অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_২৩
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
৪২.
যাবত ৭ ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরে এলো শ্রেয়িতার। পাশে উদগ্রীব ধাতস্থ হয়ে রমণীর এক হাত আঁকড়ে ধরে রেখেছে ইসমাইল। নিভু দৃষ্টিতে যুবকের দিকে পরখ করল শ্রেয়িতা। অস্পষ্ট কাতর কণ্ঠে বলে,
‘ও ওই।’
‘হুসস কোনো কথা নয়।’
ইসমাইল এর দৃঢ়স্থ জবাব। যেন এই মুহূর্তে রমণীর কোনো কথা কাম্য নয়। শ্রেয়িতা শরীরও দূর্বল অনুভব করছে। আলগা হয়ে উঠে বসার চেষ্টা করতেই কাঁধ বরাবর তীব্র ব্যথা অনুভব করে। মৃদু চিৎকার মুখ ফুসকে বেরিয়ে আসে তার ‘আহ’। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
ইসমাইল উত্তেজিত হয়ে শ্রেয়িতাকে শুয়ে দিল। তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে রগরগে ভাব ধরে বলে,
‘কি চাই আমাকে বলো নিজের মত করতে যাও কেন! বেশি বুঝদার হয়ে গেছো!’
ইসমাইল এর ককর্শভরা গলায় শ্রেয়িতা ভয়ে ঢোক গিলল। শান্তভাবে শুয়ে রইল। অস্পষ্ট সুরে ‘পানি খাব’ বলে। ইসমাইল সযত্নে উঠে গ্লাসে পানি ঢেলে শ্রেয়িতার মুখে ধরে। রমণী পানি পান করে চুক্ষদ্বয় বুজে নিল। ইসমাইল খেয়াল করে রমণী পুনরায় নিদ্রায় মতঁ হয়ে পড়েছে। রমণীর মাথার চুলে বিলি কেটে সন্তোপর্নে প্রস্থান করে কেবিন থেকে। ডক্টর এর চেম্বারে গিয়ে দরজায় কড়া নারে। ডক্টর মিসেস টিয়া শ্রেয়িতার রিপোর্ট চেক করছিল। দরজায় শব্দ হওয়ায় তিনি সৌজন্যে ‘আসতে’ বললেন কাঙ্ক্ষিত মানুষকে। ইসমাইল ভেতরে এসে বসে। ডক্টর টিয়া চশমা ঠিক করে রিপোর্টগুলো গুছিয়ে ফাইলে রাখে। ফাইলটি ইসমাইল এর দিকে এগিয়ে দিলেন। ইসমাইল নিয়ে ডক্টর টিয়াকে কিছু বলবে। তার পূর্বেই তিনি বলেন,
‘পেশেন্ট পিজিক্যালি এন্ড ইমোশানালি উইক হয়ে পড়েছে। ট্রমার উপর ভর করছে পেশেন্ট। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে যথেষ্ঠ খেয়ালখুশির দিকে নজর রাখতে হবে। পরিবেশ বদলী করলে আরো বেটার। বাই দ্যা ওয়ে পেশেন্ট আপনার কি হয়!’
ইসমাইল এতক্ষণ ডক্টর টিয়ার পরামর্শ শুনে যাচ্ছিল। আকস্মিক শ্রেয়িতার আপনত্ব হওয়ার প্রশ্ন করায় থতমত খেয়ে গেল। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে গলা ঝেড়ে বলে,
‘ফিয়ন্সে।’
‘ওহ কংগ্রেস মিস্টার ইসমাইল। আপনি নিজেও ডক্টর। ট্রিটমেন্ট আপনি করেননি কেনো!’
ইসমাইল হতাশার দৃষ্টিতে ডক্টর টিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,
‘ম্যাম আমি উচ্চপদস্থ ডক্টর হলেও প্রিয় আবেগ লুকিয়ে আছে অন্তরালে। ভেতরের পেশেন্ট প্রিয় একজন। নিজ হাতে ট্রিটমেন্ট কখনো করতে পারতাম না। বরঞ্চ তাকে যখন স্ক্যাচারে দিয়ে ভেতরে পাঠিয়ে দিলাম। লেগেছিল আমার হাত বেকাবু হয়ে পড়েছে। মাথাটা ঝিমিয়ে অবশ হবার উপক্রম।’
ডক্টর টিয়া শান্ত্বনা স্বরুপ দৃঢ়স্থ কণ্ঠে বলেন,
‘ডোন্ট ওয়ারি মাই সান। সি উইল বি ফাইন। টেক কেয়ার।’
ইসমাইল মাথা নেড়ে ফাইলটি নিয়ে পুনরায় শ্রেয়িতার কেবিনে আসে। কিন্তু এসে চমকে গেল। লক্ষ্মীনা মেয়ের হাত ধরে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। ইফদিয়ার হতবম্ভ দৃষ্টিতে তার শ্রেয়িপ্পি দিকে চেয়ে আছে। শ্রেয়িতা কিভাবে মাকে সামলাবে ভেবে পাচ্ছে না। সে তো এই ভেবে অবাক উনাদের কে এই খবর দিল! ইসমাইল আনমনে ভাবে।
‘শ্রেয়িতার পরিবারকে কে অবগত করল!’
পরক্ষণে এরফান এর কথা তার মাথায় আসে। তার সঙ্গে তিয়ানাকেও সে লক্ষ করে ছিল। কিন্তু সে মুহূর্তে শ্রেয়িতার চেয়ে জরুরি চিন্তাধারা অন্য কিছু ছিল না তার কাছে। তাদের মধ্যকার কথা বের করার সময় পায়নি ইসমাইল। সন্তোপর্নে শ্রেয়িতাকে হসপিটাইলাইজড করেছিল। এর মধ্যে শ্রেয়িতার ট্রিটমেন্ট সুন্দরভাবে হয়ে যাওয়ায় কেবিনে সিফ্ট করে ছিল রমণীকে। ৭ ঘণ্টা পর জ্ঞান ফিরবে বলে জানিয়ে গিয়ে ছিল ডক্টর টিয়া। এটুকু সময়ে ইসমাইল ৩ ঘণ্টা এনজিও ক্যানভাসে ক্লাস করিয়ে ছিল। বাকি ৪ ঘণ্টা শ্রেয়িতার সঙ্গে কাটায়। লক্ষ্মীনা আন্টির ডাকে সম্মতি ফিরে ইসমাইল এর। সে ভাবনায় মগ্ন হয়ে পড়ে ছিল। তিনি ইসমাইল এর হাত আঁকড়ে ধরে ক্রন্দনরত গলায় বলেন,
‘মেয়ের সঙ্গে কি হয়ে ছিল বাবা! জানো না দেবী না থাকলে আজ আমার মা হারিয়ে যেতো।’
ইসমাইল স্মরণে ‘ইয়া রব্বি তুমি মহান’ বলে। আন্টির কথায় সে আশ্বস্ত করে বলে,
‘কিছু হয়নি আন্টি ছোটখাট রিকশা এক্সিডেন্ট।’
লক্ষ্মীনা মেয়ের দিকে ছলছল দৃষ্টিতে এক পলক ফেলে ইসমাইল এর দিকে তাকায়। কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে বলেন,
‘মেয়ে হীনা দেবী আমার ঘরে মুসলিম মেয়ে দিলেন। এতে আমার দ্বিধা নেই। তাকে কখনো সনাতন ধর্মের পূজারী হতেও আশ্বাস দেয়নি। বরঞ্চ নিজ সন্তোপর্নে সে নিজের ধর্মে চলেছে। জানো বাবা আমার গর্ভ থেকে কখনো কন্যা সন্তান হবার নয়। পুত্র আছে তবুও একটা কন্যা সন্তান এর জ্বালা বেশ পুড়াতো। একদিন বাচ্চা কন্যাটিকে দত্তক নিলাম। নেওয়ার আগে জানতে পারলাম বাচ্চা কন্যাটি মুসলিম। আমি আর উনি খুশিমনে নিতে চাইলেও পুত্ররা নারাজ। তারা হেয় করতে আরম্ভ করে। আজও পুত্র দুটো কন্যাকে পছন্দ করে না তার ধর্মের জন্যে। তবুও বোন রুপী হওয়ায় অবহেলা করে না বোনের প্রতি গুপ্ত প্রণয় ব্যক্ত করে।’
ইসমাইল লক্ষ্মীনা আন্টির মুখে আসল কারণটা শুনে শান্ত স্বাভাবিকভাবে দাঁড়িয়ে রইল। ইফদিয়ার আড়ালে শুনে নিল। আনমনে মুচকি হাসি দিল। যে হাসিতে ছিল তৃপ্তিকর হাসি। দুজনার প্রণয়ের ইতি ঘটবে না সে ভিত্তিতে। ইসমাইল আন্টির আঁকড়ে ধরা হাত দুহাতে আবদ্ধ করে আবদারের সহিতে বলে,
‘আমি আপনার মেয়েকে চাই। নিজের অর্ধাঙ্গীনি রুপে।’
লক্ষ্মীনা বেজায় খুশি। তিনি চাইতেন কন্যার জন্যে ইসমাইল এর মত সঙ্গী। এ যেন রোদেলা দুপুরে কাঠখোড় না পুড়িয়ে রত্ন পাওয়া গেল। শ্রেয়িতা লজ্জায় বাঁ হাতের কনুই চুক্ষদ্বয়ে রেখে ঠোঁটজোড়া প্রশস্ত করে রেখাময় হাসি দিল। ইফদিয়ার তার হবু ভাবীকে ব্যঙ্গ করে বলে,
‘এখনি বুঝি লজ্জা পাচ্ছো ভাবী। কিছু লজ্জা বাসর রাতের জন্যে বাকি রেখো।’
এবার যেন শ্রেয়িতার গালে লাল বর্ণালীপূর্ণ রক্তিম আভা ফুটে উঠল। ইসমাইল আবেগী নজরে চেয়ে আছে রমণীর দিকে। যাকে নিয়ে স্বপ্ন সে মনের গহীনে বেঁধেছিল সেটাই যে পূর্ণ হতে চলেছে। ভাবতেও যেন তার মনটা খুশিতে নেচে উঠতে চায়। ইফদিয়ার তার ভাইয়ের ভবিষ্যৎ জীবনের শুভ আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে মনে। সেই সঙ্গে যাবিয়াজ এর একপলক দেখার কামনা জাগে। লক্ষ্মীনা মেয়ের কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে আহ্লাদী কণ্ঠে বলেন,
‘মা-গো সামনে দূর্গাপূজা। এরপর তোদের বিয়ের দিন ফিক্স করে নিলাম।’
ইফদিয়ার দাঁত কেলিয়ে বলে,
‘সত্যি আন্টি!’
‘হ্যাঁ মা!’
‘ভাইয়া রেডি হয়ে নাও। দূর্গাপূজা শেষে তোমাদের বিয়ে ইয়াহু।’
‘হে রে বোইন এবার বুঝি রেডি হতেই হবে। আর দেরি করা যাবে না।’
শ্রেয়িতা মুখ ভেটকিয়ে লাজুক হাসে। যা ইসমাইল এর নজর এড়ালো না। ইফদিয়ার তার ভাইকে কিছুক্ষণের জন্যে বাসায় পাঠিয়ে দিল। অনেকক্ষণ যাবত তার ভাই কাজে কাজ করেই যাচ্ছিল। এখন না হয় বিশ্রাম নিক। সে তো আছেই শ্রেয়িতার খেয়াল রাখতে। ইসমাইল এর বাহু চেপে ধরে কেবিন থেকে বেরিয়ে আনে ইফদিয়ার। সে বেচারা হতবাক হয়ে বলে,
‘বোইন পিঠবি নাকি ওমনী বের করে আনলি কেন!’
‘পিঠাইনো দরকার। বাসায় যাবে না আপুর খবর দেবে না। সবকিছুর ফয়সালা বুঝি তুমি নিয়ে রাখছো। এবার আমার কথা শোনো। যদি না মানছো বিশ্বাস করো। এই কাঁচের জানালা দিয়া ধাক্কা মারব। একদম ছয় ফিট নিচে গিয়ে মরবে।’
‘হই বোইন কউ কি বলবি!’
‘বাসায় যা খাবার খা আর কিছুক্ষণ ঘুমা। চোখের আর মাথার দিকে খেয়াল রাখো না যতসব!’
ইসমাইল মেলা সত্ত্বেও মানাতে পারল না ইফদিয়ার কে। সে নিজের সিদ্ধান্তে অটুট রইল। অতঃপর বাধ্য হয়ে ইসমাইল শ্রেয়িতার সঙ্গে পাঁচ সেকেন্ড এর মত কথা বলে রওনা দিল। যাওয়ার আগে বোনকে ‘খেয়াল রাখিস নিজের’ বলে চলে যায়। ইফদিয়ার কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থেকে কেবিনের ভেতর প্রবেশ করে। সেখানে ইতিমধ্যে ডক্টর টিয়া এসে শ্রেয়িতার শরীর এর কন্ডিশন চেক করছেন। ইফদিয়ার আলতো কণ্ঠে বলে,
‘ডক্টর এনি সিরিয়াস কন্ডিশন!’
‘নো পিট্রি গার্ল। ইটস সিম্পল। আই থিংক উই উইল ডিসচার্জ হার ভেরি সুন।’
লক্ষ্মীনা ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে কথাটি শুনে খুশি হলেন। কিছুক্ষণ আগে ফ্রেশ হতে ওয়াশরুমে গিয়ে ছিলেন তিনি। সে সময়ে ইসমাইলও দেখা করে চলে গিয়ে ছিল। ইফদিয়ার আন্টির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘আন্টি আমরা তৈরি হয়ে নিলে ভালো হবে। আপুর জন্যে ড্রেস এনেছি।’
‘ভালো করেছো মা। তুমি শ্রেয়িতাকে তৈরি করে রাখো। আমি পুত্রদের জানিয়ে দিচ্ছি আসতে।’
লক্ষ্মীনা কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন। ইফদিয়ার শ্রেয়িতাকে ধরে হসপিটালের নীল পোশাক সরিয়ে নতুন পোশাক পরিয়ে দিল। এতে কিছুটা ইতস্ততঃ বোধ করল ইফদিয়ার। কারণ শ্রেয়িতার কাঁধে-গলায়-ঘাড়ে নখের আচড় এর দাগ , ঠোঁটের কোণায় কাটা দাগ। এই দাগগুলোর অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। যেটি হলো জোরকৃতভাবে ধর্ষণ। ঢোক গিলে ইফদিয়ার ভাবে একবার জিজ্ঞেস করবে। কিন্তু মানসিক পরিস্থিতি একটু আমলে আসায় ব্যক্ত করল না। তার ভাই থেকে শুনে নিবে বলে ভেবে রাখল। অথচ যখন এরফান ভাই তাকে কল করে ছিল। তখন এরফান বলে ছিল ‘শ্রেয়িতা মেডিক্যালে। এক্সিডেন্ট করেছে সেখানে ইসমাইল ভাই আছে। আন্টিসহ তুমিও যাও।’
একটু কথায় কল কেটে দিল। বিস্তারিত না বলায় সামান্য ক্রোধ হয়ে ছিল ইফদিয়ার। তার পুনরায় অবাকও লাগল যে এরফান অপরিচিত হলেও ‘তুমি’ বলে সম্বোধন করেছে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে আন্টিসহ সে মেডিক্যাল পৌঁছে যায়। রিসেপশন থেকে কেবিন নং জেনে তড়িঘড়ি রওনা দেয়। কেবিন এর সামনে ভাইকে দেখে স্বস্তি মিলে। ভাবনা থেকে বেরিয়ে ইফদিয়ার হাস্যজ্জ্বল মুখ করে শ্রেয়িতাকে তৈরি করে নিয়ে গেল।
১ ঘণ্টা পর বাসায় পৌঁছে যায় সবাই। সেন আর রৌশ ভেতরে থাকায় ইফদিয়ার নিজের বোরকা, নেকাপ শুদ্ধভাবে টেনে ঠিক করে ফেলল। তারা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে এক নজর ইফদিয়ার দিকে তাকিয়ে উঠে চলে যায়। ইফদিয়ার বুকের উপর হাত রেখে জোরাল শ্বাস ছাড়ে। শ্রেয়িতাকে আন্টি নিজ রুমে নিয়ে যায়। সে তার মায়ের রুমে গিয়ে দেখে তার মা হাতড়িয়ে কি যেন খুঁজছেন।
ইফদিয়ার ভেতরে প্রবেশ করে দরজা ভিজিয়ে বলে উঠে।
‘আম্মা কি খুঁজছো!’
মিসেস জাবিয়া অনেকটা সুস্থ আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছেন। মেয়ের কণ্ঠ শুনে তিনি ফিরে তাকান। ঠোঁটের ফাঁকে স্মিতপূর্ণ হাসি টেনে বলেন,
‘ফোনটা পাচ্ছি না। একটু দে তোর আপন একজনের সঙ্গে কথা বলতে চায়। অনেক দিন তো হলো কথা হয়না।’
ইফদিয়ার অবাক এতদিন তার আপন জন বলতে তার মা, কাকীমা, ইসমাইল আর কেউ নয় জানে। এখন নতুন আপনজন কোথার থেকে উদয় হলো সেটাই বুঝতে পারছে না সে। তাও মায়ের কথার বিপরীতে গিয়ে বলে,
‘ঠিকাছে এত খুঁজছো কেনো ! আমার ফোন নিয়ে বলো।’
মিসেস জাবিয়া ফোনটা নিয়ে ফোন নং এ ডায়ল করে। ইতিমধ্যে রিং হচ্ছে। তিনি ইফদিয়ার সামনে কথা বলতে জড়তায় ভোগচ্ছেন। তাই চুপ করে রইলেন। কলটা অপরপাশের ব্যক্তি ঠিকই ধরেছে। ইফদিয়ার অজানা যে কলটি আজও রিসিভ হয়েছে কিনা। কারণ তার মা বোবার মত মূর্তি বনে আছে। দু’পাঁচেক মিনিট পর তিনি কল কেটে ইফদিয়ার কে দিল। আনমনে বলে,
‘দূরে যাবে রে।’
‘মানে!’
মিসেস জাবিয়ার সম্মতি ফিরলে তিনি ‘কিছু না’ বলে মাথা এপাশ ওপাশ নাড়লেন। কিন্তু মেয়েকে কিভাবে জানাবেন! ইফদিয়ার তার মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে বলে,
‘মা আগামী দশমী দিন দূর্গাপূজা চলবে! লক্ষ্মীনা আন্টি ভাইয়া আর ভাবীর বিয়ের দিন ফিক্সড করেছে একাদশ দিনে। মানে পূজার শেষে। ইসলামিক বিধিবিধান অনুযায়ী বিয়েটা হবে।’
‘তার মানে নিজ গৃহে এখন বউমাকে উঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’
‘হু মা তুমি কি আমার সঙ্গে বাসায় ফিরবে। আমার কলেজ স্টার্ট হবে তিন মাস পর।’
‘একমাত্র ছেলে জাকজমকভাবে ঘরোয়া পদ্ধতিতে বিয়েটা করাবো।’
‘ওকে আমি গিয়ে ভাইকে বলি।’
‘না তুই যা আমিই কথা বলব।’
ইফদিয়ার ‘না’ করেনি। সে উঠে যায়। নিজ রুমে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিল। তৎক্ষণাৎ ফোনের মেসেজ ঠুং ভাইব্রেইট হয়ে উঠে। মেসেজে এরফান ভাই এর আইডি থেকে মেসেজ এসেছে।
‘শোনো বোন আজকে রাত ৯টায় রাকতিয়া ক্যাফে চলে এসো।’
ইফদিয়ার একপলক দেখে চোখ বুজে নিল। বুজতেই অনাকাঙ্ক্ষিত অশ্রুসিক্ত হলো। যার অবদান শুধু যাবিয়াজ নামক যুবকের। আজও বড্ড পুড়ায়। কিন্তু আজকের দিনটায় পীড়নটা যেন সীমাহীন মনে হচ্ছে তার। অকারণে পুড়ছে হৃদয়টা। না জানি সামনে কি অপেক্ষা করছে!
৪৩.
ফেরদৌস এর পাশে এরফান বসে আছে। দুজনই গম্ভীর দৃষ্টিতে যাবিয়াজ এর দিকে চেয়ে আছে। কিছুক্ষণ আগেই শ্রেয়িতার কথা জানিয়ে ছিল। এতে রাগ মাথায় চড়ার পূর্বেই এরফান বলে দিল যে, ইসমাইল ভাই সামলে নিয়েছে। সেই সঙ্গে ছেলে দুটোকে বেধড়ক আঘাত করেছে।
এতে শান্ত হয় যাবিয়াজ এর প্রাণ। যত হোক বোনপ্রিয় মেয়ে শ্রেয়িতা। তাদের বান্ধবী কম বোন বেশি সে। একটুখানি আচ যেন সে পেলে তাদের শরীরে লাগে এমন হয়। এখন বোনের জীবনে সঙ্গপণতায় কেউ জায়গা করার মত এসেছে। তাও আবার যোগ্য একজন মানুষ। ফলে যাবিয়াজ এর আর কোনো চিন্তা নেই। নিদ্বিধায় সে বলে দিল।
‘ইসমাইল ইজ পার্ফেক্ট ফর শ্রেয়িতা।’
‘হুম বায় দ্যা ওয়ে সি এন্জ ইফদিয়ার উইল কাম ইন টু নাইন পিএম।’
যাবিয়াজ শুনে মৃদু ঠোঁট নাড়িয়ে ‘হুম’ বলে। ফেরদৌস দ্বিধাগ্রস্ত না হয়ে রাগমিশ্রিত গলায় বলে,
‘তুই আমাদের দোস্ত মানিস!’
যাবিয়াজ বোকামার্কা হাসি দিয়ে বলে,
‘কেনো আমি বুঝি না মানার ট্যাগমা কপালে নিয়ে বেড়াচ্ছি!’
‘তাহলে ছেড়ে যেতে এক সেকেন্ড এর জন্যে হলেও ভাবতি। যাবি বুঝলাম একমাস দুমাস হলেও চলতো। যাবি তাও তিনবছর। লাইক সিরিয়াসলি!’
‘দেখ দোস্ত। বাবার ব্যাপারে তোরা জানিস। এন্ড আইম অলওয়েজ সিরিয়াস টু মাই ফাদার কন্ডিশন।’
‘তাও সময় কমানো যায় না।’
‘না।’
যাবিয়াজ এর একরোখা জবাব। এরফান এতক্ষণ চুপ থাকলেও এখন বিরক্তবোধ করে বলে,
‘কেন ঐ মেয়ের জন্যেই গিয়ে থাকবি তিনবছর। আর আমাদের!’
‘তোরা যথেষ্ট এডাল্ট এন্ড হার্ডওয়ার্কার। আমার অনুপস্থিতিতে অবশ্যই তোরা এখানকার সব সামলাবি। নিজেদের ক্যারিয়ারও গড়তে পারবি।’
‘রাতে চলে আসিস। শেষবার দেখা করে যাবি।’
‘ওটা আর বলতে কি! তাকে এক নজর না দেখে কেমনে পাড়ি দিবো অজানা দেশে।’
যাবিয়াজ সে সময়ের মত ইতি টেনে কফিশপ হতে চলে যায়। গাড়িতে বসে ইঞ্চিন চালু করে। প্রথমে ভাবে একবার ইফদিয়ার কে অনুরোধ করবে বাবার সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু নিজের ইগোটাও মাঝখানে চলে আসে তার। ইগোর ব্যাপারটা বুঝে চুপ হয়ে যায়। নিজের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র গুছানোর ব্যকুলতা মনমাঝাড়ে আঁটে। রুমে এসে যাবিয়াজ তার ফোন নিয়ে কল দিল ইসমাইল কে।
ইসমাইল সবেমাত্র ফ্রেশ হয়েছে। এতক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল। ফোন আসায় কলটি কানে ধরে সালাম দিল। যাবিয়াজ সালামের জবাব দিয়ে বলে,
‘ভাইয়া আমি এসিস্ট্যান্ট পদ থেকে রিটায়ার হতে চাই। আমার বাবার চোখের অপারেশন।’
বিস্তারিত জানায় উক্ত ব্যাপারে। ফলে ইসমাইল রাজি হয়ে যায়। যাবিয়াজ কল রেখে আনমনে বলে,
‘আরেক দায়িত্বও শেষ। শুধু বাকি তুমিই ইফদিমনি।’
রাত ৯টা…
রাকতিয়া ক্যাফটা আজ পরিপূর্ণভাবে সাজানো হয়েছে। এটি পাবলিক রেস্টুরেন্ট। এখানে দূর্গাপূজা উপলক্ষে ফেরি লাইটস ইউজ করা হয়েছে। মরিচবাতির আলোতে রংধুনর বর্ণালী ছড়িয়ে পড়ছে। কেউই ভাবেনি আজকের ক্যাফ এতটা সৌন্দর্যের প্রকাশন হবে। যাবিয়াজ, এরফান, ফেরদৌস, তিয়ানা, ইফদিয়ার, ইসমাইল, শ্রেয়িতা চলে এসেছে।
তারা চোখের মুগ্ধ দৃষ্টিতে ক্যাফটা লক্ষ করে। তখনি সাবলীল কণ্ঠে একজন পুরুষ এসে তাদের টেবিলে বসার অনুরোধ জানায়। তার কথা মত ইসমাইল এক জানালার পাশের টেবিলে সবাইকে বসতে বলে। আজকের খাবারের খরচটা সে দিতে চায় বলে জানায়। এতে আর কেউ আপত্তি করেনি। শ্রেয়িতা তাদের কে নিজের আর ইসমাইল এর বিয়ের কথা জানায়। এ কথা শুনার পর যতটা না সবাই খুশি হয়ে ছিল তার চেয়ে বরং দুঃখটা এখন বেশি হচ্ছে যাবিয়াজ এর চলে যাওয়ার কথা শুনে। ইফদিয়ার যখন শুনে তখন তার শরীর অবশ মূর্তি হয়ে গিয়ে ছিল। বসেই ছিল মুখ তুলে একপলকও ফেলেনি যাবিয়াজ এর দিকে। মূর্তি রুপী হয়েও কান্না আঁটকে রেখে বারংবার ঢোক গিলছিল। এই বুঝি মিথ্যে বানোয়াট কথা বলেছে বলে মজা করে উঠবে যাবিয়াজ। কিন্তু তার ধারণা ভুল প্রমাণিত করে যাবিয়াজ বলে,
‘রাতের ১টায় ফ্লাইট। তাই ভেবেছি চলে যাচ্ছি তোদের সঙ্গে এক ঘণ্টা কাটিয়ে যায়। এতে ক্ষতি কয়!’
ইফদিয়ার খুব করে বলতে ইচ্ছে ছিল। যেন সে তাকে না রেখে চলে যায়। একবার তার মনের কথাটা বলার জন্যে জিজ্ঞাসা করুক!
যাবিয়াজ ইফদিয়ার কে চুপ দেখে কষ্ট পেল। তাও বেহায়ার মত ধরা চাপা গলায় প্রশ্ন করে।
‘তুমি খুশি রাইট আমি চলে যাচ্ছি বলে!’
ইফদিয়ার মনটা ক্ষেপে উঠে। কেউ যদি উওপ্ত আগুনে ঘি ঢেলে আগুনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। তাহলে আগুন তো বাড়বেই। সেখানে যাবিয়াজ এর প্রশ্নটা যেন ছিল ব্যঙ্গ করার মত। যেন সে তাকে ঠেস মেরে কথাটি বলেছে।
অন্যদিকে, যাবিয়াজ মনেপ্রাণে প্রার্থনা করছে। যেন একবার ইফদিয়ার না বলে উঠুক। সেই নেগেটিভ উত্তরটি যত চিল্লিয়েই হোক না কেনো তাও যেন বলে উঠুক। কিন্তু তাদের মনকামনার প্রতিক্রিয়া বিপরীত দিকে মোড় নিল।
ইফদিয়ার ক্ষেপানো গলায় সোজাসুজি বলে,
‘যতসব ন্যাকামো যাবেন তো চলে যান না। নাকি এখনো সিনক্রিয়েক্ট করার জন্যে বসে আছেন!’
ব্যস এটুকু যথেষ্ঠ হয়ে গেল যাবিয়াজ এর হাসিখুশি মুখে কালো মেঘের ছায়া নামিয়ে দিতে। হাসিটাও মিলিয়ে যায় মেঘের অন্তরালে। মলিন বিষন্নতার ছাপ ফুটে উঠে। শ্রেয়িতা তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে কিছু বলবে। তার আগেই যাবিয়াজ তার হাত আঁকড়ে ধরে মাথাটা ‘না’সূচক নাড়ে। এতে শ্রেয়িতা দমে যায়। কিন্তু ইসমাইল আজকের বোনের করা ব্যবহারে ক্ষোপ প্রকাশ করল। কোনো মানুষ যদি সফরে যায় তার সঙ্গে ভদ্রভাবে কাতিরতা ফেস করতে হয়। আপ্যয়নে কমতি রাখা যায় না। সেখানে সফরযাত্রীকেই তার বোন কটুভাবে কথা শুনিয়ে দিল। ইসমাইল রেগে জিজ্ঞাসা করে।
‘বোন তোর সব ব্যাপার মানলেও আজকেরটা মানলাম না। যাবিয়াজ চলে যাবে। তাও তোর রাগ এতটা যে সফরযাত্রীর সঙ্গে মৌনতার পরিবর্তে রুক্ষতা প্রকাশ করলি।’
ইফদিয়ার নিরবে নেকাপের আড়ালে চোখের পানি ফেলে। মাথা নিচু করে দৃষ্টি মেঝের দিকে করে রেখেছে। যাবিয়াজ কাঁপান্বিত হয়ে আমতা আমতা করে হেসে বলে,
‘ওকে গাইস আজকে আমার এখানে খাওয়া হবে না। তোমরা খেয়ে নাও। আমার বের হতে হবে।’
সবাই ঠিক বুঝতে পেরেছে কেনো যাবিয়াজ চলে যাচ্ছে। এতে যে ইফদিয়ারও অবগত। তবুও তার মন কাঁদছে যাবিয়াজ এর চলে যাওয়াটা সে নিতে পারছে না। কিন্তু হায় ইগো! চুপ করিয়ে রেখেছে।
যাবিয়াজ চলে যায়। ইফদিয়ার দৃষ্টি উঠিয়ে সে দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হচ্ছে কলিজাটা বোধ হয় বেরিয়ে ঐ মানব হৃদয়ের সঙ্গেই চলে গিয়েছে। হয়তো আর ফিরে পাবে না।
চলবে….