অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_২৯

অস্তিত্বে_চাই_তোমার_ছোঁয়া পর্ব_২৯
#লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)

৫৭.
ইফদিয়ার বোরকা পরিহিত অবস্থায় কেমনে আলাপন করবে ভেবে পাচ্ছে না। তথাপি সে নিজেই রবিউল সাহেব এর বলা রেওয়াজ বুঝেনি। যাবিয়াজ মিটমিটিয়ে তার ইফস্পরীর অসহায় মুখখানি দেখছে। যা ইফদিয়ার আড়চক্ষে দেখে চক্ষু রাঙিয়ে ক্রোধান্বিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। যাবিয়াজ তৎক্ষণাৎ দৃষ্টি সরিয়ে এদিক ওদিক তাকানোর ভান করে। ইফদিয়ার মনে মনে তীব্র আক্রোশে ফুলে উঠে বলে,

‘বাবুমশাই এর ভাব দেখো। লুটেও বুঝি প্রাণ ভরে না। এখন আমার মজা নিতাছে পোলা। কোথায় এসে বউকে বুঝাবে তা না উল্টা টাকিং মারছে মাইয়াগোর লগে।’

আসলেই যাবিয়াজ ইফদিয়ারকে জ্বালানোর জন্যে শ্রেয়িতার কাজিনদের সঙ্গে হেসে হাত উঁচিয়ে নিচিয়ে কথা বলছে। যা দূর থেকে দেখে দাঁত কিড়মিড় করছে রমণী। যুবক তো রমণীর রাগভরা মুখশ্রীতে সায় পেয়ে ক্রমশ জ্বালানো বাড়িয়ে দিল। কিন্তু তার অন্তরালে সে ভীষণ বিরক্ত উক্ত মেয়েদের উপর। কেননা তার কাছে নারী বলতে শুধু তিনজনই প্রিয়। প্রথম মা দ্বিতীয় বোন তৃতীয় স্ত্রী। এদের ছাড়া বাকি সব মেয়ে তার চোখে সম্মানের হলে বোন ঠেকবে না হয় লুচিদের খাতায় নাম লিখিয়ে নিজের বিপদ ডাকবে। তার কাছে শ্রেয়িতার কাজিনদের চালচলন পোশাক-আশাক দেখে বুঝতে সক্ষম হলো। মেয়েগুলো তৃতীয় শ্রেণির লুচি মেয়ে। চুক্ষজোড়া ঘুরিয়ে নিরবতা পালন করছে যাবিয়াজ। অথচ মেয়েগুলো রেকর্ডের মত পকপক করেই চলছে। ইতিমধ্যে বিরক্তবোধ সহ্যসীমার বর্হিভাগে প্রদীপ্ত হওয়ায় যাবিয়াজ কাজের অজুহাত দেখিয়ে সরে এলো। এসেই তার বাবার পাশে ধপাস করে বসে পড়ল।
রবিউল সাহেব সোফায় বসে বাচ্চাদের খেলা দেখছেন। আজকের বউভাতের অনুষ্ঠানে ইফদিয়ার কে দেখতে এসেছে সকলে। যেহেতু যাবিয়াজ অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ার সেরা ডাক্তার এর খ্যাতিনাম আর ভার্চুয়াল ওয়ার্ক এ সেরা হয়েছে। সেহেতু মানুষের কাছে সে অপরিচিত নয়। যাবিয়াজ মেশরাফ এর স্ত্রীকে দেখার প্রয়াসে আত্মীয় অনাত্মীয়দের ভীড় লেগেছে। একে একে সকলে নতুন বউ এর সঙ্গে সালাম বিনিময় করে গেল। খাবারের আয়োজন এখনো আরম্ভ হয়নি। বিধায় খাবারের পূর্বে বিয়ের পর বউভাত উপলক্ষে নতুন বউকে আলাপন করার আদেশ দিলেন রবিউল সাহেব। মূলত ইফদিয়ার দক্ষতা পর্যবেক্ষণ করার জন্যে তিনি আদেশটা করলেন। কেননা যাবিয়াজ এর কাছে ইফদিয়ার আলাপন করার কথা শুনেছিল। তার কারণে তিনি আজকের দিনটাই শ্রেষ্ঠ দিন বলে বিবেচিত করলেন। ইফদিয়ার ঢোক গিলে শ্বশুরের সোফার থেকে খানিক দূরে করে বসেছে। সোফায় রবিউল সাহেব, যাবিয়াজ, ইসমাইল, শ্রেয়িতা বসে আছে। এরফান এনজিও তে গিয়েছে কাজের জন্যে। তার নাকি কোনো ইমেইল এর উত্তর দিতে হবে। সেই সূত্র ধরে চলে গেল। কবে আসবে তা জানায় নেই। যাবিয়াজও ঘাটল না ব্যাপারটায়। আপাত সে ফেরদৌসকে কল করছে। কিন্তু ছেলের ফোন অফ। চিন্তিত হয়ে বলে,

‘কই মরল রে হারামীটা!’

যুবক এর চিন্তিত মুখশ্রীকে এমুর্হুত এর জন্যে স্বাভাবিক করে নিল। ইফদিয়ারকে ঘাবড়াতে দেখে যাবিয়াজ সন্তোপর্ণে এসে দাঁড়িয়ে যায় তার কাছে। ইফদিয়ার হাতে থাকা রঙ প্লেট এ বিভিন্ন রঙের মিশ্রণ করে এগিয়ে দিল ইফস্পরীর দিকে। চোখ বন্ধ করে দৃঢ়স্থ শ্বাস ছেড়ে ইফদিয়ারকে আশ্বস্ত করে। ফলে রমণী একটুখানি হলেও সাহস পেল। মৃদু হেসে প্লেটটা নিয়ে তুলি দ্বারা মেঝের উপর আলাপন শুরু করল। আগ্রহদীপ্ত নয়নে সকলে নতুন বউয়ের হাতের অঙ্কন দেখছে। যাবিয়াজ বসল না স্ত্রীর সহযোগিতায় সে দিব্য দাঁড়িয়ে রইল। ইফদিয়ার কয়েকবার ইশারায় বসতে বলেছিল। তবুও যুবক নাছোড়বান্দা। নিজের প্রিয় জিনিসের কদর যত্নে সে অবহেলাপূর্ণ নয়। আলাপন পূরণ হতে আর ২০ মিনিট আছে ইফদিয়ার। তারই মধ্যে খবর এলো খাবারের পরিবেশন সম্পন্ন হয়েছে। যাবিয়াজ প্রিয়তমার হাতের রঙ থেকে আহ্লাদ করে খানিক রঙ নিয়ে আলাপন এর মধ্যে জে প্লাস ই অঙ্কন করে দিল। লাজুক হেসে দাঁড়িয়ে গেল দু’প্রাণ। রবিউল সাহেব উঠে প্রশংসামুখর হয়ে নতুন বউকে দোয়া দিল। ইফদিয়ার কাঁধে হাত রেখে এগিয়ে এলো ডাইনিং রুমে। যাবিয়াজ এর সঙ্গে বউকে বসানোর পর খাবার পর্ব আরম্ভ হলো।

অনুষ্ঠান মধ্য রাত অব্দি চলেনি। কেননা সকল এর খুব খাঠুনি ধকল গিয়েছে। ফলে চূড়ান্ত ভাবে ৮টায় বউয়ের দর্শন পর্বের সমাপ্তি ঘটলে একে একে মেহমানদের গমনাগমন আরম্ভ হলো। ইসমাইল শ্রেয়িতা ভাবীও ফিরে গিয়েছে নিজ বাসস্থানে। যাওয়ার পূর্বে ইফদিয়ার চক্ষু-নাক এর অশ্রু একাকার হয়ে ভিজল ভাইয়ের শার্ট। শ্রেয়িতা অশ্রু চোখযুগল হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে বারংবার মুছে চলছিল। কেননা বছর পেড়িয়ে গেলেও তারা আলাদা হয়নি। আকস্মিক বিচ্ছেদ হওয়া যেন আপনজন এর মনে শিহরিত করে তুলেছে। ইসমাইল জানে তার বোন নিরাপদ বাসস্থানে আছে। সুতরাং ক্ষতি হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই। তবুও মনের কোণায় ভাইয়ের স্নেহতা রয়ে যায় বোনের প্রতি। যাবিয়াজ পকেটে হাত গুজে ভাই-বোন এর স্নেহশীল বিদায়পনায়তা দেখছে। তার নিজস্ব কোনো বোন বা ভাই নেই। ফলে সে এর মমার্থ খুব একটা না বুঝলেও শ্রেয়িতাকে সে নিজের বোনের নজরে দেখে। ফেরদৌস, এরফান এরা বন্ধু কম ভাই এর রুপে বেশি আগলে রাখার মত মানব। এদের দ্বারা স্বল্প পরিমাণে ভাইবোন এর টানপীড়নতা বুঝতে সক্ষম। ইসমাইল নিজেকে শক্ত রেখে ইফদিয়ার মাথা বক্ষপিঞ্জরে চেপে রেখে যাবিয়াজকে উদ্দেশ্য করে বলে,

‘কখনো ভাবিনি এই এতিম ছেলের মা-বোন নামক ছায়াহরণী আসবে। আল্লাহ পাক আমার কপালে লিখে রেখে ছিলেন বিধায় বোনটা ছোট হতে বড় হয়ে গেল। আজ তার নিজস্ব স্বামীর বাসা বিদ্যমান। তোকে ভাই নয় দোস্তের চোখে দেখিরে যাবিয়াজ। বোনটাকে আগলে রাখিস। তবে কোনো প্রকার সহায়তা লাগলে শুধু একটা কল দিবি। এই বান্দা সর্বদা হাজির হতে তৎপর থাকবে। আর হে, তোর দোস্তের বোন কিন্তু অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করলে এক্করে মেরে গুম করে দেবো।’

যাবিয়াজ চওড়া হাসি দিয়ে বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে আমলে নিল শুদ্ধভাবে। তবুও ইফদিয়ার ক্রন্দররত দশা দেখে খানিক ফাজলামি করে বলে,

‘হিইইই আইছে বোনের ভাই। কি করবি হে? তোর বোনরে পিঠমু, মাইর দিমু। ইহা মেরা হক হে।’

ইসমাইল ভ্রু কুঁচকে যাবিয়াজ এর দিকে অপ্রকট দৃষ্টি দিল। দেখল তার ওষ্ঠজুড়ে বাঁকা হাসি বহমান। বিষয়টি আঁচ করতে পেরে ইসমাইলও ক্রোধ হওয়ার ভান করে বলে,

‘এক কেস মেরে জেলের ভাত খাওয়ামু।’

ইফদিয়ার প্রথমত চক্ষু রাঙিয়ে যাবিয়াজ এর দিকে পরখ করে ছিল। কিন্তু ভাই এর মুখে সায়পূর্ণ কথা শুনে যেন খুশিতে মনে মনে লাফিয়ে উঠল। সেও কোমরে হাত রেখে যাবিয়াজ এর দিকে আঙুল দেখিয়ে ভাব নিয়ে বলে,

‘হাহ্ এবার মেরে দেইখো। ভাইরে এক কল মেরে তোমার ফান্দা ফাটিয়ে দিবো।’

যাবিয়াজ হাই তুলে এক জটে ইফদিয়ার কোমর টেনে কাছে নিয়ে আসে। নিজ বক্ষে আষ্ঠেপৃষ্ঠে চেপে ধরে ইসমাইল এর দিকে তাকিয়ে বলে,

‘দেখ তোর বোনরে উঠাইয়া নিসি।’

‘তোরই বউ এতে আমি অবলা পুরুষ আর কি কমু।’

ইফদিয়ার অবাক হয়ে বলে,

‘ভাইয়া।’

‘সরি রে বোন। তোর জামাই মানা কেমনে করুম।’

ইফদিয়ার গাল ফুলিয়ে অন্য দিক মুখ বাঁকিয়ে রইল। ইসমাইল হেসে শ্রেয়িতার হাতে থাকা একটি প্যাকেট নিল। সেটি সন্তোপর্ণে ইফদিপাখির হাতে দিয়ে স্নেহময়ী কণ্ঠে বলে,

‘তোর জম্মদিন এর উপহার। অবশ্যই আমার কাজের আয়ে কিনেছি। আশা করি তোর ভালো লাগবে। কয়েকমাস পর আমাদের এনির্ভাসেরী পার্টি দিবো। সেখানে জিনিসটি পরে আছিস।’

ইফদিয়ার প্রশ্নতুর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলে ইসমাইল ভেবে বলে,

‘তোর জন্যে নিজ পছন্দের জুয়েলারি দিয়েছি।’

ইফদিয়ার ইতস্ততঃ বোধ করে আবেগী গলায় বলে,

‘এর দরকার ছিল না।’

‘এক ভাই তার বোনকে দিয়েছে।’

ইফদিয়ার কথা বাড়ালো না। কেননা তার ভাইকে শত বলে ফিরিয়ে দিতে চাইলেও সে ফেরত নেওয়ার মত মানুষ নয়। ফলে সময়ের প্রেক্ষিতে তারা গাড়িতে উঠে পড়ল। মেহমান এর যাত্রা কমে এলো। রবিউল সাহেব বউমার আলাপন করা অঙ্কনে ঘোরের মত দৃষ্টি রেখেছেন। আলাপন এর সম্মুখে একটি চেয়ার নিয়ে বসলেন। পকেট থেকে ফোনটা বের করলেন। বর্তমানে কোনো ফোন কলের নং খুঁজতে উনার অসুবিধা হয়না। পূর্বে বেশ অসুবিধে হতো। যেহেতু পূর্বে তিনি অন্ধত্বের জীবন অতিবাহিত করছিলেন সেহেতু সাময়িককাল স্বচক্ষে পরখ করতে পারছেন। ফোন কল এর কনটাক্ট লিস্টে নামবিহীন একটি সংখ্যা পেলেন। দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে সংখ্যাটির দিকে চেয়ে রইলেন। তিন-পাঁচেক মিনিট পর শুকনো এক ঢোক গিলে সবুজ রঙে রাঙা কল এর মত ছবির উপর চাপ দিলেন। চাপ দেওয়ার সঙ্গেই লিখা উঠছিল কলিং। রিংগীং না হওয়ায় উনার মনজুড়ে হতাশার আস্তানায় ছড়িয়ে গেল। পরক্ষণেই একটি সার্ভিস অফিস এর মেয়েলী কণ্ঠ ভেসে উঠল।

‘আপনার কল দেওয়া নাম্বারটি যোগাযোগের বাহিরে রয়েছে।’

শুনে তিনি অপেক্ষা করলেন না কলটি কেটে দিলেন। যাবত পাঁচ বছর ধরে সংখ্যাটির উপর কম প্রভাব ফেলেননি। অর্থাৎ কয়েক’শ বার কল দিয়েছেন। কিন্তু ফলাফল একটিই কাঙ্ক্ষিত মানুষের অস্তিত্ব নেই। যেন বিলীন হয়ে গেল বনের মাঝে। যোগাযোগ এর বাহিরে এর অর্থ দ্বারা তিনি বুঝতে সক্ষম নাম্বারটির ইতি ঘটেছে। পুনরায় জাগ্রত হবার আশা করা হলো বৃথা মনোভাবনীয়।
রবিউল সাহেব নিষ্পন্নভাবে শ্বাস ছেড়ে ফোনটি পাঞ্জাবীর পকেটে গুজে নিল। আলাপন এর দিকে পুনরায় দৃষ্টি নিক্ষেপণ করলেন।
কেন যেন ইফদিয়ার প্রদর্শিত চারিত্রিক ব্যবহারে তিনি আপনজনকে দেখতে পান। যার সাথে কয়েক বছর আগেই বিচ্ছিন্ন হয়ে ছিল সম্পর্ক নামক বন্ধনটি। তবে এককালীন প্রিয় মানুষের খাতায় ‘আপনজনটি’ ছিল সর্বোচ্চ উচ্চমানীয় মানব। দৃঢ়স্থ এক শ্বাস ফেলে আলাপন এর উপর ছোঁয়া দিলেন। অালাপন এর জলস্রোত এতক্ষণে শুকিয়ে গিয়েছে। বিধায় রবিউল সাহেব এর হাতে জল এর স্পর্শতা বোধ হয়নি। যাবিয়াজ বাসার গেটে দারোয়ান এর সঙ্গে আলাপ শেষে কিছু পরিমাণে বকশিশ দিল। গেট বন্ধ করতে আজ্ঞা করে সে বাসার ভেতর প্রবেশ করে। নিঃশব্দে দরজাটি লাগিয়ে ড্রয়িং রুম পাড় হতে না হতে বাবাকে দেখল বসে রইতে। বাবা কে এখনো অনুষ্ঠানের পরিহিত পোশাকে দেখে বুঝল তিনি এখনো ফ্রেশ হোননি। বাবার কাছে গিয়ে আহ্লাদী কণ্ঠে ‘ড্যাড’ বলে উঠল। রবিউল সাহেব এর ধ্যান ফিরল। চোখ উঠিয়ে দেখলেন ছেলে তার দিকে বিস্ময় চাহনী নিয়ে দেখছে। তিনি গলা ঝেড়ে শান্তভাবে দাঁড়িয়ে গেলেন। ছেলেকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

‘কিছু বলবে বাবা!’

‘হুম এশার এর আযান দিবে। সময় পেড়িয়ে গেল মাগরিব এর নামাজ কাযা পড়তে হবে। তবে তোমাকে উদাসীন কেনো দেখাচ্ছে। কিছু হয়েছে কি!’

রবিউল সাহেব হালকা হেসে মাথা ডান-বাম নেড়ে না বোঝায়। যুবক সন্দেহ করতে চেয়েও করল না। হতে পারে তার বাবা খুশির আপ্যয়ন করছেন নিজ স্বেচ্ছায়। তিনি শান্তবেগে হেঁটে গেলেন রুমের দিকে। যাবিয়াজ বাবার যাওয়ার দিকে ক্ষণসময় তাকিয়ে সন্তোপণে নিজ রুম এ আগালো। রুমে এসে দেখে তার ইফস্পরী জায়নামাজে সিজদারত রয়েছে। সাদামাটা পোশাক পরিদান করে আছে। বুঝায় যাচ্ছে দিনের সাজসরঞ্জাম ওযুর দ্বারা মোচন করে ফেলেছে। যা বেশ ভালো লাগল যুবকের। সে মৃদু হেসে দরজার ছিটকিনি মেরে ওয়াশরুমে গেল। এখনো অনুষ্ঠান এর পোশাক পরিহিত সে। অতঃপর স্ত্রীর মত সাদামাটা রুপ ধারণ করে ওযু করে নিল। ইফদিয়ার সিজদা ছেড়ে বসল। নফল নামাজ পড়া শেষ করে জায়নামাজটা অর্ধ উম্মুক্ত রেখে বিছানায় বসল। এশার এর আযান হতে ২০ মিনিট সময় আছে বটে। উক্ত সময়ে তসবিহ পাঠ করার অনুভব গড়ল। যাবিয়াজ গোসল সেরে মাথা মোচন করতে করতে বেরুল। ইফদিয়ার বিস্ময় চাহনী নিয়ে বলে,

‘আপনি কবে এলেন আর এখন গোসল কেনো করলেন! শীতের আরম্ভ হয়েছে। রাতে গোসল করলেই ঠান্ডা লাগতে পারে।’

‘আস্তে একটু জিরিয়ে কথা বলো। আর রইল গোসল এর ব্যাপার। সকাল থেকে তোমার জন্যে খাটিয়েছি কাঠুনি। একটু পাওনা অাবশ্যিক।’

ইফদিয়ার অবগত হলো যে, ধকল এর ফলাফলে গরম লাগছে যাবিয়াজ এর। সুতরাং গোসল করাটাকে সে মন্দ ভাবেনি। যাবিয়াজ ফুলহাতা পাতলা, ঢিলেঢালা পায়জামা পাঞ্জাবি পরে মাথায় টুপি এঁটে মসজিদ ওর জন্যে তৈরি হলো। যাওয়ার আগে পর্দারত স্ত্রীর কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দিল। ইফদিয়ার আনমনে মৃদু হাসল।

৫৮.

রাত ৯টা তিয়ানা ঘুমভাব নিয়ে উঠে বসে। ঘাড়ে হালকা ব্যথা অনুভব করল। বিছানায় পরখ করে দেখে বালিশটা নিজ জায়গায় নেই। ফলে ঘাড়টাও বেঁকে ব্যথা লাগচ্ছে তার। বালিশটা সস্থানে রেখে থ্রিপিচটা টানটুন করে ঘড়ির দিকে খেয়াল করে। হুট করে তার মাথায় বাজ পড়ল। রাত ৯টা ৫ মিনিট হয়ে পড়েছে। জানালার দিকে অক্ষি মেলে দেখে নিস্তধ্ব রাতের প্রহর আরম্ভ হয়েছে। সে দিনের অনুষ্ঠান এ উপস্থিত হতে পারেনি। কপালে চাপড় মেরে আফসোস এর গলায় বলে,

‘ইশ! উনিও আমায় জাগালেন না। এখন বান্ধপ্পী বুঝি রাগে টাই টাই ফিস করে দেবে।’

‘করব না বান্ধপ্পী।’

তিয়ানা ইফদিয়ার কণ্ঠ পেয়ে অক্ষিযুগল দরজার ধারে নিক্ষেপ করে। রমণী হালকা হেসে খাবারের প্লেট নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। তিয়ানার সম্মুখে প্লেট রেখে আহ্লাদময়ী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।

‘শরীর কেমন!’

‘ভালো শুধু ঘুমটা বেশি হয়ে গেল।’

‘সমস্যা নেই। ফ্রেশ হয়ে নে খাবার আনছি খেয়ে নিস।’

তিয়ানা মাথা নাড়তেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। ইফদিয়ার ঘাবড়ে বান্ধবীর পাশ ঘেষে বসে। তার কাঁধে স্পর্শ করে চিন্তিত সুরে বলে,

‘কি রে কোথায় ব্যথা হচ্ছে!’

‘ঘাড় ব্যথা করছে। না জানি ঘুমের মধ্যে বালিশটা নড়বড় কেমনে হলো।’

ইফদিয়ার বিষয়টি আমলে তাকে বসতে বলে চটজলদি নিজের রুমে গেল। আলমারী থেকে ব্যথা দূরীকরণীয় স্প্রে বোতলটি হাতে নিয়ে তিয়ানার রুমে আসে। তার ঘাড় থেকে চুলগুলো সরিয়ে স্বয়ং স্বেচ্ছাসেবক হয়ে স্প্রে করল ইফদিয়ার। তিয়ানা স্বল্প পরিমাণে ঘাড় নাড়তে পারল। ক্ষণ যন্ত্রণা রয়ে গেলেও সে হেসে বলে,

‘হয়েছে।’

ইফদিয়ার জানে তিয়ানা সংকোচবোধে যন্ত্রণার কথা বলছে না। তাই সে নিজ দায়িত্বে নিশ্চুপে রান্নাঘরে গেল। জলের স্যাক ব্যাগে কুসুম গরম জল ভর্তি করে রুমে এসে তিয়ানার হাতে সমর্পন করে। তিয়ানা ভ্রু নাড়িয়ে অভিমানী কণ্ঠে বলে,

‘নতুন বউদের ওত কাজে মানায় না।’

‘আইছে রে জ্ঞান দানকারী। যা ফ্রেশ হয়ে আয় খাবার খেয়ে নে।’

ইতঃপূর্বে রান্নাঘরে শেফস রান্না আরম্ভ করে দিল। ইফদিয়ার প্রবণ দৃষ্টিতে পরখ করে রুমে গেল। সময় কাটছে না এখনো অব্দি বাসায় ফিরল না যাবিয়াজ। ফলে কোনো কাজ না পাওয়ায় ফোন হাতে নিয়ে বসে। ফোনের ওপেন বাটন প্রেস করতেই দৃষ্টিকটু হলো একটি নোটিফিকেশন। যেটি ছিল হোয়াইটসআপে আননোন কনটাক্ট হতে আগত। ধারণার পুরিশুদ্ধি করতে মেসেজ অপশনে চাপ প্রসারণ করে। স্বয়ং দৃষ্টিতে আতঙ্কে তৎপর হলো সে। হাতটা ক্রমান্বয়ে কাঁপতে লাগল তার। কেননা মেসেজটি এসেছে অচেনা নাম্বার হতে। মেসেজের মধ্যে থাকা ভিডিওটি দেখে সে ভীষণ আতঙ্কে ফোনটি আপাত বিছানায় রেখে দিল। পুনঃপুনঃ ফোনটি সুইচড অফ করে দিল। দু’হাটু গেড়ে হাত দ্বারা প্রসারিত করে নিজেকে গুটিয়ে নিল। মেসেজের ভিডিওটি চক্ষু দৃষ্টিতে ভেসে উঠছে। আনমনে মাথা চেপে ধরে মৃদু চিৎকার করে উঠল। লেখিকা_তামান্না(আল রাইয়ান)
যাবিয়াজ সবেমাত্র রুমের সম্মুখে এলো। অন্তভাগ হতে প্রিয়সীর মৃদু আর্তনাদ তার কর্ণাটক এ গ্রহিত হলো। সময় বিলম্ব না করে অবিরাম ধারায় বেগে রুমে প্রবেশ করল। প্রিয়সীর অতি ক্ষণসময়ে বিধ্বস্ত মুখশ্রী দেখে বক্ষপিন্ড মুচড়ে উঠল। ইফস্পরীর কাছে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিল। ইফদিয়ার আপন মানুষের উষ্ণতা পেয়ে জাপ্টে ধরল তাকে। ফুঁপিয়ে অশ্র নিক্ষেপ করে কাঁপা কণ্ঠে বলে,

‘ও ও আব আবার আমার পি পিছে লেগেছে। আমায় ভুল বু বুঝবেন না প্লিজ।’

যাবিয়াজ নরম কণ্ঠে ইফদিয়ার থুতনীর উচু করে কপালে গাড় চুম্বন দিয়ে বলে,

‘হুস অামি থাকতে কেউ তোমার পিছু নেবার নয়।’

ইফস্পরীর মাথাটা বক্ষপিন্ডে আঁকড়ে রেখে চুলের মধ্যে বিলি কেটে দিল। রমণীর অঢের অশ্রুপাতের কারণবশত নিদ্রামগ্ন হয়ে গেল। যাবিয়াজ পরম যত্নে স্ত্রীর মাথাটা বালিশে ঠেকিয়ে দিল। নরম তুলতুলে গালে নিজের হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ক্ষাণিক বুলিয়ে বিছানার চৌপাশ এ চক্ষু বুলিয়ে নিল। সন্দেহপ্রবণ কিছু না পাওয়ায় আকস্মিক নজর আঁটকে এলো ইফস্পরীর ফোনের উপর। ঘন সন্নিবেশিষ্ট অক্ষিযুগল নিয়ে ফোনটি হাতে নিল। ইফদিয়ার তার ফোনে কখনো লক বা প্যাটার্ন ব্যবহার করেনি। সেই সুবাদে ফোনের মধ্যে পূর্বের সময়ের নোটিফিকেশন চেকআউট করে। ফলাফল স্বরুপ হোয়াইটহআপে আননোন মেসেজটি পেয়ে সেখানে প্রবেশ করে। একটি ভিডিও যার ফ্রেমটি কালো। অতঃপর সন্দেহটা দৃঢ় করে ভিডিওটি চালু করল।
করতেই যেন যাবিয়াজ এর চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে আক্রোশে কেঁপে উঠে। ভিডিওর মধ্যে নাজমুল এক কিশোরীর নগ্ন শরীরে ছুড়ি বসিয়ে কেটেকুটে দেখাচ্ছে। কিন্তু এতেই সে দম ফেলেনি। বরং মাটির উপর রক্তাক্ত ছুড়ি নিয়ে ‘ইফদিয়ার’ নামটি সংক্ষেপে ‘ইফদি’ লিখল। এই ভিডিওর দৃশ্যপটে ভীষণ আতঙ্কে উঠে ছিল ইফদিয়ার। যা বুঝতে সক্ষম হলো যাবিয়াজ। ইফস্পরীর দিকে নিষ্পলক দৃষ্টি দিয়ে পুনরায় ফোনের মধ্যে দৃষ্টি রাখে। মেসেজটি ডিলেট করে আননোন নাম্বারটি ব্লক করে দিল। ফোনটি নিয়ে বেরিয়ে গেল। বাহিরের দরজা খুলার সময় তিয়ানাকে সম্মুখে পেল। কিছু না ভেবে ডাক দিল। তিয়ানা প্লেটে আপেল কাটছিল রবিউল সাহেব এর জন্যে। যাবিয়াজ এর ডাক শুনায় পিছু ফিরে তাকায়। সৌজন্য কণ্ঠে ‘জ্বি দুলাভাই’ বলে সম্বধন করে। যাবিয়াজ এসে তিয়ানাকে বলে,

‘উইল ইউ ডু মি এ ফেভার!’
(তুমি কি আমার একটি উপকার করবে!)

‘জ্বি কেনো নয়।’

যাবিয়াজ ফোনসহ কিছু টাকা তিয়ানার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে,

‘রহিম চাচুকে নিয়ে ফোনের দোকানে যাও। সেখান থেকে সিম কিনে ফোনে সেটিংস করে দিও। টাকা যত দিছি তাতে হয়ে যাবে। আর যদি বারতি লাগে তুমি ম্যানেজ করে নিও। বাসায় এসে ইফদিয়ার রুমে রেখে এসো। এখন সে ঘুম।’

তিয়ানা শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। যাবিয়াজ অপেক্ষা না করে পুনরায় আক্রোশপূর্ণ মুখে বেরিয়ে গেল। গাড়িতে বসেই ফোন নিয়ে কল লাগাল এরফানকে। সে এমাত্র গাড়িতে বসেছিল যাবিয়াজ এর বাসায় যাওয়ার জন্যে। ইঞ্জিন চালু করতে না করতেই যাবিয়াজ এর কল চলে এলো। এরফান চট করে ফোন উঠাতেই যাবিয়াজ শান্ত ককর্শভরা গলায় বলে,

‘গেট রেডি টু কিডনাপ।’

এরফান পুনঃ প্রশ্ন করল না। বাঁকা হেসে যাবিয়াজ এর কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বলে,

‘ওকে বস আইম কামিং।’

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here