দিন কেটে যায় আশায় আশায় পর্ব-৬

0
378

দিন কেটে যায় আশায় আশায়
ষষ্ঠ পর্ব

ভোরের সূর্যদয় দেখে আমরা যেমন রাতের অন্ধকার ভুলে যাই ,ঠিক তেমনি আপার ছোট্ট বাবুটাকে দেখে আমি সব ঝামেলা ভুলে গেলাম I ইচ্ছে করছিল সারাদিন বাবুটাকে কোলে নিয়ে বসে থাকিI কিন্তু রাশেদ আমাকে থাকতে দিল না I বলল এখন আপা ঘুমাবে সন্ধ্যা পর্যন্ত , আর বাবুকে নার্স নিয়ে গেছে ওকে ও ঘুম পাড়িয়ে রাখা হবে I কাজেই এখানে থেকে কোনো লাভ নেই I তারচেয়ে বরং বাড়ি গিয়ে রেস্ট নিতে I সন্ধ্যাবেলায় সব গুছিয়ে আসতে I আমি ভেবে দেখলাম কথাটা যৌক্তিক I বাড়ি চলে এলাম I নিমিষেই আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেছে I তবুও বেশি রিস্ক না নিয়ে একটু রেস্ট নিলাম I হসপিটালে যাবার সময় তাড়াহুড়ায় তেমন কিছু নিয়ে যেতে পারিনি I আমি চট করে আপার জন্য একটা ব্যাগ গুছিয়ে ফেললাম I কয়েকদিন আগে নিউমার্কেটের গিয়ে আমি আর আপা বাবুর জন্য কিছু জামাকাপড় কিনেছিলাম I আপার মেক্সি, বাবুর জামাকাপড় একটা টাওয়েল আরো কিছু টুকিটাকি জিনিসপত্র নিয়ে নিলাম I এক ফাঁকে আপার জন্য একটু সুপ ও বানিয়ে ফেললাম I সন্ধ্যা নাগাদ হসপিটালে পৌঁছে দেখলাম আপা তখনও ঘুমুচ্ছে I আমি অনেকক্ষণ বাবুকে কোলে নিয়ে বসে রইলাম I দুলাভাইয়ের কোন খোঁজ পেলাম না I নার্সের কাছে জানতে পারলাম বিকেলে একবার এসেছিল I খোঁজ-খবর নিয়ে চলে গেছে I

দুদিন পর আপাকে আমরা বাড়িতে নিয়ে এলাম I আপার ও আমার মতই অবস্থা I বাবুকে দেখে সব কষ্ট ভুলে গেছে I যদিও আপার সামনে বিশেষ কিছু হয়নি I যে কদিন আপা হাসপাতালে ছিল প্রতিদিনই আমি রাতে ছিলাম I মাঝে একদিন জুই এসেছিল বাবুকে দেখতে I জুঁইয়ের মাধ্যমেই আমার ছাত্রীর বাসায় আর ভার্সিটিতে জানিয়ে দিয়েছে যে আমি কয়েকদিন আসতে পারবো না I নোভার মা জুঁইয়ের হাতে আমার এই মাসের বেতন পাঠিয়ে দিয়েছে I মনটাই ভালো হয়ে গেল I টাকাগুলো খুব দরকার ছিল I প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে যাই দুপুরের দিকে I রান্নাবান্না করি Iতারপর আবার হাসপাতালে চলে যাই I বাড়িতে বাজার কিছু থাকেনা I দুলাভাই বোধ হয় বাইরে খাওয়া-দাওয়া করছে I একবার খোঁজও নিচ্ছে না আমরা কি খেয়ে আছি I আমি হাসপাতাল থেকে ফেরার সময় কখনও একটা পেঁপে, লাউ, কয়েকটা ডিম কিনে নিয়ে ফিরি I সেটাই রান্না করে হাসপাতালে নিয়ে যাই I তারপর আমি আর আপা একসঙ্গে ভাত খাই I এই সময়টা আমার কাছে সবচাইতে সুন্দর মনে হয় I একদিন আপা আমাকে জিজ্ঞেস করল আমি টাকার ব্যবস্থা কি করে করছি I আমি মিথ্যে করে বললাম বাড়ি থেকে মা টাকা পাঠিয়েছে I পরে অবশ্য মায়ের কাছ থেকে শুনেছি সে দুলাভাই ফোনে জানিয়েছে এই খানে সব ঠিক আছে I চিন্তার কোন কারণ নেই I উনি সব কিছু ম্যানেজ করে দিয়েছে I

মায়ের সঙ্গে আজ-কাল কেন যেন কথা বলতে ইচ্ছা করে না I কথা শুরু হবার কিছুক্ষণ পর থেকেই দুলাভাইয়ের গুনোগান শুরু হয়ে যায় I আমাকে উনার ওখানে রাখছেন থাকতে দিচ্ছেন , খাওয়াচ্ছেন ইত্যাদি ইত্যাদি Iএরপর শুরু হয় উপদেশ পর্ব I আমার উনার সঙ্গে আরো ভালো ব্যবহার করা উচিত , আরো সম্মান করে কথা বলা উচিত ,এই সমস্ত আর কি I তাই আজকাল ফোন এলে আমি ঝটপট আপাকে ফোন দিয়ে সরে যাই I খুব আশ্চর্যজনক ভাবে দুলাভাইয়ের সঙ্গে আমার কথাবার্তা বন্ধ I আপা ব্যাপারটা সহজভাবে নিলেও আমার কাছে এটা ঝড়ের পূর্বাভাস মনে হচ্ছে I দুলাভাই নিশ্চয়ই মনে মনে কিছু একটা প্ল্যান করছে I সেটা টের পেতে অবশ্য বেশিদিন লাগেনি I

এভাবেই কয়েক দিন কেটে গেল I আমার আর আপার সঙ্গে মিলিয়ে আমরা বাবুর নাম রাখলাম সাদী I দুলাভাইয়ের অবশ্য ব্যাপারটা একেবারেই পছন্দ হলো না I উনি তার মা বাবার সঙ্গে পরামর্শ করে বাবুর ভালো নাম রাখলেন I তবে আমরা সাদী বলেই ডাকি I

কদিন ধরেই মনে হচ্ছে রাশেদকে একবার ধন্যবাদ জানানো উচিত I এসব ঝামেলায় আর তার সঙ্গে দেখা করা হয়নি I আমাকে ফোন নাম্বারটা দিয়েছিল সেটা ও হারিয়ে ফেলেছি I এক সপ্তাহ পর আপা যখন একটু সুস্থ হয়ে উঠলো তখন আমি আবার ভার্সিটি যাওয়া শুরু করলাম I বেরুনোর সময় একটু লক্ষ্য রাখলাম কিন্তু রাশেদকে কোথাও দেখতে পেলাম না I চায়ের দোকানদার কে একদিন জিজ্ঞেস করবো ভাবলাম I পরদিন ক্লাস শেষ করে আমি জুঁইকে নিয়ে চায়ের দোকানে গেলাম I দোকানদার আমাকে দেখে মিষ্টি করে হাসলো I লোকটাকে দেখে খারাপ মনে হলো না I আমার কুশলাদি জিজ্ঞেস করল I শরীর কেমন আছে জানতে চাইলো I বুঝলাম সেদিন আমি অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম তখন হয়তো এই লোকটা ছিল I আমি তার কাছ থেকে রাশেদের নাম্বারটা আবার নিলাম I দুপুর বেলা ফোন দিলাম কিন্তু ধরলো না I সন্ধ্যার দিকে রাশেদের ফোনটা এলো I আমি আর আপা তখন চা খাচ্ছিলাম I আমি ফোনটা নিয়ে উঠে গেলাম I আপা চা খেতে খেতে বাবুকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়াতে লাগলো I ঠিক তখনই দুলাভাই বাসায় ঢুকল I চোখের ইশারায় আপাকে জিজ্ঞেস করল আমি কার সঙ্গে কথা বলছি I আপাকে রাশেদের নামটা বলতে শুনলাম I বাড়ি আসার পর সব গল্পই ওকে বলেছি I আপার খুব ইচ্ছা ছিল রাশেদকে একদিন বাড়িতে ডেকে খাওয়ানোর I কিন্তু দুলাভাই এর ভয়ে ঠিক সাহস পাচ্ছিল না I

সেদিন আমার কারনে উনার অনেক টাকা খরচ হয়েছে I হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ওষুধপত্রের ব্যবস্থা করা I তারপর ক্যান্টিনে ও উনি আমাকে টাকা দিতে দেননি I আমার কাছে অবশ্য টাকা ছিল ও না I আমার মনটা একটু খচখচ করতে লাগলো I ইচ্ছা করছিলো টাকাটা ফিরিয়ে দিতে I কিন্তু উনি আবার কি না কি মনে করেন I তাই বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল I তবুও আমি অস্বস্তি ঝেড়ে ফেলে বলেই ফেললাম
আমার জন্য সেদিন আপনাকে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছে I
ও তেমন কিছু না I
না না I তার পরেও I আমি আপনাকে টাকাটা ফিরিয়ে দিতে চাই I
কিসের টাকা ?
সেদিন আমার জন্য যেটা খরচ হল I
ও আচ্ছা I ফিরিয়ে দিতে চাইলে দেবে I তবে সেদিন তোমাকে ক্যান্টিনে খাইয়েছিলাম সে টাকাটা আমি নিব না I তুমি চাইলে আমাকে কোনদিন খাওয়াতে পারো I
আমি লক্ষ করলাম রাশেদ হঠাৎ করে আমাকে তুমি বলছে I ব্যাপারটা একটু কানে লাগলো I কিন্তু কেন যেন আমার খারাপ লাগলো না I আমি বললাম
আচ্ছা ঠিক আছে I কবে খাবেন বলুন ?
তোমার ক্লাসের পরে কলিম ভাইয়ের দোকানে চা খাওয়াতে পারো
আমি হেসে ফেললাম I তারপর বললাম
কালকে দুইটার সময় আপনি ফ্রি আছেন ?
হ্যাঁ কালকে আমার একটাই ক্লাস 10 টায় I তারপর চলে আসব I
আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে দুইটার সময় কলিম ভাইয়ের দোকানে আপনার সঙ্গে দেখা হবে I
আচ্ছা Iকালকে দেখা হবে ইনশাআল্লাহ I তোমার দুলাভাইকে আমার সালাম দিও I
আমি হাসতে হাসতে ফোন রেখে দিলাম I তারপর দেখলাম দুলাভাই এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে I এই কদিন আমার সঙ্গে তার একবারও কথা হয়নি I আজ হঠাৎ করেই চিবিয়ে চিবিয়ে জিজ্ঞেস করল
– কার সঙ্গে কথা বলছিলে ?
আমি জবাব দিলাম না I উনি বিড়বিড় করে একা একা কি সব বলা শুরু করলো I ছাড়া ছাড়া ভাবে দুই একটা শব্দ আমার কানে আসলো I মাথাটা একটু গরম হলেও আমি পাত্তা দিলাম না I আপাকে এই অবস্থায় ফেলে যাওয়া সম্ভব না I একা বাবুকে নিয়ে ওর অনেক কষ্ট হবে I এখন এসব কথা শুনলে আমার চলবে না I আমি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম I এতে অবশ্য বিশেষ লাভ হল না I এতক্ষণ যা বিড়বিড় করে বলছিল এখন সেটা জোরে জোরে বলতে লাগলো I এই বাসায় থেকে এসব নোংরামি চলবেনা I এখানকার ভাত খেতে চাইলে এসব ছাড়াতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি I সেদিন বুঝতে পারিনি যে তার মাথায় এতকিছু চলছে I যদি বুঝতাম হয়তো সেদিনই বাড়ি থেকে চলে যেতাম I

আমার ক্লাস সাড়ে বারোটার সময় শেষ হয়ে গেল I একটার দিকে আমি রাশেদকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম
আমার ক্লাস শেষ হয়ে গেছে I এখন কি আপনি ফ্রি আছেন ?
হ্যাঁ I আমার কাজও শেষ I তুমি থাকো আমি আসছি
আমাকে অবাক করে দিয়ে রাশেদ আমার ভার্সিটির নিচে চলে আসলো I আমি ওকে বললাম
কলিম ভাইয়ের দোকানে আমি যাব না I আপনার কি আমার সঙ্গে অন্য কোথাও যেতে কোন সমস্যা আছে ?
রাশেদ হেসে ফেললো I তারপর বলল
রিক্সা নিয়ে যাবে ?
সেটাই তো ভালো
আমরা রিক্সা নিয়ে ধানমন্ডির একটা রেস্টুরেন্টে চলে গেলাম Iমোটামুটি মানের রেস্টুরেন্ট I তেমন আহামরি কিছু না I আমি এখানে আগে জুই এর সঙ্গে এসেছি I দাম সম্পর্কে মোটামুটি আমার ধারণা আছে I আমি রাশেদ কে জিজ্ঞেস করলাম
– কি খাবেন বলুন ?
– তুমি যা খাওয়াবে তাই খাব I আমি সর্বভুক
আমি দুটো সেট মেনু অর্ডার করে বিল মিটিয়ে ফিরে এসে বসলাম I খুব কৌতুহল ছিল দুলাভাই কিভাবে ম্যানেজ হলো সেই গল্পটা শোনার I কিন্তু রাশেদকে গল্প বলার ব্যাপারে আগ্রহী মনে হলো না I ও পাশ কাটিয়ে গিয়ে অন্য গল্প শুরু করল I এত সহজ সাবলীল ভঙ্গিতে আমি কাউকে কথা বলতে শুনিনি I ভদ্রলোক টিচার বলেই হয়তো I অসম্ভব সুন্দর করে কথা বলেন I রেস্টুরেন্টে বিচ্ছিরি রকমের ইংরেজি গান বাজছিলো I আমি বিরক্ত হয়ে বললাম
কেন যে ওরা এত লাউড মিউজিক বাজায় I রাশেদ বলল
মিউজিক কি জিনিস তুমি আমাদের গ্রামে গেলে বুঝতে পারতে I আমাদের বাড়ির পাশে একজন দোতারা বাজিয়ে গান গায় I তার গান শুনলে হাসতে হাসতে তোমার মাথা খারাপ হয়ে যাবে I
গান শুনে হাসব কেন ?
সে গানের কথাগুলো নিজেই লেখে
কিরকম ?
তার একটা গান ছিল অনেকটা এরকম
পেলাস্টিকের হাড়িঁ-বাসন পেলাস্টিকের বাটি
কুমড়া গাছে ফুল ধইরাছে
আস্তে আস্তে হাটি
হাটার সময় খেয়াল রাইখো
ফাটে না যেন মাটি
আমার গলায় মতির মালা
সোনার দুলটা খাঁটি

আমি উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম I কিছুতেই হাসি থামাতে পারছি না I হাসি ব্যাপারটা বোধহয় সংক্রামক I রাশেদ নিজেও হাসতে আরম্ভ করেছে I আমি হাসির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছিনা I I উনি এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন দেখে আমি বললাম
কি দেখছেন ?
তুমি বোধ হয় সচরাচর হাসো না I
আমি অস্বস্তি নিয়ে চোখ নামিয়ে নিলাম I তারপর আস্তে আস্তে বললাম
আমি খাবার নিয়ে আসছি I
উঠে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরতেই আমি হকচকিয়ে গেলাম I আমার সামনে জাবির ভাই দাঁড়িয়ে আছেন I উনার মুখ গম্ভীর I কাটা কাটা গলায় বললেন
তোমাকে তো ভালো মেয়ে বলেই জানতাম

চলবে……….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here