সেলাই মেশিন ————- (৩)

সেলাই মেশিন
————-
(৩)

মৌরির বয়স যখন মাত্র পাঁচ, তার মা মরিয়ম মারা গেলো। খুব খারাপ জন্ডিস হয়েছিল তার, কাওকে জানায়নি, কষ্ট লুকিয়ে রেখে সাংসারিক দায়িত্ব পালন করে গেছে। মৌরির বাবা সামান্য চাকুরীজীবি, ডাক্তারের কাছে গেলেই এক গাদা খরচ। লোকের উপদেশে কী সব লতাপাতা খেয়ে জন্ডিস কমাতে চেয়েছিলো। ফল স্বরূপ মৌরিকে মা হারা হতে হলো। মৌরির এখন মাঝে মাঝে খুব অভিমান হয়। মরিয়ম যদি নিজের একটু যত্ন নিতো তাহলে এমন ছোট বাচ্চাকে ফেলে চলে যেতে হতো না। মা শুধু বাবার আর্থিক সংগতির কথা ভেবেছেন, মৌরির কথা একবারও মনে হয়নি? অবশ্য মানুষ নিজের মৃত্যুর জন্য কখনোই প্রস্তুতি নেয় না, মরিয়মও নেয়নি। ভেবেছে, এমনি সব ঠিক হয়ে যাবে। জগতে এমনি এমনি কিছুই ঠিক হয় না, মৌরি এখন বোঝে।

মরিয়মের মৃত্যুর পর মৌরির বাবা বিপদে পড়লেন। মৌরি সবে স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে, কে তার দেখাশোনা করবে, এই চিন্তায় তার বাবা অস্থির হয়ে গেলেন। ছেলের বৌয়ের মৃত্যুর খবর শুনে মৌরির দাদি তখন তাদের বাড়িতে এসেছিলেন। বাবা তাকে আটকে রাখলেন, দাদা ফিরে গেলেন। গ্রামের বাড়িতে তার কৃষি কর্ম আছে, চাইলেও অন্য কোথাও গিয়ে বেশিদিন থাকতে পারেন না, কাজ আটকে যায়। দাদি মাসখানেক মৌরিকে আদর মমতায় মায়ের অভাব বুঝতে দিলেন না। দাদির সাথে ভালোবাসার সম্পর্কের সূত্রপাত ওখান থেকে। মৌরিকে স্কুলে দেয়া আনা গোসল করানো খাওয়ানো- সব কিছুর দায়িত্ব দাদির। কিন্তু দাদীকেও তো নিজের বাড়িতে ফিরতে হবে, ওখানে দাদা একা, গেরস্থালির হাজার কাজ ফেলে ছেলের বাড়িতে থাকা আর সম্ভব না। বাবাকে অনেক বুঝিয়ে দাদি বিদায় নিলেন।

এবার সত্যি সত্যি বুকের ভেতর কেমন করতে লাগলো মৌরির, বাড়িটা যেন অন্যরকম হয়ে গেলো। ছোট্ট মৌরি কাওকে বোঝাতে পারে না কী ভীষণ শূন্যতা তার মনটাকে সবসময় অন্ধকারে ঢেকে রাখে। মৌরিকে স্কুলে বাবা দিয়ে আসতেন কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, আনবে কে? পাশের বাড়ির এক মহিলাকে অনুরোধ করে মৌরিকে স্কুল থেকে আনার ব্যবস্থা করা হলো। মহিলার ছেলেও মৌরির স্কুলে পড়ে, ছেলেকে আনার সময় মৌরীকেও নিয়ে আসতেন। মৌরি স্কুলের পরে ওদের বসার ঘরে একটা মোড়ায় চুপ করে বসে থাকতো। সেই মহিলা এক প্লেট ভাত মেখে ছেলেকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, আর ক্ষুধার্ত মৌরি সেদিকে তাকিয়ে থাকতো। একদিন মহিলা বলেই ফেললেন, “মৌরি এভাবে তাকিয়ে থাকবা না, ছোটনের পেট ব্যাথা করবে।” তখন ওই অপমানের অর্থ বোঝেনি, এখন বোঝে। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে অফিস থেকে ফিরে বাবা মৌরিকে নিয়ে যেত। বাবার হাতে থাকতো এক প্যাকেট বিরিয়ানি অথবা হোটেল থেকে আনা ভাত আর মাছের তরকারি। মৌরিকে মুখে তুলে খাওয়ানোর মতো শক্তি তার থাকতো না, সারাদিন অফিস করে ক্লান্ত বাবা প্লেটে খাবার দিয়ে পাশে চুপচাপ বসে থাকতেন। মায়ের কথা নিশ্চয়ই মনে হতো তার, ক্লান্ত বিষন্ন চোখদুটো দেখে মৌরির মন খারাপ হতো। বাবাকে বলতে পারতো না স্কুল থেকে ফিরে তার খুব খিদে পায়, বাবার জন্য এতক্ষন অপেক্ষা করতে তার কষ্ট হয়। ছোট হলেও ততদিনে জীবনের অনেক কঠিন চিত্র দেখা হয়ে গিয়েছিলো।

একদিন সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে বাবা মৌরিকে পাশের বাসা থেকে নিতে গিয়ে দেখেন মৌরি ফুঁপিয়ে কাঁদছে। মহিলার মুখ রাগে থমথম। কটমট করে বললেন, “আপনার মেয়ের খাবার ব্যবস্থা কইরা যাবেন এখন থেকে। আপনার সমস্যা দেইখা ওরে স্কুল থেকে নিয়া আসতে রাজি হইলাম কিন্তু আজকে সে কী করেছে জানেন? ছোটনের জন্য বাটারবন আনছিলাম, ওইটা খাইয়া ফেলেছে। এই কেমন মেয়ে আপনার?”

অপমানে বাবার মুখ থমথম করছে। মৌরিকে কোলে নিয়ে বাসায় ফিরে বললেন, “ওই ছেলের খাবার ক্যান চুরি করলি? লোভী মেয়ে, এত খিদা তোর? একটু সহ্য হইলো না? দাড়া, আজকে তোরে ভাত রান্না কইরা খাওয়ামু, দেখি কত খাস।”

বাবাকে এত রেগে যেতে কোনোদিন দেখেনি মৌরি। ওর ছোট্ট হৃদপিন্ড ভয়ে ধুকপুক করছিলো। মনে হচ্ছিলো বাবা ওকে আজকে মেরেই ফেলবে। বলতেই পারলো না ছোটন নিজে থেকেই ওই বাটারবন ওকে খেতে দিয়েছিলো।

বাবা রান্নাঘরে প্রথমবারের মতো রান্না করতে গেলেন। রান্নাঘর থেকে খুটখাট শব্দ আসছিলো, বসার ঘর থেকে শুনতে পাচ্ছিলো মৌরি। হঠাৎ বিকট শব্দে একটা বিস্ফোরণ আর বাবার আর্তচিৎকার শোনা গেলো! মৌরি ছুটে গিয়ে দেখে বাবা মেঝেতে পড়ে আছে আর চুলা দাউদাউ করে জ্বলছে।

গ্যাসের কোনো গোলযোগের কারণে ওই দুর্ঘটনা ঘটে। বাবার দুইটা হাতই পুড়ে গিয়েছিলো। আশেপাশের লোকজন বিস্ফোরণের শব্দ শুনে বাবাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলো। সে রাতেই দাদা দাদি গ্রাম থেকে আবার এলেন।

হাসপাতালে বাবাকে দেখতে গিয়েছিলো মৌরি। বাবা তাকে জড়িয়ে ধরে সে কী কাঁদলেন! ফিসফিস করে বললেন, “ভালো হইছে, আগুন আমার উপরে দিয়া গেছে, আমার আম্মা তো ভালো আছে। ওর যদি কিছু হইতো?”

বাবা প্রায় দুই সপ্তাহ পরে বাড়ি ফিরলেন। দাদি দাদার আগমনে বাড়িটা মৃত্যুপুরী থেকে জীবন্ত হয়ে উঠলো ধীরে ধীরে। রান্না ঘর মেরামত করা হলো। বাবা অফিস থেকে পুরো এক মাসের ছুটি নিলেন। কিন্তু আবার সেই আগের মতো দাদির যাবার সময় হয়ে গেলো। এবার মৌরি ভীষণ কান্না জুড়লো, দাদিকে কিছুতেই যেতে দেবে না। উপায়ন্তর না দেখে দাদি বললেন মৌরিকে তার সাথে করে গ্রামে নিয়ে যাবেন। বাবা আঁতকে উঠে বোলো, “ওর পড়ালেখা কী হইবো? গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা হয়? পোলাপাইন সারাদিন গাঞ্জা খায়।”
দাদি বললেন, “ওই স্কুলে তো তুইও পড়ছস, গাঞ্জা কই তোর? সবখানেই ভালো মন্দ থাকে। এইখানে মাইয়াটারে ক্যামনে রাখবি? ওর দেখাশোনা কে করবো? কাজের লোক রাখার মতো অবস্থা তোর নাই। এক পাতিল ভাত রানতে গিয়া হাত পুইড়া শেষ। তুই একলা মাইয়াটারে ক্যামনে দেখবি?”
“তোমরা দুইজন এইখানেই থাকো না। গ্রামে গিয়া আর কী করবা?”

দাদা দুই হাত তুলে না করলেন। তার অল্প বিস্তর ধানি জমি আছে, ওগুলোর চাষাবাদ তিনি নিজের হাতে করেন। কাজ পাগল ব্যস্ত মানুষ তিনি, অল্পতেই সন্তুষ্ট। গ্রামের কারবার ছেড়ে মফস্বল শহরে ছেলে বাড়িতে অকর্মন্য হয়ে পড়ে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না। তিনি নিজের ভিটেয় ফিরে যাবেনই। শেষে দাদি বলেই ফেললেন, “তুই আরেকটা বিয়া কর বাপ।”
“কী কও মা? সৎ মা আইসা আমার মাইয়াটারে যদি দেখতে না পারে?”
“আরে সব মাইয়া কি এক রকম? ভালো ঘরের নরম শরম একটা মাইয়া খুইজা বাইর কর। তোর কী এমন বয়স হইছে ? সারাজীবন কি আর একলা থাকবি? দেখ, যদি ভালো মাইয়া পাওয়া যায়।”

দাদির বিদায়ের সময় মৌরি রীতিমতো গলায় ঝুলে থাকলো। চিৎকার করে কাঁদছিলো ও। দাদি অনেক বোঝালেন, “তোর আর বেশিদিন কষ্ট হইবো না মৌরি পাখি, তোর বাপ নতুন একটা মা নিয়ে আসবো। অনেক আদর করবো তোরে।”
“আমার নতুন মা লাগবো না। তুমি থাকো।”
দাদি তবুও চলে গেলেন আর দাদির কথা সত্য হলো। তিনি যাওয়ার তিন মাসের মধ্যে বাবা শাহেদাকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন। কখন কিভাবে কেন তার সাথে এই মহিলার পরিচয় হয়েছিল, মৌরি কোনদিন জানতে পারেনি।

(ক্রমশ)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here