অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া বোনাস_পর্ব

#অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া বোনাস_পর্ব
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

৫৫.
ইফদিয়ার নিখোঁজ হওয়ায় যেন সকলের মনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু স্বাভাবিক ভঙ্গিতে সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে ছিল যাবিয়াজ। ইসমাইল তো মরিয়া হয়ে পড়েছে বোনের নিখোঁজ হওয়ার শোকে। এক প্রকার গুরুগম্ভীর পরিবেশ যেন বাসার প্রতিটা কোণায় ছড়িয়ে পড়েছে। হাসির প্রাণচঞ্চল প্রাণটি হুট করে নিখোঁজ হওয়া ব্যাপারটা অনেকের কাছে সন্দেহজনক মনে হচ্ছে। ইসমাইল ছলছল দৃষ্টিতে শ্রেয়িতার হাত আঁকড়ে ধরে বলে,

‘ইফদিপাখি না জানি কোন দশায় ভোগছে। কোথায় আছে আল্লাহ জানেন!’

এরফান পরিবারের সকলের চোখ-মুখে যে গণহারে চিন্তিত ভাব লক্ষ করছে। তার বিন্দুমাত্র চিন্তার রেশও যাবিয়াজ এর মুখশ্রীতে দেখতে পেল না। বরঞ্চ রহস্যময়ী হাসি যেন ঘন ঘন তার ওষ্ঠধারে ভেসে উঠছে। যা সকলের চুক্ষগোচর না হলেও এরফানের চুক্ষ এড়ায়নি। তার মনের কোণায় আকস্মিক একটি প্রশ্ন উদয় হলো। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান) খানিক ভেবে সে যাবিয়াজ এর কান বরাবর ঝুঁকে এলো। সন্দেহ দূরীকরণে ফিসফিসানো কণ্ঠে বলে,

‘ইফদি ভাবীর নিখোঁজের পিছে কি তুই আছিস!’

যাবিয়াজ শুনে চুক্ষদ্বয় কিঞ্চিত পরিমাণে তুলে উপরের ওষ্ঠ দ্বারা নিচের ওষ্ঠের সংঘষ করে নেতিবাচক উত্তর স্বরুপ ‘না’ বলে। শব্দটি শুনেও যেন এরফান মনে তৃপ্তি পেল না। কেননা এখনো কোথাও না কোথাও সন্দেহটা দৃঢ় হতে লাগল যাবিয়াজ এর স্বাভাবিক ভঙ্গিমায়। রবিউল সাহেব তেঁতো অনুভূতি নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। এতক্ষণ মাথা চেপে ধরে বসে ছিলেন। বিয়ের এক দিন আগে বউমা নিখোঁজ হওয়াটা কোনো স্বাভাবিক ব্যাপার নয়। সুতরাং বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করতে তিনি ধাতস্থ হলেন। যাবিয়াজ চিন্তিত হয়ে তার বাবার মুখশ্রীর দিকে লক্ষ করল। রবিউল সাহেব তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিয়ে ছেলের দিকে তাকিয়ে এমন কিছু বললেন। যা শুনার পর সকলের মুখশ্রী হতে আতঙ্কের ছাপ সরে গেল। ফুটে উঠল বিস্ময়তা! রবিউল সাহেব ব্যঙ্গ করে বললেন।

‘নালায়েক ছেড়া। এত বললাম মেয়েটাকে ভয় লাগাইস না। তাও তোর জ্ঞান হয় না। ১২টা বাজা অব্দি কেউ অপেক্ষা করবে! মেয়েটারও ক্ষুধা,পিপাসা,দৃষ্টির তৃষ্ণা আছে তো নাকি।’

যাবিয়াজ মুখ ফুলানোর ভান করে বলে,

‘উফ ড্যাড আজ ইফস্পরীর জম্মদিন। চাইছি বিরাট কিছু উপহার দিতে। তাই তো একটুখানি ভয়তা প্রাপ্য স্বরুপ তাকে দিলাম।’

‘লে শুনো ছেলের জবাব। বলে কিনা সারপ্রাইজ দিবে। আরে তুই সারপ্রাইজ দিবি ওরে বুঝলাম। সবাইরে কেন টেনশনে ফেলছিস।’

‘যে সয় সে রয়। এর অর্থ নিশ্চয় সকলের অজানা নয়।’

ইসমাইল শান্তি পেল। তার কলিজার রক্তশূন্যতা নিমিশেষে সেরে গেল। কিন্তু যাবিয়াজ এর উপর স্বল্প পরিমাণে আক্রোশ জম্মালো। যদি আজ সত্যি তার ইফদিপাখির সঙ্গে কিছু হয়ে থাকতো! তখন কি হতো তার ফলাফল বিষন্নতার রুপ নিতো। ভেবেই চওড়া ক্রোধান্বিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সে। শ্রেয়িতা শুকনো ঢোক গিলে স্বামীর পানে তাকায়। তার যাবিয়াজ ভাইয়ের উপর ঝাড়ি পড়বে এ ব্যাপারে নিশ্চিত সে! যাবিয়াজ ইসমাইল এর ক্রোধে ঢাকা মুখশ্রী দেখে আলতো হেসে ফেলে। সেও দাঁড়িয়ে প্রস্তুত ভঙ্গিতে ভাব নিল। ইসমাইল তিক্ত কণ্ঠে বলে,

‘বোনের জন্যে করছিস ভালো কথা। একবার জানালে কি তোর সারপ্রাইজে পানি ঢেলে দিতাম! তবুও কেন ভাইটাকে বোনের নিখোঁজ এর সম্মুখীন করলি।’

যাবিয়াজ ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বলে,

‘শালা সাহেব তোর বুঝি সই না আর। তোর বউ হলে রাতের আঁধারে ছাদে গিয়া সারপ্রাইজ দিবি। আমি করলেই দোষ!’

ইসমাইল থতমত খেয়ে গেল। শ্রেয়িতা ত্রপাট দৃষ্টিতে চুক্ষদ্বয় ডিম্বাকার করে স্বামীর দিকে তাকায়। তার মত ইসমাইলও তার পরীর দিকে দৃষ্টিকোণ ফেলে। তারা বুঝতে পারছে না যাবিয়াজ জানল কি করে! যাবিয়াজ দু’মানবের মনের কথা আঁচ করে গলা ঝেড়ে দৃষ্টি আর্কষণ করল।

‘খুক খুক আসলে এসবে জ্ঞান আহরণ করা আমার বাঁ হাতের ব্যাপার।’

যুবক আর দাঁড়াল না। সন্তোপর্ণে নিজ রুমে চলে গেল। তিয়ানা মুচকি হাসল পরক্ষণে হাতে ব্যথা অনুভব করায় দৃষ্টি নামিয়ে দেখল। কিন্তু দেখার আর প্রয়োজন বোধ করল না। কেননা তার পাশে লোহার ন্যায় দাঁড়িয়ে আছে এরফান। হতচ্ছাড়ীর আরেক জ্বালাতন সহ্য করতে হচ্ছে। সেই কবে যে এই খচ্চর লোকটার সঙ্গে বাসার ভেতর এলো! তখন থেকে হাতটা আঁকড়ে ধরে রেখেছেন হিসেব নেই। ভাবতেও তার গা-পিত্তি জ্বলে উঠল। তেঁতে উঠে এরফান এর হাত থেকে নিজের হাত সরানোর চেষ্টা করে। যা আন্দাজ করতে পেরে চুক্ষদ্বয় তীক্ষ্ম রাঙিয়ে দৃষ্টি ফেলে তিয়ানার উপর। সে আমতা আমতা করে বলে,

‘ব্যথা পাচ্ছি।’

এরফান কথাটি শুনে উত্তেজিত হয়ে অতীব মুহুর্তে রুমে নিয়ে এলো তিয়ানাকে। সে যেন এরফান এর কর্মে হতভম্ব হয়ে যায়। অবাক কর চাহনী নিয়ে জিজ্ঞেস করে।

‘কি ব্যাপার রুমে আনলেন কেন!’

এরফান টু শব্দ না করে সযত্নে তিয়ানাকে টেনে বিছানায় বসিয়ে দিল। ফাস্ট এড বক্স বের করে ব্যথাতুর স্থানে স্বল্প পরিমাণে মলম লাগিয়ে দিল। তিয়ানা স্বামীর যত্নে করা দৃশ্যে যন্ত্রণার কথা প্রায় ভুলে গেল। তৃপ্তির ন্যায় মৃদু হাসি চলে আসে তিয়ানার ওষ্ঠের কোণায়। এরফান মলম লাগিয়ে ভালোবাসার গভীর চুম্বন এঁকে দিল তিয়ানার হাতের গোড়ায়। যে স্থানে সে চেপে ধরে রেখেছিল। অস্পৃষ্ট কণ্ঠে তিয়ানার দিকে দৃষ্টিকোণ রেখে বলে,

‘তোমাকে অজান্তে পেয়ে বসলাম সেই বছর পাঁচেক আগে। বন্ধুর প্রতি যে টানপড়ান আছে তা হৃদয়ের গহীনে আজও স্পন্দিত হয়। তবুও তোমায় অপেক্ষার প্রহরী করে রাখলাম না। কেননা ভালোবেসে আগলেই নিলাম। না হলে হারাতে দেরি নয়। তুমি যে ছায়া রুপী হয়ে আমার সঙ্গে পথ চলে যাচ্ছো। এর জন্যে আমি আল্লাহর কাছে তোমাকেই জান্নাতুল ফেরদৌস এ চায়।’

তিয়ানার চুক্ষদ্বয়ে অশ্রু জমাট হলো। কিন্তু পড়তে দিল না এরফান। রমণী সূক্ষ্ম কণ্ঠে অাফসোসী বোধক ভাব নিয়ে বলে,

‘পাঁচটি বছর কেটে গেলেও তোমায় বাবা ডাক শুনাতে পারিনি প্রিয়। কেমনে আমায় গ্রহণ করে চলছো। তোমায় জায়গায় অন্য কেউ হলে বুঝি এতদিনে ডি….।’

এরফান পূর্ণ হতে দিল না তিয়ানার শেষাক্ত বাক্যটি। কেন দিবে যে শব্দটি শুনলে সম্পর্কের মায়াজালের ইতি ঘটবে। সে শব্দটি উঠিয়ে কেনো এই গভীর প্রণয়পর্বের সমাপ্তি ঘটাবে। তাই তো প্রেয়সীর ওষ্ঠজোড়ায় নিজের স্থান বুজে নিল এরফান। তিয়ানাও চুক্ষদ্বয় পরম অাবেশে নিমীলিত করে ফেলে। যুবক প্রেয়সীর সাড়ায় উম্মাদ হয়ে কোমর জড়িয়ে মিশিয়ে নিল নিজের সঙ্গে।

কিছুক্ষণ পর এরফান অনুভব করল তার প্রেয়সী নিদ্রামগ্ন হলো। যুবক নিশব্দে হেসে তার তিয়ুপাখিকে বিছানার নরম বালিশে শুয়ে দিল। মাথার চুলে বিলি কাটতে থেকে ডুবে গেল পাঁচ বছর সেই স্মৃতির বইয়ের পাতায়। যে পাতায় খনন করা হয়েছিল বিষাদের একটি দৃশ্যপট।

পাঁচবছর পূর্বে…..

যাবিয়াজ এর বিদেশ গমনের পর আলাদা হয়ে যায় বন্ধুমহল। যার একটি নাম আখ্যায়িত ছিল ‘ইতি দিন’। সেই দিনকে কেন্দ্র করে সবাই দূর দূরান্তরে পাড়ি জমিয়ে ছিল। কিন্তু কোনো ভাবেও ভুলতে পারিনি এরফান তিয়ানাকে। তবে বন্ধুর চলে যাওয়ার পিছনে ইফদিয়ার হাত হলেও। তিয়ানা ছিল তারই বান্ধবী। যার ফলে কোনো না কোনো ভাবে মস্তিষ্কের নিউরন এ ক্রোধের সৃষ্টি হতো। তিয়ানা যাবত কয়েকদিন এরফান এর সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে উম্মাদ হয়ে উঠে। ইফদিয়ার জন্যে তার কষ্ট হলেও এরফান এর অবহেলায় যেন দ্বিগুণ কষ্ট পেতে লাগল। বান্ধবীর সঙ্গে হাসিখুশি দিন কেটে রাতের প্রহরে এরফান এর জন্যে কেঁদেছে সে। ইফদিয়ার কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছিল। তার মন খারাপ কেনো?
কথা ঘুরানোর জন্যে তিয়ানা হাসার ভান করে বলে,

‘না এমনি বাসায় সমস্যা চলছিল।’

ইফদিয়ার কি ভেবে যেন বলে,

‘এরফান ভাইয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ঠিক আছে কি!’

তিয়ানা কথাটি শুনে অবাক দৃষ্টিতে তাকায়। তখন ইফদিয়ার গম্ভীর ভাব করে বলে,

‘তোদের মধ্যে সম্পর্ক আছে তা আমি আগে থেকে জানতাম। তোদেরকে ইসমাইল ভাই দেখেছিল। ভাইয়ার ভাষ্যমতে তোরা একে অপরকে ভালোবাসিস।’

তিয়ানা নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। বান্ধবীকে জড়িয়ে ধরে অবহেলার গুপ্ত পাতা ভাগাভাগি করে নিল। ইফদিয়ার সিদ্ধান্ত নিল যে করেই হোক! তার জন্যে কেনো তার বান্ধবী কষ্ট পাবে। কষ্ট পেলে সে পাবে তবুও বান্ধবীকে তার মূলর্থ স্বাথে পৌঁছে ছাড়বে। তিয়ানাকে আজকের মত বুঝিয়ে বাসা অব্দি পৌঁছে নিজ বাসস্থানে ফিরে গেল। বাসায় আসার পথে নতুন সিম কিনে ফোনে ঢুকিয়ে নিল। এরফান এর নাম্বারে কল দেয়। অপরপাশের ব্যক্তি অর্থাৎ এরফান ফোনটি রিসিভ করে। ইফদিয়ার নিজেকে ধাতস্থ করে গলাটা খানিক নিম্র করে বলে,

‘তিয়ানাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসবে। যদি ভালোবাসাকে পেতে চান শিগ্রী নিজের পরিবার নিয়ে তার বাসায় যান।’

কট করে ফোনটা কেটে দিল ইফদিয়ার। সিমটা খুলে রেখে দিল। বুকভরা শ্বাস ফেলে মুচকি হাসল সে। কেননা তার বান্ধবীর আগাম দিন শুভ দিনের ন্যায় প্রতিফলিত হবে। এরফান আননোন নাম্বার এর কল স্বাভাবিকতর উঠায় না। কিন্তু আজকের কলটি অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে উঠিয়ে নেওয়ায় আতঙ্কময়ী বাণী শুনে তার বুকটা যেন কেঁপে উঠল। আনমনে বলে উঠে।

‘তিয়ুপাখির বিয়ে! না না আজই আব্বু-আম্মুকে নিয়ে যেতে হবে। বন্ধুকে হারিয়েছি ভালোবাসাকেও হারাতে চায় না।’

এরফান হতদন্ত হয়ে তার বাবা-মাকে পছন্দের কথা জানিয়ে দেয়। এতে উনারা তাৎক্ষণিক ভাবে নিরবতা পালন করলেন। যা অধর্য্য করে তুলেছিল এরফান এর মনকে। পরক্ষণে উনারা হাস্যজ্জ্বল মুখশ্রী নিয়ে রওনা দিল তিয়ানার বাসায়। তিয়ানা ড্রয়িং রুমে মনমরা হয়ে বসে ছিল। হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠায় নিজ দায়িত্বে দরজা খুলে দিল। কিন্তু দৃষ্টির সম্মুখে বড় চমক থাকায় যেন বিস্ময়ে পঞ্চভূত অবস্থা তার। এরফান বাঁকা হেসে চোখ টিপ মারল। যা দেখে থতমত খেয়ে যায় তিয়ানা। সে ভাবছে এটা কি সত্যি নাকি মিথ্যে জাল! পরক্ষণে বুঝতে সক্ষম হলো সে বাস্তবে তার সম্মুখে এরফানকে দেখছে। খুশি হতে চেয়েও পারল না চাপা অভিমান মনের কোণায় ধরা দিল তার। দরজা আঁটকে দিতে চেয়ে খেয়াল করল দুজন বয়স্ক পুরুষ ও মহিলা হাসিমাখা চেহারায় মুগ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বয়স্ক পুরুষ ও মহিলাকে দেখে খানিক বিচলিত হয়ে পড়ল তিয়ানা। স্বয়ংসম্পূর্ণ রুপে স্বাদরে বাসার অন্তে প্রবেশ করতে অনুরোধ করল। এরফান ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বয়স্ক দুজনের পিছনে গেল। যার ফলে তিয়ানা অবাক না হয়ে পারছে না। সে বুঝছে না উনারা আসলে কারা! যার সঙ্গে এরফান এসেছে। কোনো কাজ সম্বধনীয় নয় তো! হতে পারে আব্বুর ডায়াবেটিস এর চিকিৎসার ভিত্তিতে এসেছে। কিন্তু আব্বুর চিকিৎসায় অধীনস্থ এরফান। তার সঙ্গে আঙ্কেল-আন্টির মত দেখতে উনাদের কি কাজ! কে জানে। তিয়ানা নিজের মত আপাত দৃষ্টিতে ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে নিল। মেহমানদের সঙ্গে ড্রয়িং রুমে এলো। তার বাবা সোফায় বসে পত্রিকা পড়ছিলেন। এরফান এর সঙ্গে দুজন অপরিচিত ব্যক্তিগণের মুখখানি দেখে তিনি সন্তোপর্ণে জিজ্ঞেস করলেন।

‘এরফান উনারা কে!’

এরফান দৃঢ় এক শ্বাস ফেলে বলে,

‘ইনারা হলেন আমার আব্বু-আম্মু। আপনার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে এসেছেন।’

তিয়ানার বাবা কথাটি শুনে মুহুর্তে খুব খুশি হলেন। তিনি আহ্লাদে কয়েকবার এরফানকে তার পরিবারসহ আসতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবার এরফান কাজের উসিলায় চলে যেতো। আজ যেন বামন হয়েও আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন তিনি। মুচকি হেসে সালাম আদায় করলেন এরফান এর বাবা-মার কাছ হতে। তিয়ানা চুপটি করে দেখে চলেছে সকলেল হাবভাব। ইতিমধ্যে সেখানে তিয়ানার মাও চলে এলেন। তিনি আসার পরই এরফান এর বাবা বললেন।

‘যাক ভাবী আপনিও এলেন। এখন না হয় বলেই ফেলি। আমরা আপনার মেয়ের হাত চাইতে এসেছি। নিজের ছেলে এরফান এর জন্যে। আপনার মেয়েকে এরফান ভীষণ ভালোবাসে।’

তিয়ানাসহ তার বাবা-মা হতবাক। বিস্ময়ে তিয়ানার বাবা তিয়ানার দিকে তাকান। মেয়ের মুখে লাজুক আভা দেখে তিনি মনে মনে নিশ্চিত সম্বধনে তার কোনো আপত্তি নেই। তাও মনের সন্দেহটা দৃঢ় না করে মেয়েকে জিজ্ঞেস করলেন।

‘মা তুই বল বিয়েতে তোর কি মত!’

তিয়ানা আড়চোখে এরফান এর দিকে দৃষ্টিকোণ ফেলে। কিন্তু যুবক তার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে। যার চোখের ভাষা বুঝা অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। তার চোখের ভাষায় স্পষ্ট প্রত্যয়মান যে, ‘একবার না করে দেখো। তারপর বুঝাব কত ধানে কত মই।’
বেচারীর কি করার ছিল ! এরফান এর তীক্ষ্মতায় ভয় পেয়ে লাজুক হেসে মাথা নাড়ল। পরক্ষণে দৌড়ে নিজ রুমে চলে যায়। যা দেখে এরফান সহ সকলে হেসে ফেলল। তিয়ানা রুমে এসে দরজা আঁটকে দিল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না বাস্তবে তার বিয়ে হবে এরফান এর সঙ্গে। স্বপ্নটা বুঝি সত্য হতে চলল! এই বাস্তবধর্মীর খুশির মুহুর্তটা সে ইফদিয়ার সঙ্গে ভাগ না করে পারল না। সন্তোপর্ণে ফোনটা নিয়ে কল দিল ইফদিয়ারকে।

ইফদিয়ার রুমে তার হিজাবের ছেঁড়া অংশ সেলাই করছে। সুতা যেন আড়াআড়িভাবে না লেগে যায় তাই সাবধানে সুই প্রবেশ করাচ্ছে হিজাবে। তার হিজাবটি দরজার ফাঁকে লেগে খানিক ছিঁড়ে গিয়ে ছিল। যার ফলে এখন কষ্ট করে সেলাই করতে হচ্ছে। ইতিমধ্যে সুই ঢুকানো জায়গাটি ভরাট করতে গিয়ে ফোন এর ভাইব্রেশনে তার সেলাই করার ধ্যানটা বিগড়ে যায়। ফোঁস করে হতাশার শ্বাস ছেড়ে অর্ধ সেলাই করা হিজাবটি বিছানার অপর পাশে রেখে দিল। ফোন হাতে নিয়ে দেখল তিয়ানার কল। সে উঠিয়ে কথা আরম্ভ করার পূর্বেই তিয়ানা আনন্দে চেঁচিয়ে বলে,

‘দোস্ত আমার স্বপ্ন পূরণ হতে চলেছে। এরফান এর সঙ্গে বিয়ে পাক্কি।’

ইফদিয়ার খুশিতে লাফিয়ে উঠল। ফোনটা শক্ত করে কানে চেপে ধরে বলে,

‘সত্যি দোস্ত মিরাক্কেল হলো।’

‘হ্যা আলহামদুলিল্লাহ। তোকে কিন্তু বিয়ের প্রতিটা দায়িত্বে থাকতে হবে।’

ইফদিয়ার চাপা বিজয়ীর হাসি দিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে কলটি কেটে দিল। আনমনে নিজের প্রতি গর্ব বোধ করল সে। কেননা তার বান্ধবীর জীবনটা বেদনায় অতিবাহিত হতে দিল না।
দুসপ্তাহ পর তুমুলবেগে বিয়ের প্রস্তুতি আরম্ভ হলো। এনগেজমেন্ট হওয়ার পূর্বে তিয়ানার বাবা এরফান এর পরিবারকে একটি সত্য ঘটনা জানিয়ে দিল। যা শুনে তিয়ানার মন বিষাদপূর্ণ হয়েছিল। তবে সে জানতো কখনো না কখনো সেই সত্যতা সকলের সম্মুখে চলে আসবে। ফলাফল রুপে চলেও আসল। এরফান ঠাই নিরব রইল। কেননা ঘটনাটি করুণ ছিল। তিয়ানা জম্ম হতে বন্ধ্যা। প্রেয়সীর করুণ দশা জেনে যেন এরফান তৎপর হলো প্রেয়সীকে আগলে নেওয়ার। আল্লাহ কাউকে অপূর্ণ রাখেন না। কোন না কোন দিন পূর্ণতা দান করেন। এই ভেবে সে তার পরিবারকে মানিয়ে নিল। এরফান এর বাবা-মাও আপত্তি করলেন না। তিয়ানাকে ভীষণ পছন্দ হয়েছেন উনাদের। বিধায় তিয়ানাকে দেখতে আসার সুবাদে আংটি পরিয়ে দিয়ে ছিল।

আজ তাদের বিয়ের দিন। বিয়ের পূর্বের কটা দিনে গায়েহলুদ-মেহেদী অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়ে ছিল। ইফদিয়ার ছন্দবেশে পাত্রপক্ষের সম্মুখে ছিল। সে চায় না তার কারণে কোনো প্রকার দ্বিধাদ্বন্দের সৃষ্টি হোক। অনুষ্ঠানটা যেহেতু তিয়ানার আনন্দের শুভারম সেহেতু কলহ সৃষ্টি করা নিতান্তুই অপ্রকৃষ্টের ব্যাপার। আনমনে ভেবে খেয়াল করল এরফান কে। তাকে দুলাভাই এর রুপে দেখে ইফদিয়ার দোয়া করল তাদের জীবনপথ যেন সহিসালামতে চলে।

ভাবনার পরিচ্ছেদ কাটিয়ে এরফান দু’অক্ষির অশ্রুজোড়া তর্জনী আঙুল সহযোগে মুছে নিল। ইফদিয়ার কে সে বউমনির নজরে দেখে। আড়চোখে ঘুমন্ত তিয়ানার গালে নরম প্রণয়ঘটিত স্পর্শ এঁকে দাঁড়িয়ে যায়। বর্তমানে অনুষ্ঠান বহমান রয়েছে। বর্হিভাগের কাজের থাকা তার দায়িত্ব। নিশব্দে বেরিয়ে যেতে গিয়ে ভাবে।

‘ইফদি ভাবীর সঙ্গে একবার কথা বলে ক্ষমা চেয়ে নেবো।’

৫৬.

ইফদিয়ার নিভু নিভু চুক্ষদ্বয় উম্মুক্ত করে চৌপাশে চুক্ষদ্বয় বুলিয়ে নিল। রুমের মধ্যে পরিপাটি বিছানা, লাল কার্পেট তার উপর গোলাপ ফুল ছড়ানো, রুমের মধ্যে সুগন্ধিময় নেশাক্ত পারফিউমও ছিটানো রয়েছে। ত্রুটিহীন সৌন্দর্যে রাঙিয়ে রইল রুমটি। ইফদিয়ার আনমনে দাঁড়িয়ে যায়। লাল কার্পেট এ পা রেখে সদর দরজার দিকে এগিয়ে গেল। দরজা উম্মুক্ত করে দৃষ্টিকটু নিয়ে তাকায়। পুরু রুম আলোকিত হলেও সম্মুখ পথ ঘন অন্ধকারে ছেয়ে আছে। আধাঁরিয়া বসতবাড়ির চৌকাঠে পা রেখে ঢোক গিলে এগিয়ে গেল ইফদিয়ার। আকস্মিক সাদা বাতির রশ্নি তার উপর পড়ল। তীব্র রশ্নির আলোকে তার হাত আপনাপনি চুক্ষদ্বয় ঢেকে নিল। পরক্ষণে হাত সরিয়ে খেয়াল করে। সাদা বাতির সহায়তায় বাসাটি সূক্ষ্মতায় রশ্নিময় হয়েছে। মেহমান সঙ্গে পরিবারের লোকজনকে দেখে খুশি হলো বটে। তবুও আশঙ্কা রয়ে গেল মনের কোণায়। কেননা তার ধারণা অনুযায়ী সে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েছিল। তাও আবার কোনো প্রকার রুমাল এর উপর ছিটিয়ে থাকা ক্লোরোফর্ম এর কারণে। তাহলে রুমালটা কে ধরেছিল!
মনের ভাবনা যেন দল পাকিয়ে উদয় হলো তার। সে যত কদম পেড়িয়ে পরিবার এর সন্নিকটে যাচ্ছ তত তীব্রতায় পুরু বাড়ি আলোকিত হয়ে উঠছে। উষ্ণ চঞ্চলতায় পা থমকে গেল তার। সম্মুখে এসে হাটুগেড়ে বসল যাবিয়াজ। তাকে দেখে কয়েক সেকেন্ড নিরব রইল। যুবক বাঁকা হেসে বলে,

‘ট্রেডটা জোস ছিল রাইট!’

ইফদিয়ার সন্তোপর্ণে আন্দাজ করে নিল যাবিয়াজ এর বলা বাণীটির অর্থ কি! এতটা ভয় কেউ লাগায় বুঝি। ঠোঁট বাঁকিয়ে দুহাত বুকের উপর গুজে মুখ ভেটকিয়ে অন্যদিক ফিরে তাকায়। তার ফিরে তাকাতেই চুক্ষদ্বয় শীতল হয়ে গেল। ডান পাশে দৃষ্টিকোণ রাখতেই নজর আঁটকে গেল একটি বোর্ড এর উপর। যার মধ্যে শিরোনাম স্বরুপ লিখা রয়েছে।
‘জম্মদিনের শুভেচ্ছা ইফস্পরী।’
বেগুনী-নীল রঙের সঙ্গে ব্লাশ ব্যবহার করে বোর্ডটাকে উজ্জ্বলতায় পূর্ণ করা হয়েছে। বোর্ড এর রঙটি ইফদিয়ার পরিহিত শাড়ির সঙ্গে মিল সম্পূর্ণ। কিন্তু রমণী এমুর্হুত বোরকা পরিহিত থাকায় সকলের কাছে বিষয়টি অপ্রকাশিত। ইফদিয়ার বিস্ময়ের আঁখিজোড়ায় যাবিয়াজ আলতো হেসে প্রেয়সীর হাত স্পর্শ করে। হাতের উল্টো পিঠে চুমু এঁকে বলে,

‘পূর্বেই অবহিত করে ছিলাম।
কষ্ট যেহেতু দিয়েছি সেহেতু চিরঞ্জীব ভালোবাসায় ভরিয়ে দেওয়ার প্রতিক্ষাও করেছি। হে তাই বলে শাসন অত্যাচার করব না তা নয় কিন্তু! এমন ভাবলে ভুলে যাও। বকাও যেমন খাবে মাইরও তেমন খাবে ঠান-ঠানা-ঠান।’

ইফদিয়ার বাণীটা শুনে গোমরা মুখ করে বিড়বিড়িয়ে বলে,

‘লে হালুয়া বজ্জাতের হুমকি দেখো। ভালোবাসা দেখাচ্ছে নাকি হুমকি মারছে আল্লাহই জানেন! কি খারুশ পোলা একখান।’

যাবিয়াজ দাঁড়িয়ে মৃদু করে ইফদিয়ারকে জড়িয়ে ধরে। রমণীর কানের কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে,

‘এত বিড়বিড়িয়ে লাভ নেই। যা বলেছি তাই করব। মেরে তেরে দ্বিগুন আদর করার মজায় আলাদা।’

ইফদিয়ার সম্মুখীন হলো লজ্জাময় পরিস্থিতিতে। সকলে তাদের দেখে মিটমিটিয়ে হাসছে। যাবিয়াজ আড়চোখে তার ইফস্পরীকে দেখছে। লজ্জাময়ী যুবতীর নেকাপের অন্তরালে থাকা লাজুক মুখশ্রী উপভোগ করছে।

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here