#পদ্মফুল
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
|৩০|
হসপিটাল থেকে একে একে সব মেয়েরা রিলিজ পেল। থানায় গিয়ে সবাই তাদের কমপ্লেন লেখাল। হসপিটালে এখন কেবল পড়ে রইল পদ্ম। তার যে পরিবার নেই, কোনো আত্মীয় নেই। হয়তো তার মামা মামী শুনেছেন এইসব কিছু কিন্তু উনারা পদ্ম-কে একবারের জন্যও দেখতে আসেননি।
দু’দিন হসপিটালে পার করবার পর পদ্ম এখন অনেকটাই সুস্থ। তবে সেটা শারীরিক ভাবে। মানসিক ভাবে সে এখনও পুরোপুরি সুস্থ হতে পারেনি। এর মাঝে আদিদ পদ্ম’র কেবিনে অনেকবারই এসেছে তাকে দেখার জন্য। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে সে পদ্ম’র সাথে একটা কথাও বলেনি। পদ্ম ভাবছে হয়তো আদিদ তার উপর রেগে আছে, হয়তো সে ভাবছে তার জন্যই তার মা বাবা আজ জেলে। কথাগুলো ভাবলে পদ্ম’র কষ্ট হয়। তার মনে হয় তার জন্য আদিদও কষ্ট পাচ্ছে। সে এখান থেকে চলে যেতে চায়। কিন্তু নার্স দেয় না। আগেরবার তাকে সেই নার্স যতটা না যত্ন করেছিল এবার তার থেকে বেশি করছে। অবশ্য আর একজন মানুষও তার খুব খেয়াল রাখছেন। তিনি হলেন আদিদের বন্ধু অভি। তিনি রোজ একবার হসপিটালে আসেন। আদিদের সাথে দেখা করে পদ্ম’র কেবিনেও আসেন। তার জন্য হাতে করে কিছু না কিছু নিয়ে আসেন। সেদিন এসে এক গাদা ফল দিয়ে গেছেন। ফল খেলে পদ্ম শরীরে বল পাবে। জোর করে একটা আপেল কেটে খাইয়ে পর্যন্ত দিয়েছেন। যদিও পদ্ম খেতে চাচ্ছিল না কিন্তু তাও খেতে হয়েছিল তাকে।
আজও সকাল সকাল অভি হসপিটালে চলে এসেছে। আদিদের কেবিনে গিয়ে শুনে সে ও.টি তে আছে। তাই সে সময় কাটানোর জন্য পদ্ম’র কেবিনে এলো। পদ্ম তখন জানলার ধারে দাঁড়িয়ে ছিল। অভি দরজায় নক করে বললো,
‘আসবো?’
পদ্ম পেছন ফিরে তাকাল। আলতো হেসে বললো,
‘আসুন।’
অভি ভেতরে এসে বললো,
‘ভালো আছো?’
পদ্ম মাথা নাড়িয়ে বললো,
‘জ্বি।’
প্রতিদিন আসার পর উনার এই একই প্রশ্ন। পদ্মও প্রতিদিন মাথা নাড়িয়ে একই ভাবে জবাব দেয়। অভি জবাব শুনে সোফায় গিয়ে বসে। তারপর ধীর গলায় বলে,
‘আরাফাতকে পাওয়া গিয়েছে।’
পদ্ম চমকে তাকায়। ধরা গলায় বলে,
‘কখন?’
‘এই যে কিছুক্ষণ আগে। আমি মাত্র থানা থেকে এলাম। অফিসার কিছুক্ষণের মধ্যেই আরাফাতকে রিমান্ডে নিবেন। আর তারপরই এই কেইসের সমস্ত জট একেবারে খুলবে।’
পদ্ম কম্পিত কন্ঠে বললো,
‘উনি কি সত্যিই এসব ক-করেছে?’
অভি বললো,
‘তোমার কি মনে হয়, ও কিছু করেনি?’
পদ্ম অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। বিশ্বাস করা যতটা সহজ, কাউকে অবিশ্বাস করা ততটাই কঠিন। সে তো বাঁচতে চেয়েছিল, ঐ মানুষটাকে ভালোবেসে বাকিটা জীবন কাটাতে চেয়েছিল। কিন্তু একদিনেই কী করে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেল? মানুষ এত খারাপ কী করে হয়? এই মানুষগুলো তো জ*ন্তু জানো*য়ারের চেয়েও অধম। পদ্ম অভির দিকে তাকাল। বিক্ষিপ্ত কন্ঠে বললো,
‘আমি ঐ লোকটাকে ডিভোর্স দিব।’
অভি শান্ত গলায় জবাব দিল,
‘বিয়ে হলেই না ডিভোর্স দিতে। তোমাদের তো বিয়েই হয়নি।’
পদ্ম অবাক গলায় বললো,
‘আমাদের তো বিয়ে হয়েছে। আপনিও তো ছিলেন সেখানে।’
অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,
‘না, বিয়েটা সেদিন হয়নি। তুমি একাই সেদিন কবুল বলেছিলে, আরাফাত কবুল বলেনি। আর কাবিননামায় ও সে কোনো স্বাক্ষর দেয়নি। যা হয়েছে তা শুধু তোমার একপক্ষ থেকেই হয়েছে। আর এসব কিছু আরাফাত তার প্রথম জবানবন্দীতে অফিসারদের জানিয়েছে। এখন তাহলে তুমিই বলো, এটাকে কি আর বিয়ে বলে ধরা যায়?’
পদ্ম চোখ বুজে জোরে নিশ্বাস ফেলে। তারপর চোখ মেলে তাকিয়ে বলে,
‘আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্য করেন। এখন আমার একটাই চাওয়া, আল্লাহ যেন ঐ লোকগুলোকে কঠিন শাস্তি দেন।’
‘হুম, শাস্তি তো ওরা পাবেই। তবে আমি তো শুধু ভাবছি আদিদের মা বাবার কথা। ঐ মানুষগুলো কী করে এসব করতে পারলেন। উনারা একবার আদিদের কথা ভাবলেন না। ছেলেটা সুজানাকে কতটা ভালোবাসে। উনারাও স্বীকার করেছেন যে, উনারাই সুজানাকে মে*রেছেন। আর তারপর তাকে ঐ আলমারিতে লুকিয়ে রেখেছেন। আর এইদিকে সুজানার মা বাবা আর আদিদ তাকে পাগলের মতো খুঁজে গিয়েছে। উনারদের কি একটা বার উনাদের ছেলের প্রতিও মায়া হয়নি? মানুষ এত নিষ্ঠুর কী করে হয়?’
পদ্ম’র চোখ দু’টো ভিজে উঠল। তার তো মা বাবা নেই বলে তার এত কষ্ট। কিন্তু ডাক্তারবাবু, উনার তো সব কষ্ট উনার মা বাবার কারণে। মানুষটা বোধ হয় প্রতিনিয়ত তিল তিল করে শেষ হয়ে যাচ্ছে। কত সহ্য করা যায়। আর যাই হোক, মা বাবা যদি সন্তানকে এইভাবে কষ্ট দেয়, তাহলে কি সেটা মানা যায়?
.
পদ্ম অনেকক্ষণ চুপচাপ ভাবল। হঠাৎ অভি বললো,
‘তুমি কি তোমার মামা মামীর কাছে আবার ফিরে যেতে চাও?’
পদ্ম অস্থির গলায় বললো,
‘না, কখনোই না।’
‘তাহলে কোথায় যাবে?’
পদ্ম কথা হারিয়ে ফেলল। সত্যিই তো কোথায় যাবে সে? তার তো কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। পদ্ম কিছু বলছে না দেখে অভি বললো,
‘আমার সাথে যাবে? আমার নিজের একটা আশ্রম আছে। সেখানে তোমার মতো আরো অনেক মেয়ে আছে। তারা তোমার মতোই এতিম। অনেক সময় অনেক কেইসের দৌলতে আমি ওদের পেয়েছি। সবাই এখন আমার সেই আশ্রমে থাকে। সেখানে একটা নারী সংস্থা তাদের নিয়ে কাজ করছে। তাদের লেখাপড়া শেখাচ্ছে, বিভিন্ন কাজ শেখাচ্ছে, যেন তারা স্বাবলম্বী হতে পারে। তুমি যদি চাও তবে সেখান থেকে একবার ঘুরে আসতে পারো। সেখানের অন্যান্য সব মেয়েগুলোর সাথে কথা বলে তোমার ভালো লাগবে, দেখো।’
অভির কথার পিঠে পদ্ম কিছু বললো না। অভি আবার বললো,
‘আমি জানি তুমি এখন আর কাউকে সহজে বিশ্বাস করতে পারবে না। তাই তোমাকে আগে সেখান থেকে একবার ঘুরে আসতে বলছি। সেখানের পরিবেশ দেখলেই তুমি বুঝতে পারবে, আমি কতটা সত্যি বলছি।’
পদ্ম এবারও নিরব থাকে। অভি বলে,
‘আচ্ছা, তুমি তাহলে ভেবে দেখো। আমি তাহলে এখন আদিদের কেবিনে গিয়ে দেখি ও ও.টি থেকে এলো কিনা, কেমন?’
পদ্ম আস্তে করে বললো,
‘আচ্ছা।’
অভি সেখান থেকে বেরিয়ে গিয়ে আদিদের কেবিনে ঢুকল। আদিদ তখন মাত্রই ও.টি থেকে বেরিয়ে এসেছে। অভিকে দেখে সে বললো,
‘কখন এলি?’
‘এই তো কিছুক্ষণ আগে। স্টাফ বললো, তুই নাকি ও.টি তে তাই পদ্ম’র কেবিনে গিয়ে ওর সাথে কিছুক্ষণ কথা বললাম। আচ্ছা, তোকে কি অফিসার কল দিয়েছিল?’
‘না।’
‘ওহহ। আরাফাতকেও পাওয়া গিয়েছে। আর ও কী বলেছে জানিস?’
‘না, জানি না আর জানতে চাইও না।’
অভি বিব্রত বোধ করলো। বললো,
‘কেন?’
আদিদ চোখ মুখ কুঁচকে তাকাল অভির দিকে। তারপর শক্ত গলায় বললো,
‘আমি এসব কথা শুনতে চাই না। এই ব্যাপারে কোনো কথা তুই আমার সাথে বলবি না। যদি অন্য কোনো কথা থাকে তো বল, নয়তো এখান থেকে চলে যা।’
অভি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। আদিদের ডেস্কের সামনের চেয়ারটা টেনে বসলো। তারপর বেশ গম্ভীর গলায় বললো,
‘পদ্ম’কে নিয়ে কী ভেবেছিস?’
‘উনাকে নিয়ে আমি কেন ভাববো? আমি তো উনার কার্ডিয়ান নই।’
অভি বিরক্ত গলায় বললো,
‘মানলাম তুই ওর গার্ডিয়ান নোস। কিন্তু, এখন তো ওকে নিয়ে তোরই ভাবতে হবে। তাছাড়া আর কে ভাববে বল? ওর তো কেউ নেই।’
আদিদ তার শার্টের হাতা ফোল্ট করতে করতে বললো,
‘ভাই, প্লীজ আমাকে ক্ষমা কর। আমি আর কাউকে নিয়ে ভাবতে চাই না। পারবো না আমি। অন্য কাউকে নিয়ে ভাবার মতো কোনো মন মানসিকতা আমার আর এখন নেই। পারলে তুই ভাব, উনার দায়িত্ব তুই নে। তুই বরং এক কাজ কর, উনাকে তোর আশ্রমে নিয়ে যা। সেখানেই উনার থাকার ব্যবস্থা করে দে। আমি আর পারবো না কারোর দায়িত্ব নিতে, আ’ম সরি।’
অভি কিছুক্ষণ সময় নিয়ে ভাবল। হুট করে বললো,
‘মা বলছিল বিয়ে করার কথা। আচ্ছা, আমি যদি পদ্মকে বিয়ে করে নিই?’
চলবে…