অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_১৬
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
২৫.
ফেরদৌস চারপাশে ছেলেদের দিকে একবার তাকিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টি ফেলে শ্রেয়িতার উপরে। শ্রেয়িতা বোকার মত লুক করে তাকিয়ে আছে তার বন্ধুগণের দিকে। তিনজনের চেহারার মধ্যে শুধু যাবিয়াজ ড্যাম কেয়ার লুক নিয়ে ফেরদৌসকে বলে,
‘ওমন হা করে কি দেখছিস!’
‘দোস্ত আমি ভেবে পায় না। এই শ্রেয়ু কি আজও মাইয়া নাকি পোলা!’
শ্রেয়িতা ক্রোধময় দৃষ্টিতে কটমট চাহনী নিক্ষেপ করে ফেরদৌসের উপর। এরফান নিজের মুখ বন্ধ করে নিল। এতক্ষণ হা করে তাকিয়ে ছিল শ্রেয়িতার দিকে। কারণ তারা তিনবন্ধু গ্রুপ হাগ দিচ্ছিল। মাঝখানে উদয় হলো শ্রেয়িতা বান্ধবী। যে তাদের তিনজনের কলিজার প্রিয় বান্ধবী এবং বোনপ্রিয়। ফেরদৌস এর ঠাট্টায় এরফান গলা ঝেড়ে উপদেশমূলক বাণী ছুড়ে দিল।
‘বালিকে ইহা বালকগণের বাসস্থান। আপনি শিগ্রি প্রস্থান করিলে অঢের খুশি হইবো।’
শ্রেয়িতা নাকের ডগায় রাগ এনে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে,
‘তিয়ু ভাবিকে বলে উচিৎ শিক্ষা দেবো হারামী।’
এরফান হকচকিয়ে গেল। সে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে শ্রেয়িতাকে প্রশ্নসূচক গলায় জিজ্ঞেস করে।
‘ওই বারংবার ঐ মাইয়ার নাম নিস কেন। ওর লগে মোর কি চলে হে!’
‘বাবাহ তলে তলে ঘুন্ডী উড়াও। সামনে বললেই দোষ। বলি মামা আর কতদিন লুকাবে!’
‘আহ হা নিজে যে মেহনাত স্যারের পিছে লুচির মত ঘুরিস সেটা কি হে!’
‘ওই মেহনাত স্যার ক্রাশ আমার। ওর ব্যাপারে কোনো কথা শুনমু না।’
‘ভালো হলো তোর মেহনাত স্যার গ্রামে ছুটিতে গেল। না হলে তুই যে হারে নজর দিস। কোন সময় না স্যারের বদহজম হয়ে ডায়রিয়া হয়।’
‘বদহজম হলে ডায়রিয়া হয়!’
বোকার মত শ্রেয়িতা প্রশ্ন করে ফেলে। যাবিয়াজ চুপ করে থাকলেও বান্ধবীর কথায় অট্টহাসি দিয়ে উঠে। সঙ্গে এরফান আর ফেরদৌসও। ফেরদৌস হাসি থামানোর চেষ্টায় বলে,
‘দোস্তি কথার কথা বলছে এরফান।’
শ্রেয়িতা এরফানের দিকে ভেংচি মেরে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে করুণ কণ্ঠে বলে,
‘আজ কেউ বন্ধু বোন না বলে।’
যাবিয়াজ,এরফান আর ফেরদৌস প্রিয় বান্ধবীর কথায় একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে। শ্রেয়িতা বোধ হয় সত্যি মন খারাপ করেছে ভেবে তারা মুখ ভেটকিয়ে অন্যদিকে হাঁটা ধরে। শ্রেয়িতা খেয়াল করে তার পিছে শূন্য হাওয়ার শব্দ ছোঁ ছোঁ করে বেড়াচ্ছে। পিছে ঘুরে দেখে তার ফাজিল বন্ধুগুলো তাকে ছেড়েই চলে গেছে। রাগে জোরে ধড়াস করে লাথি দিল মাটির উপর। মুখ ফুলিয়ে হাঁটা ধরে গাড়ির দিকে। শ্রেয়িতা এনজিও ক্যানভাসে এসেছে। তার বন্ধুগণের সঙ্গে দেখা করতে। সে প্রকৌশল-প্রযুক্তি বিভাগের স্টুডেন্ট না হওয়ায় তাকে এনজিও ক্যানভাসে নেওয়া হয়নি। গালর্স গাইড পদক্ষেপে অংশ নিয়ে অসহায় পথিকদের সহায়তা প্রদান করে। সে হোস্টেলে থাকে না বাসায় থাকে। ফলে সে ভীষণ দুঃখজনক অনুভূতি নিয়ে বাসায় থাকতে লাগে। সে যদি বায়োজেনেটিক প্রোগামের অংশীদার হত তাহলে বন্ধুগণের সঙ্গে আড্ডায় মতঁ হতো। তবে হায় কপাল ! শ্রেয়িতা অংশীদার হয়নি। বরঞ্চ সে ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং অনুষদের ছাত্রী।
এনজিও ক্যানভাস থেকে শ্রেয়িতার বাসা খুব একটা দূরত্বে অবস্থিত নয়। একঘণ্ঠা লাগে এনজিও ক্যানভাসে পৌঁছাতে। তাই সে একঘণ্ঠায় চলে এলো। তার অফ ডিউটি থাকায় বয়েস প্লেসে ঢুকে পড়ে। যেখানে বায়োজেনেটিক প্রোগামের সভা প্রশিক্ষণ পরিচালিত হয়।
অতএব, বন্ধুদের মনভরে দেখতে পেল।
পরন্তু ফাজিলের দলবল তাকে ছেড়েই ফুড়ৎ করে উড়ে গেল।
শ্রেয়িতা এনজিও ক্যানভাস থেকে বেরিয়ে খানিক দূর হেঁটে রাস্তায় ফুসকার দোকান দেখতে পেল। সেখানে এসে ফুসকা মামাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘ও মামা খানিক দুই প্লেট ফুসকা দেন না। টাটকা ঝাল দিও মামা।’
‘ঠিকাছে মা বইয়ো।'(বসো)
ফুসকা মামার কথা শেষ হতে না হতে ধপাস করে টুলের উপর বসে পড়ে শ্রেয়িতা। তার মন খারাপ হয়নি ফাজিল বন্ধুদের উপর। কারণ সে জানে তার বন্ধুগণ অবশ্য কোনো না কোনো প্লেন করছে। তাই তাকে পাত্তা দিল না। প্রতিবার এমনই হয় যখনি সে রাগ করে তার ফাজিল বন্ধুগণ এসে সারপ্রাইজ করে দেয়। শ্রেয়িতার সামনে তুড়ি বাজালো ফুসকা মামা। সে নড়েচড়ে উঠল। ফুসকা মামার দিকে প্রশ্নময় চাহনী নিক্ষেপ করে ভ্রু কুঁচকায় শ্রেয়িতা। মামা প্লেটের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সে মামার হাতে প্লেট দেখে জিহ্বায় দাঁত চেপে আফসোস কণ্ঠে বলে,
‘সরি মামা দেখি নাই দেন।’
মামার হাত থেকে ফুসকার প্লেট নিয়ে খেতে লাগে। এক পর্যায়ে তার ঠোঁটের ফাঁক থেকে টুপ টুপ করে ফুসকার মধ্যে ব্যবহৃত তেতুল এর রস গড়িয়ে পড়ছে। দুজন বদ ছেলে লোভনীয় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে শ্রেয়িতার দিকে। যার ধ্যান বিন্দুমাত্র তার নেই। ফুসকা মামা সৎ হওয়ায় দুজন বদ ছেলের লোভাতুর চাহনী লক্ষ করে। তিনি মেয়েটির সামনে গিয়ে পানি এগিয়ে দিলেন। শ্রেয়িতা ইতিপূর্বে পানির তৃষ্ণা অনুভব করছিল। কেননা ফুসকা মাত্রাতিরিক্ত ঝাল হয়েছে। পানির বোতল নিয়ে ঢক ঢক করে খেয়ে নিল। পানি বোতলটা সাথে নিল। ব্যাগ থেকে টাকা বের করে হাতে ধরিয়ে দিল ফুসকা মামার। তিনি ইশারা করেও ব্যর্থ হলেন। কারণ শ্রেয়িতা কোনো ভাবেও পাত্তা দিল না। উল্টা অহং করে ধপাধপ পা ফেলে হাঁটতে লাগল। ছেলে দুটি তার পিছু নিল। ফুসকা মামা নিশ্চুপে শুধু দেখলেন। তিনি শক্তিহীন বলে সহায়তার জন্যে এগিয়ে যেতে পারলেন না।
শ্রেয়িতা গাড়ির খুব সন্নিকটে চলে এলো। গাড়ির মধ্যে চাবি ঢুকাতেই একজন ঠুস করে চাবিটি নিয়ে নিল। শ্রেয়িতা ভ্রুজোড়া কিঞ্চিৎ নেড়ে পাশ ফিরে তাকায়। ছেলে দুটোর লোভাতুর দৃষ্টি শ্রেয়িতার গলার উড়নাতে আঁটকে আছে। তাদের মধ্যে প্রথম ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে বলে,
‘ফুলটুসি একলা ফুসকা খাইলেন। আমাদের দিলেন না নট ফেয়ার!’
‘হ মামা ফুলটুসির উড়নায় তেঁতুলের রস লেগে আছে।’
‘কি কস মামা! এনে তো মুইছা দিতে হইব।’
শ্রেয়িতা তাদের কথায় কেঁপে উঠে। কখনো কোনো ছেলে এ পর্যন্ত অশ্লীল ভাষায় ইঙ্গিত করেনি তাকে। কিন্তু আজকের দিনটা তার কাছে শুভ দিন মনে হচ্ছে না। শ্রেয়িতা চৌপাশে চোখ বুলিয়ে দেখে পার্কি প্লেস পুরুই নির্জনতায় ভরপুর। সব গাড়ির পিছে তার গাড়ি রাখা। এখানে সে চিৎকার করলেও বাহিরের রাস্তায় পৌঁছাবে কিনা সন্দেহ! ভয়ে তড়ফড় করছে শ্রেয়িতা। ছেলে দুটোর মধ্যে একজন ইচ্ছাকৃতভাবে উড়নার পাড়ের অংশে স্পর্শ করে জোরে টান দিল। শ্রেয়িতা চোখ বুজে ‘আহ’ করে চিৎ করে উঠে। অতঃপর জোরালো উচ্চ স্বরের চড়ের প্রতিধ্বনিতে ফট করে চোখ খুলে শ্রেয়িতা।
ছেলে দুটো ভূত দেখার মত চমকে উঠে। শ্রেয়িতা খেয়াল করে দেখল। তার গায়ে উড়না জড়ানো আছে। আর ছেলেটির হাত পুড়েছে যা স্পষ্ট দেখতে পারছে শ্রেয়িতা। কিন্তু যে মানুষটি ছাই করেছে তার দিকে চোখ তুলে তাকায় শ্রেয়িতা। ইসমাইল গরম ডাল নিয়ে আঘাত করেছে ছেলেটির হাতে। ফলস্বরুপ হাতের উল্টোপিঠ পুড়ে গেল। ইসমাইল শ্রেয়িতার পিছে ঢালস্বরুপ দাঁড়িয়ে আছে। দেখে হা হয়ে যায় সে। বুকের মধ্যে ডিপ ডিপ করে নম্র শব্দে কম্পন দিচ্ছে। কাপাঁন্বিত ঠোঁটযুগল হতে ‘ইসমাইল ভাইয়া’ মুখ ফুসকে বের করে ফেলে।
‘ভাইয়া’ শব্দটি শ্রেয়িতার মুখ থেকে শুনে ক্রোধমিশ্রিত নয়নে তাকায় ইসমাইল।
শ্রেয়িতা হরবড়িয়ে ‘জামাই এসেছো’ বলে জড়িয়ে ধরে। এবার ইসমাইল নিজেই বোকা বনে গেল। পুরু ১৮০° ডিগ্রির ঝটকা যেন তার শরীরে অনুভব করল। কারেন্টের শক খেলে যেমন লাগে তেমন মনে হচ্ছে তার শরীরেও শ্রেয়িতার সংস্পর্শে শক লেগেছে। শুকনো কাতর গলায় ঢোক গিলে ঠোঁটযুগল আলতো করে ভিজিয়ে নিল। ছেলে দুটো শ্রেয়িতাকে ইসমাইল এর স্ত্রী বুঝতে পেরে দৌড়ে পালায়। ইসমাইল পূর্বের ন্যায় বরফকণার মত জমে আছে। শ্রেয়িতা হাত সরিয়ে পিছে ঘুরে দেখে কেউ নেই। তৎক্ষণাৎ ইসমাইল কে ছেড়ে গম্ভীর ভাবপূর্ণ কণ্ঠে বলে,
‘থ্যাংকস হেল্প করার জন্যে।’
ইসমাইল ভ্রু কুঁচকে শ্রেয়িতার চৌপাশে একবার ঘুরে তার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে গেল। বাঁকা হাসি ঠোঁটের কোণায় কিঞ্চিৎ ঝুলিয়ে বলে,
‘নো মোর থ্যাংকস মিস পরী। আই ওয়ান্ট টু টেক এ কফি উইড ইউ…।’
‘ইউ’ শব্দটি সুরের মত টান করে শ্রেয়িতার মুখের উপর ফুঁ দিল। তার বুকের কম্পন তেজ হয়ে গেল। শরীরের লোমহর্ষক শিউরে উঠল। ইসমাইল থেকে খানিক দূরে পিছিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
‘টাইম নাই হু নিজের খেতে ইচ্ছে করলে নিজে গিয়ে খান। যতসব হেল্পের সুযোগ লুটফুট করার ধান্দা।’
শ্রেয়িতা ভেটকানো লুক মেরে গাড়িতে বসে পড়ে।গাড়ির ইঞ্চিন চালু করে বাসার জন্যে রওনা দিল। তার গাড়ি যাওয়ার দিকে ইসমাইল মুচকি হেসে ‘পরী’ বলে সম্বধন করে। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
তার শেষাক্ত কথায় না হেসে পারল না সে। অবশেষে হেসে দিল ইসমাইল। বাঁকা হেসে শ্রেয়িতার মুখশ্রী মনের গহীনে ভেবে বলে,
‘শিগ্রই তুমি নিজ থেকে আমার কাছে এগোতে চলেছো মিস পরী।’
২৬.
ইফদিয়ার কে কেউ চেঁচিয়ে ডাকায়। সে পথ চলা থামিয়ে দিল। পিছে ঘুরে দেখে তার স্কুলের পদার্থবিজ্ঞান স্যার মশিউর রহমান ‘ইফদিয়ার’ নামটি উচ্চারণ করছেন। সঙ্গে হাত দেখিয়ে দাঁড়াতে ইশারা করছেন। সে ভদ্রভাবে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। মশিউর রহমান এসে স্বল্প পরিমাণে জিড়িয়ে জিজ্ঞাসা করেন।
‘তুমি আর ওয়াসিব নদের পাড়ে কি করছিলে!
মশিউর স্যারের বিভ্রান্তপূর্ণ কথায় ঘাবড়ে গেল ইফদিয়ার। নেকাপের মধ্যে ঘামতে শুরু করে। তবুও মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। ইফদিয়ার ইতস্ততঃ বোধ কাটিয়ে মশিউর স্যার কে সম্মান প্রদর্শন করে বলে,
‘স্যার ওয়াসিব এর সঙ্গে নদের পাড়ে এক্সিডেন্টলি দেখা হয়েছে। সে কেনো গিয়ে ছিল জানা নেই।’
মশিউর স্যার সন্দেহের দৃষ্টি এখনো এড়াতে পারছেন না। ইফদিয়ার কে তিনি আগের চেয়ে বেশি ছাত্রী কম নিজের মেয়ের নজরে দেখেন। বাবা যেমন মেয়েকে শাসন করেন। তেমনি তিনিও সেই অধিকারবোধে সন্দেহ পুষচ্ছেন মনের গহীনে। কেননা আজ তিনি কপোতাক্ষ নদের প্রধান সড়কের পরের গলি দিয়ে বাসায় যাচ্ছিলেন। তখন বোরকা পরিহিত ইফদিয়ার কে ওয়াসিব এর সঙ্গে দেখে খানিক চমকালেন। প্রথমে ভাবলেন এ ব্যাপারে ইফদিয়ার মা-কে অবহিত করবেন। পরে ভাবলেন যদি নির্দোষ হয়ে থাকে দুজন! ফলে পরবর্তী চিন্তাধারা করতেই সিদ্ধান্ত নিলেন আগে ইফদিয়ার কে জিজ্ঞাসা করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ করলেন। ইফদিয়ার যে দিক থেকে বাসার পথে রওনা হয়ে ছিল। সে পথে দ্রুত হেঁটে পথ আঁটকালেন মশিউর রহমান। ইফদিয়ার মাথা নত করে ফেলে। নিচু গলায় পুনরায় বলে,
‘সত্যি স্যার আমাদের মধ্যে ‘সম্পর্ক’ শব্দটি জড়িত নেই। জাস্ট ক্লাসমেট উই আর!’
মশিউর রহমান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ইফদিয়ার কে উপদেশময় কণ্ঠে বলেন,
‘তুমি বলেছ বিশ্বাস করেছি। কিন্তু অন্য কেউ দেখলে কি ভাবতো জানো! ভাবতো তোমরা নদের পাড়ে এসে চুক্ষগোচরে প্রেমালাপ করছো। সামান্য ব্যাপারটি তখন সাংঘাতিক ব্যাপারে রুপান্তরিত হতো। এলাকায় কানাঘুসো করে বেড়াতো কয়েকজন বদলোক। তুমি তো জানোই সমাজে ছেলেদের নিয়ে বেশি কটুক্তি ছড়ায় না। যত কটুক্তি মেয়েদের নিয়ে ছড়ায়। আমাদের সমাজের প্রচলিত প্রবাদই হলো ‘আগাছার বড় বাড়’। তাই তোমার প্রতি মেয়ের মতই সাজেস্ট করব ভাবিয়া করিও কাজ, করিয়া ভাবিও না।’
ইফদিয়ার মুগ্ধময় দৃষ্টিতে স্যারের দিকে তাকিয়ে বিদায় জানায়। মশিউর রহমান হাতে থাকা বোঝা স্বরুপ পলিথিনগুলো পাঁচ আঙুলের ভাঁজে মুড়ে চলতি পথে আগালেন। ইফদিয়ার সূক্ষ্ম দৃষ্টি স্যারের দিকে বিরাজমান। মশিউর স্যারকে প্রথমে যতটা না কড়া ভেবেছিল তার চেয়ে নরম আর সরল মানুষ প্রমাণিত হলো। ইফদিয়ার দৃঢ় শ্বাস নিয়ে বাসার গলিতে প্রবেশ করে। চেনা-অচেনা মানুষের কথোপকথন কানে আসছে। চৌপাশে চোখ বুলিয়ে ইফদিয়ার মানুষগণের চলাফেরা দেখছে। আহ! এই তো ব্যস্ত নগরীর জীবনযাপন।
রাস্তার মধ্যে এক বুড়ি মহিলা যুবককে ইচ্ছাকৃত লাঠি দ্বারা নরমভাবে আঘাত করছেন। পাশে যুবতী বউ আঁচলে মুখ গুঁজে হাসছেন। ইফদিয়ার দৃশ্যটি দেখে ফিক করে হেসে দিল। বুঝতেই পারছে বুড়ি মহিলাটি শ্বাশুড়ি আর পিঠুনি খাওয়া যুবকটি উনার ছেলে। লাজুক আর সরলমনী হাস্যজ্জ্বল যুবতী ছেলের বউ। তিনি যুবকের দিকে লাজুক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেন। গলির মধ্যে তাদের দৃশ্য দেখে অনেকের মাঝে ঈর্ষা-ক্রোধ জম্মাচ্ছে। যা ইফদিয়ার মানুষদের চেহারা দেখে আন্দাজ করল। গলির ভেতরকার প্রবেশ উদ্ভট সৌন্দর্য্যে মোড়ানো। এখানে কোনো প্রকার নালা,পচাঁ ডোবা নেই। যার ফলে দুর্গন্ধ ছড়ানোর জো নেই। তবুও কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে শ্বাস প্রশ্বাস নেওয়া হলো বিষাদ জীবনে নিজের নাম লিখা। করোনার প্রলোভন আজও প্রসারিত রয়েছে জনগণের আনাচেকানাচে। ইফদিয়ার নেকাপের মধ্যে শ্বাস ছেড়ে ফল বাজারে প্রবেশ করে।
সেখানে ভিন্ন ধরনের ফল সাজানো রয়েছে। ফল বিক্রয়কারী কে ‘চাচা’ বলে সম্বধন করে ইফদিয়ার। চাচা সৌজন্যমূলক কণ্ঠে
জিজ্ঞাসা করেন।
‘আহেন আহেন মামুনি কি নিবেন আপনে!’
‘মামা একডজন লিচু দেন।’
মামা লিচুগুলো কালো পলিথিনে মোড়ে ইফদিয়ার হাতে দিল। টাকা দিয়ে দোকান থেকে বের হলো। বাসার জন্যে আরেক পা যেই আগালো। কোথার থেকে একটি গাড়ি এসে চাপ্পড় করে টায়ার দিয়ে কাঁদার পানি ছড়িয়ে দিল ইফদিয়ার উপর। ইফদিয়ার বোরকা কালো হলেও সূর্যের রশ্নিতে কাঁদার পানির কারণে খয়েরী রঙিন ধারণ করেছে। মানুষগণ তার দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছে।
ইফদিয়ার লজ্জিত হয়ে চোখ ফিরিয়ে গাড়ির দিকে তাকায়। দেখে গাড়িটা থেমে রিটার্ন এলো। গাড়ির দরজা বরাবর ইফদিয়ার দাঁড়িয়ে আছে নোংরা বোরকায়। চোখ-মুখে অসহনীয়-লজ্জা পরিলক্ষিত হচ্ছে ইফদিয়ার। গাড়ির মালিক বাঁকা হেসে দরজা খুলে বের হলো। প্রিয় মানুষটিকে সম্মুখে দেখে ছলছল হয়ে উঠে ইফদিয়ার চোখযুগল। নেকাপের মধ্যে আনমনে নিচু গলায় ‘যাবিয়াজ’ বলে উঠে সে। যাবিয়াজ দাঁত কেলিয়ে ইফদিয়ার আপাদমস্তক স্ক্যান করে বলে,
‘ইশ! নাগরের সাথে ঘুরতে ঘুরতে শেষমেষ নোংরা পানি গায়ে মেখে নিলে। নট ব্যাড তোমার মত মেয়ের শরীরে নোংরামি ছাড়া আর থাকবেই বা কি! ভেতরে হাফেজী আর বাহিরে নোংরামি।’
ইফদিয়ার হৃদয় দগ্ধ হচ্ছে যাবিয়াজের তীক্ষ্ম কথাগুলো শুনে। তবুও সে প্রতিবাদ করছে না। কেনো করবে মানুষ শুনতে,বুঝতে চাইলে শান্তভাবে বসে কথা বলে সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু যাবিয়াজ মানুষটা অবুঝের মত বিচার করে দিল। এর শেষ সেও দেখে ছাড়বে! দৃঢ় চাপা কষ্ট মনে চেপে যাবিয়াজকে শান্ত কণ্ঠে বলে,
‘আপনার অপমান করা হলে যেতে পারি!’
‘নির্লজ্জ মেয়ে গেট লস্ট।’
ইফদিয়ার চোখ নামিয়ে ছুটে গেল বাসার ভেতরে।
চোখের পানি গোপন রেখে দরজা খুলে হতবাক হয়ে গেল। অভিমান দমিয়ে খুশির ঝিলক মুখে ফুটিয়ে মিসেস হালিমাকে জড়িয়ে ধরল ইফদিয়ার। হাস্যময়ী কণ্ঠে বলে,
‘কাকি কবে আসলে উফ ভাবতে পারছি না। কত দিন হলো তোমার হাতের টাটকা কাবাব খাইনা! ঠোঁট যেন শুকিয়ে গেল কাবাব এর স্বাদ না পাওয়ায়।’
‘আহা মামুনির তৃষ্ণা আইজা মিটাইয়া দিমু নে। আই আইলাম ভোর বেলার দিইকা। তুমি ছিলা বাইরে।’
ইফদিয়ার মাথায় হাত দিয়ে মুখ ফুলিয়ে বলে,
‘ইশ! আগে যদি জানতাম আমার কাকি সুন্দরী বাসায় আসবে। তাহলে বাসার বাহিরে পা-ই ফেলতাম না।’
‘ছাড় মামুনি কি কস মুই এই বয়সে সুন্দরী কেমনে হমু!’
‘কেন কাকি এহোনো রাস্তার মোড় দিয়া আপনি গেলে ছেলেরা সিটি বাজিয়ে বলবে,
ওহে সুন্দরী চলো না।’
চোখ টিপ মেরে ইফদিয়ার মিসেস হালিমাকে জড়িয়ে ধরে। মিসেস হালিমা লজ্জায় যেন কুঁকড়ে উঠলেন। বয়স কি কম হলো উনার তাও মেয়েটা লজ্জায় ফেলার পথ খুঁজে বেড়ায়। এমন ছোটখাটো মজা ইফদিয়ার করে থাকে। তাই লজ্জা পাওয়ার ভান করেন মিসেস হালিমা।
ইফদিয়ার নেকাপ খুলে হু হু করে হেসে ফেলে। তার হাস্যমুখশ্রী দেখে মিসেস হালিমা ভাবনার মধ্যে কথাগুলি আউলায়।
মনে মনে প্রার্থনা করলেন।
‘হে আল্লাহ মাইয়াটারে কহনো কাইন্দাও না। বহুত আদুরে মাইয়া ইফদিয়ার মামুনি।’
মিসেস হালিমাকে প্রখর চিন্তায় মগ্ন দেখে ইফদিয়ার ভ্রু বাঁকিয়ে আলতো স্পর্শ করে।
তিনি চোখ সরিয়ে আমতা আমতা করে বলেন,
‘এহন যাহ ফ্রেশ হইয়া লউ। বাহির থেইকা ঢেং ঢেং কইরা আইছা আবার করোনা লাগাইস না।’
ইফদিয়ার আদুরী নয়নে মিসেস হালিমার গালে টুপ করে চুমু খেল। তিনি হকচক খেয়ে গেলেন। পরক্ষণে মেয়ের আদুরেমাখা চুমুর স্পর্শ পেয়ে আলতো করে হেসে উঠেন। ইফদিয়ার কোমর নেড়ে নেড়ে রুমে প্রবেশ করে দরজা আঁটকে দিল। হাসি যেন মুহূর্তেই চাপা কষ্টে পরিণত হলো। চোখযুগল হতে পানি গড়িয়ে পড়ে। কাকীর সামনে যথেষ্ট পরিমাণে নিজের কষ্ট চাপিয়ে রেখেছিল। তিনি যদি জানতেন তাহলে কোনো না কোনো পদক্ষেপ নিয়ে ফেলতেন। তাই মিথ্যে হাসির অভিনয় করে তড়িঘড়ি রুমে চলে এলো। বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে কেঁদে ফেলে।
অস্পষ্ট কণ্ঠে ফুঁপানো অবস্থায় বলে,
‘মাফ করব না আপনাকে কখনো। খুব খারাপ আপনি সত্য না জেনে করে জার্জ করা আপনার ফিদরাত তো। দূরে চলে যাব আপনার থেকে। কখনো আর খুঁজলেও পাবে না। আই হেইট ইউ মিস্টার যাবিয়াজ হেইট ইউ।’
চলবে…..
(গতকাল গল্প দেয় নি তাই আজ বড় করে পর্ব দিলাম।)