#বেলির_কথা (০৮)
সীমার বাবা বিয়ের ব্যপারে মেনে নিলেও তিনি চাননা সীমা পড়ুক।বেলি অনেক জোর করেও বুঝাতে পারেনা চাচাকে।শেষে বেলি বলে,
‘অন্তত এসএসসি পরীক্ষা টা দিক চাচা?’
সীমার বাবা বলে,
‘মেয়েরা এত পড়ে কি আর হবে?চাকরি করবে?আমার অত লোভ নেই মেয়ের টাকা খাওয়ার?’
‘না চাচা সবাই পড়ে চাকরি করবে এমন কথা নেই।একটা শিক্ষিত সমাজ দেয়ার জন্য হলেও পড়ালেখা জরুরি।ধরেন আপনার মেয়েকে বিয়ে দিলেন,আপনার নাতি অথবা নাত্নি হলো তাদের প্রাথমিক পড়ালেখাটা মায়েদের থেকেই শিখে।একজন ভাল শিক্ষিত মা তার সন্তানকে ভাল শিক্ষা দেন।এই ধরুন আমার আম্মা! আমাকে ছোট থেকে যেভাবে গড়ে তুলেছেন,এমন অনেক মা আছে যে সে শিক্ষাটা দিতে পারেনা।কিন্তু দুনিয়াতে ঠায় পেতে হলে পড়ালেখার বিকল্প নেই।জানেন? আমরা বইয়ে পড়েছি,
“তোমরা আমাকে একজন শিক্ষিত মা দাও আমি তোমাদের শিক্ষিত জাতি উপহার দিবো।”
তবে বলতে পারেন অনেকে শিক্ষা অর্জন করে শিক্ষিত হয়না পশুর মতো আচরণ করে।হ্যা ঠিক শিক্ষা অর্জন করে মানুষ ও হওয়া জরুরী।
দয়া করে চাচা সীমাকে এসএসসি পরীক্ষাটা হলেও দিতে দিন?’
সীমার বাবা সব মেনে নেয়।রামিম হা করে পুরা ঘটনায় চেয়ে থাকে।এ কেমন বেলিকে দেখছে সে?রামিম এগিয়ে গিয়ে বেলিকে বলে,
‘ধন্যবাদ তোকে?সরি তুই বলে ফেলেছি।’
‘সমস্যা নেই।তুই করেই বলিয়েন আমি তো আপনার ছোট ই?’
‘কিন্তু মন মানসিকতায় অনেক এগিয়ে।’
আড়াল থেকে খুশিতে সীমার চোখ পানি পড়তে থাকে।বেলি সীমাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে।
‘তুই আমার থেকে বয়সে ছোট ই হবি।যদিও একই ক্লাসে পড়ি।তোর মতো বান্ধবী পাওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যপার।তোর এত সাহস আসলো কোত্থেকে তুই কত ছোট এখনো?’
বেলি হাসে,
‘আমার আম্মা থেকে।আম্মাই আমার শক্তি,আমার অনুপ্রেরণা,আমার শিক্ষা।’
সবাই যে যার বাড়ি চলে আসে।বাড়ি এসে পুরা ঘটনা মা কে বলে বেলি হাসে।বেলির মা বলে,
‘আমি যেমন চেয়েছি তেমন ই হয়েছে আমার মেয়ে।’
‘তুমি পাশে থাকলে আমি দুনিয়া জয় করে আনবো আম্মা?’
.
প্রতিদিন শাহেদ খবরেরকাগজ এনে দেয় বেলিকে।কারণ এর আগে বেলির মা প্রতিদিন খবরেরকাগজ পড়তো সে থেকে বেলির ও পড়া অভ্যাস হয়ে গেছে।নানান জায়গার নানান মানুষ এর খবর শুনে বেলির অভিজ্ঞতা হয়ে গেছে দেশ সম্পর্কে।আর দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে।বিভিন্ন ঘটনা পড়ে সে মন ভার করে।একেক মানুষ এর গল্প পড়ে,খবর পড়ে জানতে পারে কেউ আত্ম*হ*ত্যা করে,কেউ খু*ন,সবাই মানসিক যন্ত্রণার শিকার।
তাইতো কাল সীমার বাবাকে এত কথাগুলো বলতে সে পিছিয়ে যায়নি।একজন হলেও যদি এভাবে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াত।তাহলে?
.
দেখতে দেখতে বেলিরা এসএসসি পাশ করে।ভাল ই রেজাল্ট করে বেলি।সীমা ও ভাল রেজাল্ট করে।প্রিয়া আর রিয়া কোনোমতে পাশ করেছে।
.
বেলি মায়ের ইচ্ছেতে আবার গ্রামের কলেজে ভর্তি হয়।চেয়ারম্যান শাহেদকে বুঝায় বোনকে যেন শহরে পাঠায়,ভাল কলেজে ভর্তি করায়।
কিন্তু বেলির মা বলে,
‘আমি মেয়েটাকে এতদূর পড়তে দিব না।তাছাড়া পড়ালেখাটা জরুরি ভাল কলেজ নয়।’
এদিকে রিয়াকে আর পড়াবে না ঠিক করে।সাথে ভাল পাত্র পেলে বিয়ে দিয়ে দেয়া হবে।এদিকে রিয়া রামিমকে দেখা করতে বলে।রিয়াদের বাড়ির পাশে একটা জঙ্গলের মতো জায়গা আছে।সেখান দিয়ে খুব কম মানুষ যাতায়াত করে।তাছাড়া বিকেলের দিকে একদম ই কেউ থাকেনা। ওখানেই তারা দেখা করে।রিয়া বলে,
‘চলো আমরা পালিয়ে বিয়ে করি?’
রামিম বলে,
‘পাগল হয়েছো আমার এখনো বিয়ের বয়স হয়েছে?’
‘মানে?’
‘হ্যা এটাই তো সত্যি?’
‘তাহলে আমি এখন কি করবো?’
‘জানিনা।’
রিয়া রামিমকে জোর করে জড়িয়ে ধরে।
রাস্তা দিয়ে রামিমের বাবার বন্ধু যাচ্ছিল।তিনি রামিম কে দূর থেকে দেখে কাছে এসে ভাল করে দেখেন।তারপর চলে যান।
.
বাইরে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছে বেলির ইচ্ছে করতেছে বৃষ্টিতে ভিজতে।কিন্তু মায়ের কড়া নিষেধ বাইরে যেন না যায়।তবুও বেলি বলে,
‘আম্মা একটু ভিজে আসি না?’
‘নাহ অসুখ করবে।’
বেলি গাল ফুলিয়ে বসে।
‘আমাকে নিয়ে এত চিন্তা তোমার?’
‘যেদিন মা হবি সেদিন সেটা বুঝবি মা মানে কি?’
‘আচ্ছা আমি তো মা হয়েছি, তোমার মা আরকি।’
বেলি মাকে জড়িয়ে ধরে।বেলির মা হাসার চেষ্টা করে।
‘আম্মা তুমি দিনদিন কেমন শুকায় যাচ্ছো?’
শাহেদ এসে বলে,
‘কাল তোমাকে শহরে নিয়ে যাব ই।এতদিন খুব বাহানা দিয়েছ আর নয়।’
.
বেলিদের পাকা ঘর অর্ধেক বাধা শেষ।কাজ অফ রেখে বেলিকে সহ নিয়ে শাহেদ শহরে যায়।শহরের ডাক্তার দেখিয়ে পরীক্ষা করায়।টেস্ট এর রেজাল্ট পরেরদিন দিবে বললে তারা আবারো গ্রামে চলে আসে।বেলিদের কোনো আত্মীয় শহরে নেই।
.
পরেরদিন শাহেদ একা টেস্ট এর রেজাল্ট আনতে যায়।বেলি কলেজে যায়।বেলির মা বাড়িতে থাকে।শুকনো কাশে।মুখ থেকে রক্ত বের হয়ে যায়।
শাহেদ ডাক্তারের মুখোমুখি বসে আছে,
‘শুনোন মি: শাহেদ আপনার মায়ের ক্যন্সার ধরা পড়েছে।তিনি আর বেশিদিন বাঁচবেন না।বলতে গেলে আর মাত্র কয়েকটা দিন।’
কথাটা শুনার পর শাহেদের বুক ছিঁড়ে যাওয়ার মতো করে।
‘ভুল হচ্ছে আপনার?আমার মা এত তাড়াতাড়ি?’
‘জন্ম-মৃত্যু আল্লাহর হাতে।’
শাহেদ শুকনো মুখ নিয়ে বাড়ি ফিরে।বেলি তখনো কলেজে।বেলির মা বলে,
‘ডাক্তার কি বলেছে?’
শাহেদ হাসার চেষ্টা করে বলে,
‘ভালই সব।’
বেলির মা শাহেদের হাত ধরে।
‘আমি তোর মা।তোর চোখের ভাষা বুঝি।সত্যি ই বল?’
শাহেদ মা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
‘তুমি আমাদের ছেড়ে যেতে পারো না।আমি তোমাকে আরো বড় ডাক্তার দেখাবো।’
‘না আমার সময় আর নেই আমি তো জানতাম ই।আমি চাইনা আর আমার ছেলের কষ্টের টাকা নষ্ট হোক।’
‘আম্মা?’
বেলির মা বলে,
‘যতদিন বাঁচবো বেলিকে এসব কোনোদিন বলবি না।ও সহ্য করতে পারবেনা।আর আমার কিছু কথা শোন বলতে পারিস অসিয়ত।’
‘ বলো আম্মা?’
‘আমি আমার মেয়েটাকে তোর কাছে রেখে যাচ্ছি ওরে কখনো কষ্ট দিবি না।ভাই হিসেবে যতদিন বাচবি পাশে থাকবি।’
‘আচ্ছা।’
.
বেলি কলেজ থেকে ফিরে মায়ের কি অবস্থা জানতে চায়লে বেলির মা বলে,
‘সব ঠিকই আছে।’
বেলি খুব খুশি হয়।
.
হঠাৎ একদিন বেলি কলেজে।একজন স্যার এসে জানালো তার ছুটি।তার একার ছুটি কেন?শাহেদ খবর দিয়েছে নাকি বাড়ি যেতে।
বেলি বাড়ি এসে দেখে অনেক লোকজন।এত মানুষ কেন?
বেলি ঘরের সামনে এসে দেখে শাহেদ বাশ কাটছে, বাশ দিয়ে কি হবে?বেলি ভাইয়ের সামনে যায়।
‘ভাই বাশ দিয়ে কি করবে এত মানুষ কেন?’
শাহেদ কথা বলেনা।
‘ভাই?’
‘ঘরে যা বেলি।’
‘আম্মা কই?’
শাহেদ তবুও বেলির দিকে না তাকিয়ে বলে,
‘ঘরে যা?’
বেলি এক দৌড়ে ঘরে যায়।ফ্লোরে সাদা কাপনে মাথা ডাকা কে যেন শুয়ে আছে।প্রতিবেশি এক মহিলা বেলির মাথায় হাত বুলায়।
‘সকালে হঠাৎ শরীর কাপিয়ে জ্বর উঠলো।তোর ডাক্তার কাকা আসার কিছুক্ষণ পর ই।আয় শেষবারের মতো মুখ টা দেখে নে?আর কোনোদিন যে দেখবি না?’
বেলি কথার আগামাথা বুঝেনা।আরেক মহিলা মাথা থেকে কাপড় সরায়।
বেলি মুচকি হাসে।আর বলে,
‘আমার আম্মার মতো দেখতে কে ইনি?শুয়ে আছেন কেন?আমার আম্মা কোথায়?’
মহিলা বলে,
‘তোর আম্মা ই।’
‘আমার আম্মা আমাকে না বলে কই যাবে?’
বেলি মায়ের পাশে বসে।বেলির এমন শান্তভাব কারোর ই হজম হচ্ছেনা।
‘আম্মা দেখো ওরা কি বলে?আমি জানি আমার আম্মা কোথাও যাবেনা।তাইনা?কথা বলো?’
মহিলা এসে বেলিকে বলে,
‘মনভরে দেখে নে?কিছুক্ষণ পর তোর মাকে নিয়ে যাবে।’
‘কে নিয়ে যাবে?কোথাও যাবে না আমার আম্মা।আমি আম্মাকে ছাড়া একা থাকতে পারিনা।আর আম্মা ও আমাকে ছাড়া একা থাকতে পারেনা।’
বেলি আরেকটু ঝুকে বলে,
‘আম্মা হাসো তো, কথা বলো এরা সবাই কেমন মিথ্যা বলছে?বেলির আম্মা ভাল যে না।আম্মা?’
বেলি কপাল ধরে বলে,
‘নাহ আম্মা রাগ করেছে।আর কথা বলেনা..
সকলেই হু হু করে কেদে উঠে..বেলি যেন বাচ্চা হয়ে গেছে,সে শান্তস্বর এ সব বললেও তাকে কেমন অশান্ত দেখাচ্ছে।
চলবে…..
(ভুলত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখা উচিৎ)
#তাহরীমা