে খুললাম পায়ের ব্যান্ডেজ। নীরব রেগে যেই না কিছু বলবে ঠিক তখনই বুঝে উঠে আমি বললাম

— কিছু বলতে পারবেন না। চুপচাপ শুধু দেখে যান।

তার দিকে দৃষ্টি না দিয়েই কথাটা বললাম। পায়ে মোড়ানো কাপড় খোলা হয়ে গেছে। এখন হালকা একটু রক্ত আসছে। আমি নীরবের দেওয়া ছোট সাদা রুমালটা কোলের উপর মেলে রাখলাম। পা থেকে ঝড়া রক্ত শাহাদাত আঙ্গুলে নিয়ে হাত ঘুরিয়ে লিখলাম সাদা কাপড়ে

” ভালোবাসি”

লেখা সমাপ্ত করে নীরবের দিকে তাকিয়ে বললাম

— পা থেকে রক্ত নিলাম বলে অপরাধ নিবেন না নবাব। আপনি চাইলে আমি আমার বুকের তাজা রক্তও দেবো।

বলতে গিয়ে কেন জানিনা চোখ ছলছল করে উঠলো আমার। নীরবের দিকে তাকাতেই আরো এক রত্তি আবেগ মনে জায়গা করে নিলো। তার চোখও ছলছলে। আলগোছে সে আমায় বুকে জড়িয়ে নিলো। কাঁপা কাঁপা কন্ঠে মিনিট দুয়েক পরে বলল

— ভালোবাসি আমিও। ইহকালে যেমন তুমি আমায় ছিনিয়ে নিলে ঘাতকদের থেকে। পরকালেও তুমি আমায় চেয়ে নিও আল্লাহর থেকে।

সমাপ্ত

( শেষ করলাম অবশেষে। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আপনাদের প্রত্যেকটা কমেন্ট আমাকে উৎসাহ দিয়েছে। রিয়্যাক্ট গুলো লেখার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। অফুরন্ত ভালোবাসা আপনাদের। যারা গল্পটা পড়েছেন কিন্তু রিয়্যাক্ট কমেন্ট করেননি তাদের জন্যও রইলো অন্যরকম ভালোবাসা। সবাই অনেক ভালো থাকুন। আমার জন্য দোয়া করবেন। আর সবসময় হালাল গ্রহণ করুন। হালালে যে সুখ শান্তি আছে তার ব্যাখ্যা কোনো ভাষায় হয়তো করা সম্ভব না। আল্লাহ হাফেজ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here