#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১১)
সিজন ২
লেখক– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
২২.
ইকরার বিয়ে হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। সে এখন বনানীতে চলে গেছে। মেহজার মেডিকেল কোচিং শুরু হয়েছে আরো আগে সে করতে ইচ্ছুক ছিল না। তবে তার বাবা আর ভাইয়ের জোরাজুরিতে সে এখন কোচিং যাচ্ছে। তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার এখন শখ হয়েছে। অনা আর প্রথি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির জন্য কোচিং করছে। মেহজা খুব টেনশনে আছে। সে জানে ডাক্তারি তার জন্য না। সে এখন মুক্ত আকাশে উঁড়ে বেড়াতে চাইছে। টিএসসিতে আড্ডা দেওয়ার স্বপ্ন দেখছে। চমক বদমাইশটা নাকি মেডিকেলে কোচিং করছে আর তা নিয়ে সে দৈনন্দিন দশবার হলেও কথা শুনে। তখন তার ইচ্ছা হয় চমককে একদম চি’বি’য়ে খেয়ে ফেলতে। তবে রা’ক্ষ’সী তো সে নয়। চমক হলো আসল রা’ক্ষ’সী। সেদিন রাতে কল করে বলে ইরফান নাকি তাদের এলাকায় গেছে। তাদের পাশের বাসার কোন ভাইয়ের সাথে তার চলাফেরা হয়। তার মাধ্যমে নাকি সে ইরফানের ফোন নম্বর যোগাড় করে ফেলেছে। আর মেহজা এতগুলো দিন এক বিল্ডিং এ থেকে তা করতে পারল না। চমকের ভাষ্যমতে মেহজা নাকি সব দিকেই অপটু। মেহজা অপেক্ষায় আছে পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিনের জন্য। সে খারাপ করুক বা ভালো করুক যা-ই করুক না কেন চমকের রেজাল্টটা যে খারাপ হবে সেটা সে ভালো করেই জানে। আজ বিকেলে একটু গুলশানের একটা রেঁস্তোরায় যেতে হবে তাকে। অনার জন্মদিনের ট্রিট আছে। তবে প্রথমে তাকে উপহার কিনতে যেতে হবে। প্রথির একটা পরিচিত শপ আছে সেখান থেকেই কিনবে। প্রথিকে বলা হয়েছে সেই শপে সময় মতো চলে যেতে।
কালো কামিজটা পরে চুলগুলো ক্লিপ দিয়ে বেঁধে নিল মেহজা। যা গরম পড়েছে চুল ছাড়ার কোনো মানেই হয় না। চুল ছাড়লেই ঘামে গরমে একাকার অবস্থা। মায়ের কাছে বলে সে বাসা থেকে বের হলো। অপেক্ষা করল লিফটের জন্য। প্রথমে খেয়াল না করলেও লিফটে উঠতেই ইরফানের দেখা পাওয়া গেল। ইরফান তার দিকে তাকিয়েই ছিল। চোখে চোখ পড়তে কিছুটা বিব্রত হয়েছে বলা যায়। মেহজা এক পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। ইরফান বলল,
-‘কী খবর! তোমাকে তো আজকাল দেখা যায় না।’
-‘খবর মোটামুটি। দেখা না যাওয়ার কারণ এখন আমি ভীষণ ব্যস্ত।’
-‘যেমন?’
-‘কাজ আছে নানান। তাছাড়া কোচিং করছি।’
-‘মেডিকেল?’
-‘হু।’
মেহজার মুখটা মলিন হয়ে গেল। ইরফান খেয়াল করল সেটা। মৃদু হেসে বলল,
-‘মনে হচ্ছে তুমি কিছুটা আপসেট হয়ে পড়েছ এই কথা বলায়।’
-‘না, আসলে হ্যাঁ।’
ইরফানের দিকে মুখ করে সে বলল,
-‘বাবা আর ভাইয়ার চাপে পড়েই করতে হচ্ছে। আমি জানি ওসব মেডিকেল কলেজ আমার জন্য না।’
-‘তবে কোনটা তোমার জন্য?’
-‘কার্জন হল, টিএসসি, মধুর ক্যান্টিন, ভিসি চত্ত্বর এই সব সুন্দর স্থান গুলো।’
-‘ঢাবি!’
-‘হুম।’
এবার খুব উচ্ছ্বাসিত লাগল মেহজার গলা। ইরফান বলল,
-‘আমি মনে করি মন যা চায় তার পেছনে ছোটা বেস্ট হবে। আফসোস বোঝো তো? একটা য’ন্ত্র’না হলো এই আফসোস। আজ অন্যের জন্য নিজের ইচ্ছাকে মাটি চাপা দিলে কাল যখন সেই ইচ্ছাটা পূরণ হবে না তখন কী করবে? আমি একটা বই থেকে এটা শিখেছি যে কখনো একটা স্বপ্নের জন্য অন্য স্বপ্নকে ছেড়ে দিও না। কারণ অপশন থাকা দরকার। যখন তোমার স্বপ্ন বেশি থাকবে তখন তুমি সেই উদ্যমে চলবে। এটা না হলে ওটা তো হবে। যদি একটাতেই পড়ে থাকো তবে দেখা গেল বাকি গুলো তো হলোই না সেটাও হবে না। হবে না কারণ ঐ যে আফসোস করে আর ভাবতে ভাবতেই জীবন পার করবে। ভাবনা টা কেমন বলি, ভাবনাটা হলো “এই যে বাদ দিলাম পরে যদি আফসোস করি” এমন টাইপ। মানে তোমার কাছে মনে হচ্ছে তুমি আফসোস করবে কিন্তু তুমি অলরেডি আফসোস করছ। আরেকটা ব্যাপার হলো যে এটা তোমার নিজের ইচ্ছা নয়, নিজের স্বপ্ন নয়। নিতান্তই চাপে পড়ে এটার পেছনে সময় ব্যয় করছ। তাতে তোমার এইটার প্রতি অনীহা কাজ করবে। তুমি ইচ্ছা করেই এটার মধ্যে নিজের সর্বোচ্চ চেষ্টা তো দূরে থাক সর্বনিম্নটাও দিবে না। এখানেও লস। আর মেডিকেলে সেকেন্ড চান্স আছে তবে ঢাবিতে নেই। আমার মনে হয় তোমার মাইন্ড সেট আপ আরো স্ট্রং করতে হবে। তোমাকে এটা শিউর হতে হবে যে তুমি করবে কী। প্রথমেই তোমার লক্ষ্য থাকবে নিজের পছন্দনীয় জিনিসটি হাতে তুলে নেওয়া। তারপর সল্যুশন এমনেই পেয়ে যাবে। কিছু করার আগে কিছু ভাবতে হবে। আমার মনে হয় তোমার ইমা মিস এই ব্যাপারে তোমাকে সাহায্য করতে পারবে। হাতে সময় কম তাই যা করার দ্রুত করবে।’
কথা বলতে বলতে তাদের লিফট যে কখন থেমে গেছে সেই খেয়ালই ছিল না। মেহজা খুব মন দিয়ে ইরফানের প্রত্যেকটা কথা শুনেছে। তার কাছে এই মুহূর্তে ইরফানকে দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো মনের মানুষ মনে হচ্ছে। ইরফান চলে গেল। সে কেবল তার যাওয়ার পানেই চেয়ে থাকে। এই চাওয়ার কোনো শেষ নেই।
২৩.
শপে এসে বেশ কিছু শো পিস্ দেখার পরেও আহামরি পছন্দ কিছু হচ্ছিল না। শেষে তারা পেইন্টিং সেকশন এর দিকে গেল। এবার মন মতো লাগল সব কিছু। মেহজা একটা সুন্দর পেইন্টিং নিল। একজন নারী জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে তার চোখে মুখে উৎকন্ঠা। কারো দেখা পাওয়ার জন্য আকুলতা প্রকাশ পাচ্ছে। মেহজার মনে হলো এটা সে নিজেই। ইরফানকে দেখার জন্য সেও তো এমন করে। জানে ওত উপর থেকে ইরফানকে স্পষ্ট দেখা যাবে না। তবুও পিঁপড়ের মতো আকৃতিটা দেখতেও তার ভালো লাগে। নীল রঙের বিএমডব্লিউ টা যখন গেইট দিয়ে ঢুকতে দেখা যায় তখন তার মনটা কেমন আনচান করে। এত সুন্দর চিত্র!
প্রথি নিল একটা ঘড়ি এবং সানগ্লাস সেট। শপ থেকে বের হওয়ার পর তারা যখন উবারের জন্য অপেক্ষা করছিল তখন তাদের সামনে একটা ছেলে এসে দাঁড়ায়। মেহজার দিকে তাকিয়ে ছেলেটা এক গাল হাসে। মেহজা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে। প্রথি বলল,
-‘কি ব্যাপার? আপনি কে!’
-‘আপনাকে বলার প্রয়োজন বোধ করছি না ম্যাম। তবে দরকার আছে। উনার সাথে।’
শেষ কথাটা মেহজাকে ইঙ্গিত করে বলা হলো। মেহজা বলল,
-‘কী দরকার!’
-‘আপনি মেহজা?’
-‘জ্বি। আপনি আমার নাম জানেন কীভাবে?’
-‘শুধু নাম না ঠিকানাও জানি।’
-‘তাই নাকি। তা কীভাবে?’
-‘আপনি হয়তো আমাকে চিনতে পারছেন না। আমি অয়ন। ওইদিন আপনি যে ভদ্রলোককে ওয়াশরুম যেতে সাহায্য করেছেন আমি তার ছেলে।’
মেহজা এবার চিনতে পেরেছে। তবে তার নামে নয় করিমউল্লাহ মোরশেদের কথা বলাতে চিনেছে। তিনিও সেদিন তার ছেলের কথা বলেছিল। তবে নামটা বলেনি। মেহজা বলল,
-‘ওহ্। আঙ্কেব কেমন আছেন?’
-‘ভালো আছেন। বাবা চাইছিলেন আপনি আমাদের বাসায় একদিন গিয়ে ঘুরে আসার জন্য। বাবা আমাকে সেদিন আপনাকে দেখিয়েছিল আপনি হয়তো খেয়াল করেননি আমাকে তখন। কারণ আপনি ফটোসেশনে ব্যস্ত ছিলেন। আজ যখন দেখা হলো তখন আপনার সাথে পরিচয় হতে এলাম। আর আপনি যদি রাজি হোন যে আমাদের বাসায় যাবেন তবে বাসাতেও নিয়ে যাব। আপনি গেলে বাবা খুবই খুশি হবে।’
মেহজা একটু ইতস্তত বোধ করল। বলল,
-‘এখন তো আসলে সম্ভব নয়। আমার বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্মদিন আজ। তাকে সময় দিতে হবে আসলে।’
-‘ইটস ওকে নো প্রবলেম। আপনারা কোথায় যাবেন? না হয় আমি পৌঁছে দিলাম।’
-‘তার দরকার হবে না। উবার ডেকেছি। এই এখন এলো বলে।’
-‘আপনার ফোন নাম্বারটা কী পেতে পারি?’
-‘আমার আসলে ফোন নেই।’
-‘সিরিয়াসলি? ফোন নেই!’
-‘সত্যিই নেই।’
-‘কিছু মনে করবেন না। তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি মিথ্যে বলছেন।’
-‘মোটেও না। বিশ্বাস করা আর না করা আপনার ব্যাপার।’
ততক্ষণে উবার চলে এসেছে। কালো রঙের গাড়ি থেকে একটি লোক বের হয়ে এলো। প্রথি এগিয়ে কথা বলে নিশ্চিত হলো যে এটা তাদের ডাকা উবার। মেহজাকে হাত নেড়ে ইশারায় গাড়িতে উঠতে বলে সে নিজেই উঠে পড়ে। মেহজা অয়নকে ছোট করে ‘আচ্ছা পরে কখনো দেখা হবে’ বলে চলে এলো। অয়ন বেশ কয়েকবার পেছন থেকে ডাকে মেহজা ফিরে তাকায় না।
———————-
মেহজার বাসায় ফিরতে ফিরতে আট টা বেজে যায়। বাসায় এসেই খেয়াল করল বাসার পরিবেশ অন্য দিনের তুলনায় অন্যরকম। স্বাভাবিক নয় আর কী। তার মা সোফায় বসে কার সাথে খুব ব্যস্ত হয়ে কথা বলছে আর তার বাবা চোখ মুখ শক্ত করে বসে আছে। তাকে দেখেও যেন কেউ দেখল না। দূরে ফ্লোরের এক কোণে কিছু কাগজপত্র নিয়ে রাদিফ বসে আছে। নিশ্চয়ই নতুন প্রজেক্টের কিছু কাজ করছে। তবে তার কাজে মন নেই। সে বেশ মনোযোগী হয়ে তার মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে। মেহজা তার মায়ের কথা কিছু শুনল না কারণ সে আসতেই তিনি চুপ হয়েছেন এবং অপরপক্ষ থেকে কথা বলা শুরু হয়েছে। মেহজা জুতা খুলে সোজা ডাইনিং টেবিলের সামনে চলে গেল। সেখানে একটা চেয়ারে রাফসান বসে আছে তার হাতে নুডুলস ভর্তি বাটি। গপাগপ খেয়েই চলেছে। রাফসানের রান্না করার শখ। সে প্রায় সময় নানান নতুন রেসিপি ট্রাই করে। নুডুলস্ যে কয়েক রকম ভাবে সে রেঁধেছে! গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে মেহজা রাফসানকে বলল,
-‘কীরে! কী হচ্ছে ওখানে?’
রাফসান মুখের খাবার শেষ করে বলল,
-‘তুই গিয়ে জিজ্ঞেস কর।’
-‘জিজ্ঞেস তাদের করার হলে তাদেরকেই করতাম। এখন আমি তোকে জিজ্ঞেস করছি তুই বল।’
-‘একটা ধামাকা হয়েছে বুঝলি!’
মেহজা কৌতূহল নিয়ে রাফসানের পাশে চেয়ার টেনে বসে। তারপর পানি পান করে বলল,
-‘বল তো!’
-‘তোর জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। মনে হচ্ছে বিয়ে তোর এবার সত্যিই হবে।’
-‘মানে? ফাজলামি করিস না রাফসান।’
-‘সত্যি। ভাইয়ারে জিজ্ঞেস কর।’
-‘চুপ কর বেয়াদব।’
-‘আচ্ছা।’
রাফসান চুপ করে আবার খাওয়ায় মন দিল। মেহজার মনে হলো রাফসান মজা করছে না। সে সত্যিই বলছে। মেহজা এবার কিছুটা মিইয়ে গিয়ে বলল,
-‘রাফসান তুই মজা করছিস না তো?’
-‘একদমই না। আমি সেই ম্যুডে নেই।’
-‘আমার হজম করতে কষ্ট হচ্ছে।’
-‘উহু। এটাতে হজমের কষ্ট হওয়ার কিছু নেই। বিয়ের প্রস্তাব আসতেই পারে। তবে আসল হজম না করার ব্যাপারটা হলো পাত্র। যার থেকে প্রস্তাব এসেছে।’
-‘কী বলছিস! কেন? পাত্রের মধ্যে কী সমস্যা?’
-‘আরে নাহ। পাত্র ফার্স্ট ক্লাস। আমি তো ভাবছি ওইরকম একটা মানুষের জন্য তোর মতো মেয়েকে কেন নির্বাচন করল।’
-‘কথা না পেঁচিয়ে বল কে সে? তুই চিনস তাকে?’
-‘আরে চিনব না কেন? উপর তলার ইরফান ভাই। তোর ম্যাম এর ভাই।’
মেহজা সত্যিই এবার বড় ধাক্কাটা খেল। ইরফান! কীভাবে?
#চলবে।
(রি চেইক দিতে পারিনি তাই ভুল ত্রুটি ধরিয়ে দিবেন।)