অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_২৮
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
৫৩.
নাজমুল অস্থীরচিত্ত হয়ে পায়চারী করছে রুমে। ক্রোধে এক দুটো জিনিসপত্র ভাঙচুর করলেও ক্রোধ যেন ক্রমান্বয়ে বেড়ে চলেছে তার। মাথার চুল চেপে ধরে একে একে হিসেব মিলাতে লাগল। বিড়বিড় করে বলে,
‘তুই হে তুইই আমাকে হুমকি দিছিলি। কেমনে ভুলব তোকে! তোর হুমকি যেন আমার হিংস্র পশুত্বকে জাগিয়ে দিয়েছে। তোর ইফদিয়ার তাই না! ওকে তো আমি নিজের আস্তনায় বেঁধে লুপে নিবো এক এক অপমানের শোধ। ওর শরীর যদি কেটেকুটে নদীতে না ফেলি তাহলে শান্তি পাবো না।’
নাজমুল ধপ করে সিঙ্গেল সোফায় গা হেলিয়ে দিল। তার রুমের বর্হিভাগ হতে চেয়ারম্যান সাহেব পর্যবেক্ষণ করছিলেন নিজের ছেলেকে। দাঁতে দাঁত খিচে চেপে ধরলেন উনি। এমনি তার ছেলে বেহায়াপনার সীমা লঙ্ঘন করে ফেলেছে। তার উপর ইফদিয়ার পিছে ঘুরে ইভটিজিং এর মত অপরাধ পূর্ণ কর্ম চালান দিচ্ছে। যদি ছেলের কর্ম এভাবে চলতে থাকে। একসময় মান-সম্মান খোয়াতে হবে। চেয়ারম্যান পদান্নতি থেকে অবনতির ন্যায় ঝড়ে পড়তে হবে। শয়তানি বুদ্ধি চাপলেন তিনি নিজের মনে। সন্তোপর্ণে প্রস্থান নিলেন ছেলের রুমের বাহির হতে। নিজ রুমে এসে বিছানার পাশে থাকা ড্রয়ার হতে ফোনটি হাতে নিলেন তিনি। ফোনের মধ্যে একজন ব্যক্তির নাম্বার খুঁজে কল লাগালেন। অপরপাশের ব্যক্তি ফোনটি দু’তিনেক মিনিট পর উঠালেন।
‘কেমন আছিস ভাই?’
‘খবরাখবর বাদ দিন। এতদিন পর কল দিলেন নিশ্চয় কোনো কান্ড ঘটাতে হবে। রাইট মিস্টার মোখলেস মির্জা !’
শয়তানি হেসে উঠলেন তিনি। পুনরায় কলের মধ্যে থাকা ব্যক্তিকে নিজের কুবুদ্ধির উদ্দেশ্য জানায়। শুনে অপরপাশের ব্যক্তি খানিকক্ষণ চুপ থাকলেন। পরক্ষণে বলে উঠলেন।
‘আপনি ভাবতে পারছেন যাকে উঠানোর কথা বলছেন তিনি কার কি হোন সম্পর্কে !’
‘ওসবে আমার কিছু যায় আসে না। একবার ছেলের ক্ষুধাবর্ধক মিটাতে সক্ষম হলেই বাঁচি। না হলে সমাজের সামনে নিজের সম্মানহানির মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে।’
‘তা বুঝলাম। তবে আপনার ছেলে কি মেন্টালি সিক! আই মিন সে এখন বিবাহিত মেয়ের পিছে লাগল যে।’
‘এতে তোমার নাক না গলালেও চলবে।’
অপরপাশের ব্যক্তি অট্টহাসি দিলেন। তিনি বাঁকা হেসে বলেন,
‘সম্মান দিয়ে কথা বলুন মিস্টার মির্জা! আমাকে দিয়ে কাজ করাচ্ছেন। আমার উপরই ধমক। এটা মানা দায়! সরেন বাদ দিলাম ব্যাপারটা। এখন বলুন কাজ বড় যেহেতু কর্ম ফল সেহেতু দ্বিগুণ বড় হওয়া চায়।’
মোখলেস বিরক্তর কণ্ঠে ফোঁস করে বললেন।
‘তোমার কাউন্টে ৫০ লাখ টাকা জমা হয়ে যাবে।’
‘গুড আই লাইক ইট! আপনার কাজ হয়ে গেলে জানিয়ে দেবো।’
কট করে অপরপাশের ব্যক্তি কল কেটে দিলেন। মোখলেস এর কাছে ব্যাপারটা অসম্মানের মত লাগল। তবুও মুখ ফুটিয়ে এখনি পদক্ষেপ নিতে চাইলেন না। কেননা কাজ অপূর্ণ থাকা অব্দি উনার ভেজা বিড়ালের ন্যায় আচরণ করতে হবে। একবার কাজ সম্পূর্ণ হলে স্বার্থ হাসিলে যেকোনো পদক্ষেপ নিতে উঠেপড়ে লাগবেন। আপাত দৃষ্টি মোতাবেক অসম্মান এর বিষয়টি ধামাচাপা দিলেন। ফোনটি রেখে বিড়বিড় করে বলেন,
‘ছেলেকে কষ্ট পেতে দেখে মুটেও সহ্য হচ্ছে না। বিধায় তোর সহায়তা নিয়েছি। কাজ হয়ে গেলে তোরও উচিৎ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করা।’
বলেই খানিক বাঁকা হাসলেন। পুনরায় নিজেকে ধাতস্থ করে বলে উঠলেন।
‘আর রইল আহসান এর মেয়ের কথা। সে কার স্ত্রী তা দিয়ে আমার কিছু যায় আসে না। একবার ছেলের পৈশাচিক ক্ষুধা মিটে গেলে মেয়েটিকে গুম করে দেব। কিন্তু এর জন্যে মেয়ের স্বামীকে দৃষ্টিভ্রম এর মাঝে ফেলতে হবে। পদক্ষেপ অনুসারে তার স্বামীকে টাকার গরম দেখাতে হলে তাও দেখিয়ে দেব।’
ক্ষমতা থাকায় মোখলেস নিজের কুবুদ্ধিতায় বিজয়ের ন্যায় হাসি দিলেন। নাজমুল হঠাৎ রুমে প্রবেশ করায় হকচকিয়ে উঠলেন তিনি। এখনি চমকপ্রদ দিতে চাননা ছেলেকে। যখনি মেয়েটিকে ছেলের বিছানায় অানতে সক্ষম হবেন তখনি ছেলেকে চমকে দেবার উদ্যোগ নিয়েছেন মনে। নাজমুল অতীব ক্রোধ দমিয়ে নিজের বাবার সম্মুখীন হলো। মোখলেস চুপ করে ছেলের কর্ম দেখছেন। শান্ত কণ্ঠে মোখলেসকে বলে উঠল সে।
‘বাপ মুই ইফদিয়ার ভার্সিটি পড়বাম চায়।’
‘কি বলছিস অসময়ে ভর্তি হবি। যেখানে তুই পড়াশুনা এইচএসসি- তে এসেই থামিয়ে দিয়ে ছিলি।’
‘কথা কম। মুই ইফদিয়ার রে চায়। হের লাইগা ওর ভার্সিটি ভর্তি কইরা দাও।’
মোখলেস চিন্তিত ভঙ্গিতে ছেলের পানে চেয়ে রইলেন। ছেলে একটা বিবাহিত মেয়ের জন্যে কিনা ভার্সিটি ভর্তি হতে চায়। কিন্তু আদৌ মেয়েটা ভার্সিটি পড়বে! এ নিয়ে সন্দেহ জাগ্রত হলো উনার মনে। অন্যথায় মেয়েটা পূর্বে ছাত্রী অবিবাহিত কুমারী ছিল পরবর্তীতে বিবাহিত নারী হয়ে গেল। উনার ভাষ্যমতে, মেয়ে সাংসারিক জীবনে আবদ্ধ হলে পড়াশুনা দমিয়ে ফেলে। হয়ত সেই মেয়েটাও দমিয়ে নিবে বলে ধারণা করলেন। নাজমুলকে অধর্য্য হতে না দিয়ে উদগ্রীব গলায় বলেন,
‘তুই বলছিলি মেয়েটার বিয়ে হয়েছে। এখন সে ভার্সিটি পড়বে!’
নাজমুল কথাটি শুনে উত্তেজনা ছাড়িয়ে নিল নিজের শরীর হতে। ভাবনায় ডুবে গেল। তার বাবার কথায় যুক্তি পেয়ে খানিক আমতা আমতা করে বলে,
‘মুই খবর নিয়া জানাব। তহন কিন্তু মুই ভর্তি হইয়া চায়।’
মোখলেস মৃদু হেসে ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে বলেন,
‘অফকোর্স মাই সান গো।’
নাজমুল বারতি কথন ব্যক্ত না করে বেড়িয়ে গেল রুম হতে। মোখলেস তপ্ত এক শ্বাস ফেলে আনমনে ভাবেন।
‘ছেলেটার উৎকট আচরণ করার পিছনের মূল কারণ আমি। যদি না ব্যবসায়িক কাজে বাহিরে ছুটাছুটা করতাম। তাহলে বুঝি ছেলেটা সুন্দর জীবন পেতো। অসহায় নিসঙ্গ থেকে নিজেকে অন্ধকারে ধাবিত করে নিল সে। তাই ভাগিদার আমি হলেও অপূর্ণ রাখব না ছেলের আবদার। একটা মাত্র ছেলে । স্ত্রী গত হয়েছেন বহু বছর আগে। যখন ছেলে কিনা পাঁচ বছর বয়সী ছিল। নিজ হাতে বড় করতে না পারলেও আবদার পূরণে অবাধ্য হবো না। একটা মেয়েকে কেন হাজার মেয়ে হলেও টাকা দিয়ে কিনে নিবো তোর জন্যে বাবা। অপেক্ষা কর।’
নাজমুল বাহিরে এসে তার দলের সঙ্গে যুক্ত হলো। দলের ছোট চামচা ঠাট্টার সুরে বলে,
‘মামা বেডি রে হাসিল করতে পারলি!’
‘না রে এহোনো বেডি লাইনে আহে নাই।’
মেঝ চামচা হঠাৎ প্রশ্ন করে উঠে।
‘ওসব বাদ দে। হেই কো তুই তো শুদ্ধ বাংলা কইতে পারস। তইলে আমাগোর মত কেন কথা কস!’
নাজমুল বিশ্রী হাসি দিল। রাস্তায় যাতায়াত করা মেয়েদের শরীরের দিকে তাকিয়ে বিদঘুটে অহং নিয়ে বলে,
‘মাইয়াগো রে উৎক্ত করবাম লাইগা এমনডা ভাষায় কথা কই।’
নাজমুল এর সঙ্গে উচ্চস্বরে ঠাট্টাময়ী বিশ্রী হাসি আসতে আরম্ভ করে তারা। সে আপাত ইফদিয়ার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে দলবল থেকে বেরিয়ে আসে। ইফদিয়ার বাসার সম্মুখে এসে দেখে দরজায় তালা দেওয়া। দৃশ্যটা সহ্যহীন লাগল তার। ধড়াম করে পা দ্বারা লাথি দিল দরজায়। আশপাশের প্রতিবেশীরা সরু চুক্ষে হেঁটে হেঁটে নাজমুল কে লক্ষ করে চলে যাচ্ছে নিজ গন্তব্যস্থল এ। কিন্তু নাজমুল এর কাছে এ নিয়ে মাথা ব্যথা নেই। কেননা সে ক্ষমতাপূর্ণ। নিজের শার্টের কলার হাত দিয়ে টান টান করে অহংকারী ভাব নিতে লাগল। ইফদিয়ার বাসার খুব সন্নিকটে একজন বুড়ির বাসা বিদ্যমান। বাসাটির দশা খুব দুরুহ। টিনের ছাউনীর অর্ধ অংশ ভেঙ্গে গড়িয়ে আছে। দরজার তালা ভাঙ্গা। মেঝের মধ্যে গর্ত দেখা যাচ্ছে। একপাশে নালার মত খনন করা। শহরের প্রতিটা আনাচে কানাচে বুঝি তাই নালার অপদস্থ দশা এ কারণেই।
লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
বুড়ির বাসা থেকে বিকট দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। যা রাস্তার ধারপ্রান্তে না ছড়ালেও বাসার নিকটে গেলে নাকের মধ্যে প্রবেশ করছে। পীড়ন নিয়ে নিজের নাক রুমাল নিয়ে বেঁধে নিল নাজমুল। বুড়িকে চেঁচিয়ে বলে,
‘আপনার প্রতিবেশীরা কই!’
‘মোর প্রইতাবেশী বিয়তবাড়ি গেছে।’
নাজমুল কথাটির পূর্ণ অর্থ বুঝতে পেরে আর দাঁড়িয়ে থাকল না। গাড়ির কাছে এসে বসে পড়ে। এখনো সন্ধ্যা গড়ায়নি। সন্ধ্যা হলেই বউভাত এর অনুষ্ঠান আরম্ভ হবে। যা রাতের ২টা অব্দি বহমান থাকবে। গাড়ি নিয়ে উদ্দেশ্যপূর্ণ হয়ে নাজমুল বউভাত এর অনুষ্ঠানে যুক্ত হতে চলে যায়।
৫৪.
যাবিয়াজ পরন্ত বিকেলের দিকে বেরিয়ে পড়ে। দেশ আসতে না আসতেই সে কর্মঠ হয়ে উঠেছে। দিনের আরম্ভে স্ত্রীর সঙ্গে স্বাদরে কাটাতে পারলেও দুপুরের দিকে স্বামী-স্ত্রীকে আলাদা করা হয়েছে। খ্যাতিমান অনুষ্ঠানের নামডাক বড় হওয়ার ভিত্তিতে বউভাত অনুষ্ঠানটি বড়জোড় ভাবে আয়োজিত হয়েছে। শহরের নামিদামী বিশেষজ্ঞ অথিতিবৃন্দ আসার আমন্ত্রণ দেওয়া হয়েছে। যাবিয়াজ বিয়ের পূর্বেই তার অস্ট্রেলিয়ার কলিগদের আমন্ত্রণ জানায় ইমেইল এর মাধ্যমে।
কিন্তু সকালের মুহূর্তটা থেমে গেলে ভালো হতো বলে মনে করছে যাবিয়াজ। তাহলে বউ এর সঙ্গে আদুরী মুহুর্ত বাড়াতে পারতো। ভেবেই আনমনে হাসল সে।
তাকে মিটিমিটি হাসতে দেখে ভ্রু কুঁচকে তাকায় এরফান। সে বন্ধুর হাতের কনুইয়ের মধ্যে নিজের কনুই দিয়ে ধাক্কা দিল। সম্মতি ফিরে পাওয়ায় সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে কিঞ্চিৎ সন্দেহ প্রবণতা বজায় রেখে জিজ্ঞাসা করে যাবিয়াজ।
‘তোর বুঝি আমার সুখ সই না।’
‘বাপু আমি বুঝি কিছু করেছি।’
‘কেন আমার স্বপ্নের বাসরটা একসেকেন্ডে মিটাইয়া দিলি ওইটা তোর মনে বুঝে না।’
‘উপস আইম সরি। আমি ভাবছি কাজের ঠেলায়।’
‘তোর খুশির ঠেলায় শা***লা।’
এরফান প্রথমে মিছামিছে হাসি দিলেও এবার যেন প্রাণচঞ্চল হাসি দিয়ে যাবিয়াজ এর পিঠে চাপড় মারে। যুবক নিজেও আনমনে ভাবনা ঝেড়ে লেপটপে বায়োজেনেটিক প্রোগ্রাম এর ওয়ার্ক কমপ্লিট করছে। নতুন আরেকটি প্রজেক্ট এসেছে প্ল্যান্টেশন নিয়ে। যা উদ্ভিদ বিজ্ঞানকে কেন্দ্র করে গঠিত হবে। তবে এর জন্যে জীব বিজ্ঞানের কার্যকারিতা কিরুপ প্রভাব পড়ে তার বিস্তারিত ধারণাও নিম্নে উল্লেখ করছে সে। টাইপিং স্লিক যাবিয়াজ এ বরাবরই দুর্দান্ত। চোখ বন্ধ অবস্থায়ও সে শুদ্ধভাবে বাক্য গঠণ করতে পারে। বাক্য মিলিয়ে অপর বাক্যের সংযোজন করার বিনিময়ে তার বিন্দুমাত্র ভুলত্রুটি হয় না। এরফান যাবিয়াজ এর টাইপিং দেখে বিরক্তবোধ করে ‘বা’ উচ্চারিত করার পূর্বেই নিজেকে দমিয়ে নিল। ফোঁস করে বিরক্তির শ্বাস ছেড়ে যাবিয়াজ এর হাত ধরে। হঠাৎ হাত থেমে যাওয়ায় কিঞ্চিৎ ভ্রু নাড়িয়ে ইশারা করে বুঝায় ‘কি হয়েছে!’
এরফান দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘আস্তে চালা ভাই। লেপটপও হাঁপিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তুই হাঁপাইতাছিস না কেন। যা পানি খাইয়া আয়।’
‘জ্ঞান দিচ্ছিস দেখি।’
এরফান কথা না বাড়িয়ে যাবিয়াজকে টেনে বসা থেকে উঠিয়ে নিল। যাবিয়াজ কে তার কেবিন থেকে প্রস্থান করিয়ে ক্যান্টিনে নিয়ে গেল। সেখানে ফেরদৌস চিল মুডে বসে ফোনে গান শুনছে। চুক্ষদ্বয় নিমীলিত রেখে মাথা খানিক পর পর কিঞ্চিৎ নেড়ে গানের অভিব্যক্তি প্রকাশ করছে। এরফান ঠোঁট কামড়ে ধীরস্থীর পায়ে এসে ফেরদৌস এর মাথায় থাবড়া বাজানোর মত পিঠিয়ে উঠল। বেচারার কিছু বোধগম্য হওয়ার পূর্বেই কেমন যেন বেক্কল বনে গেল। ফোনটা ঠাস করে টেবিলের উপর যায়। এমনকি তার স্মার্টলি স্পাইক করা চুলগুলি আওলা জাওলায় পূর্ণ হলো। এরফান পেট চেপে ধরে হাসতে হাসতে তার পাশে বসে পড়ে। নিজের পকেট থেকে ফোন বের করে ক্যামেরায় প্রেস করে। ক্যামেরার ফেস সাইডটি ফেরদৌস এর মুখ বরাবর ধরে এরফান বলে,
‘পুরুই বলদ লাগছে।’
ফেরদৌস ক্রোধান্বিত ভাব নিয়ে এরফান এর শার্টের কলার চেপে ধরে থাবড়ে উঠে। সেও এক পর্যায়ে নিজের পায়ে কুড়াল মেরেছে এমন মনে করতে লাগল। এরফান ছাড়া পেতে সম্মুখে শান্তপূর্ণ হয়ে বসা হ্যান্ডসাম যুবক অর্থাৎ যাবিয়াজ কে চেঁচিয়ে বলে,
‘দোস্ত বাঁচা মরে। না হলে মরণ সন্নিকটে।’
যাবিয়াজ স্বাভাবিক দৃষ্টিকোণ নিক্ষেপ করে ফেরদৌস কে আদেশানুসারে বলে,
‘একমগ পানি নিয়ে এরফানের মাথায় ঢেলে দে শান্তি পাবি।’
ফেরদৌস যেন আকাশের চাঁদ পেল। কি সুন্দর বন্ধুর কথা ভাবা যায়! এরফান কিছু বলার পূর্বেই ফেরদৌস তার সঙ্গে রাখা কোকের বোতল সন্তোপর্ণ ঢেলে দিল এরফানের উপর। যাবিয়াজ হাসি দমিয়ে রেখে দীর্ঘ এক শ্বাস ফেলে। কিন্তু এরফান এর বাচ্চামো মুখখানি দেখে সে হাসির কণ্ঠে বলে,
‘খাড়া মামা তোর ছবি উঠাইয়া তিয়ু ভাবিরে পাঠায়।’
ক্যাচ করে কয়েকটা ছবি উঠিয়ে নিল নিজ ফোনে যাবিয়াজ। ‘বন্ধুগণের পুনরাবৃত্তি’ ক্যাপশনটি দিয়ে দু’টি ছবি নিজের ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করে দিল সে। তার আইডির ফলোয়ার বেশি অর্থাৎ সেলিব্রেটি হওয়ার ফলে হাজারের উপর পর্যায়ে অবস্থান করছে। সুতরাং এক সেকেন্ডে পোস্ট করা ছবির মধ্যে প্রায় কয়েক’শ লাইক, লাভ রিয়েক্ট পড়েছে। হাসির রিয়েক্টও অনেকে করেছে। তার উপর কমেন্টে মেয়েদের গা জ্বালানো কথাবার্তা দেখার কোনো প্রকার ইচ্ছে পোষণ করল না যাবিয়াজ। পিক তুলেছে পোস্ট করেছে কাজ শেষ। বাকিটা দশকবৃন্দ দেখে যা বলে বলুক! যাবিয়াজ আনমনে কমেন্ট এর দিকে তাকিয়ে বলে,
‘তুগো মিরচি লাগে তো মে কেয়া কারুম!’
ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ফোনটা পকেটে গুজে নিল। ওয়েটার বয় কে ঢেকে নিজেদের জন্যে খাবার অর্ডার দিল। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরতে হবে কেননা রবিউল সাহেবের কড়া আদেশ। অমান্য করলে বউ ছাড়া করে দিবেন বলে জানিয়েছেন। এখন ঘন ঘন কাজ সম্পূর্ণ মিটিয়ে বাসার জন্যে তৈরি হবে ভেবে রাখল। এরফান কিছুক্ষণ হলো ওয়াশরুমে গিয়ে ছিল কোক পরিষ্কার করতে। টিস্যু দিয়ে মুখের পানি মুছতে মুছতে এসে টেবিলের চেয়ার টেনে বসে পড়ে। ওয়েটার বয় ততোক্ষণে সুপ, ফ্রেড রাইস, চিকেন ফ্রাই নিয়ে এলো। একে একে তিনজনের প্লেটে পরিবেশন করতে দিল। এতে যাবিয়াজ, এরফান আর ফেরদৌস মিলে কাজের ব্যাপারে খুঁটিনাটি কথাবার্তা আলাপ করল।
_______
ইসমাইল আজ এনজিও তে যায়নি। কেননা যাবিয়াজ ফিরে আসায় এনজিওর দায়িত্ব খানিক নিজ কাঁধে বহন করেছে। অবশ্য এই এনজিওর উদ্যোক্তা শ্রেয়িতার স্টেপ ফাদার হওয়ার সুবিধার্থে সে আর যাবিয়াজ ভাগ পেয়েছে। এখনো শ্রেয়িতার সঙ্গে তার স্টেপ ফ্যামিলির সঙ্গতা, পারিবারিক মিলবন্ধনতা বজায় আছে। লক্ষ্মীনা দিনের যথেষ্ট সময়টিতে মেয়েকে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নেন। উনাদের পরিবারের প্রশংসা অতুলনীয় বটে। ইসমাইল বিছানায় বসে ফাইল ঘাঁটছে। আড়চোখে শ্রেয়িতাকে পরখ করছে। পরী সযত্নে ইসরাইবকে ফিডিং করাচ্ছে। অন্যথায় চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে মায়ের মমতা। ইসমাইল আলতো হেসে ফাইলটি রেখে বিছানার উপর বসে। ঘুমন্ত ইসরাইব এর কপালে চুম্বন একেঁ পরীর দিকে ঘোরলাগা দৃষ্টিতে তাকায়। শ্রেয়িতা সম্মুখে কারো ঘন নিঃশ্বাসের আভাস পেয়ে পিটপিটিয়ে চোখ উম্মুক্ত করল। নিজ মুখের উপর ইসমাইলকে ঝুঁকা অবস্থায় দেখে কোনো প্রকার বিরুপ প্রতিক্রিয়া করেনি। লাজুক হেসে দৃষ্টিনত করে ফেলে। কিন্তু ইসমাইল পরীর থুতনী চেপে মুখ উপরে করে। মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে কাঁপা কণ্ঠে বলে,
‘জানি না পূর্বে কোন প্রকার সওয়াব করেছিলাম। যার ফলে তোমায় পেলাম। আল্লাহর কাছে লাখ শোকরিয়া। তুমি তো জানো আমিও তোমার মত এক এতিম ছিলাম। তারপর কপালে পরিবার নামক ছায়া এসে হাজির হয়। তুমিও যে সদস্য হলে এটাই বোধ হয় আমার মত অধমের কপাল।’
শ্রেয়িতা ইসরাইবকে এক হাতে আঁকড়ে রেখে অপর হাতে ইসমাইলের মাথা আঁকড়ে মুখোমুখি ঝুকাঁয়। কপালে নিজ ভালোবাসার গভীর স্পর্শ দিয়ে বলে,
‘আজীবন তোমার সঙ্গে থাকার প্রেরণা করেই তো আবদ্ধ হয়েছি পবিত্র বিয়ে নামক বন্ধনে।’
ইফদিয়ার দরজার আড়াল হতে তার ভাই আর ভাবির সুখী দৃশ্য দেখে তৃপ্তিময় প্রশান্তি লাভ করে। চুক্ষদ্বয়ের মধ্যে অবাধ্য জল এসে ভীড় করল। ডান হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের জল মুছে চওড়া হাসি ঠোঁটের কোণায় টেনে দরজায় কটকট শব্দ করে। দু’মানবের ধ্যান স্বচক্ষে গিয়ে থামে দরজার দিকে। দরজার বাহিরে কেউ এসেছে দেখে শ্রেয়িতা উঠতে নিলে ইসমাইল চোখ রাঙিয়ে হাত ধরে বসিয়ে রাখে। নিজ দায়িত্বে গিয়ে দরজা খুলতেই দেখে তার ইফদিপাখি দাঁড়িয়ে আছে। ইফদিয়ার ভাইকে দেখে হাসি চওড়া করে বলে,
‘ভাই পার্লার যাব। ভাবি যাবে না!’
ইসমাইল হাত উঠিয়ে হামি দেওয়ার ভান করে বলে,
‘বউহীন করে দিবি শাকচুন্নী!’
‘কি বললি ভাই তোর সাহস কম না।’
‘আমার সাহস বরাবরই বটে।’
ইফদিয়ার মুখ ভেটকিয়ে ঘুমন্ত ইসরাইবকে নিভৃত যত্নে বিছানায় শুয়ে দিল। আর ইসমাইল কে টেনে বাচ্চার পাশে বসিয়ে দিল। কড়া নির্দেশ স্বরুপ বাণী প্রদান করে।
‘ভাই যদি আমার ভাতিজা কান্না করছে। তোর এপাশ ওপাশ পিঠিয়ে ভর্তা বানাব।’
শ্রেয়িতাকে টেনে ইসমাইল এর কথা উপেক্ষা করে বেরিয়ে পড়ে। বেক্কল এর মত মুখ করে ইসমাইল তাদের যাওয়ার পানে চেয়ে মৃদু হেসে উঠে।
কয়েক মিনিটে পার্লারে এসে পৌঁছায় মেয়েদল। সবার উর্ধ্বে ইফদিয়ারকে টানাহিঁচড়া করা হচ্ছে। কে কেমনে সাজিয়ে দিবে তার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। অবশেষে দুজন বিউটিশিয়ান পার্লারে প্রবেশ করে। শ্রেয়িতা তাদের দেখে ভ্রু বাঁকিয়ে প্রশ্ন করল।
‘তোমরা কে এখানে কি কাজ!’
‘ম্যাম আমাদের যাবিয়াজ স্যার পাঠিয়েছেন।’
বাণীটি কর্ণপাত হতেই ইফদিয়ার ত্রপাট মুখে দৃষ্টি লুকানোর ভান করে। গালে রক্তিম আভা ফুটে উঠেছে। শ্রেয়িতার সঙ্গে থাকা কাজিনগুলো ‘উউউউহহু ভাবি’ বলে চেঁচিয়ে উঠে। ইফদিয়ার শান্তভাবে বসে থাকে। বিউটিশিয়ান তাদের সাজানোর কর্ম আরম্ভ করে। শ্রেয়িতা আর বাকিরাও নিজ নিজ দায়িত্বে সাজতে লাগে।
ইফদিয়ার মুখের সাজের সঙ্গে তাকে ঘন বেগুনি রঙের শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছে অপর বিউটিশিয়ান। তাৎক্ষণিক সময় পেড়িয়ে যাওয়ার পর ইফদিয়ারকে রুমে রেখে পার্লার হতে মেয়েরা রেস্টুরেন্টে গেল। ইফদিয়ারকে সঙ্গে নেওয়ার চেষ্টা করলে সে তৎপরতায় ‘না’ বলে। কেননা সে সকালে নাস্তা করেছিল। আপাত খিদা বলতেই নেই। ইফদিয়ার রুমে বসে ফোনে ফেসবুক দেখছে। সেখানে যাবিয়াজ এর আইডিতে পোস্ট দেখে হেসে উঠে। কিন্তু কমেন্টে লুচি মেয়েদের কমেন্ট দেখে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘লুচ্চি পরোটাদের ঢং দেখো। অন্যের জামাইয়ের সঙ্গে রংলিলা বানানোর শখ! তোদের মাইরি এমন শিক্ষা দিবো যা ভুলা মুশকিল অপেক্ষা কর।’
ইফদিয়ার নিজের মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চেপে ফোন লাগায় যাবিয়াজ এর ফোনে। কয়েকক্ষণ দুবার ফোন লাগতেই রিসিভ করে যুবক। ইফদিয়ার মুখ ফুলিয়ে বলে,
‘ওই মিয়া আমার সঙ্গে রিলেশন স্ট্যাটাস মারেন।’
‘কেন হিংসা হচ্ছে!’
লেপটপে একহাতে টাইপিং করতে থেকে বলে উঠে সে। রমণী সাপের মত ফোনা তুলে ফোঁস ফোঁস করে বলে,
‘আপনি শুনবেন নাকি আপনার আইডি হ্যাক করব।’
‘আল্লাহ ব্লাকমেইল দেখো মেয়ের। এত ক্ষমতা আছে বুঝি!’
‘কম কথা কাজ বেশি।’
‘আমার ডায়লগ আমারি উপর।’
‘হাহ আপনার মিসেস বলে কথা।’
যাবিয়াজ নাকুচি করে কলটা কেটে দিল। রমণীর রাগ সপ্তম আকাশে পৌঁছে যায়। সে তৎক্ষণাৎ রিলেশন উইড যাবিয়াজ দিয়ে রিকুয়েস্ট পাঠায় স্বামীর আইডিতে। কিন্তু ইতিবাচক ফলাফল না পেয়ে রেগে ফোনটা টেবিলের উপর রেখে দিল। মুখ ফুলিয়ে বসে রইল। হঠাৎ কে জানি এসে ইফদিয়ার নাকে বিকট গন্ধময় রুমাল চেপে ধরে। যা রমণীর ঘ্রাণেন্দ্রিয়ে পৌঁছে যাওয়ায় মৃদুভাবে নেতিয়ে পড়ে। চেয়ারে ঠেকে যায় তার মাথা। চোখজোড়া বন্ধ হয়ে যায়। তখনি বাঁকা হাসি দিয়ে ভেতরে এলো একজন পুরুষ।
চলবে……