বাবুই পাখির বাসা – ৫ (শেষ) অমৃতা বন্দ্যোপাধ্যায়

বাবুই পাখির বাসা – ৫ (শেষ)
অমৃতা বন্দ্যোপাধ্যায়

যখন সন্ধে পেরিয়ে বাড়ির সামনে গাড়ি থেকে নামলো সাগরনীল, ওর মা সামনের বারান্দাতেই বসে ছিলেন | প্রথম ধাক্কাটা সামলে নিয়েছেন, শান্ত হয়েই আছেন এখন | ওকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলেন | যেন বিশ্বাস হচ্ছে না সাগরনীল এসেছে |
কেন ? আসারই তো কথা | আসবে না কেন ? অঞ্জনা তো বলেছিলেন উনাকে, “সাগরকে আমি জানিয়েছি বৌদি, আসবে ও | তুমি কদিন ওর কাছে গিয়ে থেকে এস | ভালো লাগবে “|
এত বছর পরে দেখছেন ওকে, যেন সম্পূর্ণ অচেনা কেউ, নিজের ছেলে না | মাথায় ওই ঝুঁটি এই প্রথম সামনে থেকে দেখে কি অদ্ভুত যে লাগলো উনার | কে এ ?
শেষ বার দেখেছিলেন দীর্ঘ্য সাত বছর আগে | সেই সঙ্গীতার সাথে ঝগড়া করে চলে গিয়েছিল, উনার উপর ছিল এক অন্ধ রাগ | আজ যখন সাগরনীল, একহাতে তোয়ার হাত ধরে অন্যহাতে নিজেদের সুটকেস নিয়ে এসে দাঁড়ালো উনার সামনে, উনি দেখলেন একজন সুখী মানুষকে | তার গায়ে, মুখে একজনের যত্নের পরশ, ভালোবাসার ছোঁয়া | তোয়াকে পেয়ে যেন ওর জীবনটা সম্পূর্ণ হয়ে গেছে, আর অগোছালো, ছন্নছাড়া না | দেখে উনার ভালো লাগলো |
“কেমন আছো মা ? শরীর ঠিক আছে ?”, সেই চেনা গলা, ফোনের ওপার থেকে তো শোনেন প্রায়ই | চোখে আগের সেই আগুন নেই, রাগ নেই, অভিমান নেই | দুজনেই প্রণাম করলো পায়ে হাত দিয়ে, উনি মাথায় হাত রাখলেন, ” পায়ে হাত দিস না রে, সুখী থাক বাবা তোরা !”|
সাগরনীলও দেখলো নিজের মাকে |
চেহারা আগের থেকে অনেক ভেঙে গেছে | ভাবলো যাকে ঘিরে বাঁচতো মা সেই তো এখন নেই, তাই কি এরকম রুগ্ন লাগছে মাকে ? বুঝলো যে বাবার মৃত্যুতে ও নিজে যেমন ভেঙে পড়েছিল, ওর মায়ের জন্যে রুদ্রনীলের চলে যাওয়াটা হয়তো সেরম |
দাদার মৃত্যুতে ওর নিজের কি মনে হলো ? সাগরনীল জানে না | সারা রাস্তা ভাবতে ভাবতে এসেছে, তাও জানেনা | কোনোদিন সেভাবে দাদার সাথে ওর আলাদা কোনো সম্পর্ক ছিল না | মা আর দাদা, ওর কাছে যেন একটা সমষ্টি ছিল, একে ওপরের পরিপূরক | আজ এতদিন পরে এখানে দাদা নেই তাই যেন একটা খালি ভাব এই অব্দিই মনে হলো | মা যেন হঠাৎ একদম কর্মহীন হয়ে পড়েছে, সেটাই চোখে পড়লো |
অঞ্জনা এগিয়ে আসতেই সাগরনীল জড়িয়ে ধরলো, পিসির সাথে মায়ের মতন আড়ষ্ট না ও | উনি আদর করে দিলেন,বললেন, “উফঃ ! অনেক রাস্তা এলি বল? চা খাবি রে ?”
সাগরনীল কিন্তু সহজেই আবদার জুড়ে বললো, “পিসি আমার এই ঠান্ডায় কাঁপুনি ধরে গেছে | একটু কফি করে দাও প্লিজ, জমে যাচ্ছি আমি |”
অঞ্জনা হেসে ওর গাল ধরে নাড়িয়ে দিলেন, “জন্মে থেকে শীতকাতুরে রে তুই! দিচ্ছি দাঁড়া “, তোয়াকে ডেকে ভেতরে নিয়ে গেলেন “তোয়া এস তোমাদের জন্যে এই ঘরটা খুলিয়ে পরিষ্কার করিয়ে রেখেছি, সাগরের ঘর এটা |”
স্বপ্নার হঠাৎ মনে হলো, এই সহজ সম্পর্ক উনার সাথে নেই কেন ওর ? অঞ্জনার সাথে সাগরনীলকে দেখে উনার যেন এত বছরের আফসোস একসাথে মনে জমা হলো | একে আমি দূরে সরিয়ে দিয়েছিলাম ? কেন ? তারপর ভাবলেন, আচ্ছা সাগরনীল এসেছে তো ওর পিসি এত আনন্দিত হচ্ছে কেন ? কি খাবে না খাবে, ওদের জন্যে ঘর খুলে তৈরী করে রাখা এইসব মিলিয়ে যেন ছোট একটা উৎসব হচ্ছে | এইটা শোকের বাড়ি ওরা কি ভুলে গেছে ?
উনার মনের মধ্যে সব গন্ডগোল হয়ে যাচ্ছে, সব ভাবনা চিন্তা যেন জট পাকিয়ে যাচ্ছে | কোনটা ধরবেন, কোনটা ছাড়বেন ঠিক করে উঠতে পারছেন না যেন |

দাহ ওরা আসার আগেই হয়ে গিয়েছিল, রাতে খেতে বসে পিসেমশাই আর পিসতুতো দাদার সাথে সাগরনীল ওই কাজ এইসব নিয়ে একটু আলোচনা করলো | স্বপ্নার কোনো সেরম বক্তব্য নেই | ছোট করেই সব হবে ঠিক হলো, ওই বাড়ির সবাই মিলে | উনি আনমনেই তোয়া আর সাগরনীলের, দুজনকে লক্ষ্য করলেন | যেন সর্বক্ষণ একে অপরকে আগলাচ্ছে |
মাকে আলাদা করে কিছু সান্ত্বনার কথা বলতে পারেনি সাগরনীল, কি বলবে ? মায়ের সাথে কথা বলতেই ওর অদ্ভুত লাগছে | সব সময় দাদাকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে মা, সেটা দেখেই ও অভস্ত্য | সেই মা এতক্ষন এক জায়গায় বসে আছে, ওদের দেখছে | কোনো তাড়া নেই যেন, এইটা দেখে কেমন একটা কষ্ট হলো সাগরনীলের | ইচ্ছে হলো মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “তুমি দুঃখ করো না মা, এই দেখো আমি আছি তো তোমার কাছে “, কিন্তু সে বলার মতন ওর জায়গা কোথায় | ও আছে তাতে কি যায় আসে ?
খেয়ে উঠে সবাই বসার ঘরের সোফায় বসে টুকটাক কথা বলছিল | সাগরনীলও ওখানেই বসে কি একটা করছিল ল্যাপটপে, আর হাই তুলছিল থেকে থেকে | ওর পিসিই বললেন, ” যা তোরা শুয়ে পড় এতটা জার্নি করে এসেছিস, আর এখানে তো ওখানকার থেকে অনেক বেশি ঠান্ডা | ভালো করে কম্বল গায়ে দিস কিন্তু তোরা, হ্যাঁ তোয়া ?”
উনার কথায় তোয়া হেসে বললো , “হ্যাঁ পিসি, খুব ঠান্ডা লাগছে এখানে “, সবাইকে গুডনাইট বলে ওরা শুতে চলে গেল | ওর পিসি ঘুরে স্বপ্নাকে হাসি মুখেই বললেন, “তোয়া মেয়েটা খুব ভালো জানো বৌদি | সাগরকে বড্ডো ভালোবাসে, একদম যত্নে রাখে |” স্বপ্না এতক্ষন ঘোরে ছিলেন, ভাবলেন, তাই তো |

পরের দিন সকালে তোয়া এই সাড়ে আটটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠে ওদের ঘর থেকে নিচে নেমে এল | স্বপ্না আজ অনেকটা ধাতস্থ, সহজ গলাতে জিজ্ঞেস করলেন, “ঘুম হয়েছে তোমার তোয়া ?”
হেসে ঘাড় নাড়লো তোয়া, রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো | উনিও উঠে গেলেন, দেখিয়ে দেখিয়ে দিতে, “সাগর ওঠে নি ? শরীর ঠিক আছে তো ? ”
তোয়া বললো,” হ্যাঁ শরীর ঠিকই আছে, ঘুমোচ্ছে | খুব টায়ার্ড ছিল কাল, অনেকটা এসেছি তো আমরা” তারপর একটু থেমে বললো, “ও এমনিও সকালে দেরি করে ওঠে, দশটার আগে কোনোদিনই ওঠে না, রাতে অনেক্ষন জেগে কাজ করে তো “|
উনার নিজেরই ছেলের স্বভাব, অভ্যেস উনি জানেন না, তোয়া বলে দিচ্ছে উনাকে | সত্যি !! স্বপ্না কি করেছেন এতদিন ধরে?
প্রায় এগারোটায় উঠে বারান্দার সিঁড়িতে বসেই কফি খাচ্ছিলো সাগরনীল, ওর মা ডাকলেন, “সাগর তুই জলখাবার খেয়ে একবার তোয়াকে নিয়ে আমার ঘরে আসিস তো |”
“আচ্ছা, আসছি “| মায়ের ঘরে বহু বছর যায়নি সাগরনীল, বাড়িতে থাকতো যখন তখনই যায়নি | ওই ঘরে ওর দাদাও থাকতো | ও নিজের পড়ার ঘরে, বাবার ঘরে আর ওই বাইরের বারান্দাতেই বেশি থাকতো, ট্রি-হাউস বাদ দিলে |
তোয়া আর সাগরনীল ওই ঘরে আসতেই, স্বপ্না বললেন,”তোয়া আমি তো তোমাদের বিয়েতে যাতে পারিনি, তাই এখন এইগুলো তোমার হাতে তুলে দিতে চাই”, বলে একটা বড় কাঠের বাক্স থেকে বের করে একটা মোটা ভেলভেটের কাপড়ের ভারী পুঁটলি ওর দিকে এগিয়ে দিলেন | গয়না আছে ওতে, দেখেই বোঝা যাচ্ছে | তোয়া সাগরনীলের দিকে তাকালো, সেও একটু অবাক হয়েছে | চোখে চোখে ইশারা হলো কি ? স্বপ্না বোঝার চেষ্টা করলেন, হাত বাড়িয়ে আরও এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নাও …”
হাত পেতে নিল তোয়া |
সাগরনীল দেখলো বাক্সে আরও একটা ওইরকম পুঁটলি আছে, এমনিই কথা বলে পরিস্থিতি নিজের জন্যেই সহজ করতে বললো, ” গয়নার আরও পুঁটলি আছে ? ব্যাংকে না রেখে বাড়িতে রেখেছো মা?”
“হ্যাঁ, ওটা বাবুনের জন্যে রেখেছিলাম …”, স্বপ্না বলতে শুরু করলেন, কিন্তু উনার নিজের কানেই কথাটা বাজলো | বাবুনের জন্যে কেন গয়না রেখেছিলেন উনি ? উনি কি ভেবেছিলেন ওরও কোনোদিন বিয়ে হবে ? সেকি !
উনার কথায় সাগরনীল যেন একদম হতবাক হয়ে গেছে, “দাদার বিয়ে হবে ভাবতো নাকি মা? সে কি করে সম্ভব ?” এই চিন্তা মাথায় আসতেই অজান্তেই ওর কপালে ভাঁজ পড়েছে, ভুরু কুঁচকে উঠেছে | খুব মনোযোগ দিয়ে মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে | এইভাবে সাগরনীল যখন ছোটবেলাতেও উনাকে দেখতো বড্ডো অস্বতি হতো স্বপ্নার, যেন উনার মন অব্দি দেখতে পাচ্ছে ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে | এখন উনার মনে হলো যেন ছেলে মায়ের মানসিক অবস্থা জরিপ করছে, কথা ঘোরাতে হেসে বললেন, “আররে এইগুলো তো তোর ঠাকুমার গয়না, ও এমনিই দুই ভাগ করেছিলাম | এইটাও তোরা নিয়ে নে…মানে ওর তো আর ..” বলে অন্য গয়নাগুলোও ওকে এগিয়ে দিলেন |
সাগরনীল একটা চেয়ার টেনে বসলো, উনার হাত থেকে পুঁটলিটা নিয়ে ও আবার বাক্সে রেখে দিল, বললো, “না না, থাক ওটা”, একটু থেমে জিজ্ঞেস করলো, “তা তুমি কি ভাবছো মা ? আমাদের সাথে যাবে নাকি এখানেই থাকতে চাও ?”
স্বপ্না লক্ষ্য করলেন, “মা আমাদের সাথে চলো” এইটা বললো না, উনি কি চান জিজ্ঞেস করছে | কানে লাগলো যেন সেটা | তারপর ভাবলেন কেন বলবে ও যে আমাদের সাথে চলো ? ও তো বিয়েতে ডেকেছিল, উনিই তো যাননি | উনি কি ভেবেছিলেন যে বাবুন তো চলে গেছে এইবার উনার হাতে অনেক সময়, বাবুইয়ের মা হবার অফুরন্ত সুযোগ | তাই কি এসেই সাগরনীল সেই অধিকার চাইবে, ওর ভাগের মায়ের আদর আবদার করবে আবার, এই কল্পনা করেছিলেন?
“মা ?” সাগরনীলের ডাকে যেন স্বপ্নার চিন্তার জাল ছিঁড়ে গেল |
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ভাবিনি রে কিছু সেভাবে | তোরা কদিন আছিস তো এখানে ?”

আহেলী মাঝে মাঝে ভিডিও কলে কাকার সাথে কথা বলে | এসেছে শুনে নিজেই বায়না করেছে দেখা করতে যাবে | ওকে দেখে সাগরনীলও খুব খুশি, বাচ্চা মানুষ পরিবেশ এমনিই সুন্দর করে দেয় | আর এমনিতে মাকে দেখে যেন সাগরনীলের কিরম অস্বস্তি হচ্ছে, মনে হচ্ছে উনি ঠিক মানসিক ভাবে সুস্থ নেই যেন | কিন্তু সেটা শুধু শোক থেকে না আরো কিছু ? কি করবে এখনও বুঝতে পারছে না | ভাবলো কাজ মিটলে একবার পিসির সাথেই ভালো করে কথা বলে নেবে | ওর বিয়েতে এসেও পিসি এরমই কিছু একটা বলেছিল, তখন সে ভাবে গা করেনি সাগরনীল | এখন সেটা ভেবে খারাপই লাগছে |
দুপুরে খাবার পরে বাগানে দাঁড়িয়ে আহেলীকে কোলে নিয়ে তোয়াকে নানান গাছ দেখিয়ে নিজের দুস্টুমি করার গল্প শোনাচ্ছিল সাগরনীল |
“বাবা ! তুমি তো সব গাছে উঠেছ মনে হয়, বড় হয়ে এরম শান্ত হয়ে গেলে কি করে ?” তোয়া হেসে জিজ্ঞেস করল |
কাঁধ ঝাঁকালো সাগরনীল, হাসলো জোরে | ট্রি-হাউসটা আছে এখনো, তবে আগের থেকে অনেক মলিন হয়ে গেছে | কত বছর পরিষ্কার করা হয়না, পাতা জমেছে সিঁড়িতে, ধুলোয় ঢেকে আছে | কেন জানি সাগরনীলের ঠিক সাহস হলো না ওটাতে উঠে দেখার | কি জানি কি স্মৃতি মনে ভিড় করে আসবে |
বললো, “ভালোই হলো তুমি আমার সাথে এলে তোয়া | একবার আমার বাড়িও ঘোরা হয়ে গেল আর তুমি না আসলে আমারও খুব …মানে মুশকিল হতো জানো |”
জানে তোয়া, ও বুঝতে পারছে সাগরনীলের অসুবিধেটা | ওরও সাগরনীলের মায়ের আচার আচরণ একটু অস্বাভাবিকই ঠেকছে | কেমন যেন আড়ষ্ঠ উনি, আর উনাদের যেন একটু অদ্ভুত চোখে দেখছেন, এরম বার বার মনে হচ্ছে ওর | সাগরনীলকে কিছু বলেনি যদিও ও এই ব্যাপারে | শুধু শুধু ওর অস্বস্তি বাড়ানোর ইচ্ছে নেই তোয়ার |
তোয়ার এইরকম মনে হওয়াটা ভিত্তিহীন না | সত্যি ওদের খেয়াল করে দেখছেন স্বপ্না, ওদের দুজনের শরীরী ভাষা পড়েছেন | দেখছেন আর ভাবছেন | স্বচ্ছতোয়া, হ্যাঁ, স্বচ্ছ মেয়েটার মনও | ও কোনোদিন নিজের সম্পর্ক বাজি রেখে, সাগরনীল আর স্বপ্নার মাঝে সোপান হতে যাবে না | সঙ্গীতার মতন সেই চেষ্টাই করবে না | ওকে যদি সাগরনীল রেগে বলে, “আমি না আমার মা ? বেছে নাও |” ওই বুদ্ধিদীপ্ত চোখের মেয়ে অনায়াসে উত্তর দেবে, “তুমি, শুধু তুমি” | ওদের ভালোবাসায় কোনো দ্বিধা নেই যেন, অন্য কারুর প্রয়োজন নেই ওদের |
এইরকম ভালোবাসাই তো খুঁজছিল সাগরনীল ? ওকে এক মনে ভালোবাসবে এমন কেউ, অন্য কিছু দেখবে না |, তোয়াকেই দরকার ছিল ওর | আর তাই আজ ও এমন শান্ত, সুখী | ওর গুছোনো জীবনে মাকে কেন দরকার ? চৌত্রিশ বছর কি কম সময় মাকে ছাড়া থাকার অভ্যেস করার জন্যে ?
আর যদি ও ভালোই আছে তাহলে উনি খুশি হতে পারছেন না কেন ওর জন্যে ? ও যে আজ আর অভিমানী গলায় উনাকে কিছু বলছে না, রাগ করছে না সেটাতেই কি উনার অসুবিধে ? না কি উনি ভাবছেন আর অভিমানটুকুও পড়ে নেই সাগরনীলের মনে মায়ের জন্যে !! শুধুই কর্তব্য এখন |
আসলে প্রায় সাঁইত্রিশ বছর উনি একজনের সেবা করে গেছেন, তার কথাই ভেবেছেন দিন রাত | তাই সে আজ চলে যাওয়াতে উনার হাতে হঠাৎ অনেক সময় | মাথায় রোজকার চিন্তা নেই আর সেখানে তাই উঠে উঠে আসছে অহেতুক সব ভাবনা | এই এতগুলো বছর রুদ্রনীলের সাথে ওর পৃথিবীতে, ওর মতন করে বেঁচে থেকে উনি নিজেই যেন বাকি জগতের থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে পড়েছেন | উনার জীবনের উদ্দেশ্যটাই হঠাৎ যেন হারিয়ে গেছে | নিজের জীবনীশক্তি যাতে ঢালতেন সেই পাত্রটাই তো নেই আর …উনি কি করবেন ? উনার মনের সাথে সাথে শরীরও যেন ভেঙে আসছে | সব কিছুই তো রুদ্রনীলের সাথে এক তারে বাঁধা ছিল | সব বাঁধন যেন ছিড়ে গেছে ও চলে যাওয়াতে, স্বপ্নার জীবনের মানেটাই হারিয়ে গেছে | সেখানে সাগরনীল যাই করুক না কেন, কোনো পার্থক্য হবে না |

টাকা দিয়ে আজকাল কি না হয় ? তাই কিসব নিয়ম টিয়ম এগিয়ে নিয়ে পাঁচদিনের দিনই সব কাজটাজ সেরে ফেলা হলো | অনেক লোক ডাকিয়ে খাওয়ানোর কোনো ইচ্ছে সাগরনীলের এমনিও ছিল না, আর ও এখানে সব ব্যবস্থা করতেও খুব মুশকিলে পড়ে যেত | পিসি আর পিসেমশাই সহায় হলেন | ওর বাবার বেলাতেও উনারাই পাশে দাঁড়িয়েছিলেন |
বাবার কাজের কথা মনে করেই পিসিকে বললো, “বাবার বেলাতে তোমরা পাশে না থাকলে কি যে করতাম ! আমার তো অবস্থাই কাহিল হয়ে গিয়েছিল | কোনোদিন বলাই হয়নি তোমাদেরকে …” ওর পিসি, পিসেমশাই বরাবরই ওকে ভালোবাসেন খুব | ওর কথা শুনে আজ পিসেমশাই হেসে বললেন, “কি বলা হয়নি রে সাগর ? থ্যাংক ইউ নাকি ?”
তোয়াও কাছেই ছিল | ওর পিসেমশাই ওকেও উদ্দেশ্য করে বললেন, “তোমাকেও বলছি তোয়া, শুধু সাগরকে না | তোমরা দুজনেই যে জায়গায় পৌঁছেছো সেখানেও যে আমাদের মনে রেখেছ এইটা আমাদের কাছে খুব বড় ব্যাপার | তোমাদের বিয়েতে আমাদের ডেকে অত খাতির করলে আমার তো সত্যি খুব ভালো লেগেছিল | এই যে সাগর আমারও তো বলা হয়নি রে …থ্যাংক ইউ বলবো নাকি রে ?”
সবাই অল্প হাসলো | স্বপ্নার সবাইকে হাসতে দেখে বিরক্ত লাগলো, উনার মনে হলো যে এই দুঃখটা যেন শুধু উনার, এরা কেউ বুঝছে না | তার উপর যখন অঞ্জনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্বগতোক্তি করে বললেন, “রুদ্র তো সারাজীবন ওই ঘরেই আটকে থাকলো | একদিকে ওর মুক্তিই হয়েছে | ওই ভাবে বেঁচে থেকে কি লাভ ?” সত্যি আক্ষেপ করেই বলা, উনাকে শুনিয়ে বলা না তাও যেন স্বপ্নার মনে গিয়ে বিঁধলো কথাটা |
ভাবলেন কি লাভ মানে ? উনার এই এত বছরের সেবা, এত যত্ন, এত ত্যাগ, সব কি তাহলে মিথ্যে ? অকারণ ? উনার সারাটা জীবন যাকে উনি উৎসর্গ করলেন, সেই রুন্দ্রনীলের বেঁচে থাকাটা একটা শাস্তি ? মৃত্যুই তার মুক্তি ?
সেই রাত্রেই স্বপ্না খুব অসুস্থ হয়ে পড়লেন | অনেকদিনই ব্লাড প্রেসারের সমস্যা উনার, নিয়ন্ত্রণে রাখতে ওষুধ খান প্রায় বহু বছর ধরে | এই কদিন একদম অনিয়ম করেছেন, উল্টোপাল্টা চিন্তা করেছেন, ওষুধ পত্র খাননি ঠিক করে | তার উপর এত গভীর একটা শোক | বাকিদের জন্যে যাই হোক, উনার তো সন্তান ছিল সে | কাছের নার্সিং হোমে ভর্তি করা হলো, ডাক্তার দেখে বললেন হার্ট এট্যাক |
নার্সিং হোমে অপেক্ষা করতে করতে হাজারটা চিন্তা খেলে গেল সাগরনীলের মাথায় | কি করে হয়ে গেল এরকম হঠাৎ ? চোখের সামনে একদম | নিজেকেই অপরাধী মনে হলো ওর |

জ্ঞান ফিরলো অনেক রাতে | সাগরনীল এসে পাশে বসতেই ওর মা নিজের মনেই যেন অনেক কথা বলতে শুরু করলেন | বুঝি এতক্ষনে উনার নিজের মনের জট খুলে চিন্তা ভাবনাগুলো পরিষ্কার রূপ নিয়েছে | এতদিনে বোধয় উনি নিজের অন্য ছেলেটাকে একদম স্পষ্ট করে দেখতে পাচ্ছেন | ওকে কি যে বলার ছিল উনার সেই কবে থেকে তা এইবার পরপর সাজিয়ে ফেলেছেন |
নাকি সব আরোই গুলিয়ে গেছে ? কে বলে দেবে সাগরনীলকে ?
“ছেলেবেলায় কি সুন্দর গোলগাল ছিলিস রে তুই, সেই যে ক্লাস থ্রী ফোরে রোগা হতে শুরু করলি, আর চেহারা ফিরলো না তোর | ইশ ! একদম কঙ্কালসার হয়েছিস | তোয়া এত যত্ন করে তাও এরকম | ও ছিল না যখন তখন যে কি হাল করেছিলি যে জানে বাবা ! আর কি এই চুল লম্বা করেছিস! একদম ভালো না | জটার মতন লাগছে |”
এত কথা ওর সাথে আগে বলেননি ওর মা, সাগরনীল খুব অপ্রস্তুত হলো | কি বলবে ঠিক করতে পারলো না | উনিই কিন্তু আজ কথা বলার ভার নিয়েছেন |
ওর গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, “আর আমার উপর রাগ করে থাকিস না বাবুই” চমকে উঠলো সাগরনীল!! এই নাম, এই ডাক !
উনার চোখে জল, বললেন, “আমি ঠিক পরের জন্মে আবার তোর মা হবো জানিস বাবুই, আর শুধু তোর মা হবো রে | তোকে অনেক, অনেক আদর করবো, সারাক্ষন তোর পাশে পাশে থাকবো …তুই মিলিয়ে নিস | এইবারের মতন আমাকে ক্ষমা করে দে বাবা, আমার খুব ভুল হয়েছে রে |”
“একি কথা মা ? ক্ষমা করার প্রশ্ন কেন আসছে ? আমি রাগ করে নেই তোমার উপর, আর কোনো অভিমান নেই আমার | তুমি এইসব চিন্তা করো না | আমিই এতদিন একবারও আসিনি | তুমিই বরং আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিও |”
এইরকম যে ও বলবে ও নিজেই জানতো না এক মুহূর্ত আগে, সেখানে উনি কি করে কল্পনা করতেন ? অনেক বছরের ব্যবধান ভেঙে জড়িয়ে ধরলেন নিজের ছোট ছেলেকে, যে ছেলে মায়ের এই একটু আদরের জন্যে কত যুগ অপেক্ষা করেছিল | সব অভিমান কি গোলে গেল, মুছে গেল কি সব অভিযোগ ?
স্বপ্না তারপর ওষুধের প্রভাবে আবার ঘুমিয়ে পড়লেন | আর বসে থেকে কি করতো ?
একটা অদ্ভুত, অচেনা অনুভূতি নিয়ে প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ বাড়ি এলো সাগরনীল | একদম বিদ্ধস্ত হয়ে | ওর বাড়ি হলেও, আসানসোল এখন ওর কাছে একটা অচেনা জায়গা, কিছু করতেই পিসেমশাইয়ের দ্বারস্থ হতে হচ্ছে | তার উপর, এইরম হঠাৎ হয়ে যাওয়াতে হকচকিয়ে গেছে একদম |

এসে কোনোমতে হাত,মুখ ধুয়ে জামা পালটে শুয়ে পড়লো, আর শুয়েই ঘুমিয়ে গেল | তোয়াকে আর ডাকে নি | সে বেচারি আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিল |

সে রাত কিন্তু আর পার হলো না, ঘুমের মধ্যেই হারিয়ে গেলেন সাগরনীলের মা | সকালে আর চোখ মেলে তাকালেন না | ঘড়িতে কটা হবে তখন ? এই সাড়ে চারটে, পাঁচটা | ঠিক সেই সময় ওর পিসেমশাইয়ের ফোনে ফোন এল | উনার চেনা নার্সিং হোম, তাই উনাকেই জানিয়েছে |
উনি নিজের স্ত্রীকে জানিয়ে রাখলেন | ওর পিসি শুনে তক্ষুনি ডাকতে যাচ্ছিলেন, উনিই বারণ করলেন, “এইতো এল সাগর, এক ঘন্টাও হয়নি | এখনই ডেকো না, একটু ঘুমিয়ে নিক | কি করবে ছুটে গিয়ে ? এখন আর তো কিছু করার নেই | শুধু শুধু ওর শরীর খারাপ করবে |”
না, খবরটা শুনে কান্নাকাটি করেনি সাগরনীল | চুপচাপ সব কাজ করে গিয়েছিল, এবারেও পিসিরাই সব ঠিক করে দিলেন |
বাবার বেলায় অন্য রকম মনে হয়েছিল | সেবারে ওর বয়েসও অনেক কম ছিল, আর কষ্টটা একদম অন্তরে গিয়ে লেগেছিল | ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল ওকে | এবারে কিন্তু সাগরনীল সেভাবে ভেঙে পড়েনি, ধাক্কা খেয়েছিল একটা | কি হারালো, সেটাই তো এখনো স্পষ্ট না | কি যে হয়ে গেল এখনও যেন ঠিক ধরতে পারছে না | বুঝতে হয়তো ওর সময় লাগবে |
তবে ও আরেকটা জিনিস লক্ষ্য করেছিল, তোয়া যেন কেমন ঝিমিয়ে আছে | নার্সিং হোমে তোয়াও গিয়েছিল ওর মায়ের চলে যাবার খবর শুনে | ওখানে কি একটা ওষুধও কিনলো যেন, সাগরনীল জিজ্ঞেস করাতে বলেছিল, “ওই ডিসপ্রিন |”
পর পর দুটো মৃত্যু মানুষকে নাড়িয়ে দিয়ে যায় তো, একটু বেশিই যেন ঘাবড়ে গিয়েছিল সাগরনীল | জিজ্ঞেস করেছিল, “তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে তোয়া ? খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে তোমাকে, চোখের তলায় কেমন কালি পরে গেছে |”
” সেরম কিছু না,” তোয়া ওর গালে হাত রেখে আস্বস্ত করেছিল, ” ওই একটু ক্লান্ত লাগছে ব্যাস |”
কেমন করে যেন তাকিয়েছিল ওর দিকে সাগরনীল, “আমি ঠিক আছি নীল”, ওকে আশ্বাস দিয়েই বলেছিল তোয়া | লুকিয়েছিল একটা জিনিস, কিন্তু আর উপায় কি ? এখন বললে কি সাগরনীল সেটাকে ভালো ভাবে নেবে ? না রেগে যাবে বা ভেঙে পড়বে ? নাকি এখন শুনে ওর আফসোস হবে ? সাগরনীল এমন চুপচাপ হয়ে গেছে তোয়া ঠিক ধরতে পারছে না ওর মনে কি চলছে | কেমন যেন ভয় পেয়ে আছে | তোয়া ওকে এখন আর নতুন কিছু বলে আরও চিন্তায় ফেলতে চায় না | ফিরে গিয়েই কথা বলবে |

কাজ মিটলো যেদিন, সেদিন বিকেলে ওর পিসি জিজ্ঞেস করলেন, “বাড়িটার কি করবি রে সাগর ?”
পিসেমশাই বললেন, “এবারেই নিস্পত্তি করে দিয়ে যা, আবার কবে তোর সময় হবে | আর সেই এত বড় বাড়ি বন্ধ অবস্থায় পড়ে থাকা ভালো না রে |”
উফঃ ! ছুটি নেই নাকি ওর একটু ? ভীষণ ক্লান্ত লাগছে সাগরনীলের | এমন বেকায়দায় টেবিলে মাথা নামিয়ে রাখলো যে মাথাটা সজোরে ঠুঁকেই গেল ওখানে রাখা একটা কি কাঠের বাক্সে |
“আহা রে! লাগলো জোরে ?” বলে ওর পিসিই মাথায় খানিক হাত বুলিয়ে দিলেন, বললেন “আরে এইটা বৌদির গয়নার বাক্স | নিয়ে যাস তুই এইসব |”
জোরেই লেগেছে সাগরনীলের মাথায়, উঠে গিয়ে একটু জল দিয়ে এল | তারপর কি খেয়াল হলো বললো , “এই গয়নাগুলো মা নাকি দাদার বিয়ের জন্যে রেখেছিল জানো পিসি ? নিজেই বললো আমাদের | কি করবো এইগুলোর বলোতো? আমি নিয়ে যেতে পারবো না | ”
ওর পিসিও শুনে অবাক হলেন |

রাতে এমনিই দেরি পর্যন্ত জেগে থাকা অভ্যেস সাগরনীলের, এখন যেন শুলেও ঘুম আসছে না | খুব ক্লান্ত লাগছে, গায়ে হাতে যন্ত্রনা হচ্ছে, তাও ঘুমিয়ে পড়তে পারছে না | চোখ বন্ধ করলেই মায়ের মুখটা ভাসছে চোখের সামনে | মায়ের ঘরটা যেন টানছে ওকে | তোয়া ঘুমিয়ে পড়েছে কখন | ও উঠে অন্ধকার বাড়িতে একা একা ঘুরে বেরিয়েছে কাল রাতে | আজও তোয়ার পাশ থেকে সাবধানে উঠে জ্যাকেটটা গায়ে দিয়ে নিচে নেমে এল | কত যে স্মৃতি এই বাড়িতে ওর | সেই জন্মে থেকে দীর্ঘ আঠেরোটা বছর, এইখানেই তো ছিল | আর আজ দেখো, একে একে ঠাকুমা, বাবা, দাদা আর এখন মা সবাইকে বিদায় জানিয়ে একা ওই থেকে গেছে |
এই এক সপ্তাহে কি হয়ে গেল ? ও যেন থৈ পাচ্ছে না |
পায়ে পায়ে মায়ের ঘরে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলো অনেকক্ষণ | এইটুকু ঘরে মা কাটিয়ে দিল এতগুলো বছর দাদার সাথে ? ভাবলে এখন অবাক লাগছে সাগরনীলের | এতদিনে যেন ও বুঝেছে যে মা শুধু ওর সাথে সময় কাটায়নি এরকম না | অন্য কিছুই করেনি, এই এতদিন শুধু ওর দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে বেঁচেছে | সেই একাকী, নিঃসঙ্গ জীবনের কথা যতই ভাবছে সাগরনীল, ততই ওর মনের মধ্যে মায়ের জন্যে একটা ভীষণ কষ্ট পাক খাচ্ছে | ও আগে কেন এইটা ভেবে দেখেনি ? ও আর তোয়া যে সন্তান কামনা করছে সেও যদি এরকম হয় ? রুদ্রনীলের মতন ? তাহলে কি সাগরনীল আর তোয়াও নিজেদের তার সাথে বেঁধে একটা ঘরে বন্দি হয়ে থাকবে ? নিজের সন্তান এইরকম কষ্ট পেলে কি মনে হয় ?
এখন এই বয়েসে এসে, নিজেদের সন্তান আনার সিদ্ধান্তের দরজায় দাঁড়িয়ে সাগরনীলের মনে এইসব প্রশ্ন ধাক্কা খেয়ে বেড়াচ্ছে | এতকাল যা শুধু মায়ের দেয়া অবহেলা মনে হয়েছিল এখন তার গভীরে দেখছে যেন |
এইবার এসে দেখেছে ও, ওই ঘরের একটা দেয়াল ওর জন্যে বরাদ্দ করেছিল মা | সেখানে ওর কত ছবি, নানা বয়েসের | সব থেকে নতুন সংযোজন ওর আর তোয়ার বিয়ের একটা ছবি, বোধয় পিসির ছেলের তোলা | ওর সমস্ত জীবনটা ওর মায়ের কাছে এই একটা দেয়ালে ধরা আছে… “পরের জন্মে আবার তোর মা হবো” ওর কানে বাজছে এই শেষ কথাগুলো | এখন আর এইসব কেন বললো মা ?
কেন ও নিজে এত বছর এত অভিমান বয়ে বেড়ালো ?
কেন আগেই মাকে বললো না, “আমি রাগ করে নেই আর, ভুলে যাও এইসব কথা | আমাকে ভালোবাসতে হবে না তোমায় | আমি তোমাকে ভালোবাসি মা, সব সময় বেসে এসেছি | বোঝাতে পারিনি তোমাকে | ওইটাই আমার রাগ, অভিমান, দুঃখ হয়ে প্রকাশ পেয়েছে | শুধু সেইটুকু বলতে এলাম |”
কোথাও বোধয় জানলার পাল্লা খোলা আছে শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়া আসছে, কাঁপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে | তাও ওই শীতে কেন জানি ঘেমে উঠছে সাগরনীল | এতদিন যে অভিমান ছিল মায়ের উপর, সেটা যখন ও সরিয়ে রাখলো মাই হাত ফস্কে চলে গেল !! আর কি অদ্ভুত সব জিনিস বলে গেল ওকে | কেন ?
ভেবে পায় না সাগরনীল |
একজন বেঁচে থাকলে তার উপর রাগ করা যায়, অভিমান করা যায় | কিন্তু যে নেই, তার উপর ?
মাকে ছাড়াই তো ছিল, থাকবে তাই…তাহলে মনের মধ্যে কি হচ্ছে ? কিসের কষ্ট ? কেন এত রকমের ভাবনা চিন্তা আসছে? এই শীতের রাতে, তোয়ার পাশে আরামে না শুয়ে কি করছে এই ঘরে ও ?
অদ্ভুত একটা যন্ত্রনা যেন ওর মনের ভিতরে, কি এক ভয় | কিসের ? জানে না ও | ভীষণ ঠান্ডা লাগছে, মাথায় যন্ত্রনা হচ্ছে খুব | তাও এই ঘর থেকে পা সরছে না | যেন ঐখানেই গেঁথে গেছে, এই ঘরের সামনে চিরকাল দাঁড়িয়ে থাকাই ওর শাস্তি |
এইরকম কি রোজ রাতেই হবে নাকি ? এ জিনিস যে অসহ্য!! এই স্মৃতির জমায়েতে একটা একলা মানুষ পাগল হয়ে যাবে যে | রাতে হলেই তো ওরা অতন্দ্র চোখ মেলে জেগে থাকবে, এটা ওটা টেনে টেনে ওকে দেখাবে, “এই দেখো তোমার ফেলে আসা সময়”, প্ৰশ্ন করবে, “কি সাগরনীল অনুশোচনা হচ্ছে ?”
সাগরনীল তো রক্ত মাংসের মানুষ ও যুঝবে কি করে এই অশরীরী স্মৃতির দানবদের সাথে ?
না, পারবে না, হেরে যাবে |
কে বাঁচাবে ওকে এদের থেকে ? কে ?
আছে আছে, সঙ্গেই তো এসেছে সে | একা না তো ও … কিন্তু তোয়া অব্দি যে যেতে পারছে না সাগরনীল |
কার চটির আওয়াজ বাজছে নিঝুম রাতে, শান্ত বাড়িতে | তোয়া ঘুমের মধ্যেই হাত বাড়িয়ে খুঁজেছে ওকে, বিছানায় নেই বুঝে খুঁজতে এসেছে |এসে দেখে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে |
“কি হয়েছে নীল ?” তোয়ার গলা ঘুম আর ঠান্ডায় একটু জড়ানো, কিন্তু তাতে উদ্বেগ স্পষ্ট | সাগরনীলের পিঠে হাত রাখলো তোয়া, যেন বহুদূর থেকে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে এল |
উত্তর দিল না, শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তোয়াকে | সাগরনীলের হাত দুটো একদম ঠান্ডা হয়ে গেছে, শীতের রাতে ওরম হাত গায়ে ঠেকলে অস্বতি হয় | তোয়া কিন্তু কোনো অভিযোগ ছাড়াই স্বীকার করে নিল এইটুকু অস্বস্তি, ও জানে তো কষ্ট হচ্ছে সাগরনীলের | বুঝলো শীতে কাঁপছে সাগরনীল, কিন্তু ওর কপাল ঘেমে উঠেছে | জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে, হাঁপাচ্ছে, যেন খুব হয় পেয়েছে |
চিন্তাই হলো তোয়ার, জিজ্ঞেস করলো, “নীল ? শরীর খারাপ লাগছে ?”
“উঁহু”, না শরীর ঠিক আছে, তাহলে ?
এই প্রথম যেন সাগরনীল ওকে বলতে পারছে না কি হয়েছে ওর| নিজেই বুঝতে পারছে না তো, বলবে কি করে ? তোয়া তাড়া দিল না, জড়িয়ে ধরে থাকলো | তারপর হাত ধরে নিয়ে গেল ঘরে | আপত্তি করলো না সাগরনীল, নিজেও তো তোয়ার কাছেই যেতে চাইছিলো, যেতে পারছিল না তো | ভাগ্যিস তোয়া এসে উদ্ধার করলো ওকে |
কম্বলটা নিজেদের গায়ে ভালো করে টেনে ওর পাশেই আবার বালিশে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়লো তোয়া | খানিক্ষন চুপ করে শুয়ে থাকলো সাগরনীল | তোয়া ওর একদম নিরাপদ আশ্রয়, ও পাশে থাকলে কোনো ভয় নেই | আর একা লাগছে না | তারপর একদম অসহায় হয়ে বললো, “তোয়া, আমার ভালো লাগছে না একদম ” |
তোয়া ওর মাথায় হাত রাখলো, এই যন্ত্রনা বাড়তে না দেবার উপায় আছে, সহজ গলাতেই বললো “এখানে অনেকদিন হলো নীল, বাড়ি ফিরে চলো |”
বাড়ি ?
হ্যাঁ, বাড়ি ফিরে যাবে সাগরনীল | ওর আর তোয়ার সংসারে | সেখানে ভালোবাসা আছে, মন খুলে কথা আছে, এইরকম কষ্টের রাতে স্নেহভরা সান্ত্বনা আছে | অবহেলা নেই, হেঁয়ালি নেই, সারাজীবন উপেক্ষা করে সামনের জন্মের হাতছানি নেই | সাগরনীলের প্রতি অশেষ মমতা আছে সেখানে | সাগরনীলের জন্যে তোয়া আছে, তোয়ার জন্যে ওর নীল | ব্যাস ! আর কি দরকার ?
এই খালি বাড়িতে কেন ঘুরে ঘুরে মরছে সাগরনীল, এখানে কিছু নেই ওর, শুধু স্মৃতি ! তোয়ার এই ছোট্ট কথায় যেন মুক্তির রাস্তা বেরিয়ে এল |
উঠে বসে বললো, “সেই ভালো তোয়া, এইখানে থাকলে কেমন যেন লাগছে আমার | চলো বাড়ি যাই”, গায়ের জ্যাকেটটা খুলে আরাম করে শুলো তোয়ার পাশে | তোয়াই ওর বুকের কাছে সরে এল |
“তোমার শরীর ঠিক আছে তো তোয়া ? সরি তোমার ভেঙে গেল “, ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলো সাগরনীল |
“খুব টায়ার্ড লাগছে, আর বড্ডো ঠান্ডা | এই আরকি..”, তোয়া বললো, অর্ধেক সত্যিটুকু |
“হুঁ, খুব ঠান্ডা এখানে | চলো কাল পরশুই বেরিয়ে যাবো | এইসব বেচে দেব, আর আসবো না এখানে |” মনস্থির করে ফেলেছে সাগরনীল, এইভাবে নিজেকে কষ্ট দিয়ে তো কোনো লাভ নেই |
ওর দোষ কি ছিল এখন কে বিচার করে ওকে বলে দেবে ? আর সেই দোষের শাস্তিই বা কি ? ও কি কষ্ট পায় নি এত বছর ?
সেটা যথেষ্ঠ শাস্তি না তাই বা কে বললো ?
তোয়ার পাশে এসেই মনের যত চিন্তার জট যেন আলগা হয়ে খুলে এসেছে | এই শেষ কদিন মায়ের মানসিক স্থিতিই কি ছিল কে জানে ? এইরকম ধাক্কা খাওয়া মানুষের শেষ কথার গভীর মানে খুঁজতে যাওয়া নির্বুদ্ধিতা | না এইসব ভাববে না আর সাগরনীল | আর ওই অন্ধকার রাতে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াবে না |
তোয়ার গায়ের মিষ্টি গন্ধ আসছে, ওর শরীরের ওম কেন ছড়িয়ে পড়ছে … ঘুমিয়ে পড়লো কখন দুজনেই, কেউ আর খেয়াল করলো না |
সকাল বেলায় তোয়ারই ঘুম ভাঙলো আগে, উঠে দেখলো সাগরনীল উপুড় হয়ে ঘুমোচ্ছে, বাঁ হাতটা খাটের পাশে ঝুলছে, কম্বল সরে গেছে গা থেকে | যেই ও কম্বলটা ঠিক করে দিল অমনি সাগরনীল ওর হাত চেপে ধরলো, “এই এখন উঠো না, আরেকটু শোও, ঠান্ডা খুব এখন”|
তোয়া হাসলো, “শুতে পারি, তুমি আমার জন্যে একটু চা করে আনো যদি | কাল রাতে পালিয়ে বেড়িয়েছো, আমাকে ঠান্ডায় খুঁজে আনতে হয়েছে, তার কম্পেন্সেশন |”
শব্দ করে হাসলো সাগরনীল, “ঠিক কথা ! আনছি, আগে শোও আরেকটু আমার পাশে |”
উফঃ! হেসেছে সাগরনীল, যেন কত যুগ পরে | তোয়ার কথা আছে তো ওর সাথে | এইসবের জন্যে এমন অবস্থা হয়েছিল যে সাগরনীল যেন আর নিজের মধ্যেই ছিল না | এই রাতে রাতে অন্ধকারে ঘুরে বেড়িয়ে শুধু শুধু নিজেকে যন্ত্রনা দেয়া | আজ একটু ভালো লাগছে দেখতে, স্বাভাবিক লাগছে | তোয়া না আসলে সঙ্গে ? ইশ বেচারা কি যে করতো, তোয়ার নিজেরই ভেবে ভয় করছে |
“ওই দেখ ! কি এত ভাবছো ? প্লিজ তোয়া তুমি আর ভেবো না বেশি | ভেবে ভেবে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছিলাম, কাল তুমি না ডেকে আনলে ওখানেই থেকে যেতাম”, তারপর তোয়াকে ভালো করে দেখে বললো, “এই কি ব্যাপার বলতো ? আমি কি বলছি তুমি শুনছো ?”
তোয়া হাসলো, ওর পাশে শুয়ে বললো, “সকালে উঠে বকর বকর করছো কেন, চা করে আনো না”|
সাগরনীল অনেকদিন পরে ওই ফিচেল হাসি হেসে বললো, “সেই তো ! বন্ডেড লেবারের তো| এই ঠান্ডায় উঠে তোয়া ম্যাডামের চা করে আনো আগে, এত কথা কিসের ? আগে এদিকে এস তবে চা করে আনবো, না হলে না |”
কথা সাজাচ্ছে তোয়া মনে মনে, কি ভাবে বলবে সাগরনীলকে ?

ঘুম থেকে উঠে আজ পরপর অনেক কাজ এগিয়ে ফেলেছে সাগরনীল | কাল রাতে যে অন্ধকারে একা একা ঘুরছিল, তাকে আর আজ দেখা গেল না | আজ ল্যাপটপের সামনে বসে এক মনে কাজ করছে, সেই কাজ পাগল সাগরনীল | স্থিরবুদ্ধি, শান্ত, গুছোনো | স্বচ্ছতোয়ার সাগরনীল | তিন নম্বর কফির কাপ ওর হাতে |
ঝড়ের গতিতে সিধান্ত নিচ্ছে আর এক এক করে জিনিস গুটিয়ে আনছে |
তোয়া দেখছে ওকে | কদিন যেন খেই হারিয়ে ফেলছিল, আজ আবার সামলে নিয়েছে | আজ ওর চেনা চেনা নীল, ওকে দেখে মাঝেমাঝে ফিচেল হাসি হাসছে আবার কাজ করছে | তোয়ার ও দেখে খুব শান্তি লাগছে | সাগরনীলের কষ্ট হলে তোয়ারও তো কষ্ট হয় | একটুও ভালো লাগে না |
মাথায় মাথায় সব হিসেবে করে ফেলেছে সাগরনীল | পিসি, পিসেমশাইকে ডেকেছে আজ | এই বাড়ির একটা ব্যবস্থা করে যাবে ও | দাম ভালোই উঠবে, রাস্তার উপর বাড়িটা | হ্যাঁ, বিক্রিই করে দেবে | আর হয়তো আসবেই না কোনোদিন এখানে, পিছুটান রেখে লাভ নেই | কবে আবার মাথায় খেয়াল চাপবে এসে অন্ধকারে হাতড়ে মরবে | দরকার নেই সেই সুযোগই রাখার |
আর ওই গয়নার ব্যাপারেও ভেবে ফেলেছে | দাদার বিয়ের জন্যে মায়ের রাখা গয়না ও একদম নিজের বাড়ি নিয়ে যেতে চায় না | না, কুসংস্কারে বিশ্বাস করে না সাগরনীল, কিন্তু যেটা ওর ভাগের না সেটা ও নিতে চায় না | দাদা থাকতে থাকতেই মা ওকে দিলে আলাদা ব্যাপার ছিল | এখন আলাদা ব্যাপার |
তাছাড়া, এই বাড়ি তো আর এখুনি বিক্রি হবে না | ওই পিসেমশাই বা পিস্তুতু দাদার সাহায্য লাগবে, তা সেই সাহায্যের বিনিময়ে সাগরনীল কি দেবে উনাদের ? টাকা ধরে দেয়া যাবে না, অপমানজনক হবে | খুব নিকট আত্মীয়, তাতে গুরুজন | অনেক করেছেন ওর জন্যে | অনুরোধ করলে যে না করে দেবেন তা নয়, কিন্তু তাও উনাদের সময় যাবে তো এতে | বাড়ি দেখানো, বিক্রি করা সোজা না, একটা হ্যাপার জিনিস | ও নিজে এখানে থেকে করার উপায় ও নেই | কতদিন লাগবে তারই তো ঠিক নেই | তাই উপকার চাইতে তো হবেই ওকে |
এ সাধারণ উপকার তো না | তবে ? শুধু হাতে চায় কি করে ?

তাই সাগরনীল নিজের ব্যবসার বুদ্ধি লাগিয়ে দুটো সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে | একটাকে দিয়ে অন্যটা |
দুপুরে আজ এই বাড়িতেই খাবে সবাই | এই বাড়ির রান্নার লোককে দিয়ে বাজার আর রান্না দুই করিয়েছে তোয়া | যখন অঞ্জনারা এলেন তখন এই একটা মতন বাজে, সাগরনীল তখন স্নানে গেছে |
অঞ্জনা তোয়াকেই অনুযোগ করে বললেন, “সাগর বললো কালকেই চলে যাবে তোমরা | আর কটা দিন থেকে গেলে পারতে | আবার কবে আসবে কে জানে |”
তোয়া কিন্তু নিজের মনের কথাটাই অঞ্জনাকে খুলে বললো, “আসলে পিসি নীল এখানে থাকতে পারছে না একদম | দু রাত পরপর কি অস্থির হয়ে কাটিয়েছে আমি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না জানো, ঘুমোয়নি একটুও | এই এত বড় বাড়িতে এমনিই অন্যরকম লাগছে আমারই, তোমরা ছিলে তাও একরকম লাগছিল | তারপর এসেই একদম চোখের সামনে মা ওরকম … ”
অঞ্জনাও বুঝলেন, ওর হাতের উপর হাত রাখলেন বললেন, “হ্যাঁ | তোমাদের উপর দিয়ে যেন একটা ঝড় চলে গেল | যাগ্গে মায়ের সাথে একবার শেষ দেখা হয়ে গেল ওর | তাও ভাগ্গিস তুমি সঙ্গে এসেছিলে নাহলে যে সাগর কি করতো ! ভাবতেও আমি ভয় পাচ্ছি | দাদা যেবার চলে গেল, উফঃ ! কি কান্ড করেছিল সাগর, মনে আছে তোমার ?” শেষ প্ৰশ্নটা নিজের স্বামীকে করলেন |
উনিও ঘাড় নাড়লেন, বললেন, “মনে নেই আবার ? বাবা !! আমি তো ভয় পাচ্ছিলাম যে ওকেই না হসপিটালে ভর্তি করতে হয় |” তোয়া এইটা জানতো না, উনারাই ওকে সেই গল্প শোনালেন |

ওরা কথা বলতে বলতেই সাগরনীল নেমে এল, এক গাল হেসে বললো, “এসে গেছো তোমরা, ভালো হয়েছে | খিদে পেয়ে গেছে আমার | তোয়া তুমি একটু খেতে দিয়ে দেবে প্লিজ |” তোয়ার সাথে ওর পিসিও যাচ্ছিলেন, সাগরনীল ডাকলো, “পিসি তুমি একটু এস তো আমার সাথে …”
ওই কাঠের বাক্স থেকে গয়নার পুঁটলি বের করে পিসির হাতে দিয়ে বললো, “তুমি এইগুলো রাখো, এ তো ঠাকুমার গয়না | তোমারও পাওনা তো |”
ওর পিসি আপত্তি করে বললেন, “না না সেকি! আমি কেন ? তুই রাখ, তোরই তো পাওয়া উচিত | তোয়া পরবে |”
সাগরনীল নাছোড়বান্দা, “না না, এইগুলো তুমি রাখো | আমার পাওয়া উচিত বলছো তো ? আমি দিচ্ছি তোমাকে, প্লিজ নাও, না কোরো না পিসি | মনে করো না যে বাবা তোমাকে দিচ্ছে |”
সাবেকি সোনার গয়না, এর দাম হবে ভালোই, এইভাবে দিয়ে দিচ্ছে সাগরনীল ? আশ্চর্য্য হলেন, তবে কি আর করবেন | জোরাজুরিতে অঞ্জনা রাজি হয়ে গেলেন |
খেতে বসে পিসেমশাইকেই বললো সাগরনীল, “আমি এই বাড়িটা বিক্রি করে দিতে চাই, কিন্তু অতদিন আমি এখানে থেকে তো বিক্রি করে যেতে পারবো না | কি করি বলতো ? তোমার নামে পাওয়ার অফ এটর্নি দিয়ে যাই ? তুমি একটু দেখেশুনে যদি বিক্রি করিয়ে দাও, যা পাওয়া যায় আরকি ” উনাকে কিছু বলতে না দিয়েই জুড়ে দিল, “খুবই ঝামেলার ব্যাপার বাড়ি ফাড়ি বিক্রি করা | আমি তো এখানে কিছু চিনিও না, সেই গেছি ক্লাস টুয়েলভের পরে ব্যাস! তুমি যদি এটাতেও একটু পার করে দাও আমার বড় উপকার হয় | ”
আগেই গয়নাগুলো ধরিয়ে দিয়েছে এইবার অনুরোধ করছে, ওর পিসেমশাই ফেলবেন কি করে ? কি করবেন বুঝতে পারছেন না, মুখের উপর না করা যায় না | আর মিথ্যে কিছু না, সাগরনীল তো সত্যি এখানে কিছু চেনে না, আর সব কাজ ফেলে ও এখানে থাকতেও পারে না অনিৰ্দিষ্ট কালের জন্যে |
একটু ভেবে বললেন, “তুই এক কাজ কর, আমার নামে না করে দৃপ্তর নামে করে দে পাওয়ার অফ এটর্নি | ও এইসব ভালো বোঝে, দালাল লাগিয়ে ঠিক উৎরে দেবে |” তারপর একটু ভেবে বললেন, “তবে দাম কত উঠবে সে আমি বলতে পারছি না রে সাগর, তোর যদি দামে না পোষায়..”
“আররে না না, দাম নিয়ে আমার কোনো অসুবিধে নেই | আমি শুধু ওই খালি ফেলে রাখতে চাই না বাড়িটা | কে এসে জবরদখল করবে কি আরও কিছু করবে তখন সেই কেস ফেস হয়ে ঝামেলা পোহাতে হবে | আমি দৃপ্তদার নামেই করে দেব, আজকেই যাবো |”
ব্যাস হয়ে গেল ওর ঘাড় থেকে নামানো | আর সত্যি দাম নিয়ে সাগরনীলের সেরম মাথাব্যাথা নেই | যা পাওয়া যায় তাই সই |
জিনিসপত্র ওদের খুব বেশি ছিল না | সেগুলো মোটামুটি ওরা গুছিয়ে নিয়েছে | এই বাড়ি থেকে ওর কিছুই নিয়ে যাবার ইচ্ছে নেই, শুধু বাবার একটা শাল আলমারি থেকে বের করে নিজের ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখলো | না, মায়ের কিছু নেয়নি, ওই গয়না বাদে | ওই ঘরের দিকেই আর যায়নি, নিজেকেই ধমকেছে, “সামনের দিকে তাকাও সাগরনীল, পিছনের দিকে না “|
বাড়ির বাকি যা জিনিস আছে, চেয়ার টেবিল, খাট, এইসব পিসেমশাই যা বুঝবেন করবেন, বললো, “কেউ নিলে দিয়ে দিও, বা বাড়ির সাথেই বিক্রি করে দিও | যা ইচ্ছে “|
ওর সাথে কথা বলেই বুঝেছেন ওর পিসেমশাই, এই শেষ বারের মতন সব পিছুটান কাটিয়ে চলে যাচ্ছে সাগরনীল | আর আসবে না কোনোদিন | বললেন, “এই বাড়ি না থাক, আমাদের সাথে দেখা করতে আসবি তো রে সাগর ?”
মাথা নামিয়ে হাসলো সাগরনীল উত্তর দিল না, মিথ্যে কথা ও বলতে চায় না |

শুধু একটা জিনিস শেষবারের মতন করা ওর বাকি | ওই একবার, ওর ওই ট্রি-হাউসটা, বাবুই পাখির বাসাটা ও দেখে আসতে চায় | তোয়াকেও দেখাতে চায় | ওর জীবনের সেরা সময়গুলো ওখানে বাঁধা পড়ে আছে | তোয়া একবার দেখে নিলে, ছুঁয়ে দিলে যেন সোনার রং লাগবে তাতে |
খুব সাবধানে ওই ঘোরানো সিঁড়িতে পা রাখলো তোয়া, আসতে আসতে দু এক ধাপ উঠলো |
সাগরনীল যেন ছেলেবেলায় ফিরে গেছে, নিজে আগেই উঠে পড়েছে | তাড়া দিয়ে বললো, “আরে ভয় নেই | পড়লেও সেরম লাগবে না, আটকে যাবে, নিচে পড়বে না |”
তোয়া ভয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো, না এখন ও কোনোরকম ঝুঁকি নিতে চায় না | নিজের ডান হাতটা বাড়িয়ে বললো, “নীল আমার হাত ধরে ওঠো প্লিজ” অন্য হাতে রেলিং ধরেই ছিল |
ওর গলায় কি যেন ছিল সাগরনীল থমকে দাঁড়ালো | নেমে এসে ওর হাতটা শক্ত করে ধরে ওর দিকে তাকিয়ে বললো, “ভয় নেই তোয়া, আমি তোমার হাত ধরে থাকছি, এস |”
ভেতরটা অনেকদিন অবলহেলা, অযত্নে নোংরা হয়ে আছে | তাও দেখলেই বোঝা যায় যে একজন ছোট্ট ছেলে এখানে অনেক সময় কাটিয়েছে, এখানেই বড় হয়ে উঠেছে | কাঠের গায়ে গায়ে অনেককিছু লেখা, কোনোটা পেন্সিলে, কোনোটা কম্পাস দিয়ে খুঁচিয়ে | হাতের লেখা পালটে পালটে গেছে, সময়ের সাথে সাথে | কিছু পড়ার জিনিস, কিছু বা এমনিই কোনো কার্টুনের নাম | কত আঁকিবুঁকি, ফর্মুলা |
সাগরনীলের সমস্ত ছোটোবেলাটা যেন একটা ছবির মতন ওর সামনে ভাসছে | এইখানে কতদিন বাবা ওকে পড়িয়েছেন, কত গল্প করেছেন, কত স্মৃতি | সুখের দিন সে সব ওর, এই জায়গাটার কোনো স্মৃতিতে দুঃখের হাত পড়েনি | তাও আর কোনোদিন আসবে না এখানে সাগরনীল | এই শেষ বার | একটা কষ্ট না চাইতেই যে দলা পাকিয়ে উঠছে গলায়, কেন ? এখন এখানে থেকেই বা কি করতো ও ? তোয়ার সাথে বসে গল্প করতো ?
দেখছে আরেকজনও | তার পরম ভালোবাসার মানুষটাকে, তার জীবনের একটা অধ্যায়কে | সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যে হাত আঁকড়ে ধরেছিল, সে ধরাই আছে | নিজের মনেই অনেককিছু বলে যাচ্ছে সাগরনীল, “এইটা ক্লাস এইটের, এইটা আমি আইআইটির প্রিপারেশনের সময় বানিয়েছিলাম | ঐযে এইটা একটা কার্টুন দেখাতো তখন টিভিতে …”
জানে তোয়া এখানে অনেক স্মৃতি ওর, একবার সেই ঝাঁপি খুলে বসলে আর কি ফেরানো যাবে ? এখানে আর কি করবে সাগরনীল ? এইসবে হারিয়ে না যায়, বড্ডো আবেগী যে…
“এইসব বিক্রি হয়ে যাবে তোয়া, আর রেখে কি হবে ?”, ওর গলায় যন্ত্রনা | নিজের সব স্মৃতি বোঝাই এই বাড়ি বিক্রি করে দেয়া কি এত সহজ নাকি ? আবার রেখে দেয়াও যে কঠিন | এই “বাবুই পাখির বাসা” চিরকালের মতন ছেড়ে চলে যাওয়া …|
এখান থেকে সাগরনীলকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে ওকে | শুধু ওর শরীরটা না, ওর মনটাকেও ফেরাতে হবে …এই গুরু দ্বায়িত্ত্ব তোয়ার | সেই যেদিন ওরা প্রথম দেখা করেছিল এক সন্ধ্যেবেলায়, সেদিন থেকেই এই ছেলেটার সব দ্বায়িত্ব তোয়ার, না ? আর ওর জায়গায় আজ যদি এই অবস্থায় তোয়া থাকতো, তোয়ার নীল সর্বশক্তি দিয়ে ওকে আগলে রাখতো না? মাথায় হাত বুলিয়ে বলতো না, “ভয় নেই তোয়া, এই তো আমি আছি তোমার কাছে ” ?
হ্যাঁ বলতো, আগলে রাখতো | তোয়া জানে |
আর আজ সৌভাগ্যবশত ভগবান তোয়ার হাতে তুলে দিয়েছেন এক জাদুকাঠি | যার পরশে সাগরনীলের এই অশান্ত মন আবার আনন্দে ভোরে উঠবে | তোয়া ভেবেছিল এইসব শোক কাটিয়ে উঠুক, নিজেদের বাড়ি ফিরে তারপর বলবে, কিন্তু না আর অপেক্ষা না, এক্ষুনি বলা দরকার | এই ট্রি হাউসে আর একটা সুন্দর মুহূর্ত জুড়ে দিয়ে যাবে আজ তোয়া | অনেকটা রাস্তা যেতেও হবে তো, সাগরনীলের স্নেহ তোয়ার দরকার খুব, ওর মনোযোগ খুব প্রয়োজন | আর তোয়া যদি একবার খুলে বলে, ওর নীল দেবে ওকে ওর যা লাগবে, তার থেকেও অনেক অনেক বেশি |
সাগরনীলের হাত ধরে সামান্য টান দিল তোয়া, “নীল …”

নিজের কথা থামিয়ে ওর দিকে ফিরে তাকালো সাগরনীল, কাছে সরে এসে জিজ্ঞেস করলো, “কি তোয়া ?”
ওর চোখে চোখ রাখলো তোয়া | কি গভীর সে চাহুনি, সাগরনীলের আরও কাছে সরে এল, ওর আওয়াজ শুধু সাগরনীলের কানে পৌঁছচ্ছে, আর কেউ শুনছে না, ” নীল আমি, টেস্ট করে দেখেছি … পসিটিভ “|
তোয়ার মাথা নেমে এলো সাগরনীলের বুকের উপর, ওকে জড়িয়ে ধরলো সাগরনীল, “কবে জানলে ? আমাকে আগে বলো নি কেন তোয়া ?”
দেখো কান্ড! এই কথা জিজ্ঞেস করতে তো ভুলেই গিয়েছিল তালেগোলে | আহা! তোয়া একা একা এইভাবে… ইশ !কি রকম মানুষ তুমি সাগরনীল, হ্যাঁ ? দেখছো মেয়েটার চোখের তলায় কালি পড়েছে, ক্লান্ত লাগছে বলছে আর এইটা তোমার মাথায় এলো না ? এদিকে খুব তো বুদ্ধির গর্ব করো |

“এইতো বললাম নীল, তোমাকে না বললে কি করে হবে ?”, তোয়ার গলা অদূরে, সেখানে হাজার আশা মাখামাখি |
অতীত নিজের বাক্স প্যাঁটরা গুটিয়ে, নিঃশ্চুপে হাঁটা দিল |
সাগরনীলের আর মন নেই যে ফেলে আসা দিনে | ও তোয়ার সাথে জড়িয়ে আছে একদম এই বর্তমানের শক্ত মাটিতে | অচেনা, খুব অচেনা একটা সুখ যেন তোলপাড় করে দিচ্ছে ওর ভেতরটা | বাকি সব কিছু আবছা হয়ে আসছে | মনের সবটুকু তোয়ার দেয়া এই খবরে ভোরে উঠেছে |
কতক্ষন ছিল ওরা ওই ট্রি-হাউসে ? কে হিসেবে রেখেছে ?
নামছে এইবার ওরা সিঁড়ি বেয়ে |
আগে আগে সাগরনীল, ওর হাতে শক্ত করে ধরা তোয়ার হাত | বারবার ঘুরেঘুরে দেখছে ওকে আর বলছে, “সাবধানে এস তোয়া, আসতে আসতে একদম …”

গাড়ি আসানসোলকে পিছনে ফেলে অনেক এগিয়ে এসেছে , “এই তুমি নাম ভেবেছো কিছু ?”, সাগরনীল জিজ্ঞেস করলো |
তোয়া হাসলো বললো, “আজ্ঞে না ! এখনো নাম ভাবার অনেক সময় আছে …”
“আমি ভেবেছি অনেকগুলো | বলি ?”
তোয়া জোরে জোরে হাসছে, বলছে, “হ্যাঁ বলো, বারণ করলে শুনবে নাকি ?”
ওদের মুখে অনলাবিল হাসি, চোখ এখন ভবিষ্যতের স্বপ্নে ভরা, মনে আগামীর প্রস্তুতি | আর হাতে শক্ত করে ধরা একে ওপরের হাত |
তোয়া এন্ড নীল, আর আরেকজন যে আসছে … ফরেভার… ফরেভার …

~~~~~সমাপ্ত ~~~~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here