অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_০৪

অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_০৪
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

পায়ের মধ্যে দড়ির ন্যায় কিছু পেঁচিয়ে যাওয়ায় পানির মধ্যে তুলিয়ে যেতে লাগে ইফদিয়ার। মুখের মধ্যে পানি ডুকেছে। যার ফলে কাশি দিয়ে অতীব কষ্টে চেঁচাচ্ছে। কিন্তু চৌপাশে হর্ন বাজনার ফলে তার চেঁচানো কারো কানে পৌঁছাচ্ছে না। পুকুরপাড়টা তাদের বাসা থেকে খানিক দূরত্বে অবস্থিত। যার ফলে বাসার কেউ জানে না ইফদিয়ার যে এখানে। সে কষ্ট করে নিজের হাত বরশির মধ্যে পেঁচিয়ে টান দিল। কিন্তু ভাগ্য সহায় হলো না। বরশির দড়িটা যে লোহার উপর পেঁচানো ছিল। সেটা ঢিলে হয়ে খুলে পড়ে যায়। যার কারণে ইফদিয়ার পুনরায় তলিয়ে যেতে লাগে।
পুকুরপাড়টা বেশ চওড়া আর গভীরতম। যার ফলে কোনো কিছুর সঙ্গে আঁটকে গেলে। সেটার অনুকরণে পানির গভীরতায় ডুবে যায় মানুষ।
ইফদিয়ার প্রাণের মধ্যে শীতল আভা ধরা বেঁধেছে। স্বয়ং আজরাইল বোধ হয় তার সন্নিকটে আসার আহ্বান দিচ্ছে। তবুও কেন যেন তার অক্ষিগোলকে তার মা আর যাবিয়াজের প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠছে। হ্যা এরাই তো তার প্রিয় মানুষ।
এদের জন্যেই সে সব করছে। কিন্তু যাবিয়াজ! সে কি আদৌ তার প্রণয়ের অর্থ বুঝবে! বুঝবে কি প্রণয়ের দহনে পুড়ে ছাইখার হওয়া হৃদয়ের অনুভূতি। এই বিপদ সম্মুখীন মুহূর্তে লোকটার কথা ভীষণভাবে মনে নাড়া দিচ্ছে। বড্ড ভাবাচ্ছে তার কথা। লোকটি কি আসবে তাকে বাঁচাতে! নাকি শুধুই তার মনের ভ্রম রয়ে যাবে।
ধীরে ধীরে পানির নিচে ডুবে যায় ইফদিয়ার। গালের মধ্যে পানি প্রবেশ করছে ক্রমান্বয়ে।
চোখযুগল নিরবে নিশ্রান্ত হয়ে গেল। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবশ হয়ে ডুবে যেতে লাগে।
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

৮.

মিসেস জাবিয়া রুমে বসে চুপটি করে পা টিপছেন আহসান সাহেবের। ডান হাতে ধারালো প্যান্টের বেল্ট ধরে বাঁ হাতে মদ গিলছেন। মেয়ের জমানো টাকায় মদ কিনে আয়াশে উড়াচ্ছেন। এই অমানুষকে কি কখনো বাবা বলে সায় দেওয়া যায়!
কখনো নয় যে মানুষ বাবা নামে কলঙ্গ সে বাবা নয় একজন অমানুষের প্রতিচ্ছবি। তবুও এই অমানুষের সঙ্গে চুপ করে সংসার চালিয়ে যাচ্ছেন মিসেস জাবিয়া। এখনো স্বামীর রাগান্বিত হওয়ার ভয়ে পা টিপছেন। আহসান সাহেবের বেড রুমের বাহির থেকে ড্রয়িং রুমে মেঝে পরিষ্কার করছেন হালিমা। আড়চোখে কয়েকবার আহসান সাহেবের রুম পরখ করছেন তিনি। তাও উনাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে। হালিমা বেগম বয়সে ত্রিশ বছরের বেশি হবেন। তাও শরীরে বেশ জোর আছে উনার। শক্তপোক্ত হাতের বাহু হওয়ায় সহজে কাজ করে হাঁপিয়ে উঠেন না। অথচ মিসেস জাবিয়ার বয়স কমবেশি ৩১ হবে। একটু কাজ করতেই হাঁপিয়ে উঠেন। উনার শরীর বেশ দূর্বল। মেয়ে থাকলে শরীরে সুস্থতা ভোগ করেন। কারণ মেয়ে তার ভালোই সেবা করে। অথচ যখন মেয়ে বাসায় থাকে না। তখন শুরু হয় স্বামীর অমানবিক অত্যাচার। যা মানসিকভাবে খুব কষ্ট দেন উনাকে। মেয়েকে শুনাতেও পারবেন না। কারণ এ নিয়ে কড়া নিষেধ আছে স্বামী আহসানের। তাই তো মুখ বুজে নিরবে অশ্রুসিক্ত করা ছাড়া উপায় নেই উনার। যদি নিজেকে যত্নে রাখতেন তাহলে তিনিও হতেন হালিমার মত।

আহসান মদের বোতল খেয়াল করলেন শেষ কয়েকটা বোতল। এবার যেন উনার মাথায় নেশা ধরেছে। অমানবিক চাহিদা পূরণের ন্যায় দাঁড়িয়ে যান। মিসেস জাবিয়ার বাহু চেপে ধরেন। এতটা শক্ত করে ধরায় বেশ ব্যথা অনুভব করছেন তিনি। আমতা আমতা কণ্ঠে বলেন,

‘কি কি খুঁজছেন আপনি?’

‘তোর সোনার হার এখনি বের করে দে।’

চমকে তাকান তিনি। আশ্চর্য না হয়ে পারছেন না। যে সোনার হারটা স্বয়ং আহসান সাহেবের মা মানে উনার শ্বাশুড়ি মা দিয়েছেন। সেই হারটা কিনা তিনি ছিনিয়ে নিতে চান। কষ্টক্লেশ জমিয়ে মিহি কণ্ঠে বলেন,

‘ঐ সো সোনার হার দিয়ে কি কি করবেন?’

‘তোর কি শা*। তুই হারটা দে।’

‘ও ওইটা আম্মার।’

‘আম্মা মরছে বহুত আগে। তুই দে।’

‘না আপনি আগে বলুন কি করবেন!’

আহসান সাহেব অকথ্য ভাষায় গালি দিয়ে মিসেস জাবিয়াকে ধাক্কা দিলেন। অপ্রতিকূল ঘটনায় তিনি বিছানার ছিপায় কপালে আঘাত পেলেন। কপাল চেপে নিভু চোখে পরখ করলেন স্বামীর দিকে। আহসান আলমারী খুলে কাপড়চোপড় উজার করে ফেললেন। শেষমেষ আলমারীর ড্রয়ারে পেলেন সোনার হারটা। সেটা নিয়ে পৈশাচিক হাসি দিয়ে বেরিয়ে গেলেন বাসা থেকে। মিসেস জাবিয়া কষ্টে উঠে দাঁড়ালেন। উনার মন চাচ্ছে ছুটে যেতে স্বামীর যাওয়ার পথে। কিন্তু চোখে অন্ধকার নেমে আসছে। কপালে ক্ষত পাওয়ায় অজ্ঞান হয়ে গেলেন।
হালিমা উচ্চ শব্দ শুনে রান্নাঘর হতে উঁকি দিলেন। তখন মালিককে বের হতে দেখে তিনি তড়িঘড়ি রুমে যান। কিছুক্ষণ আগেই তিনি ড্রয়িং রুম পরিষ্কার করে রান্নাঘরে গিয়ে ছিলেন।
এই কিছুক্ষণটায় বড় কিছু ঘটে যাবে বলে ভাবেননি তিনি।
রুমে এসে মালকিনকে ক্ষতপূর্ণ দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। আহত দৃষ্টি নিয়ে মালকিনের পাশে বসে ডাক দিলেন। কিন্তু চোখ না খুলায় বুঝতে পারলেন মালকিন অজ্ঞান হয়েছেন। সাবধানে মিসেস জাবিয়াকে বিছানায় শুয়িয়ে দিলেন। ঘরোয়া পদ্ধতিতে কপালের কেটে যাওয়া অংশ কাপড় দ্বারা বেঁধে দিলেন। অপেক্ষা করতে লাগলেন ইফদিয়ার মামুনির।

মাটির উপর শুয়ে আছে ইফদিয়ার। মুখ থেকে অনর্গল পানি বের করছে। বেশ পানি জমেছে রমণীর পেটে। পেটের উপর স্থীরভাবে হাত রেখে ক্রমান্বয়ে চাপ দিচ্ছে যাবিয়াজ। পরণের শার্ট প্যান্ট ভিজে একাকার। রমণীর শরীর প্রায় শীতল হয়ে পড়েছে। হাতজোড়া অবশ আর ঠান্ডা হয়ে আছে। যাবিয়াজের বুকটা অমার্জিতভাবে ধড়ফড় করছে। কোনো কিছু হারানোর আশঙ্কা মনে জেগেছে তার। চোখজোড়া রক্তিম লাল আভায় পরিণত হয়েছে। মুখ থেকে শুধু ‘প্লিজ প্লিজ’ শব্দটি বের হচ্ছে। ইফদিয়ার জ্ঞানশূন্যতায় যাবিয়াজের বুক শূন্যতা অনুভব করাচ্ছে। রমণীর হাতে গরম ভাব দিচ্ছে নিজের হাত দিয়ে চাপ দিয়ে।
মাটির উপর যাবিয়াজ নিজের ফোন রেখে পুকুরে ডুব দিয়ে ছিল। সেটি নিয়ে এম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে।

‘কুইক কাম হেয়ার। আই উইল গিভ ইউ অনলি ফাইভ মিনিট।’

যাবিয়াজ এর কথায় ঘাবড়ে এম্বুলেন্স নিয়ে বের হলো নার্সগণ। রমণীকে নিজের কোর্ট পরিয়ে দিল। কোলে তুলে রাস্তার মোড়ে নিয়ে আছে। সেখানে এম্বুলেন্স এসে হাজির হয়ে যায়। ডক্টর ভেতরেই বসে ছিলেন। পেশেন্ট আসায় চটজলদি যাবিয়াজ তাকে স্ক্যাচারে রাখে। ডক্টর একজন মহিলা ছিলেন। বিধায় তিনি যথাসম্ভব জ্ঞান ফিরিয়ে আনেন ইফদিয়ার। এম্বুলেন্স করে হসপিটালে নিয়ে যেত। কিন্তু যাবিয়াজ এর কথায় এম্বুলেন্সে প্রাথমিক চিকিৎসার ফলে জ্ঞান চলে এলো ইফদিয়ার। ডক্টর ঠান্ডা না লাগার জন্যে দুটো ওষুধ প্রেসক্রিপশন করে দিলেন।
যাবিয়াজ এম্বুলেন্সের বাহিরে পায়চারী করছিল। এম্বুলেন্সের দরজা খুলার পর দেখে ইফদিয়ার কাঁপছে শীতে। ঠান্ডার কারণে অতিরিক্ত ফর্সা রক্তপিশাচী নারী লাগছে রমণীকে। ডক্টর প্রেসক্রিপশনটি যাবিয়াজকে দিল। আর সংক্ষেপে বলেন,

‘ওয়াইফের খেয়াল রাখবেন।’

দুজনে চমকে গেল। ইফদিয়ার লাজুক নয়নে মিটিমিটি হাসছে। যাবিয়াজ চোয়াল শক্ত করে তাকায়। ডক্টর এম্বুলেন্সের ড্রাইভারকে গাড়ি ঘুরিয়ে হসপিটাল পথে যেতে বলে।

‘ইউ সাউট ইউর স্মাইল। আই কান্ট টলারেট।’

‘হু বললেই হলো। আজ দেখলাম তো কেমনে টলারেট করলে।’

‘এক্সকিউজ মি মিস যেমন ভাবছ তেমন নয়। মনুষ্যত্বের কাতিরে ডুব দিয়েছিলাম।’

‘ভাঙ্গবে তাও মুচকাবে না। জানি ফিলিং আমার জন্যে আছে। শুধু মুখ থেকে বের করা বাকি।’

মনের মাঝে কথাটি ভেবে আনমনে লাজুক হেসে উঠে ইফদিয়ার।

‘চলো।’

যাবিয়াজের ধমকির সুরে বলায় ইফদিয়ার হুশ ফিরে। সেও যাবিয়াজের অনুসরণ করে গাড়ির কাছে গেল। গাড়িতে উঠিয়ে নিলে যাবিয়াজ শান্ত কণ্ঠে বলে,

‘বাসার ঠিকানা দাও। গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে ফেলবে। নাও এগুলো ওষুধ।’

ইফদিয়ারকে বসিয়ে সে ফার্মেসী থেকে ওষুধ কিনে এনেছিল। রমণী মুচকি হেসে বলে,

‘জামাই হবার আগে থেকে কেয়ারিং শুরু করে দিলে নট ব্যাড।’

‘ইউ।’

বেশ রাগমিশ্রিত কণ্ঠে বলেও লাভ হলো না। ইফদিয়ার পূর্বের ন্যায় মিটমিটিয়ে হেসে যাচ্ছে।

বাসায় এসে দেখে হালিমা মায়ের পাশে বসে আছে। ইফদিয়ার ভয় হলো মায়ের কিছু হলো না তো। রুমে গিয়ে দেখে মায়ের কপালে ব্যান্ডেজ করা। হালিমা ইফদিয়ারকে দেখে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে,

‘মামুনি।’

‘কি হয়েছিল?’

হালিমা শুরু থেকে শেষ অব্দি কথাগুলো জানায়। শুনে যেন ক্রোধ হলো ভীষণ। ইফদিয়ার ফোন হাতে নিয়ে আহসান সাহেবের ফোনে কল দিলেন। রিং হচ্ছে তবে তিনি উঠাচ্ছেন না। পর পর তিনবার চেষ্টা করেও পাওয়া গেল না আহসান সাহেবকে। ইফদিয়ার হালিমাকে কড়া গলায় আদেশ দিল।

‘আজ ঘরের দরজা খুলবেন না। ভুলেও যেন ঘরের চৌকাঠে আহসান বুহিয়ানের ছায়ামূতি না দেখি।’

হালিমা খুশিমনে রাজি হয়ে গেলেন। তিনি রুম থেকে বেরিয়ে গেলে ইফদিয়ার ফ্রেশ হয়ে গরম পোশাক পরে মিসেস জাবিয়ার পাশে শুয়ে পড়ে।

যাবিয়াজ বাসায় এসে দেখে ড্রয়িং রুমে মেহমান ভর্তি। হঠাৎ এত মেহমান দেখে সন্দেহ জাগে তার মনে। বাবাকে একজন ছোটখাটো পোশাক পরিহিত রমণীর পাশে বসা দেখে সন্দেহ নিয়ে এগিয়ে গেল। রবিউল সাহেব ছেলের পায়ের শব্দ অনুভব করে মুচকি হাসেন। তিনি দাঁড়িয়ে যান। যাবিয়াজ কাছে গিয়ে রবিউল সাহেবকে জড়িয়ে ধরে বলে,

‘ড্যাড এসব কি? এত মানুষ কেনো বাসায়? আজ কি কোনো অনুষ্ঠান ছিল?’

রবিউল সাহেব মনের মধ্যে সংকোচবোধ করছেন। তিনি এখন যে বাক্য মুখের উপর আনবেন। সেটি শুনে ছেলে কেমন রিয়েক্ট করবে। তা চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। তিনি ছেলেকে ধরে একটি ফাঁকা রুমের ভেতর এলেন। দরজা হালকা ভিজিয়ে ছেলেকে নিয়ে পরিপাটি বিছানার উপর বসেন। ছেলের হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে আদুরী কণ্ঠে বলেন,

‘বাবা আমি তোর বিয়ে ঠিক করেছি।’

চলবে…..
(ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here