সেলাই মেশিন
————-
(৯)
————-
দাদি ঢাকায় পাকাপাকি ভাবে এলেও সেসময় মৌরি যেন আরও বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ফাইনাল ইয়ারে এত বেশি আউটডোর প্রজেক্ট আর সেমিনার অংশগ্রহণ করতে হচ্ছিলো যে অনেকটা সময় ইউনিভার্সিটির বাইরে কাটাতে হতো। কাজের বিষয়ে জানতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যেতে হতো । তার উপর ডিজার্টেশনের জন্য শিক্ষকদের সাথেও যথেষ্ট কাজ করতে হতো, তাদের সাথে এপয়েন্টমেন্ট নিয়ে কাজের খুঁটিনাটি নিয়ে মিটিং করতে হতো পুরোদমে। চাকরির জন্য আলাদা সময় বের করতেও হিমশিম খেয়ে যাচ্ছিলো মৌরি। শুক্রবার এলে দাদির কাছে যেত, কিন্ত ধীরে ধীরে দেখা গেলো ছুটির দিনগুলোতেও ওর ব্যস্ততা বেড়ে দ্বিগুন হয়ে গেছে । ফলে দুই এক শুক্রবার পার হয়ে যেত, মৌরি দাদির সাথে দেখা করতে যেতে পারতো না। ওর খুব খারাপ লাগতো, কিন্তু ও নিরুপায়। এক সময় ভাবলো চাকরিটাই ছেড়ে দেবে।
পরপর দুই শুক্রবার দাদিকে দেখতে যেতে পারেনি একবার। শেষে অতি কষ্টে সময় বের করে ফুফুর বাসায় গেলো। গিয়ে দেখে বাসায় এলাহী আয়োজন, ফুফার পরিচিত কোনো বড় সরকারি অফিসার স্ত্রী সমেত আসবেন দাওয়াতে। মৌরিকে দেখে ফুফু বললেন দাদির ঘরে গিয়ে বসতে, তিনি না ডাকলে যেন দাদি বা মৌরি কেউ বাইরে না আসে।
মৌরি ভেতরের ঘরে গিয়ে দেখে মুখ গোমড়া করে কিশোরী মেয়েদের মতো গাল ফুলিয়ে আছে দাদি। মৌরি তার সামনে গেলে ওদিকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়, ওদিকে গিয়ে দাঁড়ালে আবার আরেকদিকে মুখ। দাদির কান্ড দেখে মৌরি হেসে ফেলে।
“এত রাগ করেন ক্যান দাদি? আমার তো ইচ্ছা করে ছোটবেলার মতো আপনের গলা জড়ায় ধইরা ঘুমাই। কিন্তু আমার তো চাকরি আছে, পড়ালেখায় খুব চাপ। কিন্তু এই চাপ বেশিদিন থাকবো না দাদি। মাত্র কয়েকমাস পরেই আমার অনার্স শেষ, তখন চাকরি গুলি মাইরা আপনার কাছে চইলা আসবো। এখন রাগ কমছে?”
“রাগ কইরা আর কী হইবো? এই বাড়িতে কেউ থাকে না, তোর ফুফু সারাদিন কই কই থাকে, আমার কাছে আসে না। আমার একলা একলা এই ঘরে বইসা থাকতে ভালো লাগে না।”
“টিভি দেখলেও তো পারেন। কত সুন্দর সুন্দর সিনেমা হয়, ছায়াছন্দ হয়।”
“নাহ , টিভি দেখতেও ভাল্লাগেনা ।বাংলা সিনেমায় খালি মারামারি করে আর মাইয়াগুলা মাটিতে গড়াগড়ি করে, আমার ভালা লাগে না। আচ্ছা মৌরি, তোর পড়া শেষ হইলে আমার লগে আগের মতো গ্রামের বাড়িতে গিয়া থাকতে পারবি না? এইখানে আমার ভালো লাগে না।”
দাদির চোখে অনেক আশা ঝিকমিক করে কিন্তু মৌরি জানে, দাদির স্বপ্ন পূরণ আর সম্ভব না। ওর ইচ্ছা ঢাকায় একটা চাকরি নিয়ে এখানেই থেকে যাওয়া। মাস্টার্সও করতে পারে তবে তার আগে কিছুদিন কাজের অভিজ্ঞতা নিয়ে নেয়া জরুরী। চাকরির জন্য ডিপার্টমেন্টের কয়েকজন শিক্ষকের রেফারেন্স পাওয়া যাবে। এক স্যার বলেছেন মৌরির চাকরির একটা চেষ্টা তিনি করবেন। কিন্তু দাদির এই বাড়িতে ভালো লাগে না। খোলামেলা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে এখানে ভালো লাগার কথাও না। ফুফুর বড় ছেলে দার্জিলিংয়ে পড়ে, ছোট ছেলে বাসায় থাকলেও সারাদিন ইউনিভার্সিটি আর খেলাধুলা নিয়ে ব্যস্ত। দাদি সারাদিন একা ঘরে বসে থাকে, অপেক্ষা করে কবে মৌরি আসবে।
“দাদি, আর কয়টা দিন অপেক্ষা করেন, আমি চাকরি পাইলেই একটা সুন্দর বাসা ভাড়া নিয়ে আপনাকে আমার সাথে রাখবো।”
দাদি ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “বাসা ভাড়া ক্যান? আমার বাড়ি আছে না?ওইখানে আমার সাথে থাকবি, আগের মতো।”
“গ্রামে গিয়া আমি কী করবো দাদি? আমি এইখানে চাকরি করতে চাই, আরো পড়তে চাই।”
“আরো পড়বি?” দাদির কণ্ঠে হাহাকার ঝরে পরে। কিন্তু মৌরিকে পড়তে মানা করে না দাদি।
দাদিকে নানা ভাবে সান্তনা দেয় মৌরি, ঢাকায় কত সুযোগ সুবিধা সব বর্ণনা করে, তবুও দাদির মন ভরে না। মুখ অন্ধকার হয়ে থাকে।
“দাদি আপনার সেই কবিতাগুলা কই গেলো? আগে না আমারে নিয়া কত কবিতা বানাইতেন? কোমর ভাঙার পরে কবিতাগুলাও হারায় গেছে নাকি?” দাদির মন ভালো করতে দুষ্টুমি করে বলে মৌরি।
“ধুর, রাখ তো কবিতা। তোর দাদা মইরা গিয়া আমারে এই প্যাচে ফালাইলো। কই আইসা পড়লাম? এখন কিয়ের কবিতা, কিয়ের গান, কিছুই ভালা লাগে না।”
“আমি একটা কবিতা বানাই?”
কৌতূহলে চোখ পিটপিট করে তাকায় দাদি, তারমানে মৌরির কবিতা শুনতে চায়।
“দাদারে নিয়া একটা কবিতা চিন্তা করলাম, শুনেন তাইলে। ‘দাদা ও দাদা, আমাগো বানাইয়া গাধা, কই গেলেন চইলা, গেলেন না বইলা।”
মৌরি চোখ বন্ধ করে এমন মেকি গম্ভীর ভঙ্গিতে কবিতা বললো যে দেখে দাদি ফিক করে হেসে ফেললেন।
“এই তোর কবিতা? তোর দাদা এই কবিতা শুনলে এমনেই মইরা যাইতো।”
“তাইলে আপনে শুনান একটা কবিতা।”
দাদি কিছুক্ষন চিন্তা করে মনে মনে কবিতা রচনা করে ফেললেন, “মৌরির হইবো বিয়া, ওড়না মাথায় দিয়া ……..”
দাদিকে থামিয়ে দিয়ে মৌরি বলে, “বিয়ায় খাইবা কী? পান্তা আর ঘি!”
মৌরি আর দাদি কবিতা নিয়ে খুব হাসাহাসি করলো সেদিন। হঠাৎ দরজার দিকে তাকিয়ে দেখে ফুফু কঠিন মুখে দাঁড়িয়ে আছেন।
“এত কী মজার কথা হইতেছে? হাসির আওয়াজ বাইরে শুনা যাইতেছে।”
ফুফুর কথা শুনে ওরা দুইজনই চুপ করে গেলো।
“মৌরি, তোর দাদীরে একটা সুন্দর শাড়ী পরাইয়া ড্রইং রুমে নিয়ে আয়, মেহমানের সাথে পরিচয় করায় দেই। আম্মা, মেহমানের সামনে কিছু বইলেন না আবার। তুইও কিছু বলিস না মৌরি, যা বলার আমি বলবো।”
ফুফু চলে যেতেই দাদি ফিসফিস করে ফুফুর উদ্দেশ্যে বলেন, “সবতো তুমি বলবাই, আমাগো তো মুখ নাই।”
শুনে মৌরি হেসে ফেললো, একই সাথে দাদির জন্য মায়াও লাগলো। তার সারা অবয়বে একাকিত্ব স্পষ্ট ফুটে উঠেছে।
দাদিকে নতুন শাড়ী পরিয়ে দিলো মৌরি।দাদি জিজ্ঞেস করলেন, “তোর খরচ পাতি কেমনে চলে রে মৌরি ? এখন তো আমি আর টাকা দিতে পারি না। তোর বাপ দেয়?”
“টাকা লাগবো ক্যান? আমি নিজেই তো ইনকাম করি দাদি। তবে এই কাজ আর বেশিদিন করতে হইবো না,পড়া শেষ হইলেই একটা ভালো চাকরি নেওয়ার চেষ্টা করতেছি।”
“চাকরি করবি? বিয়া করবি না ?”
“বিয়ার সময় হইলে করবো। কিন্তু দাদি আমার মতো কালো মেয়েরে কে বিয়া করবে?”
“আবার বলে কালা? আমি না বলছি, তুই কোনোদিন আমার সামনে নিজেরে কালা বলবি না। তোর ভিতরটা কত সুন্দর, যে বুঝবো সে তোরে ঠিকই বিয়া করবো।”
মৌরি আর দাদি ড্রয়ইং রুমে মেহমানের সাথে দেখা করতে এলো। খুব পরিপাটি সাজে এক ভদ্রমহিলা আর ভদ্রলোক বসে আছেন। মহিলার গায়ে পরা কামিজ দেখে মৌরি অবাক হয়ে গেলো, এ তো সেই বুটিকের কামিজ, যেখানে সে কাজ করে।
ফুফু গর্বভরে পরিচয় করিয়ে দিলো, “এই হচ্ছে আমার বড় ভাইয়ের মেয়ে মৌরি। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ইকোনমিকসে পড়ে। খুব ভালো ছাত্রী।”
মহিলা আন্তরিক ভাবে বললেন, “ও তাই! আসলেই তো খুব ভালো ছাত্রী দেখছি। এস, আমার পাশে বসো।”
মৌরি পাশে গিয়ে বসলো, দাদি সামনের সোফায় বসলেন। ভদ্রমহিলা মৌরিকে পড়ালেখা নিয়ে টুকটাক প্রশ্ন করছিলেন। মৌরি নিজের উত্তেজনা আর চেপে রাখতে পারলো না, ফস করে বলে ফেললো, “আপনি যে কামিজ পড়ে আছেন, ওটা আমার হাতেই তৈরী হয়েছে বলতে পারেন।”
“ওমা! তাই নাকি? কেমন করে?”
“এই কামিজ আপনি যে বুটিক থেকে কিনেছেন আমি সেই বুটিকের কারখানায় কাজ করি।”
“তুমি কি সেখানকার ডিজাইনার?”
“না না। আমি সেলাই কারখানায় সুপারভাইজার। এসব কামিজের কাটিং, স্টিচিং, ফিনিশিং সব আমি দেখি। কয়দিন আগেই এই কামিজগুলো সেলাই হলো আমার সামনেই তো। তাই আজকে আপনাকে কামিজটা পরতে দেখে খুব ভালো লাগলো।”
মৌরির কিভাবে একা একা কিভাবে সব মানিয়ে গুছিয়ে পড়ালেখা করছে সে গল্প শুনে ভদ্রমহিলা মুগ্ধ হলেন। ফুফু আর ফুফা মুখ শুকনা করে বসে থাকলেন পুরোটা সময়। মেহমান চলে যাওয়ার পর দাদির ঘরে এসে ফুফু রাগী ভঙ্গিতে বললেন, “মৌরি তোর বলার কী দরকার ছিল যে তুই দর্জির চাকরি করস ? তোরে ডিজাইনার মনে করছিলো, হ্যা বললে হইতো না? শুধু শুধু আমাগো ছোট করলি। তোর ফুফার তো একটা মান সম্মান আছে।”
বরাবরের মতোই মৌরি তর্কে গেলো না। ফুফু তার ইউনিভার্সিটিতে ভালো বিষয়ে পড়া নিয়ে গর্ব করলেন কিন্তু তার স্বনির্ভরতা নিয়ে গর্ব করতে পারলেন না? তবে মন খারাপ করলো না সে। এসব গায়ে না মাখার অভ্যাস ওর হয়ে গেছে। রাতে বিদায় নেয়ার আগে ফুফু বললেন, “মৌরি শোন, অনেক তো পড়লি। এইবার বিয়া শাদীর চিন্তা কর। ভাইও বলতেছিলো, তোর বিয়ার জন্য ছেলে দেখতে।”
মৌরির অনার্স শেষ হওয়ার আগেই বিয়ের জন্য চাপ আসতে শুরু করলো। ফুফা দুই তিনটা বিয়ের প্রস্তাব আনলেন, তার বাসায় দাদির উপস্থিতিতে কনে দেখার ব্যবস্থাও করলেন। মৌরি তীব্র অনিচ্ছাসত্ত্বেও ছেলে পক্ষের সামনে সেজেগুজে বসলো। এভাবে নিজেকে পণ্যের মতো ছেলে পক্ষের সামনে আসা তার একেবারেই পছন্দ না। তবু বাবা, দাদি আর ফুফুর পীড়াপীড়িতে রাজি হতে হয়। কিন্তু ছেলেপক্ষ তাকে পছন্দ করে না, গায়ের রং আর সৌন্দর্য সবার কাছে মুখ্য বিষয়।
(ক্রমশ)